#শাপলা_ও_সেতুর_গল্প
#প্রভা_আফরিন
[২০তম ও শেষপর্ব]
একটি দুঃস্বপ্নময় নির্ঘুম রাত নেমে এসেছে লিখির ওপর। হাজার চেষ্টা করেও স্বপ্নটাকে তাড়ানো যাচ্ছে না। বরং সময় যত গড়াচ্ছে কল্পনাগুলো গলা টি’পে ধরছে। বসার ঘরে দুইজন অসুস্থ মানুষ। যার মধ্যে একজনের অবস্থা খুবই বিপদজনক। রুনিকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে জাহানারা বেগম ও বাড়িটা অনিরাপদ অবস্থায় থাকবে। এই সময়ের মাঝে জাহানারা বেগমের অবস্থা খারাপ হতে পারে। স্ট্রোকও করতে পারেন। আবার রুনিকে ইমার্জেন্সি হাসপাতালে নিয়ে পৌঁছাতে না পারলে বাচ্চাসহ মায়ের বিপদের আশঙ্কা। অসহ্য মানসিক চাপের মাঝে অচল পা’দুটি টেনে লিখি ছুটে গেল প্রতিবেশিদের দোরগোড়ায়। পাশের বাড়ির মহিলাটিকে সে চাচি সম্বোধন করে। ওনাকে ডেকে এনে জাহানারা বেগমকে দেখে রাখতে বলল সে। তিনি যেন আরো দুইয়েকজন প্রতিবেশী ডেকে এনে জাহানারা বেগমের শুশ্রূষা করেন সেই অনুরোধ করে লিখি সিএনজি ডেকে রুনিকে ধরে ধরে হাটিয়ে নিয়ে তাতে চড়ে বসল। যাত্রাপথে নবীনকে ফোন দিয়ে সকল ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে ভেজা গলায় অনুরোধ করল,
“নবীন ভাই, এই বিপদে আপনিই আমার একমাত্র ভাই। আমি আপাকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি। আপনি মুনিয়া আপুকে এনে মায়ের কাছে রেখে একবার আমার বাবার বাসায় খোঁজ নিন তারা ঠিক আছে কিনা। আমার বাবা, আমার স্বামী..”
লিখির গলায় কান্না আটকে আসে। আর কোনো কথা বলতে পারে না। নবীন তড়িঘড়ি করে বলে,
“তুমি সাহসী মেয়ে লিখি। একদম মনের জোর হারাবে না। আমি তোমার আপুকে নিয়ে যতদ্রুত সম্ভব পৌঁছে যাব। এদিকটা নিয়ে ভেবো না। আল্লাহকে ডাকো।”
নওশাদের ইচ্ছে ছিল রুনিকে বড় হাসপাতালে নিয়ে অভিজ্ঞ ডাক্তার ও নার্সের আন্ডারে রেখে ডেলিভারি করাবে। কিন্তু ইচ্ছে ও বাস্তবতার বিস্তর ফারাক। রুনিকে নেওয়া হলো কাছেপিঠের একটি সাধারণ মানের বেসরকারি ক্লিনিকে। রুনি বেবি পুশ করার জোর পাচ্ছিলো না বলে দুইঘন্টা চেষ্টা করার পর ডাক্তার ঘোষণা দিলেন সি-সেকশন করা হবে।
নবীন একটু পর পর ফোন করে লিখিকে আপডেট জানাচ্ছিলো। সে জানালো মার্কেটের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ফায়ার সার্ভিস কাজ করছে। কারো ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে জানা না গেলেও দোকানগুলোর মালামাল অক্ষত না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। জাহানারা বেগমের জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু সন্তানের খোঁজ না পেয়ে তিনি একটু পর পর মূর্ছা যাচ্ছেন। লিখির মায়ের অবস্থাও তাই। মুনিয়ার পরিবার এখন লিখির বাবার বাসায় আছে। লিখিকে ওদের নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। নবীন মার্কেটে যাচ্ছে৷ খোঁজ নিয়ে বাকিটা জানাবে।
অপারেশন কেবিনে নেওয়ার পর আর সিজারের দরকার পড়লো না। বাচ্চাটা নরমালেই হলো। শেষ অবধি চেষ্টা করে একটা তুলতুলে ছেলে বাবু হয়েছে রুনির। দুর্বল, ভীতু মেয়েটা বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে আজ হুট করেই সাহসী হয়ে গেছিলো। যেই রুনি সামান্য ফুলের টোকা পেয়ে কেঁদে ভাসাতো সে আজ অনায়াসে কয়েকঘন্টা মরণ ব্যাথা সহ্য করে বাচ্চাকে পৃথিবীর আলো দেখালো। এই একটা যায়গায় প্রতিটা মেয়ে, প্রতিটা মা শারিরীকভাবে দুর্বল হয়েও পুরুষের কাছে জিতে যায়। সৌন্দর্য, শ্রম ও জীবনের মূল্য দিয়ে তারা একটি সন্তানকে জন্ম দিয়ে লালন-পালন করে। তাই বোধহয় মানুষ মেয়েদের ক্ষমতা নিয়ে তাচ্ছিল্য করতে পারলেও মায়েদের ক্ষমতা নিয়ে তাচ্ছিল্য করতে পারে না।
নতুন বাচ্চা এলে তাকে ঘিরে পরিবারের খুশির সীমা থাকে না। রুনির বাচ্চার বেলায় সেই খুশিটা কারো ঠোঁটেই ধরা দিলো না। নার্স যখন বাচ্চাকে নরম কাপড়ে মুড়িয়ে এনে লিখির কোলে দিল, ওর চেপে রাখা কান্নাটা ছিটকে বেরিয়ে এল। বাচ্চাটাও কি মন্দ সময়টা টের পেল কিনা কে জানে! সেও মামির বুকে তারস্বরে কেঁদে উঠলো। সেই যুগল কান্না দেওয়ালে বারি খেয়ে মিশে যায় অন্ধকার রাতের কোনো হাহাকারে ঠাসা গহ্বরে। রুনি দুর্বলচিত্তে শুধু চোখের জল ফেলে বিড়বিড় করে বলে,
“লিখিরে, আমার ভাইয়ের খোঁজ এনে দে। আমার ভাইকে এনে দে।”
লিখি চোখ বুজে পড়ে থাকে। এই তো কিছুদিন আগে এক খুনসুটিময় মুহূর্তে রাসিফ বলেছিল,
“একটা বিষয় খেয়াল করেছো, বিয়ের আগে আমাদের দেখা হলেই কোনো না কোনো বি’পত্তি ঘটতো। হয় তোমার নয় আমার। কিন্তু বিয়ের পর তেমন কিছুই ঘটেনি। একেই বলে সম্পর্কের পবিত্রতা।”
“আপনার বুঝি বিপ’ত্তি বাধানোর খুব শখ হয়েছে?”
“উহু, কাছের মানুষের সামান্যতম ক্ষ’তি আমি চাইনা। আর তুমি তো আত্মার মানুষ। আল্লাহ তোমার বিপদও যেন আমার উপর দিয়ে নেয়।”
সেসব কথা মনে করে লিখির চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে,
“আপনিও তো আমার আত্মার মানুষ। আপনার বিপদ আমি কি করে সইবো? আল্লাহ আমাকে সহ্য শক্তি দিয়েছেন, যন্ত্রণা প্রশমনের ক্ষমতা দেননি।”
রাসিফের খোঁজ পাওয়া গেল রাত তিনটায়। আগে পাওয়া গেল জাহিদুল ইসলামের খোঁজ। নবীন ঘটনাস্থলে গিয়ে জানতে পারলো আগুন লেগেছিলো ভবনের তিন তলায়। জাহিদুল ইসলামের দোকান নিচতলায় ছিলো বিধায় মালামাল না সরাতে পারলেও জানের ক্ষ’তি হয়নি। কিন্তু ওনার এ’জমা রো’গ থাকায় অতিরিক্ত ধোঁয়ায় আঁ’টকে পড়ার ফলে অক্সিজেন অভাবে অসু’স্থ হয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলেন। ওনাকে উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে।
রাসিফের দোকান তিন তলাতেই ছিল। মুমিনুল আজ জলদি বাড়ি ফিরে যাওয়ায় সে একাই দোকানে নতুন তোলা মালামাল গুছিয়ে নিচ্ছিলো। আগুন যখন লাগে তখনও সে দোকানেই ছিল। সকলের ছোটাছুটিতে অবস্থা বুঝে সে দোকান থেকে বের হয়ে আসে। কিন্তু আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় সিড়ি দিয়ে নামার ব্যবস্থা ছিল না। অবস্থা বেগতিক হলে বাঁচার তাগিদে অনেকেই জানালা ভে’ঙে নিচে লা’ফিয়ে পড়ার দুঃসা’হস করে ফেলে। রাসিফও তাদের একজন। তিনতলা থেকে লা’ফিয়ে পড়ার ফলে তাকে গুরু’তর আহ’ত অবস্থায় প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু কাধে ওপেন ফ্রা’কচার হওয়ায় পরে রাজধানীতে পাঠানো হয়।
____________
সময় তার নিয়মে চলে যায়। রেখে যায় কিছু যন্ত্রণাময় ক্ষ’ত কিংবা সুখস্মৃতি। বিভীষিকাময় রাতটির পর কে’টে গেছে চারটি মাস। বদলে গেছে আগুনে পো’ড়া ভবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষের ভাগ্যও। কেউ মুমিনুলের মতো জীবিকা হারিয়েছে, আবার কেউ সর্বস্ব। রাসিফের সম্পূর্ণ পরিবারের ব্যয় দোকানের ওপর নির্ভরশীল ছিল। লিখির পরিবারেরও তাই। তাদের সর্বস্বই আগুনে পুড়ে গেছে। সেই সঙ্গে ভেঙে পড়েছে পরিবারের আয়ের মেরুদণ্ড। লিখির বাবা জাহিদুল ইসলাম অল্প সময়ে সামলে উঠতে পারলেও রাসিফের পরিবার পারেনি। রাসিফ এখন সুস্থ, তবে পুরোপুরি নয়। তিনতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে সে ব্যাপক আহ’ত হয়। হাত-পা-মাথায় চো’ট লাগে। তবে সবচেয়ে গুরুতর আঘা’ত লাগে ডান কাধ ও হাতের জয়েন্টে। সেখানে ওপেন ফ্রাক’চার হওয়ায় ফলে তার একটা বড় সা’র্জারি করাতে হয়েছে। মাথায়ও ছোট একটা সা’র্জারি হয়েছে। সাঃর্জারির ও চিকিৎসার পেছনে রাসিফের সব টাকা তো গেছেই লিখিও নিজের সব টাকাও দিয়ে দিয়েছে। লিখির ওপর বর্তমানে সংসারটা টিকে আছে।
লিখি যে শুধু চাকরি করছে এমন নয়, রাসিফের ব্যবসাটা নতুন করে চালু করেছে। অফিস থেকে ফিরে, চোখের নিচের কালি ও মুখের ক্লান্তিগুলো মেকআপ দিয়ে ঢেকে, সেজেগুজে প্রতিদিন দেড়-দুই ঘন্টা লাইভ করে। অনলাইনে পোশাক অর্ডার নেয়, রাতে বসে সেগুলো প্যাকিং করে, সকালে অফিস যাওয়ার পথে কুরিয়ারে নির্দিষ্ট ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়। তাকে দিনরাত এক করে সংসারের জন্য খাটতে দেখে রাসিফের কান্না পায়। মেয়েটা শুধু দিয়েই যাচ্ছে। বিনিময়ে রাসিফ তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি। লিখি অবশ্য তাতেই সন্তুষ্ট। কিন্তু রাসিফের মন মানে না। সে মনে মনে ঠিক করে খুব জলদিই দোকান ভাড়া করে ব্যবসায় নামবে। ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে গেলে সে লিখিকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেবে। বাড়ির জন্য একটা কাজের লোক রাখবে। আল্লাহ চাইলে তার মা-বউকে বাকিটা জীবন কোনো কষ্ট করতে দেবে না।
ইশ! ভাবনাটা যদি বাস্তবের মতো সহজ হতো! নতুন দোকান খোলা, মালামাল তোলার পুঁজিটুকু রাসিফের হাতে নেই। বাড়ির সামনের খোলা যায়গাটুকু বিক্রি করে টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু মা বা লিখি কেউই তাতে সায় দিতে পারে না। লিখি বলে ধৈর্য ধরতে। তার বিশ্বাস অনলাইনে ভালো সাড়া পাওয়া যাবে। সেখান থেকে একটু একটু করে পুঁজি জমা হবে। রাসিফ অনলাইন বিজনেসে প্রথমে ভরসা করতে পারেনি। প্রথম প্রথম লিখিও সাড়া পায়নি। কিন্তু সে লেগে ছিল। কাস্টমার কি ধরনের পোশাক চায়, মার্কেটে কোন ড্রেসের চাহিদা বেশি সব দিক খেয়াল রেখে সে কালেকশন আনে। লাইভে প্রতিটা ড্রেস ডিটেইলসে দেখায়। প্রথমে তেমন সাড়া না পেলেও এখন কমবেশি সেল হচ্ছে।
লাইভ শেষ করে মেকআপ তোলার সময় লিখির ফোন বেজে উঠলো। মুনিয়া কল করেছে। সে রিসিভ করে বলল,
“বিয়ের পর তো আমাকে পরই করে দিয়েছো। কথাই বলো না।”
“আমি পর করে দিয়েছি নাকি তুই-ই সময় পাস না?”
লিখি জিভ কে’টে বলল,
“আচ্ছা বাদ দাও। শ্বাশুড়ির ধা’রালো আহ্লাদে কেমন আছো বলো?”
“এভাবে বলিস কেনো? তোর কি মনে হয় আমার শ্বাশুড়ি শুধু ঝগড়াই করে?”
“করে না বলছো?”
“সে প্রতিটা সংসারেই টুকটাক লেগে থাকে। মানিয়ে চলতে হয়। তোর নবীন ভাইয়ের মত একজন ভালো মনের মানুষের জন্য আমি সারাজীবন মানিয়ে চলতে পারি। তবে আম্মা আমাকে সমঝেও চলে বুঝলি।”
লিখি হাসে। নবীনের মা কেন মুনিয়াকে সমঝে চলে তা তার জানা। নবীনের বিয়ের সময় তার মা মুনিয়াকে মেনে নিতে চাননি। নবীন অনেক বুঝিয়েও যখন মাকে রাজি করাতে পারছিলো না তখন বাড়ি ছেড়ে দূরে গিয়ে চাকরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাতেই কাজ হয়। নিমরাজি হয়ে ওনাকে ছেলের বিয়ে দিতে হয়েছে। তারপরই নিধির বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়। নিধি ততদিনে মুনিয়ার চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে প্রেম করছে। তাদের প্রেমের ফুল ফুটিয়েছিল লিখি। দুই পরিবারের কেউই ওদের সম্পর্ক মানতে রাজি ছিল না। লিখি দুই পরিবারের সেতু হয়ে সম্পর্কটা টিকিয়েছে। তার চেষ্টায় অবশেষে বিয়েটা হয়। নিধি মুনিয়ার বাড়ির বউ হয়ে যাওয়ার ফলে তার মা একটু চুপসে গেছেন। ছেলের বউকে কিছু বললে তার প্রভাব নিজের মেয়ের ওপরও পড়তে পারে কিনা! এই বুদ্ধিটা যে লিখির মাথা থেকে বের হয়েছে তা বুঝতে মুনিয়ার অনেকটা সময় লেগেছে। বোনের সুখী সংসারের জন্য মেয়েটা কম করেনি।
মুনিয়া বলল,
“খুব পরিশ্রম যাচ্ছে নারে? নিজের দিকে তো খেয়ালই দিচ্ছিস না। দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছিস।”
“তোমরা আছো তো খেয়াল রাখার জন্য।”
“শোন, তোর জন্য কাল টিফিন পাঠাবো। বাসা থেকে বয়ে নেওয়ার দরকার নেই। তোর ভাইয়ের সাথে বসে খেয়ে নিবি।”
“নবীন ভাই টিফিন নিয়ে এলে তুমি না বললেও ভাগ বসাবো।”
লিখি কাজ সেড়ে বসার ঘরে আসতেই নওশাদকে দেখতে পেলো। তার কোলে চারমাস বয়সী রাদিফ, পিটপিট করে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। লিখি হেসে বলল,
“আপাকে নিতে এসেছেন?”
“বাচ্চার মা হয়ে গেল তবুও স্বভাব বদলালো না। পান থেকে চুন খসলেই বাচ্চাটাকে নিয়ে চলে আসে। অফিস ফেলে আমাকে ছুটতে হয় বাচ্চার মাকে ফিরিয়ে আনতে।”
“আপনি কি চান আপা বদলে যাক?”
লিখির কথায় নওশাদ হেসে ফেললো। বলল,
“এ হলো সুখের অত্যা’চার, শালাবউ। সইতেও পারি না, কইতেও পারি না।”
রুনির বাচ্চা হওয়ার দিনটার কথা ভাবলে আজও নওশাদের মনটা ভার হয়ে আসে। সেদিন খুব ভোরে রুনি ওকে ফোন দিয়ে বলেছিল,
“বাবুর আব্বু, তুমি তো সত্যি সত্যি আব্বু হয়ে গেছো।”
এই কথাটা যতবার মনে পড়ে, নওশাদের নিজেকে অপরাধী মনে হয়। যদি সে না যেত সেদিন। তাহলে পরিবারটার বিপদের দিনে একটু হলেও সাহায্য করতে পারতো। নওশাদের ভাবনার মাঝেই রাদিফ ওর জামা ভিজিয়ে দিলো। নওশাদ গলা উঁচিয়ে বলল,
“এই রুনি, বাবুকে ডায়পার পরাওনি কেন?”
ভেতর থেকে আরো জোরে উত্তর এল,
“বাবুর আব্বু পরাবে বলে।”
লিখি ওদের ঝগড়া শুনে হাসতে হাসতে সরে গেল। ভাগ্যিস পরিবারের খুশিটা আগের মত আছে।
রাসিফের উদাস দৃষ্টি জানালার বাইরে। নিকষকালো আধারের মাঝে রাস্তার দুর্বল বাতিটা দূর থেকে হলদেটে জোনাকি পোকার বাতির মত লাগছে। রাসিফ তার ডানহাত এখন নির্বিঘ্নে নড়াচড়া করতে পারলেও হাড় সম্পূর্ণ জোড়া না লাগা অবধি কাজ করা নিষেধ। অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলে এখন অর্থোপেডিকের পরামর্শে হাতের বিভিন্ন ব্যায়াম করছে সে। লিখি ভাতের প্লেট নিয়ে এসে ওর পাশে বসে বলল,
“এখনো খাননি কেন?”
রাসিফ বাইরে থেকে চোখ সরালো। মুচকি হেসে বলল,
“তুমি খাইয়ে দেবে বলে।”
লিখি ভাত মাখাতে মাখাতে বলল,
“এটা কিন্তু ঠিক না। আমার আরো দেরি হতে পারতো। ততক্ষণ কি না খেয়ে থাকবেন?”
“আমি তো পরিশ্রম করি না যে খিদে পাবে। বরং তোমার সন্ধ্যাতেও একবার পেট ভরে খাওয়া উচিৎ।”
লিখি সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল,
“খুব সুবিধা নিচ্ছেন আপনি। এখন হাত নড়াচড়া করতে পারা সত্ত্বেও মা, বউ, বোনের হাতে খাচ্ছেন। এবার থেকে সবাইকে মানা করে দেবো। নিজের হাতে খাবেন।”
“তোমাদের হাতে খেলে খাবারের স্বাদ বেড়ে যায়। তৃপ্তি পাই।”
রাসিফ মুখের খাবার চিবোতে চিবোতে লিখিকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে। কি নিদারুণ ক্লান্তি মেয়েটার মুখে। সরু থুতনিটা আগে শুধু রাসিফের ভালোবাসায় সিক্ত হতো। আর এখন পরিশ্রমে সারাক্ষণ সিক্ত থাকে। রাতের নামমাত্র ঘুমের পর আবারো ব্যস্ততা শুরু হবে মেয়েটার। রাসিফ বলল,
“প্রতিদিন লাইভ না করলে হয় না?”
“প্রতিদিন না করলে অনেক মানুষের কাছে পৌঁছাবো কি করে?”
“লাইভে একটানা বকবক কিভাবে করো? চোয়াল ব্যথা করে না?”
“প্রতিদিন এক কথা জিজ্ঞেস করতে একঘেয়ে লাগে না?”
“বিয়ের পর থেকে আমি তোমাকে কিছুই দিতে পারিনি। শুধু নিয়েই গেলাম। সাথে নিজের দায়িত্বটাও চাপিয়ে দিলাম।”
“আমার এমনটা হলে বুঝি আপনি ফেলে দিতেন? আর অতো ইমোশনাল হওয়ার কিছু নেই। আপনার ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেলে আমি চাকরি ছেড়ে শুধু ঘুরে বেড়াবো আর চিল মা’রবো।”
“ঈগল কি দোষ করলো?”
রাসিফের ঠাট্টায় ভারী পরিবেশটা হালকা হলো। দুজনের মুখে হাসি ফুটলো। লিখি খাবারের লোকমা মুখে তুলে দিতে চাইলে রাসিফ সেটা ওর মুখেই দিয়ে দেয়। ঠোঁট উল্টে বলে,
“বাড়ির সামনের জমিটা বিক্রি করতে দিচ্ছো না। তাহলে বন্দক দেবো ভাবছি। মামা জমিটার বিনিময়ে টাকা দেবেন। পরে আস্তে আস্তে শোধ করে আবার ফিরিয়ে আনবো। আমি আর হাত গুটিয়ে থাকতে পারবো না।”
লিখি কিছুক্ষণ চুপ রইল। একটু ভেবে বলল,
“যা করবেন, ধীরে ধীরে করুন। অন্তত দুটি মাস সময় নিন ব্যবসায় বসতে। তাতে হাতটাও পুরোপুরি বিপদমুক্ত হবে। আর আপনার দোকান নতুন করে চালু হলেও লাইভে অর্ডার নেওয়া বন্ধ করবো না। দুইদিকে সমানতালে চললে ব্যবসা বড় হবে।”
“তখন তোমাকে চাকরি করতে দেব না বলে দিলাম।”
“আচ্ছা করবো না।”
খাওয়া শেষে লিখি হাত ধুয়ে এসে ঘর অন্ধকার করে রাসিফের গা ঘেঁষে বসলো। খোলা জানালা দিয়ে সামান্য আলো আসছে। সেই আলোয় দুজনকে কাছ থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। রাসিফ লম্বা শ্বাস টেনে নিতে বুঝলো লিখির আজ মন ভালো। সে রাসিফের পছন্দের পারফিউম মেখেছে। মেয়েটা শুধু রাতেই সাজগোজ করে, পারফিউম মাখে। তার সব সজ্জা শুধু রাসিফের জন্য। রাসিফ মোহগ্রস্ত গলায় বলল,
“আমরা বিয়ের পর বেড়াতে যাইনি। ব্যবসায় ব্যস্ত হওয়ার আগে একবার লম্বা ট্যুর দেবো দুজনে। কোথায় যাবে বলো? পাহাড় নাকি সমুদ্র?”
“টস করে দেখি? শাপলা হলে সমুদ্রে আর সেতু হলে পাহাড়ে।”
রাসিফ বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল,
“আবার টস!”
“এ্যাহ, টস করেছিলাম বলেই না আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম।”
“ভাগ্যিস করেছিলে। কয়েনটা বের করো একটা চুমু খেয়ে কপালে বাধিয়ে রাখি।”
রাসিফের বিদ্রুপ গায়ে মাখলো না লিখি। স্বামীর বাম কাধে মাথা রেখে নির্ভার হয়ে বাইরে তাকায়। তার বিশ্বাস এই দুর্দিন কে’টে যাবে। আবারও সুখে ভরে উঠবে বাড়িটা। রাসিফের আশ্বাসের হাতটা লিখিকে জড়িয়ে ধরে। ফুরফুরে হাওয়ায় ভেসে আসছে উষ্ণ আবেগ। সেই আবেগে উভয়ের হৃদয় কানায় কানায় পূর্ণ হয়। রাসিফ ফিসফিস করে বলে,
“তুমি কী জানো, তুমি যে একটা চু’ন্নি?”
লিখি মুচকি হেসে বলে, “হু, আপনার হৃদয়টা যে চু’রি করেছি।”
~সমাপ্ত~