#শাপলার_মৃত্যু (৯)
#থ্রিলার (১৮+)
(২০ বছর আগের কথা)
নদীর ধারে একটি মেয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। আপনমনে খেলছে। তার দুপায়ে সস্তা নুপুর। সে নুপুরের ঝুনুর ঝুনুর শব্দ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। পশ্চিমে বৈশাখের কালো মেঘের আনাগোনা। কিছু সময় গড়াতে না গড়াতেই ঝুপ করে বৃষ্টি নামে আকাশ ফুঁড়ে।
মেয়েটির মন খারাপ হয়ে যায়। কারণ তার বন্ধুরা এখনো আসে নি। বন্ধুদের সাথে আম কুড়াতে যাওয়ার কথা আজকে।
মেয়েটি বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ক্ষণিককাল বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু কারো দেখা মেলে না। এরপর সে একা আমবাগানের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
আম বাগানটি গ্রামের মাতাব্বরের। বাগানের দেখভাল করার জন্য মালি রাখা হয়েছে। চতুর্দিকে বেড়া দেওয়া। বৃষ্টির সাথে সাথে বজ্রপাত হচ্ছে সমান তালে। মালি তার ঘরে বসে সিগারেট ফুঁকছে আর রেডিওতে গান শুনছে। পুরোনো দিনের গান। যদিও বৃষ্টির জন্য রেডিওর গান ভালোমতো শোনা যাচ্ছে না। ঝি-ঝি শব্দ বেরুচ্ছে। হঠাৎ মালি জানালা দিয়ে দেখল একটি বাচ্চা মেয়ে বেড়া টপকিয়ে বাগানে ঢুকছে। বৃষ্টিতে তার শরীর ভিজে গেছে। স্তনযুগল কেবল মাত্র স্ফীত হওয়া শুরু করেছে। তবুও ভেজা কাপড়ে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
মালি সিগারেটটি ফিল্টার পর্যন্ত টেনে শেষ করল। মাতাব্বরের বাড়ির ঠিক পেছনে আম বাগান। আশেপাশে আর কোনো বাড়ি নেই। তার ওপর বৈশাখের তুমুল ঝড় বৃষ্টি। আকাশ কাঁপিয়ে চিৎকার করলে কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পাবে না।
মেয়েটি তার ফ্রক থলের মত করে ধরে আম টুকিয়ে রাখছে। উবু হয়ে আরো একটি আম কুড়ানোর সময় কেউ খপ করে তার হাত ধরে ফেলল। মেয়েটি ভয় পেয়ে গেলো। মুঠি করে ধরে রাখা ফ্রকের অংশটি ছেড়ে দিল। ফলে কুড়িয়ে নেওয়া বাকি আমগুলোও নিচে পড়ে গেল।
মালি গম্ভীর মুখে বলল,
এখানে কি করছিস? ঝড় বৃষ্টির দিনে মাতাব্বরের বাড়িতে আম চুরি করা হচ্ছে?
মেয়েটি থতমত খেয়ে বলল,
আমি তো আম চুরি করতাছি না মামা। বাতাসে পইড়া থাকা আম কুড়াইতাছি।
তোর এত বড় সাহস? মাতাব্বরের আম বাগানে ঢুইকা আম কুড়াস? সাহেব এডা শুনলে মাইর একটাও মাটিতে পড়ব না। জানস?
মেয়েটি মিনতি করে বলল,
আইচ্ছা মামা। আমি আর আম কুড়ামু না। আমারে যাইতে দেন।
মালি বুক থেকে পা পর্যন্ত মেয়েটিকে একবার দেখল। খ্যাঁক করে হেসে বলল,
এইভাবে তোরে যাইতে দিলে কি আমার ডিউটি করা হবো রে? সাহেবের কাছে আমি কি জবাব দিমু?
আমার ভুল হইয়া গেছে মামা। আমারে যাইতে দেন। আর কোনোদিন আমি আম কুড়াইতে আসুম না।
এইভাবে তোরে যাইতে দেওয়া যাবো না।
মালি একথা বলার সাথে সাথে কাছে কোথাও বজ্রপাত হল। সে ডানে বামে তাকিয়ে বলল,
ঠাডা পড়তাছে। বাইরে দাঁড়াইয়া কথা কওয়া যাবো না। আমার ঘরে আয়।
মেয়েটি হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল,
মামা, আমি বাড়িত যামু। আমারে যাইতে দেন।
মালি কোনো উত্তর দিল না। বিশ্রীভাবে হাসল। এরপর মেয়েটির হাত আরোও শক্ত করে ধরে টানতে টানতে নিজের ঘরের দিকে নিয়ে গেল। মেয়েটি প্রাণপণে চেষ্টা করছে নিজেকে মালির হাত থেকে ছাড়ানোর। তার পঞ্চইন্দ্রীয় বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে। মেয়েটি চিৎকার করল। কিন্তু হায়! প্রকৃতির গর্জনের কাছে তার চিৎকার নিতান্তই তুচ্ছ। অসহায় মেয়েটি সাহায্য চাইছে।
মালি নিজের ঘরের দরজা ততক্ষণে ভিড়িয়ে দিয়েছে। জানালার পর্দাও টেনে দিয়েছে। মেয়েটির পায়ের নুপুরের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঝুনুর ঝুনুর। ঝুনুর ঝুনুর।
মেয়েটা যখন বাসায় ফিরল তখন সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে চারিদিকে। মালি জোর করে পাঁচটি আম দিয়ে দিয়েছে। মেয়েটি ব্যাথায় হাঁটতে পারছিল না। কোনোভাবে নিজের বাড়ি পৌঁছে, ভেজা বারান্দায় গা এলিয়ে দেয়। আমগুলো গড়াগড়ি খেতে থাকে আশেপাশে।
পরের দিন সূর্য ওঠার আগেই পুরো গ্রামে বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেল। কানাঘুষো শুরু হল।
মেয়ের বাবা মাতাব্বরের পা ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। বিচার চাইল।
মাতাব্বর সুষ্ঠু বিচার করবে বলে আশ্বাস দিল।
মালিকে ডাকা হল। গোটা গ্রামের সবার সামনে তাকে সজোরে চড় মারা হল।
ব্যাস এটুকুই।
একজন উঠতি বয়সী কিশোরীকে ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে ভরা মজলিসে চড় মারাটাই যেনো যোগ্য শাস্তি!
মেয়ের বাবার হাতে পঞ্চাশ টাকা গুঁজে দিতে দিতে মাতাব্বর বলল,
উঠতি বয়সের মাইয়া। বিয়া তো দাওয়ান লাগবো! বিষয়ডা নিয়া বাড়াবাড়ি করলে তোমারি ক্ষতি। মালির আর কি হইব? পুরুষ মানুষ। চাইপা যাও। তোমার মেয়ারে বিয়া দেওয়ার দায়িত্ব আমার।
এই পঞ্চাশ টাকার ভ্যালু তখন ঢের বেশি! মেয়ের বাবা চেপে গেল। ধর্ষণের শাস্তি শুধুমাত্র একটি চড়েই বহাল রইল।
তবে গ্রামের মানুষেরা মেয়েটিকে ‘নষ্টা’ হিসেবে আখ্যায়িত করল। এ অবশ্য নতুন কিছু না। পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার পর ‘বীরাঙ্গনা’ দেরও একই চোখে দেখা হয়েছে। তাদের সমাজ গ্রহণ করেনি। অথচ তাদের যত বিসর্জন এবং অমানবিক অত্যাচার মাথা নত করে পেতে নেওয়ার পেছনে কারণ ছিল একটাই – স্বাধীন বাংলাদেশ চাই!
মেয়েটির বেঁচে থাকা তখন বিভীষিকাময়! প্রতিনিয়ত নিজের সাথে যুদ্ধ করতে লাগল সে। বাকি দশটা মেয়ের মত স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার যুদ্ধ। তবে গ্রামের মানুষেরা মেয়েটিকে তার অবস্থান বুঝিয়ে দিত বারংবার।
বছর কয়েক পার হল। মাতাব্বর মেয়ের বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাল। ভালো একজন ছেলে পাওয়া গেছে। ব্যবসা করে। পূর্বের ঘটনা সব জানে তবুও মেনে নিয়েছে।
মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেল। তবে একটি ‘কিন্তু’ রয়ে গেল। সেই ”কিন্তু’ টি রহস্যে ঘেরা। এই রহস্যের উদঘাটন করা মোটেও সহজ নয়!
চলবে…
#আতিয়া_আদিবা
[এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে দুটো করে পর্ব আসবে ❤️]