“লুকোচুরি”
পর্ব- ১৪
(নূর নাফিসা)
.
.
ভোরে ফজরের নামাজ পড়েই রিজোয়ানা ছাদে এসে হাটছে। আবছা আলোর এ শহর খুবই মায়াবী লাগছে। দিনের কিছু বিশেষ সময়ও সৃষ্টিকর্তাকে বেশ মনে করিয়ে দেয়। তার মধ্যে এই ভোর অন্যতম। মনটাকে স্বচ্ছ করতে যেন তার এক অসীম ক্ষমতা আছে। আর অনায়াসেই মনে করিয়ে দেয় এই ক্ষমতা তাকে সৃষ্টিকর্তা দিয়েছে। তখন খুব নিকটে অনুভব হয় সৃষ্টিকর্তাকে। এতো এতো অপরূপ সৃষ্টি মহান আল্লাহ কেবল মানুষের জন্যই সৃষ্টি করে দিয়েছেন। আর মানুষ তার কত অপব্যবহারই না করে বেড়াচ্ছে। আল্লাহ তার বান্দাদের ভালোবাসলেই কি, বান্দা যে সেই ভালোবাসাকে গ্রহণ না করে পিছিয়ে আসছে! ভাবতেই বড়সড় নিশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। হাতে ফোন, ইভানের কল এলো,
“হ্যালো, যাবে না ছাদে?”
“হুম, ছাদেই আছি। এসো।”
“ছাদেই! কে কে?”
“আমি আর তোমার বউ।”
“ও আচ্ছা। বরের আগেই চলে গেছো?”
“বর নাকি লেট লতিফ।”
“অযৌক্তিক! সবসময় কিন্তু বরই আগে থাকে।”
“এইতো তার যথাযথ প্রমাণ।”
“আরে না, মসজিদ থেকে বেরিয়ে শরীফ চাচার সাথে দেখা হলো। হেটে হেটে একটু কথা বললাম। বেশিক্ষণ তো হয়ওনি। পাঁচসাত মিনিট হবে।”
“আমি এসেছি আরও পাঁচ মিনিট আগে।”
“তো আমাকে কল দিতে। আমি তো জানি তোমাকেই কল করে নিয়ে আসতে হবে।”
বলতে বলতে ছাদের দরজা খুললো ইভান। তাকে দেখতে পেয়ে রিজোয়ানা কল কেটে দিলো। দুহাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। ইভান মুচকি হেসে সালামের জবাব দিয়ে রেলিং টপকে এপাশে চলে এলো।
“গ্রামে যাচ্ছো কবে?”
“আগামীকাল।”
“ক’দিনের জন্য?”
“বলতে পারি না। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।”
“সারাজীবন থেকে যাওয়ার প্ল্যান আছে নাকি?”
“প্রয়োজনে যাবো থেকে।”
“হাবভাব তো ভালো ঠেকছে না! বিয়ে টিয়ে ঠিক হয়ে যায়নি তো!”
রিজোয়ানার চেহারায় অভিমান ফুটে উঠলো। সে জবাব না দিয়ে এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। ইভান জ্বিভ কেটে তার হাত ধরে টেনে পেছন থেকে ঝাপটে ধরে বললো,
“ওকে, ওকে। আর বলবো না। এমনি মজা করছিলাম।”
“ছাড়ো! তোমার মজার উপর সর্দি ফেলি!”
“হা হা হা! আচ্ছা ফেলো। দাঁড়াও চুপ করে। সূর্যোদয় দেখবো দুজনে।”
“ছাড়ো বলছি!”
“উহুম।”
“পা মেরে দিবো এখন।”
“আহ! দাড়াও না একটু চুপ করে।”
আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে ইভান। রিজোয়ানা এবার রাগান্বিত কণ্ঠ ছেড়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“ছাড়ো, নয়তো সত্যিই চলে যাবো।”
ইভান এবার ছেড়ে দিয়ে মুখোমুখি হয়ে রেলিংয়ে হেলান দিলো এবং হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বললো,
“শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সৌভাগ্য হবে না আমার?”
“চলো, না করেছে কে?”
“যেতেও তো বলেনি কেউ।”
“বললেই কি যাবে?”
“একবার বলেই দেখতে।”
“যাবে না যে, সেটা ভালো করেই জানি। তাই বলিনি। এমনিতে গেলে বলতাম, ঈদে পরিবার ছেড়ে সেখানে যাবে এ আমি কোনোক্রমেই বিশ্বাস করিনা।”
ইভান এক গাল হেসে বললো,
“তোমাকে অন্যরকম লাগছে। ফুটফুটে চেহারায় মায়ার ভীড় জমেছে। একমুহূর্তে আলতো করে ছুয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।”
বলতে বলতে মাথাটা ধীরে ধীরে এগিয়ে নিলো রিজোয়ানার দিকে। রিজোয়ানা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললো,
“এতো ইচ্ছে পূরণ হতে নেই। আমি তো চলে যাচ্ছি৷ আমার ঈদ সালামি কোথায়?”
“কাল না এতোকিছু পাঠালাম!”
“ওটা তো ঈদ গিফট। গিফট আর সালামি এক হলো নাকি! সালামি দাও।”
“এখন কিসের সালামি! ঈদের দিন না দিবো সালামি।”
“ঈদের দিন তো আমি থাকবো না। এডভান্সই দাও।”
“ঈদ করো আমার সাথে, তবে দিবো।”
“আমার পরিবার গ্রামে যাবে আর আমি তোমার সাথে ঈদ করবো? সেই ব্যবস্থা করেছো?”
“চলো করে দিচ্ছি ব্যবস্থা। তুমি চাইলে এখনই নিয়ে যাবো বাসায়।”
“জ্বি না। সেটা সম্ভব না। এভাবে যাবো না। এখন এতো কথা বলো না। সালামি দাও।”
“কি সালামি সালামি শুরু করেছো। একবারও তো জিজ্ঞেস করলে না আমি ঈদের শপিং করেছি কিনা!”
“তোমার শপিং করা লাগবে না। তুমি পুরাতনগুলোতেই ঈদ করো। পরিবারের কর্তাদের এতো নতুন নতুন লাগে না। দেখো না, আমার বাবাকে হাজার বার বলেও নিজের জন্য কিছু কিনতে রাজি করাতে পারি না। তাই ভাইয়া এখন জিজ্ঞাসাও করে না। নিজের পছন্দমতো কিনে এনে বাবার হাতে ধরিয়ে দেয়। ওইটা আর না পরে পারে না।”
“তোমার বাবা তো কিপটা।”
রিজোয়ানা তার হাতে মেরে বললো,
“তুমি ভালো কোনদিক দিয়ে? কখন থেকে সালামি চাইছি, এখনো সালামি পেলাম না!”
এবার সে নিজেই পকেট থেকে ওয়ালেট নেওয়ার জন্য টানাটানি করতে লাগলো। ইভান বাঁধা দিয়ে বললো,
“আরে আরে! হচ্ছে কি! ভোরবেলা ছিনতাই!”
“হ্যাঁ, ছিনতাই।”
জোরাজুরিতে রিজোয়ানার জয়। দুকদম পিছিয়ে গিয়ে ওয়ালেট ফাঁকা করে দেখলো কিছু টাকা আছে। সে হাসতে হাসতে বললো,
“যা আছে তাতেই হবে। কিছু হলেও তো পেলাম।”
এরপর ওয়ালেট মুঠোয় রেখেই কিছুক্ষণ গল্পসল্প করে চলে এলো। ঘরে এসে মনে হলো ওয়ালেট যে তার হাতে! কথার ছলে তো ভুলেই গিয়েছিলো ফিরিয়ে দেওয়ার কথা! ইভানও তো একবার মনে করলো না! সে দ্রুত বারান্দায় এসে দেখলো ইভানকে দেখা যায় কি না। তার দেখা না পেয়ে সে ফোন হাতে নিয়ে কল করতে যাচ্ছিলো এমনি অয়ন নিয়নের বারান্দার দরজা খুলে ইভান এলো। রিজোয়ানাকে তাকাতে দেখে বললো,
“সালামির সাথে কি আমার ওয়ালেটও রেখে দিবে? ওটা ফিরিয়ে দাও। ভিজিটিং কার্ড আছে।”
“আমিও এটার কথাই ভাবছিলাম। মাত্রই তোমাকে কল দিতে যাচ্ছিলাম।”
রিজোয়ানা গ্রিলের ফাঁকে এগিয়ে দিতে গেলে বললো,
“এদিক দিয়ে পারবে? নিচে এসো নাহয় ছাদে।”
“কোথাও যেতে পারবো না। এদিকেই নাও।”
ইভান হাত বাড়ালো রিজোয়ানাও হাত বাড়িয়ে দিলো। এক-দেড় ইঞ্চি শর্ট আছে। দুজনেই গ্রিল ঘেঁষে দাড়িয়ে আরেকটু এগিয়ে গেলো। এবার হয়েই যেতো কিন্তু ইভান না ধরতেই রিজোয়ানা ছেড়ে দিয়েছে! দুজনেই হা হয়ে তাকিয়ে আছে হুট করেই তিন তলা থেকে ঝাপিয়ে পড়া ওয়ালেটের দিকে। পড়েছে তো পড়েছেই, তা-ও আবার নিচে সরু রাস্তাটায় বসে থাকা কুকুরের উপর! কুকুর ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠে দূরে সরে গেলো। ইভান রেগেমেগে তাকালেও রিজোয়ানা হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছে! তার এতো হাসির কারণ কুকুরটা! সে হাসতে হাসতেই বললো,
“আমার কি দোষ! তোমার ওয়ালেট সুইসাইড করতে চেয়েছে। দাঁড়িয়ে আছো কেন এখনো? যাও নয়তো কুকুর মুখে নিয়ে দৌড় দিবে। তখন তোমার টাকা, ওয়ালেট, ভিজিটিং কার্ড সবই যাবে।”
“যা কাণ্ড ঘটাও তুমি!”
ইভান ছুটে চলে গেলো নিচে। রিজোয়ানা হাসি নিয়ন্ত্রণে আনতে আনতে এখানে দাঁড়িয়ে পাহাড়া দিতে লাগলো সে যেতে যেতে কেউ আবার ধরে কি না দেখার জন্য। যদিও এটা মূল রাস্তা নয়। অন্যসময় এদিকে বসবাসরত বাচ্চাকাচ্চারা কিংবা লোকজন আসাযাওয়া করে। রমজানের সকাল হওয়ায় এসময়টাতে মানুষের আনাগোনা নেই। ইভান নিচে গিয়ে কাগজের সাহায্যে ওয়ালেটটা ধরে ভেতরের জিনিসপত্র নিয়ে ওয়ালেট ময়লার ড্রেনে ফেলে দিলো। উপরের দিকে তাকালে রিজোয়ানা দুহাতে মুখ চেপে আবারও হেসে উঠলো। সারাদিনেও তার এই হাসি ফুরাবে কিনা সন্দেহ! শিহানের সাথেও তো ব্যাপারটা শেয়ার করা দরকার! ভাবতেই আবার হেসে উঠলো!