শাপলা ও সেতুর গল্প পর্ব ১

0
1100

ঠোঁট চেপে কাঁদছে তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা রুনি। কান্নার ফলে কেঁপে উঠছে তার সদ্য মাতৃত্বের ধকল সইতে থাকা অমলিন, মেদযুক্ত দেহ। তার সামনে বসে গালে হাত দিয়ে সেই কান্না দেখছে রাসিফ। প্রায় বিশ মিনিট হলো রাসিফ বড় আপার বাড়িতে এসেছে। সেই থেকে রুনির কান্না থামছেই না। বরং সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অশ্রুকণার স্রোতের মিছিল তীব্রতর হচ্ছে। মিহি কান্নার সুর ধীরে ধীরে আক্ষেপের চিৎকারে পরিনত হচ্ছে। একটা মানুষ এতটা কাঁদতে পারে সেটা নিজের বড় আপাকে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারতো না রাসিফ। কান্নার ফলে রুনির শাড়ির আঁচলের একাংশ ভিজে উঠেছে। রাসিফ এবার অধৈর্য হয়ে বললো,

“আর কত কাঁদবে আপা? কাঁদার কারণটাও তো বলবে? যুক্তিযুক্ত হলে আমিও নাহয় সঙ্গ দেবো।”

রুনি ভেজা, লালাভ চোখে ভাইয়ের দিকে তাকালো। করুণ স্বরে বললো,
“ব্যঙ্গ করছিস ভাই? আমার কান্না দেখে তুই ব্যঙ্গ করতে পারলি?”

রাসিফ গাল থেকে হাত নামিয়ে বললো,
“ব্যঙ্গ কেনো করবো আপা? আমি তোমার কান্নার সুনির্দিষ্ট কারণটা জানতে চাইছি। যদি সত্যিই দুঃখজনক কিছু মনে হয় আমিও কাঁদবো তোমার সঙ্গে। তোমার দুঃখে তো আর আমি হাসতে পারি না। কিন্তু কারণটা না জেনে তো আমি কোনো যুক্তিযুক্ত প্রতিক্রিয়াই দেখাতে পারছি না।”

রুনি আক্রোশে বলে উঠলো,
“তোর দুলাভাই সকালে বলছিলো অনেকদিন কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়া হয় না। তাই আজ রাতে সে আমাদের বাইরে খাওয়াতে নিয়ে যাবে। শখ করে বললাম তাকে বাইরে খেতে হবে না। আমিই রেধে খাওয়াবো। মানুষটা সারাদিন পরিশ্রম করে আসে, এইটুকু ইচ্ছে তো পূরণ করতেই পারি। পারি না?”

“একশবার পারো। কিন্তু এর মাঝে ঝগড়া হওয়ার তো কিছু দেখছি না।”

“আম্মা মাঝখান দিয়ে বাধ সাধলেন। বললেন আমি রাধলে নাকি তার ছেলের কাচ্চি খাওয়ার শখ জনমের মতো মিটে যাবে। তারচেয়ে বাইরে খাওয়াই ভালো। তুই বল, আমি কি এত খারাপ রান্না করি? কিছুদিন আগেও তো পায়েস রেধে খাওয়ালাম। তখন তো আমিও ভাগে পেলাম না। আর এখন এই বদনাম শুনতে হচ্ছে!”

রুনির কান্নার শব্দ আরেকদফা বৃদ্ধি পেলো। এমন সময় রুনির শ্বাশুড়ি নাজিয়া বেগম বসার ঘরে উপস্থিত হলেন। রাসিফকে দেখে বললেন,

“রাসিফ যে? চলেও এসেছো?”

রাসিফ সলজ্জে মাথা নাড়িয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো। বললো,
“জি আন্টি। আপা সকালে ফোন দিয়ে আসতে বললো। তাছাড়া ব্যবসার কিছু কাজও আছে, তাই আরকি।”

“ভালো করেছো। খাও-দাও, বিশ্রাম করো। এরপর যাওয়ার সময় এই আপদটাকে নিয়ে যেয়ো তো।”

রুনি কান্না থামিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে শ্বাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। যেন আশ্চর্য কিছু শ্রবণ করে ফেলেছে। কিছুক্ষণ অবাকতার রেশ কাটিয়ে বললো,
“এত বড় কথাটা আপনি বলতে পারলেন আম্মা? আমি আপদ? আমাকে বের করে দিতে চান? ও বাবাগো..”
রুনি কপাল চাপড়ে পুনরায় কান্নায় ভেঙে পড়লো।

নাজিয়া বেগম শক্ত গলায় বললেন,
“শুধু বের করবো না, আমার একমাত্র ছেলের আমি আবার বিয়ে দেবো।”

“দেখেছিস ভাই? দেখ, কি অবস্থায় আছে তোর বোন। আমিও থাকবো না এখানে। কেউ আটকাবে না বলে দিলাম।”

রাসিফ অসহায় মুখে দুজনকে দেখছে। শ্বাশুড়ি-বউয়ের মাঝে সে কি বলবে ভেবে পেলো না। নাজিয়া বেগম দুইহাত ভাজ করে দাম্ভিক স্বরে বললেন,
“আটকাচ্ছে কে?”

“ভুলে যাবেন না আপনাদের বংশধর আমার গর্ভে।”

“বংশধর তোমার পেটে সেটাই তো সমস্যা। না জানি আমার নাতি-নাতনি তোমার মতো স্বভাব পেয়ে বসে।”

রুনির মুখ আরো বিকৃত হলো। কি একটা কথা যেন মনে পড়তেও ভুলে গেলো। তার একটি স্বভাব হলো কান্নার সময় জমিয়ে রাখা মোক্ষম পয়েন্টগুলো সে ভুলে যায়। অথচ ঝগড়া থেমে গেলেই আবার সব গড়গড় করে মনে পড়ে যায়। কিন্তু তখন আর কথা শোনানোর কোনো ছুতো খুঁজে পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে খাতায় নোট করে রাখতে, যেন ঝগড়ার সময় সেটায় চোখ বুলিয়ে ধুন্ধুমার কান্ড বাধিয়ে জিততে পারে। এই নোট করে রাখার কথাটাও আবার ঝগড়ার পর মনে থাকে না। কি এক যন্ত্রণা! নিজের দুর্বলতা ঢাকতে রুনি আরো জোরে কাঁদতে শুরু করে। রাসিফের দিকে তাকিয়ে ব্যথিত কন্ঠে বললো,

“এই তোর বোনের প্রতি ভালোবাসা? এই তোর দায়িত্ব? বাবার পর তুই তো আমার বাপের বাড়ির একমাত্র অবিভাবক। তোর সামনে আমাকে অপমান করা হচ্ছে তবুও কিছু বলবি না?”

রাসিফের কপালে সমান্তরাল ভাজের রেখা ফুটে উঠেছে। সে চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“কি বলবো বুঝতে পারছি না।”

“আমি বুঝে গেছি। বাবুর আব্বু ছাড়া কেউ আমাকে ভালোবাসে না। কেউ না।”

রুনি ফোন হাতে ঝাপসা চোখে স্বামীর নাম্বারে ডায়াল করলো। নাজিয়া বেগম খেকিয়ে উঠে কয়েক পা এগিয়ে এসে বললেন,
“ছেলেটা কি কাজে গিয়েও শান্তি পাবে না? অফিসে বসেও তাকে ন্যাকা কান্না সইতে হবে?”

“আমি ন্যাকা কান্না করি আম্মা?” রুনি ফোস করে উঠলো।

“অবশ্যই করো।”

রুনি দাত কিড়মিড় করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো। শ্বাশুড়িকে উপেক্ষা করে ফোন কানে নিয়ে ঘরে চলে গেলো। রাসিফ হতাশ দৃষ্টিতে আপার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার আপা বয়সে বড় হলেও আচরণে ভীষণ ছেলেমানুষ। আর শ্বশুরবাড়িও জুটেছে তেমনই। অহেতুক কারণে যেমন খুশি হয়, তেমনই অহেতুক বিষয়কে কেন্দ্র করে ধরোরে, মা’রোরে ধরনের ঝগড়াও বাধিয়ে দেয়। যদিও তা শুধু রুনি ও তার শ্বাশুড়ির মাঝে লক্ষ্যনীয়। মাঝে মাঝে প্রতিবেশীও বাদ যায় না। মাসে কমপক্ষে একবার রাসিফকে কাজ ফেলে আপার শ্বশুরবাড়ি ছুটে আসতে হয়। মন দিয়ে আপার অভিযোগ শুনতে হয়, এরপর আপাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। কিছুদিন পর গিয়ে দুলাভাই মান ভাঙিয়ে নিয়ে আসে। রুনি মাসের অর্ধেক সময় বাপের বাড়ি আর অর্ধেক শ্বশুরবাড়িতে কাটায়। বিষয়গুলো এখন সকলেরই গা সওয়া।

রাসিফের অন্তর থেকে একটা তপ্ত দীর্ঘশ্বাস নির্গত হলো। এখন কি হবে তা ওর জানা। রুনি তার স্বামী নওশাদকে ফোন দিয়ে একগাদা অভিযোগ তুলবে, নওশাদ কাজের ফাঁকে হু হা করলেও আসলে কিছুই শুনবে না। সেই রাগে রুনি ব্যাগ গোছাবে বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য।

নাজিয়া বেগম বললেন,
“তুমি বসো রাসিফ। আমি খাবার নিয়ে আসি। তোমার বোনের এখন দুনিয়ার কিছুই খেয়াল থাকবে না। ভাইকে যে খেতে দেবে কিছু সেটাও মাথায় থাকবে না।”

“ব্যস্ত হবেন না, আন্টি। আমি শুধু আপার জন্য আসিনি। কিছু কাজও আছে। দোকানে কিছু নতুন মাল তুলবো। তার জন্য যেতে হবে। এসে নাহয় আপাকে নিয়ে যাবো।”

“নিয়ে যাও। কিছুদিন থেকে মাথা ঠান্ডা করে আসুক।”

নাজিয়া বেগম আর বেশি কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে গেলেন। তিনি নাক উঁচু স্বভাবের মানুষ। রাসিফদের চেয়ে অবস্থাপন্ন পরিবার। এই নিয়ে খানিক দম্ভও আছে। রাসিফের কেনো জানি মনে হয় তার আপা বাপের বাড়ি থাকুক চায় বলেই নাজিয়া বেগম ঘন ঘন ঝগড়া করে। রাসিফ আপার রুমে গেলো। রুনি শব্দ করে নাক টানছে আর ব্যাগ গোছাচ্ছে। যদিও গোছানোর বিশেষ কিছু নেই। তার দরকারি সব কিছুই দুই বাড়িতে সমানভাবে আছে। রাসিফ নিঃশব্দে আপার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। রুনি ওকে দেখে অভিমানী গলায় বলে,

“দেখেছিস ভাই, তোর দুলাভাইও আমায় পাত্তা দেয় না। এবার আমি আর ফিরবো না।”

“আচ্ছা, ফিরতে হবে না।”

“বাবুকেও ওদের দেবো না। তাহলেই উচিৎ শিক্ষা হবে।”

রাসিফ মাথা কাত করে সম্মতি দিলো। রুনি কান্না আটকাতে চাইছে। তবুও বারবার ঠোঁট ভেঙে আসছে, চোখ ভিজে উঠছে। রাসিফের কাছে মনে হয়, তার আপাকে কাঁদলেই যেন বেশি সুন্দর লাগে। এমন রূপে যতবার সে নিজের বোকা আপাকে দেখে ততবারই স্নেহে হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। রাসিফ রুনির মাথায় হাত রেখে বললো,

“কেঁদো না আপা। আমরা তো তরকারিতে মশলা বেশি খাই, ওরা কম খায়। তাই তোমার মিষ্টান্ন জাতীয় রান্না ছাড়া আর কোনো রান্নার স্বাদ ওরা বোঝে না। আর তোমাকে এই সময় কে রাধতে বলেছে? এমনিতেই কি গরম, তারওপর তুমি হুটহাট অসুস্থ হয়ে পড়ছো এখন। রাধতে বারন করায় ভালোই হলো। তুমি একটু আরামে থাকতে পারবে। আর দুলাভাই অফিসে কত ব্যস্ত থাকে জানো তো। তখন অন্যকিছুর খেয়াল থাকে না। তাই হয়তো মনোযোগ দিতে পারেনি। তুমিও পাত্তা দিয়ো না।”

রুনির মন গলে গেলো। পরম মমতায় ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে বললো,
“আমি তখন ভুল বলেছি। আসলে তুই ছাড়া আমায় কেউ বোঝে নারে।”

“তবুও বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে আছে? আজকে যাবে আমার সঙ্গে?”

“যাবো। তোর দুলাভাইকে শাস্তি দিতে যাবো।”

রাসিফ তাড়া দিয়ে বললো,
“ঠিক আছে। তুমি ব্যাগ গুছিয়ে, রেডি হয়ে থেকো। আমি কিছু কাজ সেরে ঘন্টাখানেক পর আসছি।”

_________________

গরমে জনজীবন দুর্বিষহ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের আলো যেন তীরের সুতীক্ষ্ণ ফলার মতো গায়ে বিঁধে। কর্মব্যস্ত দিনে বাসে গাদাগাদি করেও স্থান পাওয়া মুশকিল। সেই সঙ্গে ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়ে সময় নষ্ট হওয়া, বাসের ভেতর গাদাগাদি করে দাঁড়ানো মানুষের দেহের তাপ, ঘামে ভেজা বিশ্রি গন্ধ, গায়ে-গায়ে ধাক্কাধাক্কি, সব মিলিয়ে নাভিশ্বাস উঠে যাওয়ার যোগাড়। রাসিফ ঘন্টাখানেক সময়ের কথা বলে বের হলেও তার তিনঘন্টা লেগে গেলো, তবুও পৌঁছাতে পারলো না। আপা নিশ্চয়ই পথ চেয়ে বসে আছে। দেরি হওয়ায় রেগেও গেছে বোধহয়। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে। রাসিফ হাতে ধরা জিনিসগুলোর জন্য রিসিভ করতে পারেনি।

রাসিফের কাপড়ের দোকান। বাবা মা’রা যাওয়ার পর রাসিফকেই দোকানের হাল ধরতে হয়েছে। এবং সেটাকেই জীবিকা হিসেবে গ্রহন করেছে। মধ্যবিত্ত রাসিফের ছোট পরিবারটি সেই দোকানটির উপরেই নির্ভর করে টিকে আছে। দোকানটিতে মূলত মেয়েদের থ্রিপিস, কুর্তি বিক্রি করা হয়। আজ দোকানের জন্য নতুন কিছু কুর্তি কালেকশন পাইকারি নিতে এসেছিলো সে। কাস্টমাররা চাহিদা দেখালে নিয়মিত মালগুলো স্টকে রাখবে বলে ভাবছিলো।

বাসের ঝাকুনিতে দুলে উঠলো রাসিফ। সিট খালি না পাওয়ায় সে দাঁড়িয়ে আছে। এমনিতেই যায়গা সংকট, তারওপর আরো কিছু মহিলাকে বাসে তোলায় রাসিফের মেজাজ বিগড়ালো। বিগড়ালো আরো অনেকের। গাদাগাদি করে যাত্রী তোলায় ড্রাইভার, কন্ডাক্টরকে বিশ্রি গা’লি দিতেও ভুল হলো না কারো কারো। রাসিফ নিজেও দিলো, তবে মনে মনে। মেয়েদের গায়ের সঙ্গে যেন স্পর্শ না লাগে তাই সে আগেই পিছনের দিকে চলে গেলো। কিছুদূর যেতে একটা সিট খালি হতেই রাসিফ ঝাপিয়ে পড়লো সেই সিটে। পাশের সিটে একটি মেয়ে বসা। বাসের সিটগুলো সংকীর্ণ হলেও রাসিফ দূরত্ব রেখেই বসলো। কুর্তির বাধা বান্ডিলখানা রাখলো কোলের ওপর। বাস যখন ফ্লাইওভারের উঠলো তখন আর কোনো জ্যাম রইলো না। বাসের বিরামহীন, তীব্র গতিতে ছুটে চলার সঙ্গে জানালা দিয়ে হুহু করে ঠান্ডা বাতাস প্রবেশ করতে লাগলো। রাসিফ স্বস্তি পেয়েও পেলো না। পাশের সিটে বসা মানবী তার স্বল্পদৈর্ঘ্য চুলগুলো খুলে রাখায় তা উড়ে এসে রাসিফের নাকে মুখে পড়লো। সেই সঙ্গে নাকে ধাক্কা দিলো মিষ্টি একটি ঘ্রাণ। রাসিফ বিরক্ত হলো। আঁড়চোখে পাশে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটি বাইরের দিকে মুখ করে বাতাস অনুভবে ব্যস্ত। সে ডাকলো,

“এক্সকিউজ মি?”

মেয়েটি ফিরে তাকালো। কৌতুহলী দৃষ্টিতে রাসিফের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,
“জি? আমাকে বলছেন?”

“আপনার চুলগুলো…”

বাকিটুকু বলতে হলো না। মেয়েটা বুঝে গিয়ে নিজে থেকেই বারকয়েক সরি সরি বলে উঠলো। রাসিফ আস্তে করে “ইট’স ওকে” বলে চোখ ফিরিয়ে নিলো। বাস ফ্লাইওভার থেকে নেমে পড়েছে। পাশের মেয়েটা দুইহাত উঁচিয়ে চুলগুলোকে একত্র করে একটা উঁচু ঝুটি করে নিলো। হাত নামানোর সময় তার কনুইয়ের গুতো লাগলো রাসিফের কাধে। মেয়েটা আরেকদফা সরি বললো। রাসিফ মনে মনে মহা বিরক্ত হলেও মুখে কপটতা ফুটিয়ে রাখলো। খানিকটা সময় পর মেয়েটি নেমে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতে রাসিফকে আবারো ঝামেলায় পড়তে হলো। একে তো বাস জনাকীর্ণ। তার ওপর ওর কোলে একটা বড়সড় কাপড়ের বান্ডিল। অনেকটা ঠেলেঠুলে, আঁকাবাঁকা হয়ে সে মেয়েটিকে বের হতে দিলো। তবুও গা ঘেঁষেই গেলো দুজনের। রাসিফের অস্বস্তি হয়। মেয়েটির পেছনে বাসে ওঠা মহিলার দলও নেমে গেলে স্বস্তি অনুভূত হলো। কেননা মহিলারা যাবতীয় সব সাংসারিক গল্প ও প্রতিবেশীদের মুখরোচক আলাপ দিয়ে পরিবেশ গমগমে করে রেখেছিলো।

কিছুদূর পেরোতেই রাসিফের খেয়াল হলো তার ফোনটা পকেটে নেই। রাসিফ ভালো করে সব পকেট চেক করতে বুঝলো তার মানিব্যাগটাও নেই। সে ভীত কন্ঠে আওড়ালো,
“আমার মানিব্যাগ! আমার মোবাইল!”

“পকেট মাইরের খপ্পরে পড়ছেন ভাই?”

রাসিফ হতবাক হয়ে বসে রইলো। আসলেই তাই! বাসে গুঞ্জন শুরু হলো একজন পকেটমারের শিকার হয়েছে। অন্যরাও নিজেদের মালামাল ঠিক আছে কিনা দেখতে লাগলো।
“মালামাল সাবধানে রাখবেন তো মিয়া। ভরা বাসে কেডায় যে হাত সাফাই করবো টেরই পাইবেন না।”

“কয়দিন আগে এক মহিলা যাত্রী বারবার আমার গায়ের উপরে পইড়া সুযোগ বুইঝা আমার সব টেকাপয়সা ছিনতাই কইরা নিছিলো। টের পাইছি মহিলা নাইমা যাওয়ার পরে।”

“একটু আগেই না একদল বোরকা পড়া মহিলা নামলো? ভীড়ের মাঝে কাজটা মনে হয় ওরাই করেছে। এদের বড় চক্র আছে। যাত্রীর বেশে কিভাবে যে পকেটমারি করবে টেরই পাবেন না।”

একেকজন একেক ধরনের মন্তব্য করতে লাগলো। রাসিফ কোনো কথা বললো না। ওর মাথায় তখন পাশের সিটে বসা মেয়েটার গা ঘেঁষে যাওয়ার দৃশ্যটাই বারবার ঘুরেফিরে আসতে লাগলো। রাসিফ মাথায় হাত দিয়ে বিড়বিড় করে উঠলো,

“তার মানে মেয়েটা চু’ন্নি ছিলো!”

#শাপলা_ও_সেতুর_গল্প
#প্রভা_আফরিন
#সূচনা_পর্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here