#শিমুল_ফুল
#৪২
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
পুষ্পকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় শিমুল পড়ায়।পুষ্পর সামনে এইচএসসি পরীক্ষা এই মুহুর্তে তার সাবজেক্ট ভিত্তিক প্রাইভেট পড়ার দরকার ছিলো কিন্তু টাকার অভাবে প্রাইভেট পড়া হচ্ছে না।শিমুল লেখাপড়ায় ভালো ছিলো বিধায় পুষ্পকে পড়াতে সমস্যা হয় না।লেখাপড়ায় পুষ্প আগের থেকেও বেশী মনোযোগী হয়েছে।যেকোনো মূল্যেই হোক শিমুলের কষ্টের প্রতিদান দিতেই হবে।তাকে বিয়ে করেছে বলেই তো শিমুলের কপালে এই দু/র্যোগ নেমে এসেছে।কই রাজপুত্রের মতো দিন কাটাতো আর এখন কি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে!পুষ্পর ইচ্ছা করে শিমুলের সব কষ্ট দূর করে দিতে,চোখের ক্লান্তি দূর করে দিতে।তার পরিক্ষার আর মাস দুয়েক বাকি।পরিক্ষার সময় গ্রামে যেতে হবে।দুজনে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ে।শিমুল পুষ্পর মাথায় হাত ভুলিয়ে দেয়।পুষ্প হাসিমুখে শিমুলের দিকে তাকিয়ে থাকে।শিমুলের সামনে পুষ্প সহজে কাঁদে না তার কান্না দেখলে শিমুল খুবই মন খারাপ করে তাই তার কষ্ট লাগলে সে লুকিয়ে বাথরুমে গিয়ে কাঁদে।পুষ্পর হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে শিমুল বললো,
“কতো কষ্টে রাখছি।তারপরেও এতো খুশীর কারণ কি?”
পুষ্প বাচ্চাদের মতো ঠোঁট গোল করে বললো,
“সুখেই তো আছি।আমার হাসিমুখ দেখতে কি তোমার ভালো লাগছে না?”
“লাগবেনা কেনো!তোমার হাসিমুখ দেখার জন্যই তো বেঁচে আছি সোনা।”
শিমুলের এই ছোট আদুরে ডাকে পুষ্পর মনে জমজমিয়ে খুশীর জোয়ার বয়।সেই খুশীতে পুষ্প তার চিকন গলায় গেয়ে উঠে,
“আমি চাইনা বাড়ি গাড়ি আর তোমায় পেলে চলবে আমার।
অল্প আলো থাকনা ঘরে
বিলাসিতার কি দরকার।
প্রেমে প্রেমে হয়ে গেলো রে
আর বাধা দিবে কে এসে!”
শিমুল চোখের পলক ফেলে বললো,
“বাহ সুন্দর তো!”
“পাশের বাসার বক্সে লাগিয়ে রাখে।শুনতে শুনতে মুখস্ত হয়ে গেছে।”
“আসলেই তোমার বিলাসিতার দরকার নেই?”
“না।”
“সবার মতো সুখে থাকতে ইচ্ছা করে না?”
“আমার সুখ’ই তো তুমি।এই যে তুমি পাশে আছো আমি বেশ সুখে আছি।এর চেয়ে বেশী সুখ কাকে বলে আমি জানিনা জানতেও চাই না।”
শিমুল মুগ্ধ চোখে তার মিষ্টি বউটাকে দেখে।এই ছোট এক রুমের বাসায় টাকা কম ঠিক কিন্তু ভালোবাসায় ভরপুর।যেখানে দুজনের মাঝে ভালোবাসা সর্বদা বিরাজমান সেখানে বিলাসিতা না হলেও চলে।চলুক সময় তার গতিতে।কিছুক্ষণ কথা বলার পরে পুষ্প ঘুমিয়ে যায়।
শিমুল একধ্যানে পুষ্পকে দেখে।
মেয়েরা এমন কেন?নিজের সবটা উজার করে নিজেকে সুখী প্রমাণ করতে চায়।নেই কোন আবদার নেই কোনো ইচ্ছা,অভাবে টু শব্দটি না করেই কেমন সব মেনে নেয়,মানিয়ে নিতে অক্লান্ত চেষ্টা করে।শিমুল অবাক হয়ে ছোট পুষ্পকে দেখে,পরিস্থিতির চাপে পরে কতোটা বুঝধার হয়ে গিয়েছে,কতো বুঝে!কতোটা ধৈর্যশীল।কি দারুনভাবে শিমুলের এই দরিদ্রতায় নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে।কখনো ঘুরতে গেলেও কিছু খেতে চায় না কিনতে চায় না।শিমুল এটা সেটা কিনে দিতে চায় কিন্তু পুষ্প কিনতে চায় না সে তো জানে শিমুলের পকেটের অবস্থা!শিমুলের পকেটে যদি কখনো টাকায় ভরে যায় তখন শিমুল এই নারীটার কথা ভুলবে না।শূন্য পকেটে এতো ভালোবেসে শক্ত করে হাতটা আঁকড়ে পাশে দাঁড়িয়েছে,ভরসা দিয়েছে,সাহস যুগিয়েছে,এমন স্ত্রী কয়জন পায়?যে পুরুষ পায় সে নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান।এই ভাগ্যবান পুরুষের মধ্যে শিমুল একজন।এখন রাত তিনটা শিমুলের ঘুম আসছেনা।ঘুমন্ত পুষ্পর দিকে তাকায়।সারাদিন কাজ করে বাসায় এসে পুষ্পর এই মায়াবী মুখটা দেখলে সব য/ন্ত্রণা নিমিষেই পালায়।কতো আদর লাগে এই মেয়েটাকে এটা শিমুল ছাড়া আর কেউ জানেনা।ঠান্ডা নিঃশ্বাস ফেলে পুষ্পর গালে কপালে চুমু খায়।শিমুল মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে পুষ্পর হাত দু’টো দিকে করে।এই কয়েকমাসে হাতে অনেকগুলো ফোস্কা পড়েছে।অপটু হাতে রান্নাবান্না করে হাতের অবস্থা করুণ।শিমুল অনেকটা সময় ধরে দা/গগুলো দেখে।মাথা নিচু করে দা/গগুলোতে চুমু দেয়।কপালে পড়ে থাকা ছোট ছোট চুল সরিয়ে অপলক তাকিয়ে দেখে।মোবাইলের ফ্ল্যাশ বন্ধ করে পুষ্পকে টেনে বুকে নেয়।মেয়েটার শরীরটা ন/ষ্ট হয়ে যাচ্ছে।চেহারায় ক্লান্তির ভাব স্পষ্ট।শিমুলের হঠাৎ মনে হলো সে ব্যার্থ।পুষ্পর জন্য কিছুই করতে পারছে না।কতো অফিসে একটা চাকরির খুঁজে গেলো কেউ চাকরি দিতে চায় না।আর দেবেই বা কেন?নেই কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা,নেই মামা,নেই মানি চাকিরী পাবে কোন ভিত্তিতে?একটা চাকরির জন্য কতো মানুষের পায়ে পায়ে ঘুরছে তা আল্লাহই ভালো জানে।আপন লোকেরা শিমুলকে তার অবস্থান বুঝিয়ে দিয়েছে,চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়েছে সমানে সমানে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে লোকসম্মুখে পরিচিত
বলার দরকার নেই এতে নাকি বড়লোক নামের বন্ধু,পরিচিতদের সম্মান ন/ষ্ট হয়।এতো টেনশন শিমুল আর নিতে পারেনা।বাসাটা পাল্টানো দরকার।পাশের রুমে সারাক্ষণ জোড়ে জোড়ে গান বাজায় এতো শব্দে পুষ্পর পড়া হয় না।গলির বাসা রুমের সামনে দিয়ে বা/জে ছেলেদের অবাধ চলাফেরা।সে সারাদিন বাসায় থাকেনা পুষ্পকে একা রেখে গিয়ে চিন্তায় থাকতে হয়।সে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে সকালে কাজে যেতে হবে।আসলে গার্মেন্টসে মানুষ পেরে কাজ করেনা,বিপদে পরেই গার্মেন্টস মুখী হতে হয়।এই যে গার্মেন্টস আছে বলেই তো শিমুল পুষ্প দু’মুঠো ভাত খেতে পারছে।বিপদের পথে এই খারাপ উপাধি পাওয়া গার্মেন্টসই গরীবদের ভরসা।শিমুল তপ্ত শ্বাস ফেলে পুষ্পর গায়ে কাথা দিয়ে দেয়।
শওকত হাওলাদার কপালে হাত দিয়ে বসে আছে।চোখ বন্ধ করেও তার মনে হচ্ছে চারিদিকে বিপ/দ কিলিবিলি করে ছুটে আসছে।আহ এখন শিমুলের শূন্যতা বেশ টের পাচ্ছে।ছেলেটা যে তাকে কোনো টেনশন দিতো না এটা এখন বুঝতে পারছে।সেদিনের হা/ঙামা থেকে বি/রোধী দলের নেতা তার নামে মিথ্যে মা/মলা সাজিয়ে থানায় কে/স করেছে যদি কে/স জিতে যায় তাহলে উনাকে চেয়ারম্যান পদ থেকে বহি/ষ্কৃত করা হবে।উনার মাথায় কিচ্ছু ধরছেনা।একবার ভাবে শিমুলকে ফোন করবে আরেকবার ভাবে না।মজিব হাওলাদার ছেলের কাছে এসে দাঁড়ায়।
“কি করবি কিছু ভেবেছিস?”
বাবার গলা শুনে শওকত হাওলাদার চোখ মেলে তাকায়।
“কি করবো?আপনি আর আম্মা বলেন কি করা দরকার।খুব তো ছেলেটার পিছনে লেগেছিলেন এখন সবকিছু সামলান।”
মজিব হাওলাদার নিজেও শিমুলের শূন্যতা টের পাচ্ছে।কাচুমাচু করে বললো,
“আমার একার দোষ নেই কিন্তু তুই’ই সেদিন বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলি।”
শওকত হাওলাদারের মাথার রগ দপদপ করে জ্বলে উঠে।হাতের লাঠি ভেঙে গেলে এটার মূল্য বুঝতে আর তার বেগ সামলাতে কেমন লাগে এটা শওকত হাওলাদার হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে।একটা বিয়েই তো করেছিলো!আর সবাই মিলে কি মানু/ষিক অত্যা/চারটাই না করেছে।ভু/ল হয়ে গিয়েছে,এই ভু/ল শুধরানোর উপায় কি?শিমুলকে ছাড়া রাজ/নৈতিক কাজে টিকা মুশকিল মনে হচ্ছে।
মুন্নীর সাত মাসের সাধের অনুষ্ঠান।পুষ্প আর শিমুলকে বারবার ফোন করে যেতে বলেছে।অনেকদিন যাবত যেতে বলছিলো পুষ্প এই সেই বাহানা দিয়ে না করে দিয়েছে কিন্তু এবার না গেলে ব্যপারটা আসলেই খা/রাপ দেখায়।পুষ্পর বাবা মাও আসবে।অনেকদিন হলো বাবা মাকে দেখে না খুব ইচ্ছা করছে তাদের দেখতে।শিমুল পুষ্পর মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনের ভাব বুঝার চেষ্টা করছে।পুষ্প বই গুছিয়ে পাশের টুলে রাখে।
“কি করবো।যাওয়া উচিৎ না?”
শিমুল মাথা নেড়ে বললো,
“হ্যাঁ।কিন্তু এমন সময় অনুষ্ঠানটা হচ্ছে একদম মাসের শেষে হাতে টাকাই নেই।কিভাবে কি করবো বলতো।”
পুষ্প নিজেও শিমুলের পকেটের খবর জানে।মুন্নীর বাসায় গেলে টাকার দরকার।এই মুহূর্তে এতো টাকা নেই।সে কিছুক্ষণ ভেবে তার মোবাইলটা হাতে নিয়ে বললো,
“এটা বিক্রি করে দাও।”
শিমুল মোবাইল’টার দিকে তাকায়।তার কিনে দেয়া ফোনটা।যেদিন কিনে দিয়েছিলো পুষ্প কি খুশী হয়েছিলো।আর আজকে বলছে ফোনটা বিক্রি করে দিতে!সে অসন্তোষ গলায় বললো,
“মাথা খারাপ?”
পুষ্প মুচকি হেসে বললো,
“মাথা খারাপের কি আছে!আপুকে দেখতে যাবো টাকা লাগবেনা?আর তুমিতো সারাদিন পাশেই থাকো এতো দামী মোবাইলের কি দরকার?”
“তাই বলে বিক্রি করে দিবো?”
“আরে সমস্যা নেই।আমার মোবাইলের দরকার নেই বিধায়ই তো বলছি।”
“না।কারো কাছে ধার নিলেই হবে।”
পুষ্প রাজি হয় না।তার জেদ জিতে যায়।আঠারো হাজার টাকার মোবাইল মাত্র চার হাজার টাকায় মোবাইলটা বিক্রি করে দেয়।সকাল সকাল দুজনে রেডি হয়ে মুন্নীদের বাসায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।পাঁচ রকমের ফল আরো হাবিজাবি কিছু নিয়ে শিমুল আর পুষ্প মুন্নীর বাসায় যায়।মুন্নী বোনকে পেয়ে খুব খুশী হয়।রোকসানা আর মিজান মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রাখে।রোকসানা হাপুস নয়নে কতোক্ষন কাঁদে।বারবার বলে তোর একি অবস্থা শুকিয়ে গেছিস কেনো?মুন্নীর হাজবেন্ডের নিজেদের বাড়ি।সাফিনের বাবা মা সহ আরো আশেপাশের অনেক’কেই দাওয়াত করা হয়েছে।মুন্নীর হাজবেন্ড এক ফাকে সবার সাথে শিমুলের পরিচয় করিয়ে দেয়।বোনকে দেখে পুষ্পর মনটা ফুরফুরে হয়ে যায় কিন্তু এই ফুরফুরে মেজাজ বেশীক্ষণ ভালো থাকে না ড্রয়িংরুমে পা দিয়েই শুনল সাফিনের মা একজনের সাথে বলছে,
“আরে এই মেয়েটাকেই তো আমার ছেলের বউ করতে চেয়েছিলাম।”
“হ্যাঁ।সাফিন আমাকে ছবি পাঠিয়েছিলো।”
“ওই যে ছেলেটা সোফায় বসে আছে?ওইটা এর বর।ভাবো আমার রাজপুত্রের মতো ছেলেকে ফিরিয়ে কাকে বিয়ে করলো?”
মহিলাটা বললো,
“খা/রাপ মেয়ের পাল্লায় পড়োনি এটাই অনেক।”
সাফিনের মা সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
“হ্যাঁ।সেটাই।”
পুষ্পর মুখ মূহুর্তেই থমথম রূপ ধারণ করে।পিছনে ফিরে দেখে রোকসানা ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।পুষ্প মুচকি হাসার চেষ্টা করে।কা/ন্না আড়াল করতে বাথরুমে ঢুকে যায়।ইশ এতো কা/ন্না পাচ্ছে কেন?পুষ্প কেঁ/দে মুখ ধুয়ে বের হয়।তখনি ঘটে আরেক ঘটনা।মুন্নীদের বিল্ডিংয়ের এক দম্পতি আসে।নাম মিরাজুল হক।ড্রয়িংরুমে সবাই বসে কথা বলছে উনি এসে শিমুলকে দেখে চমকে যায় শিমুলও চমকে উঠে।মিরাজ সাহেব সবার সামনেই বলে,
“আরে শিমুল যে!তুমি এখানে?”
মুন্নীর শশুড় বলে,
“মিরাজ তুমি শিমুলকে চিনো নাকি?কিভাবে চিনো?”
শিমুলের গলা শুকিয়ে আসে।আড়চোখে পুষ্পকে দেখে পুষ্পও কাঠকাঠ চোখে তাকিয়ে আছে।মিরাজ সাহেব বললো,
“আরে আমার গার্মেন্টসে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করে আমি চিনবো না!”
উনার উত্তর শুনে সবাই থমকে যায়।বিশেষ করে রোকসানা আর মিজান শেখ।পুষ্প মাথা নিচু করে বসে থাকে।মুন্নীর হাজবেন্ড পরিস্থিতি সামাল দিতে বললো,
“শিমুল আমার ভায়রা ভাই লাগে।আসেন মিরাজ কাকা বসেন।”
মিরাজ ভ্রুকুটি করে শিমুলের দিকে তাকায়।উনার তাকানো দেখে মনে হচ্ছে শিমুল কোনো আবর্জনা,তার থেকে দু/র্গন্ধ বের হচ্ছে।মুন্নীর হাজবেন্ডের কাছে গিয়ে বললো,
“তোমার ভায়রা আমার গার্মেন্টসে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করে?কিভাবে সম্ভব?”
পুষ্প আর শিমুল মিরাজ সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে মন্নীর হাজবেন্ড বললো,
“কাকা বসেন না।খাবারের ব্যবস্থা করছি।”
সাফিনের মা থামলেন না।নিচু গলায় মুন্নীর শাশুড়ীকে বললো,
“আমার রাজপুত্র কে ছেড়ে গার্মেন্টস কর্মীকে বিয়ে করেছে।আজকাল কার মেয়েদের রুচি কি ভাবা যায়?”
মুন্নীর শাশুড়ী বললো,
“মুন্নীর বোন মুন্নীর মতোই ভালো ভেবেছিলাম।কিন্তু আমিতো দেখি গোমটার নিচে পোংটার বাসা।”
সাফিনের মা মুখ ঝামটা দিয়ে বললো,
“আল্লাহ বাচিয়েছে এমন মেয়ে বিয়ে করাইনি।দেখেন মিরাজ সাহেব কেমন করে তাকাচ্ছে!”
মন্নীর শাশুড়ী কম যায় না।
“গার্মেন্টসের সিকিউরিটি গার্ড কিনা আমার ছেলের ভায়রা?ভাবলেই তো গা ঘিনঘিন করে উঠে।ছি ছি ছি।”
রোকসানা পুষ্পর হাত ধরে নিয়ে যায়।বারান্দায় গিয়ে পুষ্পর দিকে তাকায়।পুষ্প মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে।তার মাকে বলা মিথ্যা কথাটা এভাবে বেরিয়ে আসবে সে কল্পনাও করেনি।রোকসানা বললো,
“এই তাহলে শিমুলের কোম্পানির চাকরি?”
পুষ্প জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
“আম্মা আসলে আমি বুঝতেছিলাম না কিভাবে তোমাদের সত্যিটা বলবো।”
রোকসানার ঠোঁট তিরতির করে কাঁপে।
“তোর জামাই গার্মেন্টসে কাজ করে!শেষ পর্যায়ে এসব শুনতে,আর দেখতে হলো?”
পুষ্প রোকসানার চোখে চোখ রেখে বললো,
“আম্মা গার্মেন্টসে কাজ করা কি খারাপ?”
“পুষ্প তোর মাথা কি ঠিক আছে?রাজরানীর মতো থাকতে পারতি আর এখন কোন না কোন বস্তিতে থাকিস।”
পুষ্পর চোখ পানিতে ভরে উঠে,
“বস্তিতে থাকলেও আমি সুখে আছি।”
“মানুষের মুখে তো আর ধরে রাখা যায় না।সাফিনের মা আর মুন্নীর শাশুড়ী এতোক্ষণ কি বললো এগুলো শুনিসনি?”
পুষ্প কোন কথা বলেনা।ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।রোকসানা’ই বলে,
“তোর জন্য আমাদের লজ্জা পেতে হচ্ছে।মুন্নীর না জানি কতো কথা শুনতে হয়।”
পুষ্প থমকে যাওয়া মুখে বললো,
“আম্মা আমার জন্য তোমাদের লজ্জা পেতে হচ্ছে?তাহলে আসতে বললে কেন?”
“তখন কি জানতাম নাকি শিমুল গার্মেন্টসে চাকরি করে।”
পুষ্প আর কিছু বলেনা পাথর চোখে তার আম্মাকে দেখে।রোকসানা পুষ্পর হাত ধরে বলে।
“মা-রে তোকে তো প্রতিষ্ঠিত ছেলের কাছেই বিয়ে দিতাম বিয়ের পরে আর কোনো টেনশন থাকতো না।কিন্তু এখন যে তোকে নিয়ে অনেক চিন্তা হয়।”
পুষ্পর মনে অপ/মানের ছোড়া দগদগ করে জ্বলে উঠে।মায়ের ক/ষ্টটাও বুঝতে পারে।কোন কথা না বলে ড্রয়িংরুমের দিকে যায়।শিমুল তখনো সোফায় স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।পাশের সোফায় সাফিনের মা মুন্নীর শাশুড়ী এটা সেটা বলেই যাচ্ছে।পুষ্প কিছু বলার আগে মুন্নী টেনে ধরে তাকে রুমে নিয়ে যায়।
“শিমুল গার্মেন্টসে কাজ করে?”
গার্মেন্টসে কি মানুষ কাজ করেনা?যারা গার্মেন্টসে কাজ করে তারা কি মানুষ না?সবার এমন প্রতিক্রিয়ার মানে কি?পুষ্প শান্ত গলায় বললো,
“হ্যাঁ করে।তো!গার্মেন্টসে কাজ করে জানলে কি আমাদের দাওয়াত দিতে না?”
পুষ্পর কথায় মুন্নী দমে যায়।আস্তে করে বললো,
“রাগ করিস কেন?”
পুষ্প মুন্নীর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে বললো,
“রাগ করি না তো আপু।আমার জামাই গার্মেন্টসে কাজ করে আমার কি রাগ মানায়?”
পুষ্প ড্রয়িংরুমে আসে।তে/জী,রা/গী শিমুলের চোখের বর্ন সেই কখন থেকেই লাল হয়ে আছে কিন্তু সে নির্জীব।মাথা নিচু করে সবার কথাই শুনছে কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করছেনা।দুপুরের খাবার রেডি হলে মিরাজ সাহেব শিমুলের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“খেতে আসো।যা বেতন পাও তা দিয়ে আর যাই খাও এই ভালো খাবার তো পাবে না!”
শিমুলের হাত পা কেঁপে ওঠে।শরীর ঝাকিয়ে রা/গ বেরিয়ে আসতে চায়।পুষ্প পাশে এসে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে।শিমুল ঠান্ডা গলায় বললো,
“স্যার আমরা কি না খেয়ে থাকি?”
মিরাজ সাহেব কিছু বলার আগে সাফিনের মা গলা বাড়িয়ে কথা বলেন।পুষ্পকে বউ করতে না পারার ক্ষোভ যেন এখনি মিটিয়ে নিচ্ছে।
“আরে খাবে না কেন?কিন্তু এমন রাজকীয় খাবার কিভাবে খাবে?মিরাজ ভাই ওর বেতন কতো?”
ধনীরা গরীবদেরকে অপমান করার সুযোগ পেলে যেন সুদে-আসলে পুরন করে নিতে চায়।মিরাজ সাহেবও ব্যতিক্রম না।মুচকি হেসে বললো,
“বেশী না সাড়ে সাত হাজার।”
সাফিনের মা খ্যাকখ্যাক করে হেসে উঠে।
“আমাদের বাড়ির কাজের লোকটার বেতন দশ হাজার।”
শিমুল পুষ্পর দিকে তাকায়।পুষ্প শিমুলের র/ক্তবর্ন চোখের দিকে তাকিয়ে যেন শিমুলের ভেতরটা পড়তে পারলো।আস্তে করে বললো,
“চলো।”
শিমুল সবার দিকে একবার তাকিয়ে পুষ্পর হাতটা ধরে বেরিয়ে আসে।রোকসানা,মুন্নী বাধা দিলেও তারা দাঁড়ায় না।যেখানে সম্মান নেই সেখানে আর থাকার প্রশ্নই আসে না।শিমুল আর পুষ্প রাস্তায় নেমে পড়ে।পুষ্প সেই কখন থেকে কাঁ/দছে।শিমুল কিছু বলছেনা মুখে রাজ্যের অন্ধকারের মেলা বসিয়ে চুপ করে আছে।শিমুল পুষ্পকে নিয়ে সামনের একটা হোটেলে যায়।দুজনেই না খেয়ে আছে।এতো অপ/মানের পরে ওই বাড়িতে খাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।পুষ্প কাচুমাচু করে বললো,
“আমি খাবো না।”
শিমুল চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
“আমি খাবো।খুব খিদা পেয়েছে।”
পুষ্প শিমুলের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে আবার কেঁ/দে দেয়।
রাতে পুষ্পর মন ভালো করতে শিমুল রাতের ঢাকা দেখায়, হাসাতে চায়।শিমুলের মুখের দিকে তাকিয়ে পুষ্প’ও হাসে।ঘুমোতে গিয়ে শিমুল বললো,
“এই পুষ্প আমি তোকে রানীর মতো রাখতে পারছিনা।আসলেই আমি তোর লাইফটা শেষ করে দিলাম।”
শিমুলের চোখের পানি পুষ্পর নজর এড়ায় না।ছেলেটা কাঁদছে!বোবা কান্নার যে কোনো শব্দ নেই থেমে থেমে নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর প্রশস্ত বুকটা কাঁপছে।প্রিয় পুরুষের এমন ভেঙে যাওয়াটা পুষ্পর সয় না।নিজেকে সামলে আলতো করে হাসার চেষ্টা করলো শিমুলের বুকে মাথাটা রেখে ফিসফিস করে বললো,
“দুর এসব কি কথা!আমিতো বেশ সুখে আছি।শিমুলের রানীর কি দুঃখ থাকবে?সে তো নিজেই রানী।তুমি মন খারাপ করোনা তো।”
শিমুল ভেজা চোখে পুষ্পর দিকে তাকিয়ে থাকে।মেয়েটা এতো বুঝধার!আসলে পরিস্থিতি মানুষকে বুঝধার বানিয়ে দেয়।শিমুল উঠে দাঁড়ায়।পুষ্প অবাক হয়ে বললো,
“এতো রাতে কোথায় যাচ্ছ?”
শিমুলের চোখ ভরে জল আসে।পুষ্পর সামনে এসব কান্না-টান্না করা যাবেনা।পুরুষদের কান্না দেখানো কোনো ভালো কাজের মধ্যে পড়ে না।পুরুষরা কাঁদবে একা,অন্ধকারে,খুব গোপনভাবে।সে হাত নেড়ে বললো,
“আসছি”
পুষ্প সোজা হয়ে শুয়ে থাকে।সে কিভাবে জেনো বুঝে গেছে শিমুল বাহিরে গিয়ে ইচ্ছেমতো কাঁদবে।তার নিজেরও কান্না আসে।বালিশ মুঠো করে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে।তার জন্যই তো শিমুলকে এতো অপমান সইতে হলো!আহা টাকা!টাকা যে কি যার নেই সে বুঝে।দশ টাকার যে কি মূল্য নিম্নবিত্তরাই বুঝে।পুষ্প মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে যে সে একদিন শিমুলের মাথার মুকুট হবে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিবে।
শিমুল ব্রিজের উপরে গিয়ে দাঁড়ায়।অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠে।আজকের দুপুরের কথাগুলো মনে হলেই ম/রে যেতে ইচ্ছে করে।এতো অপমান!পুষ্পর করুণ মুখটার দিকে তাকালে শিমুলের দম আটকে আসে।এমন তো কথা ছিলো না।তাহলে!কেন সব উল্টো হচ্ছে?শিমুল দু’হাত দিয়ে মাথার চুল খামচে ধরে।তার ইচ্ছে করছে এই ব্রিজ থেকে ঝাপ দিয়ে ম/রে যেতে।আচ্ছা এই ব্রিজের উপর থেকে লাফ দিয়ে পড়লে কি সে ম/রবে?নাকি রাস্তায় চলন্ত গাড়ির নিচে গেলেই ম/র/ণটা সহজ হবে!শিমুলের মাথায় একটাই কথা কিলবিল করে সে ম/রলে কি পুষ্পর জীবনের ছন্দ পাল্টাবে?ভালো বর, ভালো ঘর পাবে?যদি পায় তাহলে ম/র/তে ক্ষ/তি কি?
চলবে…….
#শিমুল_ফুল
#৪৩
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
শিমুল চোখ বন্ধ করে ব্রিজের গায়ে হেলে দাঁড়ায়।সে কি ভাবছে এসব?ম/রে যাবে!ম/রে গেলে তার পুষ্পটা কই যাবে?শিমুলকে হারিয়ে পা/গল হয়ে যাবে না?পা/গল মেয়ে আরো উল্টাপাল্টা কিছু করলেও অবাক হওয়া যাবে না।যাকে নিয়ে এতো আয়োজন সেই যদি ছন্নছাড়া পা/গল রূপ ধারণ তাহলে কিভাবে হবে?আর সবচেয়ে বড়ো কথা এমন কিছু করলে শিমুল প্রেমিক হিসেবে ব্যর্থ হয়ে যাবে না?তার বাবা জিতে যাবে না?ধুর পা/গলের মতো কি সব ভাবছে!সে ম/রবে কেন?সে তো বাঁচতে চায় হাজার বছর পুষ্পর মিষ্টি মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে চায়।অনেকদিন পরে আঙুলের ভাজে সিগারেট ধরে।অর্থ সংকটে পড়ার পরে এই বাড়তি খরচটা আপনা-আপনিই কমে গেছে কি দরকার একটা সিগারেট খেয়ে ষোল টাকা আগুনে পো/ড়াবার!নিজের দিকে তাকালে এখন শিমুলের অবাক লাগে কতো বদলে গেছে সে?সিগারেট খেয়ে মুখে চকলেট দিয়ে বাসার পথে হাটে।
রোকসানা বিছানায় শুয়ে কাঁদছে।তার মেয়ে আর মেয়ে জামাইটা না খেয়েই চলে গেলো।বুকটা এতো পু/ড়ছে!হঠাৎ করে শিমুল গার্মেন্টসে কাজ করে শুনে মাথা ঠিক ছিলো না বিধায় কয়েকটা কটু কথা না হয় পুষ্পকে বলে ফেলেছে।এখন বুঝতে পারছে এমন করে বলা ঠিক হয়নি।আর কেউ না জানুক তারা তো জানে শিমুল কেমন ঘরের ছেলে!বসে বসে খেলেও তার বাবার সম্পদ কমবে না আর সে কিনা গার্মেন্টসে কাজ করছে!কার জন্য করছে তাদের মেয়ের জন্যই তো।পুষ্পকে ভালো রাখতেই তো ছেলেটা নিজের আত্মসম্মান বাজি রেখে সব করছে।কিন্তু উনারা রা/গের মাথায় যা তা বলে দুজনকে অপমান করলেন।মিজান এই নিয়ে অনেকবার পুষ্পর মোবাইলে ফোন দেয় কিন্তু বারবার বন্ধ বলে।উনারা মনে করে হয়তো মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে কিন্তু কেউ জানতে পারলো না পুষ্পরা ফোনটা বিক্রি করেই মুন্নীকে দেখতে এসেছিলো।মেয়ের শশুড় বাড়ি বিধায় রোকসানা শব্দ করে কাঁদছে না।মিজান স্তব্ধ হয়ে পাশে বসে আছে।রোকসানাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না।মেয়ের এই অবস্থায় তারও যে খারাপ লাগছে।
শুক্রবার রাতে পুষ্পর শরীর খা/রাপ করে।শিমুল ফার্মেসী থেকে ওষুধ এনে দেয়।সকালে শিমুল আর পুষ্পকে রান্না করতে জাগায় না।কাজে যাওয়ার সময় হলে রাতের থাকা খাবারগুলো গরম করে নিজে না খেয়ে রেখে দেয়।যে খাবারটা আছে এতে পুষ্প সকালে আর দুপুরে খেতে পারবে। এখন যদি শিমুল খায় তাহলে পুষ্প দুপুরে খেতে পাবেনা।আর পুষ্প এই অসুস্থ শরীর নিয়ে রান্নাও করবেনা খাবেওনা।তার মনের ভাব সে দোকান থেকে কিছু একটা খেয়ে নিবে।যাওয়ার আগে পুষ্পকে জাগিয়ে দিয়ে যায়।শিমুল দোকান থেকে বন,কলা আর চা খেয়ে কাজে যায়।তার কপালে কি আছে শিমুলের জানা নেই।মিরাজ সাহেব কি তাকে কাজ থেকে বাদ দিয়ে দেবে?ভাবতে ভাবতে শিমুল কাজ করে।ম্যানেজারের কাছে শুনে মিরাজ স্যার আসেনি।শিমুলের মনে কু ডাকে।যদি বাদ দিয়ে দেয়?তাহলে আরেকটা কাজ কই থেকে যোগার করবে?এতো লেখাপড়া করে কি লাভ হলো?একটুও কাজে লাগছেনা।দুপুরে লাঞ্চ আওয়ারে সবাই খাবার খাচ্ছে।শিমুল চুপচাপ টুলে বসে আছে।পেটে এতো ক্ষুধা লেগেছে যে মাথা ঝিমঝিম করছে।এতো বড়ো দিন বন কলা খেয়ে থাকা যায়?শিমুল পেটে ব্যাথা অনুভব করে।তার ভাত খেতে এতো ইচ্ছে করছে মনে হচ্ছে এক বসায় এক গামলা ভাত খেয়ে ফেলতে পারবে।সে মানিব্যাগ বের করে কতো টাকা আছে দেখে,অল্প টাকা আছে।তারপর ধীর পায়ে উঠে রাস্তার পাশে সস্তা একটা হোটেলে ঢুকে।হোটেলে গরুর মাংসের ঘ্রাণে ম ম করছে।শিমুলের মন চায় গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেতে,গরুর মাংস যে তার খুব প্রিয়।কিন্তু পকেটে টাকা কম,মাংস খেলে টাকা বেশী লাগবে বাসায় পুষ্পটা একা তাকে ছাড়া মাংস খাওয়ার প্রশ্নই আসে না।চোখ বন্ধ করে নিজের ইচ্ছাকে মাটিচাপা দিয়ে ডিম তরকারি,ডাল আর ভাত নেয়।টেবিলে খাবার আসলে গ্রোগ্রাসে গিলতে থাকে।ক্ষুধায় তাড়াহুড়ো করে খেতে গিয়ে গলায় খাবার আটকে কাশি চলে আসে।সামনে থেকে কেউ একজন পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়।শিমুল পানি খায়।সামনের লোকটা বলে,
“এতো তাড়া কিসের শিমুল?আস্তে খাও।”
শিমুল হাতের গ্লাস টেবিলে রেখে অবাক হয়ে সামনের মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকে।তার প্রাক্তন ভার্সিটির প্রিন্সিপাল সালাম হক।শিমুল ভালো ছাত্র ছিলো বিধায় ভার্সিটিতে তার কদর ছিলো আলাদা।সালাম হক শিমুলকে সবসময় অন্যচোখে দেখতেন।বাবার থেকে কোনো অংশে কম ভালোবাসেন না এই স্যার।কিন্তু শিমুলের জানামতে স্যারের টাকার অভাব নেই তাহলে এই সস্তা হোটেলে স্যার কি করছে?সে সালাম হককে এই স্থানে আশা করেনি।অবিশ্বাস্য গলায় বললো,
“স্যার!আপনি?”
সালাম হক হাসে।শিমুলের দিকে তাকিয়ে বলে,
“খাওয়া শেষ করো মাই বয়।খাওয়ার মাঝে কথা বলা ভালো কাজ নয়।”
শিমুল অপ্রস্তুত ভাবে ডিমের কুসুম মুখে দেয়।সালাম হক চোখ ভুলিয়ে হোটেলটা দেখে,এখনো প্রায় সময়ই তিনি এই হোটেলে খাবার খেতে চলে আসে।শিমুলের অবস্থা দেখে,কাপড়-চোপড়ের নমুনা দেখে তার অভিজ্ঞ চোখ পরিস্থিতি বেশ টের পাচ্ছেন।নিজের অতীতের সুন্দর সময়ের কথা মনে পড়ে যায়।তার স্ত্রী সাহিদাকে নিয়ে ঢাকায় আসার পরে কি কষ্টে দুজন দিন কাটিয়েছে।একটা রড ফ্যাক্টোরীতে কাজ করে দিন কাটিয়েছে।প্রায়ই এই হোটেলে ভাত খেতো তাই তো এখনো মাঝেমধ্যে এখানে খেতে আসে।সালাম হকের মনে হয় দামী দামী রেস্টুরেন্টে খেয়েও এমন শান্তি লাগে না যতোটা এই হোটেলে খেয়ে লাগে।ভার্সিটিতে পড়ে পাশ করার পরে তখনকার স্যাররা তাকে ভার্সিটিতেই চাকরি দেয়।সেই থেকে সালাম হকের দিন ঘুরে।আজ সে এই ভার্সিটির প্রিন্সিপাল।কতো টাকা,বাড়ি,গাড়ি হয়েছে কিন্তু অতীতের কথা মনে হলেই বুকে চিনচিন করে ব্যা/থা করে উঠে।শিমুল খাওয়া শেষ করে।তার কেন জানি স্যারের দিকে তাকাতে ল/জ্জা লাগছে।সালাম হক ওয়েটারকে ডেকে দধি অর্ডার করে।দধি আসলে খেতে খেতে বলে,
“বুঝলে শিমুল।এটা হলো আমার প্রিয় হোটেল।এই হোটেলের ডাল,আলুর ভর্তা,শুটকির ভর্তা,সবজি সব আমার প্রিয় খাবার।”
স্যারের কথায় কি বলা যায় শিমুল খুঁজে পায় না।প্রতিউত্তরে একটু হাসার চেষ্টা করে।সালাম হক নিজেই বলে,
“তুমি এখানে যে?”
শিমুল দ্বীধায় পরে যায়।গার্মেন্টসের কথা বলা উচিৎ কিনা বুঝতে পারছেনা।মাথা চুলকে বললো,
“স্যার!কাজ করি।”
সালাম হক শিমুলের মনের ভাব বুঝতে পারেন।তিনি খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললেন,
“কোন গার্মেন্টসে?”
শিমুল থমকায়।লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে।স্যার বুঝে গেছে!এই স্যারই শিমুলকে লেকচারার হিসেবে ভার্সিটিতে জয়েন করার কথা বলেছিলো তখন শওকত হাওলাদারের কথায় সব ছেড়েছুড়ে চলে গিয়েছিলো।সে মাথা নিচু করে টেবিলে থাকা সস্তা টিস্যু পেকেটের দিকে তাকিয়ে থাকে।সালাম হক শিমুলের লজ্জা মাখা মুখ দেখে বললো,
“সামনের গলির পরে যে রড ফ্যাক্টরি টা আছেনা?আগে আমি ওটায় কাজ করতাম।যা টাকা পেতাম তা দিয়ে নিজের পড়া চালাতাম আর তোমাদের ম্যাডামকে নিয়ে থাকতাম।”
স্যারের বলা কথাগুলো শুনে শিমুল অবাক হয়ে তাকায়।স্যারের বর্তমানে যা অবস্থা কেউ কখনো কল্পনাও করতে পারবেনা স্যার রড ফ্যাক্টরিতে কাজ করেছে।শিমুলও ভাবতো না যদি না স্যার নিজের মুখে না বলতেন।শিমুল আস্তে করে বললো,
“সামনের গার্মেন্টসে।”
সালাম হক বললো,
“তুমি লজ্জা পাচ্ছ নাকি?আরে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।হোচট না খেলে জায়গা চিনবে কিভাবে?এই যে সময়টা কাটাচ্ছো একসময় গিয়ে মনে হবে জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সময় এটা।এই সময়টা থেকে অনেক কিছু শিখার আছে।জীবনে প্রতিটা পদে পদে এই সময়টার কথা মনে হবে আর তুমি শক্তি পাবে।”
স্যারের কথায় শিমুল সহজ হয়।অল্পবিস্তর কথা স্যারকে খুলে বলে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“অনেক চাকরির জন্য চেষ্টা করেছি এখনো করছি।কিন্তু হচ্ছে না।”
সালাম হক বলেন,
“এখনি ভে/ঙে পড়ছো যে!শক্ত থাকবে দেখবে বি/পদ আসলেও মোকাবিলা করতে কোনো।সমস্যা হবে না।আর এতোদিন হলো,আমাকে একবার স্মরণ করতে।”
শিমুল অকপটে বলে,
“লজ্জায় আপনার কাছে যাইনি।লেকচারার হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন আর আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।”
“লজ্জায় কি জীবন চলছে?নিশ্চয়ই চলছে না।পুরুষদের লজ্জা থাকতে নেই।সমস্যা ঠিক জায়গায় গিয়ে তুলে ধরতে হয় তা না হলে সমাধানের আশা করা বোকামী।”
শিমুল মুগ্ধ চোখে সালাম হকের দিকে তাকিয়ে থাকে।আগেও তিনি শিমুলকে এভাবে বুঝাতেন এখনো বুজাচ্ছেন।সালাম হক মাথা নেড়ে বললো,
“বিকেলে ভার্সিটিতে যাবে।ঠিক আছে।”
শিমুল মাথা নেড়ে সায় দেয়।সালাম হক উঠে দাঁড়ায়।মুচকি হেসে বলে,
“শিমুল তুমি যেভাবে ভাত খেলে তোমাকে দেখে আমার মনে হলো আমি যুবক বয়সের আমাকেই দেখছি।বিকেলে দেখা হচ্ছে তাহলে।”
আস্তে করে উনি বেরিয়ে যায় যাওয়ার আগে বিল দিতে ভুলে না।শিমুল না করলে বাচ্চাদের যেভাবে তার বাবা চোখ রাঙিয়ে না করে ঠিক সেভাবেই না করে।
গার্মেন্টসে ঢুকতে একটু লেট হয়ে যায়।দারোয়ানকে অনেক বুঝিয়ে বেরিয়েছিলো।এখন গিয়ে দেখে মিরাজ সাহেব দারোয়ানকে বকাঝকা করছে।শিমুলকে দেখে ইচ্ছামতো কথা শুনায়।এক পর্যায়ে বলে আর কাজে আসতে হবে না।আসলে সেদিন শিমুল উনার কথার উপর কথা বলেছে আবার বউ নিয়ে নাকের ডগা দিয়ে চলে এসেছে এটা উনার গায়ে লেগেছে।তাইতো শিমুলকে তাড়াতে চাইছে।শিমুল মাথা ধরে যায়।আস্তে করে বেরিয়ে আসে।মনে মনে রাজ্যের যতো বিশ্রী গালি আছে সব উগরে মিরাজের উপরে দেয়।সালাম হকের আদেশ অনুযায়ী হাটতে হাটতে ভার্সিটিতে যায়।সালাম হক যেন শিমুলের অপেক্ষায়ই ছিলো।আসার সাথে সাথে বললো,
“শিমুল!ইংরেজীতে মাস্টার্স করেছো না?”
উনার মনোভাব শিমুল বুঝতে পারে না।বোকার মতো মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।
“ইংরেজি পড়াতে পারবেনা?পারবে তো।আমার স্টুডেন্ট আমি জানি না!”
শিমুল এবার উনার কথার মানে বুঝতে পারে।সারা শরীরে এক অজানা উত্তেজনা ছেঁয়ে যায়।চোখের পলক কয়েকবার ফেলে বলল,
“স্যার!”
সালাম হক শিমুলের দিকে না তাকিয়ে ফাইল হাতে নিয়ে বলে,
“শনিবার থেকে জয়েনিং।”
শিমুল অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকে।তারপর খুশীতে সালাম হককে জড়িয়ে ধরে ফেলে ।পরমূহূর্তেই মনে হয় জড়িয়ে ধরাটা বেশী করে ফেলেছে।উনাকে ছেড়ে বলে,
“স্যার।সরি।আসলে…”
শিমুল আর কিছু বলতে পারেনা তার গলা কেঁপে উঠে।সালাম হক কাধে হাত রেখে বললো,
“সমস্যা নেই।যাও বাসায় যাও।”
বাসায় আসার বাকিটা পথ শিমুল পারেনা উঁড়ে উঁড়ে চলে আসে।গলিতে এসে এক প্রকার দৌড়ে বাসায় গিয়ে ঢুকে।পুষ্প কিছু বুঝে উঠার আগেই শিমুল পুরুষালি গলায় চিৎকার করে উঠে।পুষ্প ভ/য় পেয়ে যায়।শিমুলের চিৎকারে তার হাত পা কাঁপে।শিমুল এসবে তোয়াক্কা করে না।পুষ্পকে পাজকোলা নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বলে,
“বউরে,চাকরি তো হয়ে গেছে রে বউ।”
চলবে…..
❝আমার লিখা গল্পটা অনেকের কাছে বানোয়াট মনে হতে পারে।আসলে আমরা যারা এই অবস্থানে যাই না তারা কখনো এমন পরিস্থিতির খবরও জানি না।।হ্যাঁ যারা বলেন বানো/য়াট তারা এদিকে এসে শুনেন,যা রটে তার কিছু হলেও ঘটে।❞