“লুকোচুরি”
পর্ব- ১০
(নূর নাফিসা)
.
.
পঞ্চম রমজানে, ভোরে সেহেরির পর আর ঘুমায়নি রিজোয়ানা। নামাজ আদায় করে কুরআন পড়েছে। সূর্য উদয় হয়েছে আরও প্রায় ঘন্টাখানেক আগে। ঘরের এবং আশেপাশের পরিবেশ এসময় সম্পূর্ণ নিরব। কেননা বেশিরভাগ মানুষই এসময়টা ঘুমিয়ে কাটায়। কিছুটা সময় লুবনা কুরআন পড়েছিলো। তিনিও ঘুমিয়ে পড়েছেন সূর্য উদয়ের আগেই। রিজোয়ানা কুরআন রেখে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলো। ইচ্ছে হলো একটু হাটাহাটি করার। তাই সে ফ্ল্যাটে তালা লাগিয়ে ফোনটা সাথে নিয়ে ছাদে চলে এলো। এখানে এসে দেখলো পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে তারা চার ভাই উপস্থিত! শিহান, অয়ন ও নিয়ন রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে একে অপরের সাথে। রিজোয়ানা লক্ষ্য করলো তারা কোনো গেইম খেলছে। শিহান প্রশ্ন করছে আর একে অপরকে টপকে বাকি দুজন উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। ইভান জুতা এক পাশে রেখে খালি পায়ে হাটছে। মনযোগ তার হাতে থাকা ফোনের দিকে। রিজোয়ানা ইচ্ছাকৃত হালকা কাশি দিলে ইভান এদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। বাকিরাও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। রিজোয়ানা রেলিংয়ের পাশে এগিয়ে এসে বললো,
“এতো সকাল সকাল সবাই এখানে!”
শিহান বললো,
“সকাল সকাল গুড্ডু সুড্ডুকে রংধনু দেখাতে নিয়ে এলাম।”
“বৃষ্টি হয়নি, আবার রংধনু!”
শিহান চোখ মেরে বললো,
“আরে, বৃষ্টি লাগে না। এমনিতেই রংধনু উঠবে। গতকাল নিউজে বললো না!”
“নিউজে বলেছে রংধনু উঠবে! এমন নিউজ তো আমি কখনো দেখিনি! গুড্ডু সুড্ডু, তোমাদের বোকা বানাচ্ছে শিহান৷ এখন রংধনু উঠবে না। বৃষ্টি হলে রংধনু দেখা যায়।”
ব্যাস! শিহানের পেছনে লেগে গেছে দুইটা। ওদিকে পুরো ছাদ দৌড়াচ্ছে তারা শিহানকে ভীষুম ভীষুম দেওয়ার জন্য! এদিকে ইভান এগিয়ে এসে নিজেদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো, ঠিক রিজোয়ানার মুখোমুখি। তাদের কাণ্ডে রিজোয়ানা হেসে ইভানের উদ্দেশ্যে বললো,
“এতো সকালে এখানে? ঘুম আসেনি?”
“ঘুমাইনি।”
“কেন?”
“ফজর নামাজ পড়ে বাবার কবর জিয়ারত করতে গিয়েছিলাম চার ভাই। শিহান ঘুমাবে না তাই টেনে নিয়ে এলো ছাদে। এসে দেখলাম ভালোই লাগছে, সূর্যোদয় দেখা, ঠান্ডা বাতাস দেহে মাখা। মাঝে মাঝে তোমার প্রেম এসে ছুয়ে যাচ্ছে বিনা অনুমতিতে।”
“ইশ! আমি তো এসে সাতসকালে ফোনের দিকে কড়া নজর দেখলাম। ফোনে এতো কি, হ্যাঁ?”
“তুমি, তুমি আর তুমি।”
“ভণ্ডামির জায়গা পাও না? মুখে মুখে আমি, আর ফোনের ভেতর অন্য কেউ নেই তো!”
“ধুর! অনলাইনে ছিলাম একটু। নাও, ফোন চেক করো।”
“প্রয়োজন নেই। এই ঘুম পাগলরা কিভাবে না ঘুমিয়ে আছে এখনো?”
“শিহান বলেছে আজ যদি তারা সূর্যোদয় দেখে, তাহলে ম্যাজিক বল কিনে দিবে। মানে ঠেলে ধাক্কিয়ে আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছে আরকি। যাক, রাজি হয়ে গেলাম। দিন দিন ঘরে থেকে থেকে ব্রয়লার মুরগি হয়ে যাচ্ছে, ভাবলাম দৌড়াদৌড়ি করার প্রয়োজন আছে। যেই সূর্যোদয় দেখা শেষ, সেই শুরু হয়েছে ম্যাজিক বল কিনে দেওয়ার তাড়া। দোকান বন্ধ, রংধনু উঠবে, আরও কত বাহানায় আটকে রাখা!”
হটাৎই গুড্ডু সুড্ডু চিৎকার করে ছুটে এসে বললো,
“ভাইয়া, দোকান খুলেছে।”
ইভান পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,
“দোকানদার রোযা রেখে ম্যাজিক বল বিক্রি করে না। সন্ধ্যায় এনে দিবো। যাও।”
“না… এখন!”
“আরে! দোকানদার মাত্র দোকান খুলেছে, বিক্রি করার প্রিপারেশন নিবে না!”
“না, চলো…”
এদিকে আবার রিজোয়ানা সুর টেনে দিলো,
“মিথ্যুক কোথাকার! বাচ্চাদের তোমরা পেয়েছো কি! দুজন মিলে বোকা বানিয়ে যাচ্ছো।”
“তুমি আবার আরেক যন্ত্রণা! আমার সাথে গল্প করছো, ভালো লাগছে না তোমার?”
“তাই বলে তাদের এভাবে বোকা বানিয়ে যাবে!”
অয়ন বললো,
“ভাইয়া, আসো তো। দোকান বন্ধ করে ফেলবে আবার!”
“বলেছি না, সন্ধ্যায়!”
“এখন আসবা! চলো। নয়তো আম্মুর কাছে বলে দিবো তুমি আপুর সাথে ছাদে এসে কথা বলছো।”
“যাও, তো। ওইযে, শিহান ভাইয়াকে ধরো।”
“ওই, না! চলো…!”
এবার দুজন শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে তার দুই পায়ে ধরে টানতে লাগলো। শিহান অপর প্রান্তে থেকে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। এদিকে রিজোয়ানাও হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছে! ইভান দুইটার দুইহাত ধরে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বললো,
“আরে হচ্ছে কি! প্যান্ট ছিড়ে যাবে তো! মানইজ্জত নিয়ে টানাটানি! যাচ্ছি, যাচ্ছি রে ভাই! ছাড়ো, যাচ্ছি তো!”
দুইজন ঠেলতে ঠেলতেই নিয়ে গেলো তাকে। তাকে এভাবে জ্বালাতনে ফেলার কারণে যাওয়ার সময় শিহানকে দৌড়ানি দিলো ইভান৷ শিহান এক দৌড়ে তাদের আগেই নিচে নেমে গেলো। রিজোয়ানাও এপাশে নেমে গেলো।
ইফতারের পর রুমে এসে যখন নামাজ পড়ছিলো, তখন ফিসফিস শব্দ পেয়েছিলো। মনে হচ্ছিলো ইভান ডাকছিলো। নামাজের শেষদিকে আবার ফোন বাজতে থাকলো। রিজোয়ানা নামাজ শেষ করে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো ইভানই কল করেছে। তাই কল ব্যাক করলো। ইভান রিসিভ করতেই রিজোয়ানা বললো,
“লজ্জা করে না, হুটহাট বউয়ের ফোন রিসিভ করে ফেলো যে? তোমার তো উচিত ছিলো সাথে সাথেই কেটে দিয়ে কল ব্যাক করা। তারউপর বউ আবার বেকার!”
ইভান হেসে বললো,
“তাই? কল তো আমিই দিয়েছিলাম। তুমি রিসিভ করতে পারোনি। এটা শ্বশুর কন্যার শাস্তি।”
“কল ব্যাক করো।”
“উহুম।”
“কেটে দিলাম আমি।”
“দাও। একটা সারপ্রাইজ ছিলো, মিস করবে তুমিই।”
“কি মিস করবো?”
“বলবো কেন?”
“আযব! আচ্ছা, কাটবো না। বলো কি বলবে?”
ইভান কিছু না বলে হাসলো। রিজোয়ানা বললো,
“হাসছো কেন আবার? বলো?”
“কিছু না। এমনি ফোন করেছি।”
“ধ্যাৎ!”
রিজোয়ানা কল কেটে দিলো। কয়েক সেকেন্ড পরই আবার কল করলো ইভান। রিজোয়ানা রিসিভ করে বললো,
“আবার কি?”
ইভান বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“হেই, রিজু! তুমি কি সালোয়ার কামিজ পরে আছো?”
“মানে!”
“তুমি সালোয়ার কামিজ পরে আছো কি না?”
“নাহ, আলখাল্লা পরে আছি।”
“হা হা হা। ভবিষ্যতে তোমাকে আলখাল্লাই পরাবো আমি। আপাতত ঝটপট মাথায় কাপড় দিয়ে, ঝটপট রুম থেকে বের হবে। তারপর ঝটপট ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে ঝটপট সিড়ি দিয়ে নিচে চলে আসবে।”
“নিচে? এখন! কেন? নিচে কেন?”
“কথা কম। যা বলছি, তা করো। ঝটপট বলেছি তো ঝটপট কাজ করো।”
“আমি এখন বের হতে পারবো না। এই সন্ধ্যায় উনার ঝটপট ঝটপট চলছে। দিনে হলে এক কথা ছিলো।”
“আমি দুই মিনিটের বেশি অপেক্ষা করবো না। গুড বায়।”
ইভান কল কেটে দিলো। রিজোয়ানা ব্রু কুচকে ভাবতে লাগলো নিচে কেন নামতে বললো! তখন যে সারপ্রাইজের কথা বললো, তাহলে কি সত্যিই কোনো সারপ্রাইজ রেখেছে? তা নয়তো নিচে নামতে বলবে না তো! রিজোয়ানা এবার ঝটপট বেরিয়ে এলো। পেছন থেকে লুবনা জিজ্ঞেস করছিলো, “কোথায় যাস?”
সে তার পথে চলতে চলতে জবাব দিয়ে এলো, “আসছি।”
অতঃপর নিচে গেইটের কাছে এসে কাউকেই দেখতে পেলো না। গেইটের বাইরে এগিয়ে এসে রাস্তার বিপরীতে শিহানকে দেখতে পেলো, হাটাহাটি করছে। শিহান তাকে দেখে ডানে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বললো,
“ভাইয়া, এসে গেছে।”
রিজোয়ানাও ডানদিকে তাকিয়ে দেখলো ইভান মুদি দোকান থেকে বেরিয়ে আসছে। পকেটে ওয়ালেট রাখতে রাখতে সে ঘন ঘন কদম ফেলে চলে এলো রিজোয়ানার কাছে। মুখে ফুটন্ত মুচকি হাসি। যা মন ভালো থাকলে সবসময়ই প্রকাশ পায়। রিজোয়ানা কোমড়ে এক হাত রেখে বললো,
“কি ব্যাপার? তুমি সিগারেট খাও?”
“আ! এতোদিনে হঠাৎ এই প্রশ্ন!”
“খাও কি না?”
“না তো। তুমি জানো না সেটা!”
“তাহলে দোকানে কি করছো?”
ওদিকে শিহান রাস্তা পাড় হয়ে এপাশে আসছে। এদিকে ইভান ফিক করে হেসে উঠে বললো,
“দোকানে! দোকানে কি শুধু সিগারেট খাওয়ার জন্য যায় মানুষ? এক হাজার টাকার নোট ভাঙাতে গেলাম। সুযোগ পেয়ে শিহান রুটি কলা নিয়ে ভাগলো। সেটার বিল পে করে এলাম।”
রিজোয়ানা শিহানের উদ্দেশ্যে বললো,
“কাজটা কিন্তু তুমি ঠিক করোনি। সামান্য রুটি কলা নিয়ে তুমি ভেগেছো! আরও বেশি কিছু নেওয়া প্রয়োজন ছিলো। দশ বিশ টাকা কি বিল করেছো? তোমার ভাইয়ের মান সম্মানের একটা ব্যাপার আছে না!”
শিহান শব্দযোগে হেসে এক ঢোক স্পিড গিলে বললো,
“দশ বিশ টাকা না। একজোড়া রুটি, এক হালি কলা, সাথে একটা স্পিড ক্যান। ষাট সত্তর টাকা বিল তো হবেই। এর বেশি নেওয়ার মতো সামনে কিছু পাইনি, সময়ও হয়নি।”
“একজোড়া রুটি, এক হালি কলা আবার স্পিডও! কোথায় এগুলো?”
শিহান পেটে হাত বুলিয়ে ইঙ্গিত করলো খেয়ে ফেলেছে। রিজোয়ানা “খাদক” বলে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। ইভান বললো,
“তুমি যে কেমন সংসারী হবে, আমার বুঝা হয়ে গেছে। অন্যদের বউরা টাকা বাঁচানোর ধান্ধায় থাকে, আর আমার বউ চায় কোনদিকে আমার খরচ হবে!”
“তুমি যে কিপ্টুস। তোমার কিপ্টামি ছুটাচ্ছি। ঝটপট তো এলাম, তো আমার সারপ্রাইজ কোথায়?”
“ঝটপট এসেছো, এবার ফটাফট চলো।”
“কোথায়?”
“পালাবো।”
“মানে!”
শিহান বললো,
“আপু, তাড়াতাড়ি পালাও। ভাইয়া খুনের দায়ে ফেঁসে গেছে। পুলিশ তোমাদের খুঁজছে।”
“আরে! কি শুরু করেছো তোমরা! পাগল করে দিবে আমাকে!”
শিহান হেসে উঠলে রিজোয়ানা বুঝতে পারলো সে মিথ্যে বলেছে। কিন্তু ইভান তার হাত ধরে বললো,
“শীঘ্রই চলো। সংসার করতে হলে পালাতে হবে। নয়তো তোমার আমার সংসার এই দুনিয়ায় সাজবে না। আমরা আলাদা বাসা নিয়ে সংসার করবো।”
“লুকোচুরি”
পর্ব- ১১
(নূর নাফিসা)
.
.
“শীঘ্রই চলো। সংসার করতে হলে পালাতে হবে। নয়তো তোমার আমার সংসার এই দুনিয়ায় সাজবে না। আমরা আলাদা বাসা নিয়ে সংসার করবো।”
“আশ্চর্য! সংসার করার জন্য পালিয়ে যাবো!”
“যেতে হবে। চলো তো।”
“এই, না। আমি যাবো না।”
ইভান হাত টেনে দু’কদম এগিয়ে নিয়ে বললো,
“আসতে বলেছি না! এসো।”
“পাগল হয়ে গেছো তুমি! ছাড়ো, আমি যাবো না।”
রিজোয়ানার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। তা দেখে ইভান হাত টান রেখেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“ঝটপট এসেছো, চটপটি খাবে না? আচ্ছা, বাসায় চলে যাচ্ছি তাহলে। টাকাটা বেঁচে গেলো!”
কথার সাথে সাথে ইভান হাত ছেড়ে দিলো। তার অভিনয় বুঝতে পেরে রিজোয়ানা ক্ষেপে গিয়ে তার হাতে জোরেসোরে ঘুষি মেরে বসলো।
“ফাজিল! জানতাম আমি, মিথ্যে বলছো! এখন চটপটি খেতে যাবো কিভাবে! এতোক্ষণ বাইরে থাকলে মা আবার বকাঝকা শুরু করবে।”
শিহান বলল,
“আরে, দোকান তো কাছেই। বেশিক্ষণ লাগবে না। গপাগপ গিলে নিবে। চলো তো এবার। অনেক্ক্ষণ ধরে অপেক্ষা করাচ্ছে ভাইয়া। সেই কখন থেকে মনটা চটপটি চটপটি করছে!”
ইভান বললো,
“কিসের চটপটি! মা পাতিল ভরে ভাত রান্না করে রাখছে। ভাত খা গিয়ে, যা!”
রিজোয়ানা দুহাতে তার এক হাত পাকড়ে ধরে বললো,
“ভাত তুমি খেয়ো গিয়ে। আগে আমাদের চটপটি খাওয়াবা। আমাকে ডেকে এনে এখন পালানো হচ্ছে?”
“ডেকেছি? কখন ডাকলাম! মনে করো তুমি ঘুমিয়ে ছিলে এতোক্ষণ। আর যা ঘটেছে, তা স্বপ্ন ছিলো। এখন তোমার ঘুম ভেঙে গেছে। তুমি আবার নিজেকে নিজের রুমে আবিষ্কার করবে।”
রিজোয়ানা তাকে ঠেলে নিয়ে যেতে যেতে বললো,
“আমার ঘুম এখনো ভাঙেনি। আগে চটপটি খাবো, তারপর ঘুম ভাঙবে।”
“কেন খাওয়াবো, হ্যাঁ? তুমি তো পালাতে রাজি হলে না!”
“রাজি হইনি যে, সেজন্যই খাওয়াবে।”
শিহান তার ফ্রেন্ডের সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে তাদের আগেই হাটছে। ইভান এবার স্বাভাবিকভাবে হাটতে হাটতে রিজোয়ানার পেছনে হাত রাখলে সে সরিয়ে দিলো। কিন্তু দুরত্ব বজায় রেখে হাটতে রাজি না ইভান। তাই সে হাত মুঠোয় নিয়ে তারপরই পথ চলেছে। চটপটি খেয়ে আর বেশিক্ষণ দেরি করেনি রিজোয়ানা। নয়তো এদিকে আবার মায়ের ক্লাস নেওয়া শুরু হয়ে যাবে! ইভান ইচ্ছে করে তাকে আরও লেট করানোর চেষ্টা করছিলো। কিন্তু সেখানে রিজোয়ানার প্রচেষ্টা সফল।
এমনিতে খাওয়াদাওয়া সব ডাইনিং টেবিলে হলেও ইফতারটা তাদের ড্রয়িংরুমের ফ্লোরে কিংবা বাবামায়ের রুমের খাটে আয়েশ করে বসে করা হয়। দ্বাদশ রমজানে আবহাওয়ায় গরমটা বেশি পড়ায় মায়ের কাজ সব এগিয়ে দিয়ে ইফতার তৈরির ফাঁকে রিজোয়ানা ড্রয়িংরুমের ফ্লোর মুছে দিলো। গরমের দিনে ঠান্ডা ফ্লোরে পা ফেলতেও বেশ আরাম বোধ হয়। তাই রিজোয়ানা ধেই ধেই করে হেটেই যাচ্ছে। মাগরিবের আজানের দশ মিনিট আগে কিচেন থেকে একে একে সবকিছু এনে গুছিয়ে রাখছে ফ্লোরে। বাবা ওযু করে আসছে, লিসান রুমে আছে। কিছুক্ষণ আগেই মাত্র ফিরেছে, ফ্রেশ হচ্ছে হয়তো৷ এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো। রিজোয়ানা জগে পানি নিচ্ছিলো তাই লুবনা এসে দরজা খুলে দেখলো ইভান ও শিহান! ইভান হাসিমুখে সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম, ফুপি। কেমন আছো?”
কতদিন পর এই ছেলেটা প্রত্যক্ষ কথা বললো তার সাথে। তাছাড়া তাদের উপস্থিতিতে লুবনা অবাক হয়েই বললো,
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ, ভালোই। তোরা কেমন আছিস?”
শিহান জবাব দিলো,
“ভালো আছি বলেই তো হুটহাট ফুপির বাড়ি ইফতার করতে চলে এলাম।”
লুবনা হেসে বললেন,
“ভালো করেছিস। অনেক খুশি হয়েছি। আয়, ভেতরে আয়। অয়ন নিয়নকে নিয়ে এলি না?”
“ধুর, বাদ দাও। অন্যদিন পাঠিয়ে দিবো।”
রিজোয়ানা কিচেনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে! ইভান এভাবে এসে সারপ্রাইজ দিবে ভাবতেই পারেনি! ইভান তাকে দেখে মুচকি হেসে ব্রু নাচালো। রিজোয়ানা লজ্জা পেয়ে হাসি চাপা রেখে পানির জগ নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বললো,
“শিহান, কেমন আছো?”
“এইতো ভালো আছি, ভাবি।”
সবসময় আপু, আর এখন তাকে ভাবি ডাকায় রিজোয়ানা চোখ পাকালো। শিহান হেসে লুবনার হাতে তাদের নিয়ে আসা প্যাকেট ধরিয়ে দিলো। লুবনা বললো,
“এগুলো কেন নিয়ে এসেছিস! রোজার দিনে ইফতার তো বাসায়ই বানানো হয়েছে। বোকা কোথাকার!”
ওদিকে শিহান জবাব দিচ্ছে, এদিকে ইভান রিজোয়ানাকে বলছে,
“ভালো আছো রিজোয়ানা?”
এমনিতে সবসময় রিজু, আর আজ রিজোয়ানা! শ্বশুরবাড়ি পদার্পণ করে কতো নম্রতা কতো পরিবর্তন! মুখভঙ্গি এমন যেন কতোদিন পর আজ দেখা হলো। লুবনা মুখ চেপে অস্পষ্টভাবে হাসলো। রিজোয়ানাও মুখ টিপে হেসে জবাব দিলো,
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।”
সে আর পাল্টা কোনো প্রশ্ন করলো না। মায়ের সামনে ইভানের করা অভিনয়েই লজ্জিত, তাই নিজে অভিনয় করে লজ্জা ভারী করলো না। মাকে জিজ্ঞেস করলো,
“মা, খাবার কি টেবিলে তুলবো?”
লুবনা হ্যাঁ বললেও শিহান নিষেধ করে সাথে সাথে নিচেই বসে পড়লো। ইভানও নিষেধ করেছে তবে সাথে সাথে বসে যায়নি ফ্লোরে। বরং দাঁড়িয়ে থেকে শিহানকে সতর্ক করে দিলো,
“হুট করে তো বসে পড়লি, টুপ করে আবার গিলে ফেলিস না। আযান কিন্তু দেয়নি এখনো।”
রিজোয়ানার বাবা এলো, তারা সালাম দিলো। লিসান এলো, শিহান কথা বললেও ইভান কিছু বলেনি। লিসানও স্বেচ্ছায় কিছু বলেনি। আযান পড়লে ইফতার করতে করতেও তাদের মধ্যে গল্পসল্প চললো। খুবই ভালো কেটেছে সময়, পুরোনো কোনো কথাবার্তা উঠে আসেনি তাদের এই সুন্দর মুহুর্তে। যেন পরিস্থিতি সবটাই স্বাভাবিক, কোনো ঝগড়া বিবেধ কিছুই হয়নি কখনো! ইফতার শেষে তারা বেরিয়ে এলো নামাজ পড়তে মসজিদে যাবে। লুবনা কতোবার বললো দুজনকে রাতের খাবার যেন এখানে খায়। তারা অন্য একদিনের কথা বললো, আজ কোনোমতেই রাজি হলো না।
এখান থেকে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই আবার ফোনে কথা হলো রিজোয়ানার সাথে।
“দেখা হলে সালাম পর্যন্ত দেই না, কথা তো দূরেই থাক, ছায়া দেখলেই পালিয়ে যাই, আরও কি কি যেন বলছিলে? এবার কেমন সারপ্রাইজ দিলাম, হুম? একেবারে বাড়িতে গিয়ে শ্বশুর শ্বাশুড়ির সাথে সাক্ষাৎ করে এলাম।”
“ইশ! কি সারপ্রাইজ! আর কি বীর পুরুষ! ভয়ে ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে এসেছে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য, বুঝিনি মনে করেছো?”
“তুমি তো সবসময় একটু বেশিই বুঝো।”
“বেশি না, ঠিকই বুঝি। এসব চাপা ছেড়ে লাভ নেই, বুঝেছো? আবার কি অভিনয়, যেন শ্বাশুড়ি জানে না উনি যে লুকিয়ে লুকিয়ে পীরিতি জমিয়ে ক্ষীর! ইশ! কি ঢং! ভালো আছো রিজোয়ানা…?”
তার ভেঙানোতে ইভান হাসলো। রিজোয়ানা বললো,
“কোথায় এখন?”
“বেশি খেয়ে ফেলেছি তো, রাস্তায় হাটছি।”
“আসবে আবার? রাতে খাওয়াদাওয়া করে যাও…”
“বুক চিনচিন করছে হায়, মন তোমায় কাছে চায়। মনটা খুব কাছে চাইছে নাকি আমাকে, আবার আহ্বান জানাচ্ছো যে?”
“স্টুপিড! খাওয়ার জন্য বলেছিলাম। থাকতে বলিনি।”
“খাওয়ার পর যে আবার বলবে না, থেকে যাও…! তার গ্যারান্টি কি?”
“অই, আসা লাগবে না তোমার।”
“হা হা হা, আসবোও না। আজ বাসায় ইফতার করিনি, সেটা নিয়েই পেরেশানিতে আছি মা কি না কি বলবে! আবার রাতের খাবার!”
“ভীতুর ডিম!”
“শিক্ষাজীবনের প্রতিটি ক্লাসেই ছিলো এক পিস মিম!”
“হি হি হি! মামী জিজ্ঞেস করলে কি বলবে? হুম?”
“জিজ্ঞেস করবে না মনেহয়। আর যদি করেও তাহলে সত্যিটা বলে দিবো।”
“তাহলে নিশ্চিত, গণ্ডগোল বেঁধে যাবে।”
“বাঁধলে বাঁধুক, অযথা মিথ্যার আশ্রয় কেন নিবো? লুকোচুরি আর কতদিন?”
“বলিনি তো আমি মিথ্যে বলতে। আচ্ছা, বাসায় যাও। অফিস থেকে ফিরে বাসায়ও তো যাওনি। পোশাক চেঞ্জ করে বিশ্রাম নাও গিয়ে।”
“হুম, ভবিষ্যতে যে তুমি আমাকে বড্ড জ্বালাবে তা বুঝতেই পারছি।”
“মানে?”
“যারা প্রেম জীবনে বেশি কেয়ার করে, তারা সংসার জীবনে বেশি জ্বালাতন করে। এখন বলছো বিশ্রাম নাও, তখন বলবে বিশ্রামের গুল্লি মারি!”
“ও আচ্ছা! তো জানোই যখন আগে থেকেই সাবধান হয়ে যাও।”