গল্প : লারিসা | পর্ব : ছয়
ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
একবেলা খাবার আর দু’বেলা নির্যাতনের ফলে একেবারে মিইয়ে গেছে মেয়েটা। আজ আবার রক্তক্ষরণ। ধীরে ধীরে চোখদু’টো ঘোলাটে হয়ে আসছে তার। মাথাটা ঝিম ধরে আসছে। সে বুঝতে পারছে, তার জীবনটা এবার থেমে যেতে চলেছে।
বাচ্চা শিশুটা মায়ের কোলে নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। চোখদু’টো খোলা। ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছে শুধু। মেয়েটা অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তার কোলের শিশুর দিকে। আজ দুপুরেও সে প্রেগনেন্ট ছিল না। বিকেলেও তেমন কিছু উপলব্ধি করতে পারেনি। অথচ এক রাতের মধ্যে… কীভাবে সম্ভব? একটা বাচ্চা তার মায়ের পেটে অন্তত আট-ন’ মাস থাকে। কিন্তু এই ছেলে যে কয়েক মিনিট ছিল মাত্র!
আর বেশিক্ষণ নেই।
আন্দাজ করা যাচ্ছে, আর বেশি সময় তার হাতে নেই।
কোলের শিশুকে উদ্দেশ্য করে অনেক কথা বলার ছিল। কিন্তু নিঃশ্বাস আটকে আসছে। গলা কাঁপছে। মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। তবুও সে শ্বাস টেনে বলে, “এত তাড়াহুড়ো করে পৃথিবীতে আসতে গেলি কেন? আমার হাতে সময় নেই বলে? তাহলে আরো কিছুদিন আগে আসতে পারলি না? তাহলে তোকে মন ভরে কোলে নিতাম, আদর করতাম। আমাকে সেই সুযোগ দিলি না তো?” বলতে বলতে চুপ করে যায় মেয়েটি। আস্তে করে ডান দিকে হেলে পড়ে যায় তার দেহ। তখনই বাচ্চা শিশুটা হাত-পা ছুঁড়ে কেঁদে উঠে।
পরদিন সকালবেলা ওই সাধুদের একজন এদিকে এসে মেয়েটার লাশ খুঁজে পায়। তার কোলে একটা বাচ্চা শিশুও। শেষরাতের বৃষ্টিতে ভিজে বাচ্চাটা একদম চুপসে গেছে। তাকে কোলে নিয়ে নিজের গায়ের কাপড় দিয়ে গা মুছে দেয়। তারপর সবাইকে ডেকে আনে।
বাচ্চা শিশুর মা-বাবাকে অনেক খুঁজেছে ওরা। কোথাও পাওয়া যায়নি। ওরা আসলে জানেই না যে, এই বাচ্চাটা ওদেরই একজন, ওদেরই পাপের ফসল।
মাস তিনেক পরে ওদের চোখে ধরা পড়ে, বাচ্চাটা আসলে স্বাভাবিক না। মাত্র তিন মাস বয়সে সে হাঁটতে শিখে গেছে এবং কথাও বলতে পারে পুরোপুরি। তার ঠান্ডা পানি সহ্য হয় না। ভীষণ খাদক এবং আরামপ্রিয়। কিন্তু একদিন জঙ্গলে কুড়িয়ে পাওয়া নবজাতকের যে সেই রাতের কথা স্পষ্ট মনে আছে, সেই নেকড়ে, তার মা, এমনকি তার মায়ের বলা সবগুলো কথা, সবকিছু স্পষ্ট মনে আছে সেটা কেউই আন্দাজ করতে পারেনি।
ছেলেটার নাম দেওয়া হলো লি রি।
মাত্র তিন বছর বয়সে সে কোথা থেকে যেন একদল নেকড়েকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। সেগুলো প্রায় কুড়িজনকে আহত এবং তিনজনকে নিহত করার ফলে শাস্তিস্বরূপ লি রি’কে একটা ঘরের ভেতরে বন্দি করা হয়। এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সে পঁচিশ বছর পর্যন্ত এই ঘরেই বন্দি অবস্থায় থাকবে। পঁচিশ বছরের পার হবার পর তাকে একটি দায়িত্ব দেওয়া হবে। দায়িত্বটা হলো, যখন কোনো মেয়ে এই সাধুদের দলে যোগ দিতে চাইবে তখন সেই মেয়েটিকে সন্ধ্যের আগে আগে লি রি’র কাছে পাঠানো হবে। লি রি সেই মেয়েটির আত্মাশুদ্ধির ব্যবস্থা করবে।
এতদিন জানালা দিয়ে খাবার, পানি এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেওয়া হত। বহু বছর পর এক সন্ধ্যায় লি রি’র ঘরের দরজা খুলে গেল!
লি রি আনন্দে আত্মহারা। এবার বুঝি মুক্তি দেওয়া হবে! কিন্তু সে তখনও জানে না যে, তাকে নিয়ে ভিন্ন কিছু চিন্তা করা হয়েছে।
একজন মেয়ে মানুষকে লি রি’র ঘরে দেওয়া হলো।
সাধুদের মধ্যে সবচে’ বয়স্ক লোকটি লি রি’র কানে কানে সেই জঘন্য কাজ করতে বললে সে আঁতকে উঠে। আত্মাশুদ্ধি আর দেহভোগের মধ্যে পার্থক্য লি রি জানে না৷ এসব সে কখনো কানেও শুনেনি৷ কিন্তু তবুও মনে নাড়া দিলো তার। আত্মাশুদ্ধির নামে একটা মেয়ের সর্বস্ব লুটে নেওয়া… না না!
কালো সুতোর মালা হাতে নিয়ে এগিয়ে যায় লি রি।
তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছে। বয়স অনুমানে আঠারো কিংবা উনিশ হবে। ফরশা চামড়ার মেয়ে। মাথায় একরাশ সোনালি চুল। চোখদু’টো ভীষণ চঞ্চল। তার সাথে কী ঘটতে চলেছে তা সে জানে। জানে বলেই আলগোছে নিজেকে লি রি’র কাছে সপে দেয় সে। মাথাটা নিচু করে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে।
মেয়েটির গলায় কালো মালাটা পরিয়ে দিতে হবে।
না না, গলায় নয়, পরাতে হবে বুকে। ঠিক বুকে। লি রি একটু এগিয়ে গিয়ে আবার পেছনে ফিরে আসে। থতমত খেয়ে বলে, “এটা আপনাকে পরাতে হবে।”
“পরিয়ে দিন।” নিচু আওয়াজে বলে মেয়েটি।
“এভাবে পরানো যাবে না।”
“তাহলে?” মুখ তুলে তাকায় মেয়েটি।
“বুকে পরাতে হবে।”
“পরিয়ে দিন।”
“আপনি বুঝতে পারছেন না। এভাবে হবে না…”
লি রি পুরো কথা বলার আগেই মেয়েটি স্বেচ্ছায় নিজের গা খালি করে দেয়। বলে, “এবার হবে তো?”
সুতোটা পরিয়ে দিতে হাত কেঁপে উঠে লি রি’র। আতঙ্কে তিনহাত পেছনে সরে যায় সে। বলে, “এটা সম্ভব না। এটা আমার দ্বারা কখনোই হবে না। আমি পারব না।”
মেয়েটা কাছে আসে তার। ফিসফিসিয়ে বলে, “কিন্তু আমি আপনাদের দলে যোগ দিতে চাই। আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না। প্লিজ!”
চলবে
মো. ইয়াছিন