#শুধু_তুই
#পর্বঃ০৭
#Rifat_Amin
শীতের শেষ। তবুও এই শেষ সময়ে শীতটা যেনো একটু জেঁকেই বসেছে। কম্বলের নিচ থেকে উঠা দায়। সকাল ছটায় ঘুম থেকে উঠলো প্রহর। রাত দুটোর সময় ঘুমিয়ে সকাল ছ’টায় ঘুম থেকে উঠা কতটা কষ্টকর তা হারে হারে টের পাচ্ছে সে। সারারাত জেগে পড়াশোনা করা,আর দিনের বেশীরভাগ সময় দরকারে বাইরেই কাটায় সে। কিন্তু ইদানিং রশ্নির সাথে দেখা হচ্ছে না। সেদিন ওকে থাপ্পড় মারার পর থেকে অপরাধবোধে ভূগছি, রশ্নি নিজেও নিজেকে হাইড রাখার চেষ্টা করছে। কি অসহ্য যন্ত্রণা। আজ বিশ ফেব্রয়ারী। প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেছে। এই সাতটা দিনে রশ্নি প্রহরের সামনে এসে দাঁড়ায় নি। অবশ্য দাঁড়ানোর কোনো কারণও দেখছি না। প্রহর ফজরের নামাজটা পরে নিয়ে ফোন করলো তার পূলকভাইকে। আজকে ঐশীকে দেখতে যাবার কথা। গতকাল রাগের বসে সরাসরি না করে দিয়েছিলো প্রহর। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে রশ্নির সাথে দেখা করা খুব জরুরী। যদিও এমনিতেই ওদের বাসা যাওয়া যায়। কিন্তু বারবার একজন যুবতী মেয়ের বাড়ি যাওয়াটা দৃষ্টিকটু। কয়েকবার রিং হবার পর পূলকভাই ফোন ধরলো। প্রহর বললো,
– ঘুমে ডিস্টার্ব করলাম বোধহয়। আজকে কি সত্যিই ঐশীকে দেখতে যাবা? (প্রহর)
পূলক ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বললো,
-হ্যাঁ। তোমাকে তো বলা হলো আমাদের সাথে আসো। তাও তো রাজি হলে না। (পূলক)
-সমস্যা নেই ভাই। আজ যেতে পারবো। আসার সময় মামা মামিকে নিয়ে আমাদের বাসায় উঠিও আগে। ঠিক আছে? (প্রহর)
-হুম ওকে। থ্যাংস ফর জয়েনিং আস। (পূলক)
কথা বলার পর ফোন কাটলো প্রহর। রশ্নির সামনে কিভাবে দাঁড়াবে, কিভাবে তাঁর রাগ ভাঙ্গানো যায় সেই চিন্তায় বিভোর হলো সে। শুধু বয়সে বড় হলেই সবসময় প্রেয়সীর উপর কর্তৃত্ব থাকে না, কর্তৃত্ব রাখতে হলে তাঁর মনযুগীয়ে চলতে হয়। নাহলে ছোট্ট রমণীর আকাশ সমান অভিমানে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেখান হতে উদ্ধারের সদুপায় আবিষ্কার হয়নি। ভয়ানক যন্ত্রণা!
?️
সকাল থেকেই নিজেকে সাঁজাতে ব্যস্ত ঐশী। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই বারবার আয়নায় নিজেকে দেখছে সে। পার্লারেল দুটো মেয়ে এসে দক্ষহাতে সাজিয়ে দিচ্ছে তাকে। আর হাতে মেহেদী লাগানোর কাজটা আমিই করে দিচ্ছি। এ জেনো বিয়ের আগেই প্রস্তুতিমূলক বিয়ে। উত্তেজনায় হাত-পা রীতিমত কাঁপছে ঐশীর। সাথে এক আকাশ ভালোলাগা আর বিষণ্নতায় অনুভূতিগুলো কেমন ফ্যাকাসে হয় কর্পূরের মতো উড়ে যাচ্ছে। পাশে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে আমার মেহেদী দেয়ার কাজ নিরীক্ষণ করছে প্রেয়সী। কিছুক্ষণ পর বোর লাগায় আমারটা ফোন হাতে নিলো সে। সদ্য ফোন চালানো শিখতে পাওয়া প্রেয়সী শুরুতেই কললিস্টে ঢুকলো। উদ্দেশ্য তার প্রহরভাইকে ফোন দিয়ে জানানো যে, রশ্নি আপু মেহেদী দিচ্ছে ঐশী আপুকে। ঘটনাটা অতি সিরিয়াস। শুরুতেই ডায়ালে গিয়ে মুখস্থ নাম্বারটা লিখেই কাল করলো সে। সামনে আসলো খাটাশ নাম। এটা আবার কি নাম! যাই হোক। প্রহরভাই ফোনটা সাথে সাথে ধরে বললেন,
-তুই ফোন ধরছিস না কেন? কখন থেকে ফোন দিচ্ছি জানিস? (প্রহর)
প্রহরভাইয়ের কাটকাট গলা শুনে হাসি বিস্তৃত হলো প্রেয়সীর। সে হাস্যজ্বল স্বরে বললো,
– আমি প্রেয়সী দাভাই। একটা ভয়াভয় খবর জানাতে ফোন করেছি। সেটা হচ্ছে ঐশী আপুর মেহেদীর কালার বেগুণী হচ্ছে কেনো? অথচ আমারটা লাল। (প্রেয়সী)
ঠিক তখনই আমার কানে গেলো কথাটা। প্রেয়সীর মুখ থেকে দাভাই নামটা শুনে মনটা বিষাক্ত হয়ে উঠলো আরো। আমি রক্তিমস্বরে বললাম,
-ফোনটা কাট প্রেয়সী। নাহলে তোকে আজ শেষ করে ফেলবো। ফোন দেএএএএ! (আমি)
শেষের কথাটা এতটাই উচ্চস্বরে বললাম যে রুমের বাকি কয়েকজন ভয়ে কেঁপে উঠলো৷ প্রেয়সী গুটিয়ে যাওয়া হাতে ফোনটা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। আমি জানি, এখন মা আমার রুমে বিচার নিয়ে আসবে৷ কেনো প্রেয়সীকে মারলাম? কি ওর অপরাধ। হেনতেন। এদিকে এখনো প্রহর ভাই লাইনে আছে। আমি বিছানা থেকে ফোনটা নিয়েই বললাম,
– প্রেয়সী ফোন করেছিলো। আর আমার নাম্বার থেকে ডিস্টার্ব করার জন্য দুঃখিত। আল্লাহ হাফেজ। (আমি)
প্রহরভাই সাথে সাথে শান্তস্বরে বললেন,
-আমি আসছি পুলকভাইয়ের সাথে। প্রস্তুত তো তুই। এতো রাগ শরীরের জন্য ক্ষতিকার (প্রহর)
আমি কোনো কথা বললাম না। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মানুষটার প্রতি দিনদিন ঘৃণা যেনো বেড়েই চলেছে। রাগ হয়, কিন্তু রাগ প্রকাশ করার ওয়ে থাকে না। আমি উনার মতো পাষাণ মনের মানুষ না যে সময় নেই অসময় নেই মেরেই চলবো। ভাগ্যিস সেদিন প্রেম এসেছিলো সময় মতো। নাহলে নিজের গার্লফ্রেন্ডের জন্য মেরেই ফেলতো আমায়। একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ফোনটা রেখে কাজে মন দিলাম। জীবন অদ্ভুত।
নদীর ধারে আপন মনে সিগারেট টানছে প্রেম। যদিও সিগারেট নিয়মিত খাওয়া হয় না। সবটা মুডের উপর নির্ভর করে। আজ মুড সিগারেট খাওয়ার সাথে ম্যাচিং হয়েছে। হাতে ব্লাক কালারের গিটার। একটা গান গাওয়া হবে। মন খারাপের একটা গান। হাতের সিগারেট টা নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে গান ধরলো সে,
-এই শহরে নেই তুমি, এ শহর আমার নয়।
কাটছে দিন বছর হয়ে, পড়ছে মনে তোমায় বারেবার।
তুমি ছাড়া আমি একা, শহরটা বড্ড ফাঁকা।
এ শহর আমার জন্য নয়, ভালো থেকো তুমি সবসময়।
এ শহর আমার জন্য নয়, ভালো থেকো তুমি সবসময়। ”
তোমার আমার দিনগুলো, মনে পরে ভীষণ।
তোমার ভালোবাসায়, ছিলো আদরমাখা শাষণ।
তুমি ছাড়া, আমি একা শহরটা বড্ড ফাঁকা।
এ শহর আমার জন্য নয়, ভালো থেকো তুমি সবসময়।
এ শহর আমার জন্য নয়, ভালো থেকো তুমি সবসময়।
ভালো লাগেনা এই শহর, আমি ফিরে যাবো বাড়ি
হাঁটবো এক সাথে আবার, আর নেইতো বেশী দেরী। ?
হঠাৎ করেই গানটা থামিয়ে দিলো প্রেম। মুড নেই, এখন আর গান গাওয়া হবে না। গিটারটা নিয়ে উঠে পরবে এমন সময় সামনে দাঁড়ালো একটা মেয়ে। আরে এইটা তো সেদিনের মেয়েটা, যে আমার এক্সিডেন্টের সময় আমার সামনে ছিলো।মেয়েটা হেঁসে বললো,
-ভয় নেই, আজ আর বলবো না আপনি আমার পিছু পিছু এসেছেন। বরং আমিই আপনার গান শুনে থেমে গেলাম (মেয়েটা)
-ওহহ আচ্ছা। ভালো আছেন? (প্রেম)
-জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি,? বাই দ্য ওয়ে, আমার নাম আফিয়া বিনতে সারা । আপনি তো প্রেম তাইনা ? (সারা)
-আলহামদুলিল্লাহ। হ্যাঁ আমি প্রেম। (প্রেম)
-আপনার নামটা সুন্দর। (সারা)
-আপনারটাও। (প্রেম)
কিছুক্ষণের মধ্যেই সুর্যটা তেজ হারিয়ে বিলুপ্ত হবার উপক্রম হলো। প্রেম বাইকের চাবিটা হাতে নিয়ে বললো,
-উঠে পরুন। আমি মেইনরোডে নামিয়ে দেবো। এই জায়গাটা তেমন ভালো না। ভয় পাচ্ছেন নাকি? ভয় পাবেন না৷ আমি আপনার ভাইয়ের মতো না। নিশ্চিন্ত থাকুন৷ (প্রেম)
নিজের ভাইয়ের নামে এমন গুনগান শুনে সারা কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
– আপনি বারবার আমার ভাইকে টানেন কেন? আপনি নিজেও তো আমার সাথে ফ্লার্ট করার চেষ্টা করছেন। নিজেকে সাধু হিসেবে শো অফ করার কারণ নেই। (সারা)
প্রেম হালকা হেসে বললো,
– মেয়েদের সাথে যেছে কথা বলা আমার সিলেবাসে নেই। এটা আমার ভাইয়ের থেকে শেখা। মেয়েরা হচ্ছে দূর্বলতা, সেই দূর্বলতাটুকুও আমার নেই। কিন্তু আমার ভাইয়ের আছে। তাই একটামাত্র দিক দিয়ে ভাইয়া পিছিয়ে আছে আর আমার মতো এত বেপরোয়া হতে পারে নাই। আশা করি চিরদিন মনে থাকবে। আর যায়গাটা ভালো না। সাবধানে ফিরেন। আল্লাহ হাফেজ।
সাথে সাথেই বাইক স্টার্ট করে তীব্র গতিতে ধুলো উড়িয়ে যায়গাটা ত্যাগ করলো প্রেম। কিছুক্ষণ পর আলো কমে এলো। আলো নিভলেই এই শহর চেনা যায়। শহরের ভদ্র মানুষদের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মুখোশটা খুলে যায়। সারার ভয় লাগছে এখন। আসলেই জায়গাটা কেমন ভয়ানক। বেড়িয়ে যাবো কখন আল্লাহ। কোন শখে যে উঠলাম না বাইকে।
?️
ঐশীকে দেখতে এসেছে পুলকভাই। সাথে এসেছে উনার বাবা মা, প্রহরভাইয়া আর আন্টি৷ আঙ্কেল হয়তো অফিসে তাই আসতে পারে নাই। প্রহরভাই আসার পর থেকে নিজে রুমের ভীতর বন্দি রেখেছি। কোনোভাবেই উনার সামনে দাঁড়ানো যাবে না। উনার মুখ আমি দেখতেই চাইনা। কিন্তু সে আশা সম্ভবত দুরাশা। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার আম্মিজান আমারে ডাক দিলেন। কিন্তু আমি তো বের হবো না। বের হলেই শরবত দেয়ার বাহানা হলেও প্রহরভাইয়ের সামনে যেতে হবে বোধহয়। কোনোভাবে আম্মিকে ম্যানেজ করলাম
কিন্তু ঘটলো এক বিপত্তি। প্রহরভাই যখন নিজে এসে বাইরে আমাকে ডাকলেন তখন ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হবার উপক্রম হলো। কিছুক্ষণ পর উনি থেমে গেলেন আর আমি যেনো প্রাণ ফিরে পেলাম। কিন্তু শেষ হাসিটা উনিই হাসলেন। বেলকনির সরু রাস্তা দিয়ে ছাদ থেকে রুমে ঢুকা যায়। দরজাটা আজকেও খোলা থাকায় সেই রাস্তা দিয়ে প্রহর ভাই আমার রুমে ঢুকলেন। রুমের লাইট অন করার সাথে সাথেই চমকে উঠলাম। যে মুখটা দেখবো না দেখবো না বলে এত কাহিনি করলাম। শেষ পর্যন্ত দেখতেই হলো। পরনে সেদিনের ড্রেসআপ। উনি কি চায়? সেদিনের ড্রেসআপ দেখিয়ে আবার কি মনটা তিতিয়ে তুলতে চান। আমি বিরক্তস্বরে বললাম,
– লজ্জা লাগছে না? লজ্জা করে না বিনা অনুমতিতে একট মেয়ের রুমে ঢুকতে। এতদিন ভাবতাম আমি নিজেই শুধু নির্লজ্জ। তাইতো আপনার মতো পাষাণ মানুষের হাতের মার খাওয়ার পরও আপনাকে সম্মান করেছি। কিন্তু আপনি তো আপনিই। সেই স্থানটা ধরে রাখতে পারলেন কই? (আমি)
প্রচন্ড রাগের মাথায় কথাটা বলেই জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে থাকলাম। উনি আমার দিকে এগিয়ে এসে হাতে একটা নীল কাগজ আর একটা নীল শাড়ি ধরিয়ে দিলেন। রুমের লাইটটা অফ করে এসে বললেন,
– বল। কি বলবি বল। আজ তোর সব কথা শুনবো। আমার জন্য এই সাতটা দিন তোর মনের মধ্যে কি ভয়ানক রাগ জমে আছ সব আমার উপর ঝাড়। লাইটটা অফ করলাম কারণ রাগলে তোকে আরো সুন্দর লাগে। একটা গান আছে না, রাগলে তোমায় লাগে আরো ভালো। ঠিক ওরকম। এমন সুন্দর মহুর্তে তোর দিকে তাকানো পাপ। এই ভয়ানক পাপটা এখন করা উচিত হবে না।
আমি মানুষটার দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকালাম। এই মহুর্তে কি বলা উচিত জানি না। কখনো আমার মাঝে এমন সুন্দর মহুর্ত আসেনি । আশ্চর্য! আমি রাগ করতে পারছি না কেনো? এমন হুট করে রাগ হারিয়ে যাওয়ায় নিজের প্রতি ভীষণ বিরক্ত হয়ে গেলাম৷ ভীষণরকম বিরক্ত!
চলবে ?