“লুকোচুরি”
পর্ব- ৭
(নূর নাফিসা)
.
.
“কেন, মামি বুঝি বলেছে তোমার ভাইকে বিয়ে করে নিতে?”
“হুম, গত রাতে বলছিলোই তো এমন কিছু। ভাইয়া বলছিলো তোমার কথা। দ্যান মা বললো, বিয়ে করলে বল বউ দেখি।”
“আর তোমার ভাইয়া কি বললো?”
“ভাইয়া বলেছে, যাকে বিয়ে করেছি তাকে আগে ঘরে তুলো।”
“আচ্ছা, যাই। গোসল করবো।”
রিজোয়ানার মুখের মলিনতা বিলীন করতে শিহান বললো,
“ওসব বাদ দাও, ভাইয়াকে ফুসলে হানিমুন সেড়ে আসো। ভাইয়ার কাছে কিন্তু টাকা আছে। বের করতে চায় না, বুঝেছো? ভাইয়ার বেতন টেতন কিন্তু মা জমা নেয় না। ঘরের খরচে যা যায় আরকি।”
“ঘরের খরচই বা কম কিসে, হুম? আর পরিবারের বড় ছেলে, পরিবারের দায়িত্ব নিতে না পারলে কেমন হবে!”
“ধুর! আমি অনুপ্রেরণা দিচ্ছি, আর তুমি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছো! বিশ্বাস করো, দেশের আনাচে কানাচে এতো এতো সুন্দর জায়গা! ওফ্ফ! মন বসে গেলে, ঘরে ফেরানো দায়! মুগ্ধ না হয়ে পারবে না। তোমাকে কিছু ছবি পাঠাবো। দেখলে যাওয়ার ইচ্ছে জাগবে হান্ড্রেড পার্সেন্ট। সুযোগ কাজে লাগাও, ভাবিজী। আমাকেও সাথে নিতে চাইলে মাইন্ড করবো না! শুধু একটা নক দিবে। তোমাদের ডিস্টার্ব করবো না, আমি আমার মতো হারিয়ে যাবো। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা তোমাদের।”
“হিহিহি। আচ্ছা? এতো মুগ্ধতায় জড়িয়ে গেছো? কাউকে রেখে আসোনি তো আবার, বারবার ছুটে যাওয়ার জন্য?”
“ধুর! তোমার সাথে কথা বলা মানেই লাইন ক্রস করা! যাও, যাও, গোসল করো৷ ক্ষুধা লেগেছে আমার। আজই তো মাসের শেষ লাঞ্চ। পেট পুড়ে নেই।”
এমনি লুবনা এলো রুমে। রিজোয়ানার উদ্দেশ্যে বললো,
“কি রে! এখনো গোসল করতে যাসনি!”
“হ্যাঁ, যাচ্ছি।”
ওপাশে থেকে শিহান লুবনার উদ্দেশ্যে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম, ফুপি। ভালো আছো তুমি?”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আছি ভালোই। তুই কেমন আছিস?”
“তোমাদের দোয়ায় আলহামদুলিল্লাহ, অনেক ভালো। ইফতারের দাওয়াত টাওয়াত পাবো নাকি? রোযা রাখি তো।”
লুবনা হেসে বললেন,
“পাবি না কেন৷ চলে আসিস। ত্রিশ দিনেরই দাওয়াত।”
“কি মুশকিল! রোযা উনত্রিশটা হলে ঈদের দিনও আমাকে ইফতারিই খাওয়াবা!”
“ধুর, ফাজিল! যতদিন ইফতার, ততদিনেরই দাওয়াত। হয়েছে এবার?”
“আচ্ছা, ঠিক আছে।”
লুবনা রুম ছেড়ে যেতে যেতে বললো,
“অয়ন নিয়নকেও সাথে নিয়ে আসিস।”
“নিজে বাঁচলে বাপের নাম।”
বলতে বলতে শিহান বারান্দা ছেড়ে চলে গেলো। রিজোয়ানাও হাসতে হাসতে ত্যাগ করলো নিজ বারান্দা। দুপুরে মায়ের সাথে খেতে বসলে লুবনা বিড়বিড় করতে লাগলো,
“শিহান ছেলেটা একেবারেই ভিন্ন। যেমন মুখে মধু, তেমনই আচার-ব্যবহারে। দেখলেই সালাম দিবে, এটা সেটা জিজ্ঞেস করবে। আর বাকি ছেলেগুলো পুরো মায়ের স্বভাব পাইছে। আরেক মেয়ের জামাই তো পাইছিই। মাশাল্লাহ! কথা তো বলবে দূরে থাক! দেখলে সালাম পর্যন্ত দেয় না। দৌড়ে পালায়। ফুপির সাথে সম্পর্ক তো নাই ই, শ্বশুর শ্বাশুড়িও মানে না। আবার বউ বউ করতে আসে! মানুষের মুখের কথায় কি না হয়! সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে মানুষের আচার-ব্যবহারই যথেষ্ট। জীবনে নিয়েছে কোনো খবরাখবর? সবই আমার কপালের দোষ। উছিলায় আমার বাপ! না একূল, না ওকূল, কোনো কূলেই ফেলে যায়নি!”
রিজোয়ানা কিছুই বললো না। চুপচাপ শুনে গেলো শুধু। সন্ধ্যার পরে ইভান কল করলে রিজোয়ানা বললো,
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কোথায় তুমি? রুমের লাইট অফ, বারান্দার লাইট অফ!”
“রুমেই। অন্ধকার রুমে শুয়ে আছি। বাসায় ফিরেছো?”
“হ্যাঁ, ফিরেছি একটু আগে। ফ্রেশ হয়েই তোমাকে কল করলাম। এসময় শুয়ে আছো কেন? শরীর খারাপ?”
“তা জেনে তোমার কি লাভ?”
“এটা কেমন কথা বললে?”
“কেমন আবার। যেমন শুনেছো তেমনই। এতো বউ বউ করে পাগল, শ্বশুর শ্বাশুড়ির খবর নিয়েছো ক’দিন? হুম?”
“কেন, কি হয়েছে শ্বশুর শ্বাশুড়ির?”
“এখন কেন বলতে যাবো কি হয়েছে না হয়েছে? আমার সাথে তো খুব মধুমাখা আলাপ জমাতে পারো। বাবামাকে দেখলে কি একটা সালাম পর্যন্ত দেওয়া যায় না?”
“আমার সাথে দেখাই হয় না, সালাম দিবো কিভাবে!”
“দেখা হয় না? নাকি দেখা দাও না? হুম? দেখা হবে কি করে, ছায়া দেখলেই দৌড়ে চলে যাও।”
ইভান আর প্রত্যুত্তর না করে হাসলো শুধু। রিজোয়ানা তার হাসির প্রতি বিরক্ত হয়ে বললো,
“হাসো আবার? জানো, মা আজ কি বলেছে? কপালের দোষে তোমার মতো একজন জামাই পেয়েছে যে কি না দেখা হলে সালাম পর্যন্ত দেয় না। খোঁজখবর নেওয়া তো দুরেই থাক! আর শিহানের কতটা প্রশংসা করলো, সে দেখলেই ফুপির সাথে কত গল্প জুড়ে দেয়। আর তুমি কিসের ভাতিজা আর কিসের জামাই হয়েছো, হ্যাঁ? আমার বাবা-মা কি খুব বেশি কিছু প্রত্যাশা করে তোমার কাছে? দেখলে কথা বলবে, একটু ভালোমন্দের খবরাখবর নিবে, শ্বশুর শ্বাশুড়ির আগে তো তারা তোমার ফুপা-ফুপি। এসব কি তোমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না? বাসায় ছোটখাটো একটা আয়োজন হলেও তোমাকে স্মরণ করে করে আফসোস করে, সব ভালো থাকলে তো কোনো আয়োজনেই মেয়ের জামাইকে বাদ রাখতো না। আর সেখানে তুমি সেই সুযোগটাই দাও না তাদের।”
রিজোয়ানা থামতেই ইভান বললো,
“ফুপি কি সত্যিই বলেছে এমন কিছু?”
“তোমার কি মনে হয়, আমি বানিয়ে বলছি?”
“তা না। মানে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।”
“শুনো, জামাইয়ের কাছ থেকে একটু ভালো আচরণ সব শ্বশুর শ্বাশুড়িই প্রত্যাশা করবে। তুমি যেমন আচরণ করবে তারাও তোমাকে তেমন ভাবেই বরণ করে নিবে। বউ বউ করে পাগল হলে বউ পর্যন্তই সম্মান আটকে থাকবে, শ্বশুর শ্বাশুড়ির আদর স্নেহ তোমার ভাগ্যে জুটবে না।”
“সত্য বলতে, আমি একটু ভয় পাই উনাদের সাথে কথা বলতে।”
“কিসের ভয়? আমার বাবা মা কি বাঘ না ভাল্লুক যে তোমাকে খেয়ে ফেলবে?”
“আহা, খেয়ে ফেলবে তেমন কিছু না। আমার সম্পর্কটা তো এখন শুধু ফুপু ভাতিজার না। জামাই হওয়া সত্ত্বে আমার মানটা একটু বেশি। শুধু আমার ক্ষেত্রে না, প্রত্যেকটা ছেলের ব্যাপারটাই এমন। ফুপি একটা কটু কথা বললে ভাতিজা সেটা সহজে গায়ে মাখবে না। কিন্তু জামাইয়ের মাইন্ডে লেগে যাবে৷ ধরো আমি নিজ থেকে কথা বলতে গেলাম আর ফুপি মুখ ফিরিয়ে নিলো, তখন আমার সম্মানটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? সেই ভয়টাই পাই। দ্বিতীয়বার যাওয়ার উৎসাহ কি হারিয়ে ফেলবো না? তাছাড়া এরপর যদি আমাকে ডাকেও তা-ও তো যেতে পারবো না অপমানবোধের কারণে। তারচেয়ে কি ভালো নয় দূরেই থাকি। সেই ভেবে আর এগোতে চাই না। যেদিন নিজ থেকে ডাকবে সেদিনই যাবো। কারণ সেদিন তো আর অপমানবোধের শংকা থাকবে না।”
“হ্যাঁ, দূরে থেকে থেকে তো বেশি বেশি ভাবা ছাড়া আপনার কাজ নেই। চেষ্টা করে দেখেছেন কখনো, আমার মা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে কি না?”
“ওইযে, ভয় ছিলো মনে। এখন যেহেতু জেনেছি মনোভাব, তো এখন থেকে করবো চেষ্টা।”
“হুহ্! শিহান কত কথা বলে, তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি কখনো আর উনার সাথে যেন আমার মায়ের চরম শত্রুতা!”
“বললাম তো করবো চেষ্টা। তোমার মাকে বলো, সকাল সন্ধ্যা কয়েকবার তোমার রুমের বারান্দা পরিদর্শন করতে। প্রতিদিন কথা বলবো। ওকে?”
“আহা! খুব ঠেকা পড়েছে তো আমার মায়ের। ঠেকা পড়েছে না তোমার সাথে কথা বলতে বারান্দায় অপেক্ষা করার?”
ইভান শব্দযোগে হেসে বললো,
“খুব তো ঝগড়া করলে, এবার একটু প্রেমে সাড়া দাও। সারাটাদিন পরিশ্রম করার পর বউয়ের কাছ থেকে তো একটু প্রেমালাপ প্রত্যাশা করতেই পারি। তাই না? মিষ্টি মিষ্টি কথা বললে মনটাও একটু ফ্রেশ ফ্রেশ লাগে। বুঝতে পেরেছো?”
রিজোয়ানা মলিনতার কণ্ঠে বললো,
“মামী নাকি অন্য মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিতে বলেছে তোমাকে?”
“কে বলেছে এসব?”
“শুনলাম কারো কাছে।”
“রিজু, আমি মাইন্ড ফ্রেশ রাখতে চাইলাম আর তুমি খারাপ করে দিতে চাইছো?”
“জানতে চাইলাম শুধু।”
“রিজু, আমি শুধুমাত্র তোমাকে ভালোবাসি আর তোমাকেই প্রত্যাশা করি জীবনে। অন্য কাউকে জড়ানোর কথা দ্বিতীয়বার ভাবার প্রত্যাশাও রাখি না। সুতরাং কে কি বললো সেদিকে তোমার কান না দিলেও চলবে। তুমি কি কাঁদছো?”
“না।”
“কন্ঠ ভারি হয়ে গেছে। শুনো, ভবিষ্যতে এসব ফালতু ব্যাপারে বলে বলে আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়ো না বলে দিলাম। তাহলে কিন্তু সতীনের সংসার করতে হবে।”
“ইশ! করে দেখুন না বিয়ে। আপনাকে আমি আস্ত রাখবো নাকি? ফোনে একদিন কথা না বলার কারণেই আপনার বারান্দার কি হাল হয়েছে, আর বিয়ে করলে আপনার কি হাল করবো আমি ভাবতে পারছেন?”
“হা হা হা… ভাবা দরকার। বাই দ্যা ওয়ে, অলসো লাভ ইউর জেলাসি এন্ড কিউটনেস।”