শুচিস্মিতা -শেষ

0
744

#শুচিস্মিতা – অন্তিম পর্ব
Tahrim Muntahana

~ তোমাকে সম্মান দেওয়াটা তোমার হজম হয়নি আম্মা। নাহলে আমাকে এভাবে অস্বস্তিতে ফেলতে পারতে না!

রাশিদের কথায় মিসেস মমতা চমকালেন। মেয়ে বাড়ির লোক সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাশিদ কোনো দিক না দেখেই মা কে আবার বললো,

~ আমার আর কোনো দায় থাকলো না আম্মা।

হনহন করে বেরিয়ে আসলো বাড়ি থেকে। মনে হচ্ছে বুকের উপর কেউ পাথর চাপিয়ে রেখেছে। মিসেস মমতা বিব্রত হলেন। ছেলে তাকে এভাবে অসম্মান করবে ভাবেননি। মেয়ে বাড়ির লোক নিজেরাও অসম্মানিত হয়েছে। তারা তো যেচে মেয়ে দিতে যায় নি। তাহলে? মেয়ের চাচা গমগম কন্ঠে বললো,

~ ছেলের অনুমতি ছাড়াই এসেছিলেন আপা? এত বড় একজন মানুষ, আপনার বিবেকে বাঁধলো না? সংসার করবে ছেলে, এতে যদি তার‌ই মত না থাকে আমাদের মেয়ে সুখী হবে?

মিসেস মমতা উত্তর দিতে পারলেন না। মেয়ের মা কিছুটা চেঁচিয়ে বললো,

~ আমার মাইয়ার এখন একটা বদনাম হ‌ইলো। পাড়ার লোকে ছি ছি করবো না?

~ আমি আসলেই বুঝতে পারিনাই আমার পোলাডা এমন বেয়াদব হ‌ইছে। আমি মাফ চাইতাছি, মাফ ক‌ইরা দিবেন। আমার দরকার ছিলো ছেলে কে জানাইয়া আসা, হুটহাট বিয়ার কথা শুইনাই রাইগা গেছে। এখনকার যুগের পোলা তো, ধুমধাম ছাড়া পছন্দ করে না। আমি আবার আসমু‌।

মনের ভেতর এক রাশ রাগ লুকিয়ে বের হয়ে এলো বাড়ি থেকে। রিজার্ভ করা অটো থাকায় কোনো অসুবিধাই হলো না তার। উঠে বসতেই অটো চলতে শুরু করলো। অটোওয়ালা ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলেই সুন্দর করে ব্যাপার টা কাটিয়ে নিলেন মিসেস মমতা। আজ বাড়ি গিয়ে তুলকালাম বাজাবে! তার মুখের উপর কথা বলা, আজ‌ই মুখে লাগাম টানবে!
অন্যদিকে মোড় থেকে অটো নিয়ে সোজা নিজের বাড়ির পথ ধরেছে রাশিদ। কাল সকাল হলেই গ্রাম ছাড়বে! বছরে পা দিবে না এই গ্রামে! যে গ্রাম তাকে অপরূপা কে হারানোর ভয় দেখায়, হারানোর ব্যাথায় জর্জরিত করে সে গ্রামে আর নয়! একটুর জন্য মনে হয়েছিল এই বুঝি শুচিস্মিতা কে পাওয়া হলো না, সংসার করার স্বপ্ন পূরণ হলো না! দীর্ঘশ্বাস গোপন করে রাশিদ, বুকটা খুব পুড়ছে। তাকে যা করার খুব তাড়াতাড়িই করতে হবে!

~ তুই চাইলে আনতারা কে বিয়ে করতে পারস ফাতিন!

মায়ের কথাই চমকালো ফাতিন। রাত আটটার দিকে বাড়িতে এসে পৌঁছেছে সে। আনতারা’র জীবনে এত আনন্দময় একটা দিন সে থাকবে না? সবার সাথে আলাপচারিতা সেরে ঘরে এসে বসেছে একটু। এর মধ্যে মিসেস সেলিনা কথাটি বলে উঠে‌ন। ফাতিনের মনের মধ্যে যেন কৃষ্ণমায়া কে পাওয়ার এক বাসনা জেগে উঠলো। আনন্দ তে ভরে গেল বুকটা। হঠাৎ করেই যখন রাশিদ নামক পাগল প্রেমিকের মুখশ্রীটা ভেসে উঠলো মনকুঠিরে, খুশিতে ভাটা পড়লো তার। তখন মনে হলো আনতারা’র এই সফলতার জন্য‌ই কালো মেয়ে কে তার মা ছেলের ব‌উ করতে চাইছে। তাচ্ছিল্য হেসে বললো,

~ কালো মেয়েকে ছেলের ব‌উ করবে?

~ আমি মানতেছি বলছিলাম এমন। এখন আমার কোনো আপত্তি নাই তো।

~ আমার আছে!

~ এখনি ভালোবাসা সব হাওয়া হ‌ইলো? বড় গলায় বলছিলি না?

~ সে বিষয়ে কথা বলছি না! আমি বিশ্রাম নিবো। কসম দেওয়ার আগে ভাবা উচিত ছিলো আম্মা।

~ আমি কসম ফিরাইয়া নিতাছি। তুই আনতারা কে বিয়া কর।

~ পারবো না!

মিসেস সেলিনা মনে হয় পণ করেই এসেছেন ফাতিন কে যেভাবেই হোক রাজি করাবেন। কিছুটা চেঁচিয়ে বললেন,

~ আমার ক….

~ খবরদার আম্মা! এমন কোনো কসম দিও না যার ফলে ছেলেই হারিয়ে ফেলো। চিরদিনের জন্য এ বাড়ি ছাড়বো। তোমার মতামত‌ই ই তো সব হবে না। আনতারা’র মতামত আছে, ছোট চাচা চাচির মতামত আছে, মেইন কথা আনতারা কিছুতেই বিয়ে করবে না। আমি কিছুতেই রাশিদ আনতারা’র মাঝখানে আসতে চাই না। এমন কোনো কাজ করো না আম্মা, অনুরোধ করছি।

মিসেস সেলিনা চমকে উঠেন। তার কানে শুধু দুটো নাম‌ই বাজছে; রাশিদ, আনতারা! মুহুর্তেই রাগ যেন আকাশ‌ ছুঁই ছুঁই! কোনো ভাবেই সম্ভব না এটা। আজ রাশিদের ব্যবহারে তার খটকা লাগলেও পাত্তা দেয়নি, এখন তো শিউর। রাগের মাথায় কি থেকে কি বলে ফেলেছে মনে হতেই ফাতিন ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। এখন কি হবে? মিসেস সেলিনা ঘর থেকে বেরিয়ে যান। ফাতিন ও পিছু নেয়, সে বুঝতে পারছে অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে।
কেয়ার সাথে কথা বলছিলো আনতারা‌। মেয়েটা একা একা ভয় পাচ্ছে কিনা, কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা তাই জেনে নিচ্ছিলো। এমন‌ সময় বড় চাচি কে নিজের ঘর দেখে উঠে দাঁড়ালো, ফোন টা এগিয়ে দিয়ে কিছু বলবে মিসেস সেলিনা থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন আনতারা’র গালে। স্তব্দ হয়ে গেল আনতারা। বাড়ির পুরুষ রা বাড়িতে নেই, কামরুন্নাহার রান্নাঘরে ছিলেন, চেঁচামেচি শুনে এগিয়ে এসে এমন দৃশ্য দেখবে হয়তো কল্পনাও করতে পারেনি। হুশ ফিরলো তখন যখন মিসেস সেলিনা চ‌ওড়া গলায় বললো,

~ শরম করে না তোর? ঢাকা যাইয়া তাইলে এসব করছস? বল রাশিদের‌ সাথে আর কি কি করছিস? মিছা কথা ক‌ইলে একদম মাইরা ফেলমু।

~ আম্মা চুপ করো, শুনতে পাবে সবাই। কি সব বলছো?

মিসেস সেলিনা ছেলের কথা শুনে যেন আরো রেগে গেলেন। আরেকটা থাপ্পড় দিতে যাবে তার আগেই মিসেস কামরুন্নাহার আনতারা কে নিজের সাথে আগলে নিলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

~ খবরদার ভাবী, আমার মেয়ের গাঁয়ে আরেকটা স্পর্শ‌ও তুমি করবে না। ভালোভাবে কথা বলো, এসব বাক্য আমার মেয়ের সাথে আমি টলারেট করবো না। সংযত করো নিজেকে।

ক্ষনিক সময়ের জন্য থেমে গেলেও মিসেস সেলিনা পুরোপুরি থামলেন না। বাড়ির‌ পুরুষ রা আসলে তাদের কানে কথাটা তুলে দিবে, ভেবে নিজের ঘরে চলে গেলেন। মিসেস কামরুন্নাহারের বুকে গুটিসুটি মেরে পড়ে র‌ইলো আনতারা। ফাতিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে চলে গেল। খুব তাড়াতাড়িই রাশিদের সাথে কথা বলতে হবে।

গভীর রাত। সাড়ে এগারোটার মতো বাজে। তালুকদার বাড়ির সদস্য রা আজ ড্রয়িং রুমে বসে আছে, আনতারা বাদে‌। সবার মুখ‌ই তুলনামূলক গম্ভীর। মিসেস সেলিনা রসিয়ে রসিয়ে সব‌ই বলেছে। ফাতিন কিছু বলার সুযোগ‌ই পায় নি। মিসেস কামরুন্নাহার চুপ আছেন, সুযোগ বুঝে কথা বলবেন তিনি। ফরিদ তালুকদার বললেন,

~ কোনো ভাবেই সম্ভব না এইডা, এইভাবে মান ডুবাইলো বংশের?

বড় ভাইয়ের কথায় আহনাফ তালুকদার চুপ করে র‌ইলেন। কিন্তু আমির তালুকদার চুপ করে থাকলেন না,

~ এমন কোনো কাজ করেনি বড়ভাই যে বংশের মান ডুববে। আরো নিজের প্রতিভা দ্বারা উজ্জ্বল করছে।

~ তুমি চুপ থাকো আমির। ডাক দেও মুখপুরিরে, জিজ্ঞেস করো কি কি করছে?

মিসেস সেলিনা’র কথায় চোখ বুজে নিলো ফাতিন। রাগে শরীর জ্বলছে তার। মিসেস সেলিনা’র কথাগুলো যে খারাপ দিকে ইঙ্গিত করছে ঢের বুঝতে পেরেছে সবাই। আহনাফ তালুকদার বললেন,

~ বিয়ের ব্যবস্থা করি, ভালা ছেলে দেইখা। আমি চাইতেছি না গ্রামে এইসব ছড়াছড়ি হোক। দুই পরিবারের‌ই মান খারাপ। ঘর থেইকা যেন বের হ‌ইতে না পারে! এত বড় সাহস যখন হ‌ইছে, বুঝা উচিত ছিলো মিলমিশ খাবো না!

আহনাফ তালুকদার উঠে আনতারা’র দরজায় তালা দিলেন। মিসেস কামরুন্নাহার এবারো কিছু বললেন না। শুধু নিজের স্বামীর দিকে তাকালেন। তার‌ই বা কি করার আছে, সে মেয়ে জানলেও আদতেও তো তার ঔরষজাত নয়! নিজের ঘর থেকে সব‌ই শুনলো আনতারা। দরজায় তালা দেওয়ার সময় এসেছিল দৌড়ে! কাজ হয়নি। ধাক্কায় দরজা, কেউ আসে না। ক্লান্ত শরীর নিয়ে শুয়ে পড়ে। তার বিশ্বাস রাশিদ কিছু না কিছু করবেই! অথচ ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকা রাশিদ জানতেও পারলো না তালুকদার বাড়িতে তার অপরূপা কষ্ট পাচ্ছে, হাহাকার করছে, তাকে খুঁজছে! নিয়তি কি তাদের সাথ দিবে না?

সকাল টা শুরু হলো অন্যরকম! মিসেস মমতা’র চেঁচামেচি তে। যে তালুকদার বাড়ির বাগানে দাঁড়িয়ে আনতারা কে গালমন্দ করে যাচ্ছে। আশেপাশের বাড়ি গুলো খানিক দূরে হ‌ওয়ায় শুনতে তেমন‌ পায় নি কেউ! তবে তালুকদার বাড়ির পুরুষ রা রেগে গেছেন। তাদের বাড়িতেই দাঁড়িয়ে এত বড় বড় কথা কি করে বলে এই মহিলা! আমির তালুকদার গর্জে বলে উঠলেন,

~ বের হোন বাড়ি থেকে। নিজের পোলা সামলাইতে পারেন না? কোন সাহসে এই বাড়িতে পা রাখছেন?

~ আমার পোলারে আজ কাল কের মধ্যেই বিয়া করামু, সুন্দরি মাইয়া দেইখা। তোমার মাইয়া রে ব‌ইলা দিও আমার পোলার লগে যেন যোগাযোগ না রাখে।

বের হয়ে গেলেন তিনি। আমির তালুকদার মাথা নত করে বাড়ির ভেতর ঢুকলেন। মিসেস কামরুন্নাহার তখনো নির্বাক। যেন কিছুই ঘটেনি। আনতারা নিজের বেলকনি থেকে ছোট চাচার নত মুখটা দেখলো। কেন যেন নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে তার। লজ্জা লাগছে, কিভাবে চোখ মেলাবে? তার মনে হলো তাদের বিচ্ছেদ ই এই সমস্যার সমাধান। কালো মেয়ে রা সত্যিই সংসারের যোগ্য না! সমাজ টা তার কাছে বিচ্ছিরি লাগছে, মনে হচ্ছে কেউ তাকে ধরে বেঁধে কোরবানি দিতে নিয়ে যাচ্ছে। এই যে সকাল হতেই আহনাফ তালুকদার ছেলে খুঁজতে বেরিয়েছিল। যেকোন ভাবেই এরা সবাই তার স্বপ্ন, তার ভালোবাসা কে গলা টিপে হ*ত্যা করতে তৎপর হয়ে উঠেছে। দরজার কাছে ছুটে গেল আনতারা। এখনো বন্ধ! আনতারা’র একটা গান খুব মনে পড়ছে। দরজায় ঠেসে বসে, গুণগুণ করে গেয়ে উঠলো,

“আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি
মন বান্ধিবি কেমনে,
আমার চোখ বান্ধিবি, মুখ বান্ধিবি
পরাণ বান্ধিবি কেমনে।”

পরিস্থিতির সাথে গান টা যেন খাপেখাপ। কান্না’রা যেন উপচে পড়তে চায়ছে। কিছুটা শব্দ করেই কেঁদে দেয় আনতারা। দরজার অপাশে দাঁড়িয়ে ভেতরের আর্তনাদ শ্রবণ করে আহনাফ তালুকদার। ঘটকের সাথেই দেখা করতে গিয়েছিলেন। নিজের ঘরে যাওয়ার সময়‌ই গুণগুণ শব্দ শুনে থামে। নিজেকে পরাজিত সে আগেই মেনে নিয়েছে। এখন তার নিকৃষ্ট মনে‌ হচ্ছে। কোনো বাবা মেয়ের এমন কষ্ট সহ্য করতে পারতো? সে পারছে কিভাবে? সে তো ঠিক মতো বাবা’‌ই হয়ে উঠতে পারলেন না! অন্যদিকে নিজের চুল খামচে অস্থির চিত্তে পাইচারি করছে রাশিদ। মায়ের প্রশ্ন থেকে বাঁচার জন্য ই কাল রাতে খিল দিয়েছিল, এই খিল দেওয়াটাই যে তার সর্বনাশ ডেকে আনবে সে কি জানতো? একটু আগে ফাতিনের কাছে সবটাই শুনেছে সে, মায়ের চেঁচামেচিও কানে গেছে। তার মা যে এত তাড়াতাড়ি মানবে না সে জানে। তাকে পালাতে হবে, কোনো কিছুর বিপরীতেও শুচিস্মিতা কে ছাড়তে পারবে না। তড়িঘড়ি করে ফোন লাগাই আনতারা’র নম্বরে। রিসিভ হয়, অপর পাশ থেকে ভেসে আসে,

~ মায়ের পছন্দে বিয়ে করে নিন রাশিদ ভাই, আপনি আমার ভাগ্যে নেই!

সবকিছু ঠিকঠাক করার ভাবনা টা মাথা থেকে বের হয়ে গেল। রাশিদের মনে হচ্ছে মেয়েটিকে ঠাস ঠাস করে কয়েকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতে পারলে। আনতারা আবার বললো,

~ আমার প্রতি আপনার যে ভালোবাসা সেই থেকে অনুরোধ করছি রাশিদ ভাই, এতে দুই পরিবারের ই মঙ্গল!

~ আমার ভালোবাসার উপর তোমার কোনো অধিকার নেই শুচিস্মিতা! কারণ তুমি আমাকে ভালোবাসো নি!

খট করে ফোন কেটে যায়। আনতারা’র মুখে হাসি ফুটে! কিছুটা শব্দ করেই হাসে সে। এতক্ষণের খারাপ লাগা টা কেটে গেছে। রিলেক্স মুডে লাগেজ গোছাতে লাগে। কোন কিছুর বিনিময়ে এই পাগল প্রেমিক কে ছাড়া যায় না‌। সবাই নিজ স্বার্থে লড়ে, সেও নিজের ভালোবাসা’র স্বার্থে লড়ুক! একসময় না একসময় পরিবার ঠিক মেনে নিবে! কয়েকদিনের কষ্ট কে উপেক্ষা করে সারাজীবন কষ্টে কে থাকতে চায়! তার সুখ যে রাশিদ নামক পুরুষ টির মাঝেই অন্তর্নিহিত!

~ আম্মা, সব মা’ই তো চায় তার সন্তান সুখে থাকুক, শান্তিতে থাকুক। তুমিও তো তাই চাও না? না হলে ভাইয়ের এক কথায় আমার জন্য পছন্দ করা পাত্রী কে তো ভাইয়ার ব‌উ করতে না। তাহলে আমার ক্ষেত্রে এমন অবিচার কেন, তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না আম্মা?

ঠিক জায়গায় ইমোশনাল কথাটা বলে রাশিদ নিজের উপর‌ই বাহুবা দিলো। মিসেস মমতা ছেলের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে র‌ইলেন। দু’দিনের মেয়ের জন্য ছেলে তার ভালোবাসায় আঙুল তুলছে? আবার ভাবে সে কি একটু বেশীই করে ফেলেছে রাগের বশে? রাশিদ আবার বললো,

~ আম্মা তোমার নাম‌ই তো মমতা, আমি তো জানি আমার আম্মা কখনোই বাইরের মানুষদের কথা শুনে ঘরে অশান্তি করে না। মা মরা মেয়েটাকে একটু ভালোবাসো না আম্মা। জানো তোমার ছেলে টা ওই মেয়ের পেছনে দুটো বছর শেষ করেছে, পাগলের মতো ঘুরেছে, তবুও মেয়েটা গলে নি, তোমাদের কথা ভেবে সবসময় এড়িয়ে গেছে। এই দেখ একটু আগেও আমাকে বললো তোমার পছন্দ মতো বিয়ে করতে। কিন্তু আমার যে ওই মেয়েটাকেই লাগবে আম্মা। হাজার সুন্দরী মেয়ে কে আমার মনে ধরে না আম্মা! তুমি তো মমতাময়ী মা, ওই মেয়েটার মা হিসেবে বিচার করো তো! ছেলে-মেয়েদের সুখ ই তো বড় তোমার কাছে, তাহলে?

রাশিদ টের পায় নি তার বাবা রাজীব তাজ‌ওয়ার ও ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনছে। মিসেস মমতা ছেলের হাহাকারে কি বলবেন খুঁজে পেলেন না। একটাও ভুল কথা বলে নি। রাজীব তাজ‌ওয়ার আনতারা কে কখনোই ছোট চোখে দেখেন নি, সবার থেকে আলাদা’‌ই দেখতেন। এর মধ্যে কালকে যখন খবর পেলেন আনতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চান্স পেয়েছে, অনেক খুশি হয়েছিলেন তিনি। তিনি যদি আগে কখনো জানতেন তার ছেলে মেয়েটার জন্য এত পাগল; অনেক আগেই তালুকদার দের সরণাপন্ন হতেন, ছেলের সুখের জন্য হয়তো অনুরোধ ও করতেন! মিসেস মমতা কে ইশারা’য় সম্মতি দিতে বলে পেছন থেকে সরে গেলেন রাজীব তাজ‌ওয়ার। মিসেস মমতা আর কথা বললেন না শুধু ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে একটু হাসলেন। মনের মধ্যে খচখচ করলেও, ভাবলেন একসাথে থাকতে থাকতে হয়তো মায়াও জন্মে যাবে। তার ছেলে ভালো থাকুক! এখন তালুকদার’রা রাজি হলেই হয়!

গভীর রাত! বাড়ির পুরুষদের মধ্যে ফরিদ তালুকদার, আহনাফ তালুকদার বাড়িতে রয়েছেন। ফরিদ তালুকদার স্ত্রীর বুদ্ধিতে আনতারা কে নিজের ছেলের ব‌উ করতেই রাজী হয়েছেন। সকাল টা হলেই ছোট ভাইয়ের কাছে প্রস্তাব রাখবেন, তার বিশ্বাস তার ভাই তার মুখের উপর না বলতে পারবে না! যেখানে ফাতিন নিজে রাজি, আনতারা’র জন্য‌ও ছেলে দেখা হচ্ছে সেহেতু প্রশ্ন‌ই আসে না প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার। মিসেস সেলিনা ছেলের সুখের জন্য পদক্ষেপ নিতে পেরে খুব খুশী। অনেকদিন থেকেই তিনি ভাবছিলেন, ছেলের এমন উদাসীনতা দেখেই রাজী রাজী ভাব ছিলেন। তবে আনতারা’র সফলতায় আর না করলেন না। অথচ এত কিছুর মাঝে নিজের ছেলের অস্থিরতা টাও টের পেলেন না তিনি!

উড়না টেনে চোখ মুখ ভালো ভাবে ঢেকে আয়নায় নিজেকে দেখে নিলো আনতারা‌। নাহ চেনা যাচ্ছে না! বেলকনি দিয়েই বের হ‌ওয়ার কথা ভেবেছে সে, মিসেস সেলিনা খাবার দেওয়ার সময় ফোন টাও নিয়ে নিয়েছে! তাই ছোটচাচি কে বলতে পারলো না, তালা টা খুলে দিতে। চিন্তাও হচ্ছে তার, যদি পড়ে যায় বা কাপড়ের গিট খুলে যায়! হাত পা তো ভাঙবেই, বাড়ির মানুষ ও জেনে যাবে! সাবধানে পা ফেলে বেলকনিতে দাঁড়াতেই দরজার অপাশ থেকে শব্দ ভেসে আসলো। ভয় পেয়ে গেল আনতারা! ঝটপট ঘরে আসতেই দরজা টা খুলে গেল, প্রবেশ করলো আহনাফ তালুকদার। আনতারা একপ্রকার আতকেই উঠলো, পেঁচানো উড়নাটাও খুলতে পারে নি, বুঝে গিয়ে যদি সদর গেইটে তালা দিয়ে রাখে? তাহলে তার পরিকল্পনা শেষ! কিন্তু আহনাফ তালুকদার তেমন কিছুই করলেন না, বরং বেলকনি থেকে আনতারা’র লাগেজ টা এনে দরজার বাইরে রাখলেন। আনতারা’র সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা হাত টা মাথায় রাখতেই; আনতারা যেন একনিমিষেই বুঝে গেল তার বাবা কি চাইছে! চোখের জল বাঁধ না মানতেই প্রথম বারের মতো জড়িয়ে ধরলো বাবাকে। একটু সময়ের জন্য, কেমন অস্বস্তি হচ্ছিলো! এক ছুটে দরজার বাইরে গিয়ে ফের পেছনে একনজর তাকালো, বাবার অশ্রু ভেজা চোখ দেখে লাগেজ নিয়ে ছুটলো সদর দরজায়! আড়াল থেকে মিসেস কামরুন্নাহার বেরিয়ে আসলেন! আনতারা’র যাওয়ার দিক আর আহনাফ তালুকদারের দিকে তাকিয়ে হাসলেন তিনি। বললেন,

~ তুই ভালো থাকিস আনতারা, তোর এই মা সবসময় তোর সাথে আছে! আজ তোর প্রাপ্তির খাতাটাই আরেকটা প্রাপ্তি যোগ হলো, বাবার ভালোবাসা!

নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ততক্ষণে আনতারা সদর দরজা পেরিয়েছে! আনতারা সরাসরি ফাতিনের ঘরের দিকে দৃষ্টি ফেললো। ফোন কানে গুঁজে তাকে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে। আনতারা’ও এক গাল হেসে হাত নাড়িয়ে অন্ধকারে মিশে গেল! ফাতিন বলে উঠলো,

~ কৃষ্ণমায়া অন্ধকারে মিশে গেছে আলোর খুঁজে, ফারাহ!

ফারাহ সুখ, দুঃখের সংমিশ্রণে ঘেরা অনুভূতি নিয়ে চোখ বুঝলো! টের পেল তার ভাই অস্পষ্ট সুরে বলছে,

~ ভালোবাসা ভালোবাসাকে নিয়ে ভালো থাকুক!

তাজ‌ওয়ার বাড়ির পেছন সাইড দাঁড়িয়ে ইটের টুকরো নিয়ে রাশিদের বেলকনি বরাবর ছুড়ে মারলো আনতারা! সাথে সাথে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো পুরুষালি অবয়ব। আনতারা অবাক হলেও এক বুক স্বপ্ন ও তার স্বপ্নের হাতিয়ার নিয়ে শটান হয়ে দাঁড়িয়ে র‌ইলো। রাশিদ একনজর আনতারা কে দেখে দৌড়ে বেরিয়ে আসলো বাড়ি থেকে। ফাতিন মেসেজ করছিল, নাহলে তো সে টের‌ই পেত না! আনতারা’র বরাবর দাঁড়িয়ে হাতে লাগেজ দেখে অবাক হয়ে শুধালো,

~ শুচিস্মিতা!

~ বিয়ে করবেন, রাশিদ ভাই?

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here