#শাপলা_ও_সেতুর_গল্প
#প্রভা_আফরিন
[পর্ব-১৭]
ইদানীং রাসিফের চোখের পাতায় গাঢ় ঘুম জমা হয় না। কেমন একটা স্বপ্ন ও বাস্তবের মাঝে রাতগুলো কে’টে যায় তার। এই ঘুম না হওয়ার কারণ লিখি। মেয়েটার মধ্যে থেকে ‘নতুন বউ’ ‘নতুন বউ’ ভাবটা সরে যাচ্ছে। ফলে এখন সে কারণ ছাড়া শাড়ি তো পরেই না বরং আরো একধাপ এগিয়ে ইদানীং ঘুমানোর সময় বড় নেকের ঢিলেঢালা টিশার্ট এবং পালাজো প্যান্ট পরছে। রাসিফ যতবার ওকে এই বেশে দেখে বুকের ভেতর ছলাৎ করে ওঠে। সময়ের সাথে বুকে বহমান অবাদ্ধ নদীর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ বাড়তেই থাকে। কয়েকদিন যাবত গরমের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় রাতে কাঁথাও প্রয়োজন পড়ছে না। বিপত্তিটা যেন এই সুযোগে আরো বেড়ে গেছে। পাশ ফিরলেই দেখা যায় হয় টিশার্ট কাধ বেয়ে পড়ছে অথবা পালাজো হাটুতে উঠে এসেছে। কি বিপত্তি! রাসিফের অবাদ্ধ দৃষ্টি না চাইতেও বারবার লিখিকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে। সরাসরি বলতে না পেরে রাসিফ একদিন ব্যঙ্গ করে বলেছিলো,
“এমন পেটিকোট পা’জামা পরে কি লাভ?”
লিখি পাল্টা প্রশ্ন করে,
“লুঙ্গি পড়েন কেনো?”
“আরামের জন্য।”
“সেইম টু ইউ।”
“তাহলে এক কাজ করো। এসব পেটিকোটওয়ালা পা’জামা ছেড়ে আমার সাথে লুঙ্গি পরো। এমনিতেও তোমার এই পোশাক কোনো কাজের না। রাতে বাচ্চাদের পোশাকে পরিনত হয়। তারচেয়ে দুজনে ভাগাভাগি করে পরলে পোশাক কেনার টাকাও বেঁচে যাবে।”
“হুম, আইডিয়া মন্দ না। ভেবে দেখবো।”
রাসিফ ক্ষেপে যায়। তার কোনো কথাই গায়ে মাখছে না মেয়েটা! নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে এমন করছে! সে বলে,
“এই মেয়ে? ফাজলামি পেয়েছো? ভুলে যাবে না ঘরে একজন পুরুষ বাস করে। শালীনভাবে চলাফেরা করবে।”
“আমি জানি ঘরে একজন পুরুষ বাস করে। আর সে পরপুরুষ নয় বলেই শালীনতার প্রশ্ন আসছে না। আমি এভাবে চলবো।”
কথাটায় লিখির অপ্রকাশিত আশকারা ছিলো কিনা কে জানে! রাসিফও বলে,
“তাহলে আমিও মন যা চায় তাই করবো। তুমি আমার বিয়ে করা বউ বলে কথা।”
সেদিনের পর রাসিফ পেয়ে বসেছে। অসীম সাহস নিয়ে ঘুমানোর ভাণ করে লিখির গায়ের ওপর হাত পা তুলে দিতে শুরু করেছে। কখনো সেভাবেই রাত কেটে যায় আবার কখনো লিখির কনুইয়ের গুঁ’তো খেয়ে চুপসে যায়। বিয়ের সময় যত গড়াচ্ছে রাসিফ ও লিখির মাঝের সুপ্ত জড়তা ও ব্যবধান তত উধাও হচ্ছে। কে জানে? নতুন অনুভূতির প্রজাপতিও হয়তো চুপিচুপি উপস্থিতি জানান দিয়ে গেছে।
রাসিফের দোকানের কর্মচারী মুমিনুল বিয়ে করেছে রাসিফের আগে। ছেলেটা প্রতিদিন হাসি মুখ নিয়ে কাজে আসে। মুখ দেখলেই বোঝা যায় সে কত সুখী। অন্যদিকে রাসিফ দিনের শুরু থেকে শেষ অব্যক্ত এক অস্থিরতায় ডুবে থাকে। আগে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরতে রাত নয়টা-দশটা বেজে যেতো। এখন সন্ধ্যা হলে আর দোকান আর মন টিকতে চায় না। ঝ’গড়া হোক বা সাধারণ আলাপ, লিখির কন্ঠটা শুনতে ইচ্ছে হয়। রাসিফ ফোন হাতে নিয়ে লিখিকে কল দিলো। রিসিভ হতে বেশি সময় লাগলো না।
“হ্যালো!”
রাসিফ শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। বলে,
“তুমি কি ব্যস্ত?”
“তা তো অবশ্যই। কিছু বলবেন?”
“আসলে সাদিক পরিবার নিয়ে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসবে আজ।”
“কে সাদিক?”
“যার সামনে আমাকে বয়ফ্রেন্ড পরিচয় দিয়েছিলে।”
“ওহহ আচ্ছা। কিন্তু কেনো আসবেন? আপনাদের দুই পরিবারের না মন কষাকষি হয়েছে?”
“ঠিক করার জন্যই আসছে। সাদিককে বোঝাতে পেরেছি সবটা নিছক ভুল বোঝাবুঝি ছিলো। রাগ-অভিমান যাই হোক, আমরা তো আত্মীয়। তাই রাগ ভুলে আজ চাচিকে নিয়ে বউ দেখতে আসবে। তুমি জলদি বাড়ি ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করবে।”
“করবো।” লিখি কিছু একটা ভেবে আবার জিজ্ঞেস করলো,
“সাদিক ভাই কি পাত্রী পেয়েছে বিয়ের জন্য?”
“এখনো পায়নি তবে দেখাদেখি চলছে।”
“ঠিক আছে।”
এরপর নিরবতা। উভয়পক্ষই নিশ্চুপ হয়ে কানে ফোন ধরে রইলো। কিছুক্ষণ পর লিখি বললো,
“আপনি কি আরো কিছু বলবেন?”
“না, রাখছি।”
রাসিফ ফোন কাটলে লিখি কাজে মন দিলো। নবীনকে ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে বললো,
“মুখ শুকিয়ে রেখেছেন কেনো নবীন ভাই? কিছু হয়েছে?”
“ব্যস্ততা কম থাকলে এসো চা খাওয়া যাক।”
লিখি বুঝলো নবীন কিছু বলতে চায়। সেও তাকে অনুসরণ করে ক্যান্টিনে গেলো।
নবীন উশখুশ করছে। ব্যপারটা কি করে লিখিকে বলবে বুঝতে পারছে না। দু’সপ্তাহ আগে সেই যে মুনিয়ার সাথে ফোনে কথা বলা শুরু হয়েছিলো, এরপর প্রতিদিন রাতেই অনেকটা সময় ধরে দুজনে ফোনে যুক্ত থাকতো। এমন নয় যে তারা খুব বেশি কথা বলে। দুয়েকটা কথা, একটু নিরবতা, নিঃশ্বাসের শব্দ সেই সাথে নিঝুম রাত, সবটাই দুজনের কাছে উপভোগ্য ছিলো। রাতের বেলা নবীনের ঘর থেকে অস্পষ্ট কথা বলার আওয়াজ পেয়ে নিধি সেদিন মাকে বলেই ফেলেছে ভাইয়ার কারো সাথে সম্পর্ক আছে বোধহয়। সেই থেকে সবাই ওর পেছনে পড়েছে মেয়েটা কে জানার জন্য। নবীন তেমন কিছু নয় বলে পাশ কাটিয়ে গেছে। মনের কাছে সে নিজেই স্বচ্ছ ছিলো না। মুনিয়ার নিষ্পাপ স্বভাব ওকে প্রথম থেকেই আকর্ষণ করতো। সময়ের সাথে তা প্রবল হয়েছে। এত ভালো মেয়েটির একজন বিপত্নীক পুরুষের সাথে বিয়ে হবে মানতে না পেরে নবীন ওকে ফোনে বলেছিলো বিষয়টা নিয়ে আরেকবার ভাবতে।
মুনিয়া উদাস গলায় বলেছিলো,
“ভাবতে হবে না। এই সম্বন্ধটাও ভাঙবে দেখে নেবেন।”
“কিভাবে?”
“বিয়ে ভাঙতে আমার রূপই যথেষ্ট। সাথে বয়স আর মেদবহুল শরীর তো আছেই।”
“এভাবে বলো না মুনিয়া।”
“এভাবেই বলতে হয়। কালোদের সহানুভূতি দেখানোর লোকের অভাব হয় না। এই যেমন আপনারও সহানুভূতি হচ্ছে আমার ভাগ্যের ওপর।”
“আমি সহানুভূতি দেখাই তোমাকে? তোমার মনে হয়?”
“তাহলে আপনার আমাকে নিয়ে ভাবনাটাকে আমি কি বলে ডাকবো আপনিই বলে দিন?”
নবীন উত্তর দিতে পারেনি। পরের সপ্তাহে মুনিয়াকে দেখতে আসার কথা থাকলেও কোনো কারণবসত পাত্রপক্ষ আর আসেনি। এরমাঝে দুজনের ফোনালাপ চলছিলো বেশ৷ কিন্তু গত দুইদিন মুনিয়ার সাথে নবীনের আর যোগাযোগ হয়নি। নবীন কল করলে কখনো ফোন বন্ধ বলছে আবার কখনো বেজে বেজে কে’টে যাচ্ছে। হঠাৎ কি হলো! নবীনের হাঁসফাঁ’স লাগে। দুই সপ্তাহেই মুনিয়ার কন্ঠ তার স্বভাবে পরিনত হয়েছে। তবে একটা ভালো দিক হলো, গত দুইদিনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতায় সে সেদিনের দিতে না পারা উত্তরটা পেয়ে গেছে। মুনিয়াকে নিয়ে তার ভাবনার নাম সহানুভূতি নয়, এই ভাবনার নাম ভালোবাসা। সে একটু একটু করে মেয়েটার প্রতি দুর্বল হয়েছে। দুর্বলতার চরম প্রকাশ হলো ভালোবাসা। তাই আজ ব্যগ্র হয়ে লিখির কাছে খোঁজ নিতে এসেছে।
লিখি ঘড়ি দেখে বললো,
“চুপ থাকবেন? নাকি কিছু বলবেনও?”
নবীন ইতস্তত করে বললো,
“মুনিয়াকে ফোনে পাচ্ছি না দুইদিন ধরে। ওদের বাড়িতে সব ঠিকঠাক আছে তো?”
“মুনিয়া আপুর তো গত পরশু অ্যাঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেছে। পাত্রপক্ষ আগের সপ্তাহে আসেনি বলে ধরেই নিয়েছিলাম তারা আর আসবে না। কিন্তু গত পরশু পাত্রপক্ষ এসে সব কথা সেড়ে অ্যাঙ্গেজমেন্ট করে রেখে গেছে। বিয়ের ডেট ঠিক হয়ে যাবে যখন তখন। আপু হয়তো ব্যস্ত আছে।”
নবীনের মনে হলো সে ভুল শুনেছে। সে অবিশ্বাস্য চোখে লিখির দিকে তাকিয়ে রইলো অনেকটা সময়। লিখি মনোযোগ দিয়ে নিজের কাপের চা টুকু শেষ করে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
“নিধি তো ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। খুব ছোট নেই এখন। একজন ভালো পাত্র আছে। ওর বিয়ের কথা যদি ভাবেন আমাকে জানাবেন। এখন গেলাম।”
নবীন কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। কণ্ঠনালী রোধ হয়ে গেছে। বড্ড দেরি করে ফেলেছে সে। সবুর করতে করতে ওর ভাগ্যের সব খুশিই বিলীন হয়ে গেছে। মুনিয়াও কি তবে সেভাবেই হারিয়ে গেলো!
____________
রুনি সাত মাসে পড়েছে। গত একমাস একটানা শ্বশুরবাড়ি থাকার পর সে বাপের বাড়ি এসেছে। ওকে নামিয়ে দিয়ে গেছে জেসমিন। রুনিকে এবার এত দেরি করে আসতে দেখে সকলের অবাক দশা। রাসিফ বিস্ময় চেপে না রেখে বলেই ফেললো,
“আপা, আমার কন্টাক্ট নাম্বার কি হারিয়ে ফেলেছো?”
“না তো, সেভ করাই আছে।”
“তাহলে যে ফোন দিলে না? এবার কি ঝ’গড়া হয়নি?”
“আর বলিস না, সেদিন তো তোকে কল দিতামই নিয়ে যাওয়ার জন্য। আম্মা বলে কিনা আমি ছোটখাটো একটা হাতি! বাবুর আব্বু নাকি হাতি পুষছে! ভাবতে পারছিস?”
“তাহলে ফোন দিলে না কেনো?”
“এখন সবাই আমার বেশি বেশি যত্ন নেয় বুঝলি। আম্মা নিজেই ভালো ভালো খাবার এনে আমাকে সরি বলেছে। বলেছে এই সময় হাতির মতোই খাওয়া উচিৎ। নাহলে বাবু অপুষ্ট হবে। আমি যেন রাগ না করি।”
“এখন আসলে কেনো?”
রুনির মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো৷ বললো,
“তোর দুলাভাই আমাকে পাত্তাই দেয় না। বিদেশি মেয়েদের সাথে চলাফেরা করে। একসাথে ছবি তুলে ফেইসবুকে আপলোড দেয়। থাকবো না ওর সাথে।”
নওশাদের কোম্পানি একটি চায়না কোম্পানির সাথে কোলাবোরেশান করছে। ফলে চাইনিজ কর্মীদের সাথে ওদের কাজ করতে হচ্ছে। রুনি বোধহয় তাদেরই কোনো চাইনিজ মেয়ে দেখে ক্ষেপেছে। লিখি রান্নাঘর থেকে নাশতা এনে রুনির কাছে বসেছে সবে। রুনির অভিযোগ শুনে হেসে বললো,
“দুলাভাই তো ওই মেয়েদের সাথে কাজ করে। কাজের ফাঁকেই ছবি তুলেছে। ছেলেও আছে অনেক। আমি দেখেছি ফেইসবুকে।”
“তোমরা হেসে গড়াগড়ি করো। আমার দুঃখ কি বুঝবে? মেয়েগুলো কত লম্বা, চিকন, নিখুত, স্টাইলিশ। আবার গড়গড় করে ইংরেজি বলে। আমার মাঝে তো এর একটা দিকও নেই।”
রুনি কাঁদছে আর খাচ্ছে। রাসিফ একবার খাবার এগিয়ে দিচ্ছে আরেকবার টিস্যু এগিয়ে দিচ্ছে। ওদের দুজনকে দেখে লিখি ঠোঁট টিপে হাসছে। সে আশ্বাস দিয়ে বললো,
“তোমার যা আছে তা ওই বিদেশিনীদের নেই আপা। দুলাভাই তোমাকে ছাড়া অন্যদের কথা ভাবতেই পারবে না। দেখো ঠিক চলে আসবে নিতে।”
“আসবে না। আমি যখন ফোনে বললাম চলে যাচ্ছি সে ইংরেজিতে ফটর ফটর করতে ব্যস্ত ছিলো। আজ যদি ভালো ইংরেজি জানতাম সাদা মুলা গুলোকে শা’সিয়ে দিতাম যেন আমার বাবুর আব্বুর থেকে দূরে থাকে।”
পূর্ণিমা দূরে থেকে ওদের কথা শুনছিলো। রুনির কথা শেষ হতেই দম্ভ করে বললো,
“ইংরাজি কওয়া এতডাও কঠিন না। এই আমিই এক বিদেশি পোলার লগে মোবাইলে প্রেম করছি৷ তাও ইংরাজিতে।”
রুনি ঠোঁট বেকিয়ে বললো,
“ঢপ দেওয়ার যায়গা পাস না? তুই ইংরেজিতে প্রেম করেছিস?”
পূর্ণিমা লাজুক চোখে মাথা নাড়ে। বলে,
“হ। প্রত্যেকদিন সকালে দাত মাজতে মাজতে আর রাইতে ঘুমাইতে যাওয়ার সময় কথা কইতাম।”
“কি কথা বলতি শুনি?”
“সকালে জিগাইতো, ‘হোয়াট ডুয়িং।’ আমি উত্তর দিতাম, ‘আই অ্যাম দাতিং মাজিং। মুখ ধুয়িং কথা কয়িং।’ আবার রাইতে জিগাইলে কইতাম, ‘আই অ্যাম ঘুমিং। গুড নাইট।’ আরো কত কথা যে কইতাম। ইংরাজি কওয়া কঠিন কিছু না। বাংলা কথার পিছে ইং-মিং-জিং-টিং লাগায় দিলেই ইংরাজি হইয়া যায়। ফোনডা নষ্ট হওয়ার পর বিদেশি নাম্বারডা আর পাইলাম না। নাইলে এতদিনে বিয়া কইরা বিদেশ থাকতাম। আপনে বেবির ফাদারের লগে এমনে কথা কইয়া দেইখেন কেমন খুশি হয়।”
পূর্ণিমার কথা শেষ হতেই লিখি মুখ ঢেকে অট্টহাসিতে মেতে উঠলো। রুনি খাওয়া থামিয়ে স্তব্ধ হয়ে পূর্ণিমার দিকে তাকিয়ে আছে। হাতের সদ্য নাক মোছা দলা পাকানো টিস্যুটা পূর্ণিমার দিকে ছুড়ে বললো,
“ইংরেজের বাচ্চা, এক্ষুনি চোখের সামনে থেকে দূর হ।”
চলবে…
(