#শর্ত
#লেখনীতে:অনুসা রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:০৪
সাতটা দিন কেটে গেছে। কিন্তু মিতালির কোনো খোঁজ নেই। শিশির সেদিন রাতের পর থেকে নিজেকে সামলে নিয়েছে। রাতের কথাগুলো ওর মনে ধরেছে। আসলেই মিতালির কথা ভেবে নিজেকে কষ্ট দেয়ার কোনো মানেই নেই।তাছাড়া দোষ তো তারও রয়েছে। নিজের পছন্দেই বিয়ে করেছিল। এবার অন্যকেউ কেন ঘানি টানবে?এদিকে সায়ানও আস্তে আস্তে রাতকে নিজের মা বলে ভেবে নিয়েছে। তাইতো রাতকে সামনে না পেলেই কান্নাকাটির বন্যা বয়ে যায়। শিশিরও থামাতে পারে না তাকে। মাঝে মাঝে শিশির ভাবে,
-” আমার ছেলেটা তো এত মা পাগল ছিল না। রাত আদর দিয়ে দিয়ে ওকে এখন থেকেই মাথায় তুলছে।”
ভাবতে ভাবতে ভ্রু কুঁচকে সায়ানকে সামলাতে লাগলো সে। সায়ান তো সায়ানই। সে কান্না থামাবে না বলে আজ পণ করেছে। শিশির বিরক্ত হয়ে ভাবছে,
-” রাত জানে যে ছেলেটা ওকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। তবুও কই গিয়ে বসে আছে এখন?”
ভেবেই সে সায়ানকে কোলে নিয়ে হাঁটতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ পর দৌড়ে এলো রাত। সায়ানকে কোলে নিয়ে ঠান্ডা করতে করতে বললো,
-” এইত আমি এসে গেছি। ছাদে গেছিলাম রে বাবা।”
শিশির ভ্রু উঁচু করে দেখছে।সায়ান চুপ হয়ে রাতের চুল নিয়ে খেলছে। শিশির ঠান্ডা গলায় বললো,
-” তোমার কোলে যেতেই শান্ত হয়ে গেছে।”
রাত ভাব নিয়ে বললো,
-” আমার ছেলে তো আমার মতই হবে।”
বলেই সে সায়ানকে নিয়ে নিচে যাওয়ার পথে রওনা হলো। এদিকে শিশির অবাক হয়ে ভাবছে,
-” কত সহজেই নিজের ছেলে হিসেবে মেনে নিচ্ছে রাত। তাহলে কি মায়ের কথাই ঠিক? রাতই আমাদের পরিবারের যোগ্য বউ। সায়ানের যোগ্য মা?”
ভেবে পায় না শিশির। কি দেখে সে মিতালিকে ভালোবেসেছিল? অবশ্য ভালোবাসার কি কোনো কারণ থাকে? অনুভূতি এসেছিল বলেই তো সে মিতালিকে ভালোবেসে আপন করেছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিশির।কলেজে যাওয়ার জন্যে তৈরী হতে শুরু করে।
.
রাত আটটায় বাড়ি ফিরে আসে শিশির। ড্রইংরুমে কাউকে না পেয়ে নিজের রুমের দিকেই অগ্রসর হয় সে। দেখতে পায় চৈতী বেগম বের হচ্ছেন রুম থেকে আর রাতকে উদ্দেশ্য করে বলছেন,
-” অসুবিধা হলে ডাক দিস কিন্তু। বললাম সায়ানটা আমার কাছে থাকুক।”
অপরপাশ থেকে রাত কিছু বললো না। চৈতী বেগম রুম থেকে বের হয়ে ছেলেকে দেখেই চিন্তিত গলায় বললেন,
-” একটু দেখে রাখিস মেয়েটাকে।”
শিশির শুধু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। তারমানে রাতের কিছু হয়েছে। কি হয়েছে সেটা জিজ্ঞেস করার আগেই চৈতী বেগম চলে গেলেন।শিশির রুমে ঢুকতেই রাতকে চাদর গায়ে শুয়ে থাকতে দেখতে পেল। পাশেই সায়ান হাত-পা ছুঁড়ে খেলছে। শিশির অন্যপাশ দিয়ে গিয়ে সায়ানের কপালে আদর করে দিলো।কিন্তু রাতের চোখ বন্ধ। শিশির ভাবলো,
-” এসময় চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে যে..”
কিছুক্ষণ সায়ানকে আদর করে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল।ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখতে পেল রাত উঠে সায়ানকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে। সে কিছু বলতে যাবে এমন সময় চৈতী বেগম এসে বললেন,
-” শিশির?খাবারটা উপরে দিয়ে যাব?”
শিশির রাতের থেকে চোখ সরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
-” না মা। আমি আসছি তুমি যাও।”
-” এসো।আর রাত?”
রাত শ্বাশুড়ির দিকে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকালো। চৈতী বেগম বললেন,
-” ঔষধ নিয়েছিলি?”
রাত না বোধক মাথা নাড়িয়ে ধীর গলায় বললো,
-” আমার অভ্যাস আছে আন্টি সমস্যা নাই।”
চৈতী বেগম চোখ রাঙিয়ে বললেন,
-” খেয়ে নিবি। রেখে যাচ্ছি। ”
বলেই তিনি একটা ঔষধের প্যাকেট বেডসাইড টেবিলে রেখে দিলেন।রাত বললো,
-” এসব প্রায়ই হয় আমার।তাই এত টেনশন কইরেন না আন্টি।”
-” চুপ কর। তোর কোনোকিছু নিয়ে টেনশন করার দরকার নাই।সায়ানকে নিয়ে সমস্যা হলে শুধু আমায় একটা ডাক দিস। পাশের রুমে আছি।”
বলতে বলতে চৈতী বেগম শিশিরকে আরেকবার তাড়া দিয়ে বললেন,
-” কিরে দাড়িয়ে আছিস কেন? কখন যেতে বললাম!”
কিছু না বুঝতে পারা শিশির এতক্ষণে চোখের পলক ফেলে জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
-” হুম যাচ্ছি। ”
বলেই শিশির প্রস্থান করলো। কিন্তু তার একটা চিন্তা রয়েই গেলো,
-” কি হয়েছে রাতের?কোনো বড় অসুখ? দেখে তো জ্বর মনে হলো না।”
.
ভীষণ রাত অবধি খাতা দেখার অভ্যাস রয়েছে শিশিরের। আজও ব্যতিক্রম না। রাত প্রায় দেড় টা বাজে। শিশির নিজের মত করে খাতা দেখছে।হঠাৎই কারোর গোঙানির শব্দে ধ্যান ভাঙে তার।আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো যে শব্দটার উৎপত্তিস্থল কোথায়!বিছানার দিকে চোখ পড়তেই দেখতে পেল রাত পেটে হাত দিয়ে কাতরাচ্ছে। শিশির হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এসে রাতের মাথায় হাত রাখতে গিয়েও রাখলো না। কি যেন ভাবলো। পরমুহূর্তেই আবার কপালে হাত রেখে বললো,
-” কি হয়েছে রাত?তুমি কাতরাচ্ছো কেন?”
রাতের কপাল,নাক,ঠোঁটে উপর-নিচে ঘেমে একাকার। শুধু ঠোঁট চিপে পেটে হাত দিয়ে এপাশ-ওপাশ করছে।শিশিরের কেমন ভয় হচ্ছে। রাতের মারাত্নক কিছু হয়নি তো? সে রাতের ঘাড়ের পিছনে হাত দিয়ে মাথাটা উঁচু করে জিজ্ঞাসা করলো,
-” বলো না রাত! কি হয়েছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে তোমার?”
রাত কোনোমতে বললো,
-” পে..পেটে।”
শিশিরের হাত চাদরের উপর থেকেই রাতের পেটে চলে গেল। সে অস্থির হয়ে বললো,
-” এখানে?”
রাত হ্যা বোধক মাথা নাড়ায়। শিশির কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর ভ্রু কুঁচকে বললো,
-” উঠে বসো। শুয়ে থাকলে আরো ব্যাথা করবে।”
বলেই সে রাতকে উঠিয়ে বসালো। রাত মাথা নিচু করে সহ্য করছে। শিশিরের চোখ পড়লো বেডসাইড টেবিলে রাখা ঔষধটার দিকে। ঔষধটা তার অপরিচিত নয়। বেশ কয়েকবার মিতালির জন্যে এনেছে সে। আর তাই রাতের সাথে এই মুহুর্তে যে পরিস্থিতিতে পড়ছে সেই পরিস্থিতিতে কখনো পড়তে হয়নি।শিশির দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাতকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-” ঔষধটা খাওনি কেন?”
রাত নিচুস্বরে বললো,
-“আমার অভ্যাস আছে।”
-” কে বলেছে অভ্যাস করতে?”
শিশিরের কথায় চুপ মেরে যায় রাত। শিশির পানি ঢেলে রাতের হাতে ঔষধটা দিয়ে বললো,
-” খেয়ে নাও।”
-” কিন…”
-” খেতে বললাম।খেলে সমস্যা?”(চোখ রাঙিয়ে)
রাত আর কিছু না বলে খেয়ে নিলো। শিশির রাতকে ভালো করে পর্যবেক্ষন করে বললো,
-” এসময় এত জাঁকজমক শাড়ি পড়ার কি দরকার?”
-” আসলে আমার তো কোনো ড্রেস নাই এখানে। বাসায় যা পড়তাম সব ট্রলি তে। আর ট্রলি নামানোর শক্তি হয়নি। তাই..”
-” থাক আর কিছু বলতে হবে না।”
বলেই শিশির নিজেই ট্রলি ব্যাগটা নামালো।কিন্তু সেখানে সবই থ্রি-পিস। শিশির একটা প্লাজো বের করে আর নিজের একটা টি-শার্ট নিয়ে রাতে হাতে ধরিয়ে দিলো। রাত শুধু বসে বসে দেখছে। শিশির রাতকে হাত ধরে ওয়াশরুমের সামনে দাঁড় করিয়ে বললো,
-” দাড়িয়ে থাকব?”
-” না না না।”(জোরপূর্বক হেসে)
শিশির ভ্রু উঁচু করে তাকিয়ে চলে গেল দরজার দিকে। চেঞ্জ করে ওয়াশরুম থেকে বের হলো রাত। শিশিরের টি-শার্ট টা অনেকটাই ঢিলা হয়েছে তার।ওড়না জড়িয়ে পেট চেপে বের হয়েছে। বিছানায় আধশোয়া হতেই হট ওয়াটার ব্যাগ হাতে শিশরকে দেখতে পেল। শিশির রাতের কাছে এসে ওর দিকে ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
-” ছুঁইয়ে রাখো। আরাম পাবে।”
রাতের কেমন লজ্জা লাগতে শুরু করলো।নিচের দিকে তাকিয়ে ব্যাগটা নিলো।ঠিক তখনই সায়ান কেঁদে উঠলো। লাইটের আলোয় সমস্যা হচ্ছে বাচ্চাটার। রাত ব্যাগটা রাখতে যাবে এমন সময় শিশির বলে উঠলো,
-” যেটা করতে বলছি সেটা করো।”
-” কিন্তু সায়ু…”
-” যেটা বললাম।”
বলেই ও মশারিটা উঠিয়ে সায়ানকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতে লাগলো। লাইটা নিভিয়ে দিয়ে ড্রিম লাইট জ্বালালো। রাত চুপচাপ শুয়ে হট ওয়াটার ব্যাগ লাগিয়ে আছে। আর সায়ানকে উদ্দেশ্য করে বলছে,
-“ইশ,আমার সায়ুর কষ্ট হচ্ছে? একটু ব্যাথাটা কমলেই…”
আর বলতে না দিয়ে শিশির বললো,
-” ওর কষ্ট হচ্ছে না। আমি ঘুম পাড়াচ্ছি তো। তুমি রেস্ট নাও।”
রাত মুখ ভেংচি কেটে অপরপাশে ফিরে গেলো।হঠাৎ কি ভেবে মিটমিট করে হেসে ভাবলো,
-“আপনার মনটা ভীষণ ভালো শিশির স্যার। আজ নতুন আপনাকে আবিস্কার করলাম।আপনি খুব ভালো।”
এদিকে শিশির রাতের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে ভাবছে,
-” ইশ,মেয়েটা আমাদের জন্যে কতকিছুই না করছে। সায়ানের জন্যে নিজের ব্যাথা ভুলে যাচ্ছে। ওর মত মেয়ে হয় না।আমারই ভুল ধারণা। ও মিতালির মত না।”
ভেবেই মুচকি হাসলো,শিশির। হয়তো আবারো নতুন কোনো অনুভূতি পেতে চলেছে সে।দুজনের মনেই দুজনের জন্যে ভালোলাগার সৃষ্টি হচ্ছে। শেষমেশ রাতের পরিকল্পনা সফল হবে তো?
চলবে…