#শব্দহীন_অনুভূতি
#পলি_আনান
#পর্ব_১৭
আরাফের ঘুম ভাঙে ভর দুপুরে।হৃদিতা আইদা আর আদীবের সাথে মেঝেতে বসে লুডু খেলছিল।উপরে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে আছে আরাফ।আইদার গুটি কেটে দেওয়ায় হুট করেই রেগে যায় আদীব।
– এই বেয়াদব আমার পাঁকা গুটি কাটলি কেন তুই?আমি না তোর ভাই।
– ভাই হয়েছিস তো কি হয়েছে, খেলা তো খেলাই। খেলার সময় আপন পর ভাই বান্ধব বিচার করতে নেই।
– সময় সুযোগ আমারো আসবে দেখেনিস।তখন তোর কি হাল করি মনে রাখিস,
আদীব আর আইদার ঝগড়া বেড়াই চললো তাদের থামাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে হৃদিতা।আইদার মুখ চেপে ধরতেই আইদা হৃদিতার হাত কামড়ে দেয় এবার দুজনের মাঝে আবারো তুমুল ঝগড়া বিরক্ত হয়ে হৃদিতা এবার জোরে ধমক দেয়।তখনি চোখ মুখ কুচকে পীট পীট করে ঘুম থেকে উঠে যায় আরাফ।উঠে বসতে নিলেই মাথায় প্রচন্ড চাপ এবং ব্যাথা অনুভব করে।
হৃদিতা বুঝতে পেরে আইদা আর আদীবকে চলে যেতে বলে তাদের সাথে সাথে হৃদিতাও নিচে নেমে যায়।আরাফের জন্য লেবুর শরবর বানিয়ে আবার উপরে ফিরে আসে।
– নিন এটা ,ঝটপট পেটে চালান করে দিন।
আরাফ বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে নেয়।
-মাথা ভারি ভারি লাগছে কেন উফফফ!
– রাত দিন পার করে যদি ছাই পাশ মদ গেলা হয় তাহলে কি মাথা ঠিক থাকার কথা?আমার তো মনে হয় না।
আরাফ বালিশটা সরিয়ে নিজের দিকে তাকায়।কাল রাতে যে শাট পড়া ছিল এখনো গায়ে সেই শাট।
– আরাফ এটা দ্রুত পেটে চালান কর।
আরাফ মাথায় হাত দিয়ে উঠে বসে।দ্রুয় লেবুর শরবতট মুখে পুরে ঠোঁট বাকিঁয়ে নেয়।
– দূর, জঘন্য লাগে একটু চিনি দিলে কি ক্ষতি হয়ে যেতো।
হৃদিতা প্রত্যিত্তর করলো না চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে যায়।আরাফ মাথায় হাত দিয়ে হৃদিতার কান্ড দেখছে।সে ভাবছে কাল রাতের কথা মাতাল নেশার ঘোরে থাকা কালীন হৃদিতার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলেনি তো?
– হৃদিতা এই হৃদিতা,
আরাফের জোরে চিৎকারে সারা রুমে প্রতিধ্বনি হতে থাকে।হৃদিতা দ্রুত ছুটে এসে আরাফের সামনে দাঁড়ায়।
– কি সমস্যা তোর চিৎকার দিচ্ছিস কেন?
– আমি কাল বাড়ি ফিরলাম কখন?
– রাতের তিনটায়, কেন?
– তোর সাথে কিছু করেছি আইমিন রুড বিহেব!
– না।
আরাফ থামলো। কয়েকবার ঢোক গিলে এদিক সেদিক চোখ বুলালো। আগে আরাফ যখন নেশা করে বাড়ি ফিরতো তখন রুমের সব কিছু মাঝে মাঝে ভাঙচুর। তার বাবাকে গালাগাল করতো।তখন হুমায়রা এসে আরাফকে কন্ট্রোল করতো। কিন্তু এবার কি করেছে সে, হৃদিতা হঠাৎ আজ এমন চুপচাপ গম্ভীর কেন?আরাফ আরো কিছুক্ষন ভাবতে থাকে।নেশা অবস্থায় তার পেট থেকে সত্যি কথা বেরিয়ে যায় আরাফ কি কোন সত্যি কথা বলে ফেলেছে তার সম্পর্কে হৃদিতাকে?সে যে ভালোবাসে! কথাটা ভাবতেই আরাফ হৃদিতার দিকে তড়াক করে তাকায়।
– হৃদিতা আমি কি তোকে কিছু বলে ফেলেছি?আইমিন আমার মনের কিছু,ধর এমন কথা যেটা তুই জানতি না।
আরাফ ঢোক গিলে। হৃদিতা তার দিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।সে ভেবছে বলবে কি, বলবেনা।অবশেষে হৃদিতা সিধান্ত নেয় আরাফের কালকের কথা হৃদিতা কিচ্ছু বলবে না।
– না কিচ্ছু বলিস নি।
– মানে কি আমি রুমে এলাম আর ঘুমিয়ে গেলাম?
– না তাও না।
– তবে?
– একটু মাতলামি করেছিলি কিন্তু আমি পাত্তা দি নি।কান টেনে বিছানায় ফেলে ঘুমাতে বলেছিলাম তুইও ঘুমিয়ে গেলি।
– স্ট্রেঞ্জ!
হৃদিতা কথা বাড়ালো না আবারো বড় বড় পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।তখনি আরাফ আবারো ধমক দিয়ে তাকে রুমে ডাকে।
– কিরে আমি বলেছিলাম না এই রুমের বাইরে যাবি না। তাহলে রুম থেকে বের হলি কেন?
– তোর মতো মাতালরা দুপুরেও উঠে না। তারা রাত জেগে নেশা করে আর দিনের শেষ পর্যন্ত ঘুমায়।সো চাপ নিস না।
– নিয়াজ ভাইয়ের ঘুম এখনো ভাঙেনি?
– না।বাই দা ওয়ে তুই এখন কি খাবি?দুপুরের নাস্তা নাকি সকালের ভাত!
হৃদিতার মশকরা বুঝতে আরাফের একটু সময় লাগলো। ঠোঁট বাকিয়ে গাল চুলকে বলে,
– ভুল বলেছেন জনাবা,দুপুরের ভাত আর সকালের নাস্তা হবে।
– তোর মতো মাতালের বউ হলে আরো কত কি ভুলবো তার হিসেব নেই।
আরাফ মাথা নিচু করে হাসলো। হৃদিতা তবে মুখ দিয়ে স্বীকার করলো সে আরাফের স্ত্রী।
– কিরে হাসছিস কেন?উওর দে কি আনবো তোর জন্য?
– আমি এই বাড়ির জল টুকুও মুখে তুলবো না। বেইমান, বেইমান এই বাড়ির সদস্যরা।
হৃদিতা গাঢ় করে শ্বাস ছাড়ে।আরাফ কাল সন্ধ্যা থেকেই রেগে আছে তবে সেই রাগ আবার সাত সকালে চওড়া না হয়ে যায়।
– একটু আগেই তো লেবুর শরবত খেলি এখন বলছিস মুখে তুলবি না
আরাফ কথা বাড়ালো না ওয়াশরুমের ভেতর ঢুকে দরজা আটকে জোরে চিল্লিয়ে বলে,
– তোর হাতে বিষ খেতেও প্রস্তু আমি।
হৃদিতা মিষ্টি করে হাসে। আলমারি থেকে আরাফের জামা নামাতে নামাতে বিড়বিড় করে বলে,
– ভাঙবি তবু মচকাবি না।
নোমানের সামনে তার মুখোমুখি বসে আছে মাইশা।নোমানের দিকে সে তাকিয়ে আছে অপলক ভাবে। নোমানের আচার আচরন ভঙ্গিমা সব যেন তাকে বার বার মুগ্ধ করে তুলছে।তার দৃষ্টি অনুসরন করে তাকায় নোমান।
– কি সমস্যা তোমার এইভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
– না কিছু না।
দুজনেই আবার চুপ থাকে।কয়েক মিনিট পর নোমান বলে,
– কাজটা তুমি একদম ঠিক করো নি।
– কোন কাজ?
– এইভাবে অফিসে না আসলেও পারতে।তোমাকে বুঝতে হবে, আমি রাজনৈতিক দলের লোক আমাকে নিয়ে কোন ছুতো পেলেই নিউজ হয়ে যাবে শত্রু পক্ষ তিল থেকে তাল করবে। তাই পরবর্তীতে যা করবে ক্যায়ারফুলি করতে হবে।
– সরি নোমান ভুল হয়ে গেছে।আর ভুল হবে না।আসলে তোমায় দেখতে ইচ্ছে হলো তাই আর নিজেকে সামলাতে পারিনি।
– নোমানের বউ হতে উঠে পড়ে লেগেছো আর দৈর্য্য নামক জিনিসটা তোমার মাঝে নেই তা তো মানতে পারলাম না এনিওয়ে কি খাবে চা নাকি কফি?
-না লাগবে না কিছু।
মাইশা দ্রুত তার পার্স থেকে ছোট্ট একটি বক্স বের করে বক্সের ভেতরে একটি আংটি।নোমানের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরতেই দ্রুত ঝটপট আঙুলে আংটি ঢুকিয়ে দেয় মাইশা।নোমান অবাক হয়ে তাকালে মিষ্টি করে হাসে মাইশা।
– কেমন হয়েছে?
– তুমি এটা কেন পড়ালে?
– দেখো সেইম আঙটি আমার হাতে।
মাইশা এবার সবচেয়ে আশ্চর্যের কাজটা করলো নোমানের হাত টেনে তার অধর ছুঁয়ে দিলো সেই হাতে।দ্রুত চেয়ার থেকে উঠে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যতি হয়।
– আমি আসি এবার।
মাইশা দ্রুত চলে যায় অফিস থেকে এদিকে নোমান স্তম্ভিত হতে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে।আঙুলে থাকা আংটিটার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে,
– কেন এই বাঘের রাজ্যর রানী হতে চাইছো তুমি?ক্রমশ দূর্বল করছো আমায়।মাঝে মাঝে মনে হয় আমার পাপী জীবনে তোমায় না জড়াই আবার মাঝে মাঝে মনে হয় শক্ত করে জড়িয়ে রাখি তোমায়।তুমি আমার সত্যি নেশা অন্য রকম নেশা।
গল্পটি লেখনীতে পলি আনান।
নোমান আংটিটায় নিজের ওষ্ঠ ছুঁয়ে দেয়।বিড়বিড় করে বলে,
– মাই লাভ!
আরাফ ওয়াশরুম থেকে বের হতেই হৃদিতাকে খাওয়ার হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা ধমক দেয়।
– এই এখানে খাবার এনেছিস কেন?বললাম না খাবো না।
– আপনার জন্য কে এনেছে এগুলো আমি খাবো।
আরাফ আড় চোখে হৃদিতার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।বিছানায় বসে চুল ঝাকরাতেই হৃদিতা এগিয়ে এসে আচঁল দিয়ে আরাফের মাথা মুছতে থাকে।হৃদিতার হঠাৎ কান্ডে আরাফ ভড়কে যায়। এক রাতেই এত চেঞ্জ কি করে হলো হৃদিতা।আরাফের অবাক চাহনী দেখে ঠোঁট বাকিয়ে তার পাশে বসে যায় হৃদিতা।
খাওয়ার থালা হাতে তুলে আরাফের মুখের সামনে খাওয়ার তুলে ধরে,
– নে হা কর!
হৃদিতার কান্ড দেখে এবার আরাফ অবাক হলেও প্রকাশ করে না।কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারলো না।যে মেয়ে দূরে দূরে থাকে সে মেয়ে হঠাৎ করেই এত কাছে,এত পাশে আর্শ্চজ!
আরাফ হা করে খাওয়ার মুখে তুলে নেয়।
– তোর কি হয়েছে হৃদিতা তোর মাঝে হঠাৎ এত পরিবর্তন?
– আমার কি হবে আজব! নে হা কর।
আরাফ কিছুক্ষণ চুপ থাকে ঠোঁট বাকিয়ে হৃদিতার কানে ফিসফিস করে বলে,
-মহারানী আর কত জাদু দেখাবে আমায়?ঘুম থেকে উঠেই তোমার এইসব কান্ড কীর্তি আমার হজম হচ্ছে না।বিয়ের পর একবার নেশা করেই বউয়ের এত আদর সোহাগ বেড়ে গেছে তবে একবার কেন আমি প্রতি রাতেই নেশা করে বাড়ি ফিরবো তবে বউটা আমার সয়ংসম্পূরর্ণ আমার হয়ে যাবে।
আরাফের কথায় চটে যায় হৃদিতা। প্লেট টা নামিয়ে আরাফের চুল গুলো টেনে দিয়ে বলে,
– লাত্তি মেরে যদি রুম থেকে তোকে না বের করেছি আমার নাম হৃদিতা মেহেরীন না।ভালো হয়ে যাও আরাফ ভালো হয়ে যাও,এখনো সময় আছে।
– তুমি আমার হয়ে যাও হৃদিতা তুমি আমার হয়ে যাও এখনো আমি তোমাতে বিভোর আছি।
আরাফের দাত কেলানো প্রশ্নে কোন উওর দিলো না হৃদিতা।চুপচাপ আরাফের মুখে ভাত পুরে দেয়।এদিকে দরজার আড়ালে দারিয়ে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে তাদের খুনশুটি দেখছে কেউ।যার চোখ দিয়ে ঝরে পড়ছে আগুনের ফুলকি।
বেশ অনেকটা রাত হয়ে গেছে আজকে আবারো আরাফ বাড়িতে ফিরেনি।তার চিন্তায় হৃদিতা নিদ্রাহীন বসে আছে।বেশ কয়েকবার আরাফকে ফোন করেও পাওয়া গেলোনা।দীরে দীরে রাত বেড়েই চলেছে।তখনি দরজায় ঠকঠকানো আওয়াজ হহ হৃদিতা গায়ে ওড়না জড়িয়ে দরজার সামনে দাঁড়ায়। বেশ কয়েকবার জানতে যায় দরজার বাইরে কে?
কিন্তু কোন শব্দ পাওয়া গেলোনা। বেশামাল ভাবে দরজায় করাঘাত করছে অপর প্রান্তের লোকটি।হৃদিতা ভেবেই নিল দরজার অপর প্রান্তে আরাফ।
আরাফেকে বকতে বকতে দরজা খুলে চমকে যায় অদ্রিজা।সে ভুলেও টের পায়নি আজ তার জন্য বিপদ অপেক্ষা করছে।দরজা খুলতেই নিয়াজকে চোখে পরে তার দ্রুত দরজা আটকাতে নিলেই নিয়াজ হৃদিতাকে ধাক্কা দিয়ে রুমে ডুকিয়ে দরজা আটকে দেয়।হৃদিতা নিজেকে বাচাঁতে চিৎকার দিতে গেলেই মাতাল নিয়াজ মুখ চেপে ধরে তার।
নিকষ কালো আঁধারটায় আরেকটি কালো অধ্যায় সূচনা হয় হৃদিতার। জীবনে দুঃখ গুলো ছুঁয়ে যায় তার জীবনে আরেকবার।প্রলয়ংকারি ঝড়ে মুষড়ে পরে সে।তবে কি পালটে যাবে তার জীবনের রঙ?
চলবে…