গল্প: লারিসা || পর্ব : পাঁচ
পেটের ভেতরে কিছু একটা এখনও নড়ছে। চিনচিনে ব্যথা টের পেয়েও দাঁড়িয়ে থাকে না মেয়েটি। কারণ ততক্ষণে সাধুদের বসতিতে হৈচৈ পড়ে গেছে। চারদিকে লোকজন খোঁজতে বেরিয়েছে। পেয়ে গেলে আবারো তাকে ঘরের ভেতরে বন্দি করা হবে। পরিণাম হিসেবে কী শাস্তি দেওয়া হবে তা হয়তো ওরা নিজেও জানে না।
কিন্তু শারীরিক পরিবর্তনটা খুব বেশি হয়েছে। সামান্য সময়ের ব্যবধানে মেয়েটির পেট অনেক বেশি বড়ো হয়ে গেছে এবং পেটে চিনচিনে ব্যথাও শুরু হয়েছে। না না, চিনচিনে বললে ভুল হবে। ইতোমধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে নিতে মেয়েটি নিজের পেটের দিকে তাকায়। তার পেটে মানুষের বাচ্চা নয়তো আবার!
নাঃ, আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হলো না। মৃদু আর্তনাদ করে বসে পড়ল মেয়েটি। যন্ত্রণায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার। দম চেপে রেখে নিজেকে শান্ত রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। হঠাৎ চঞ্চল ঘোলাটে চোখগুলো কোথাও আটকে যায়। একজোড়া চোখ। একজোড়া বিস্মিত চোখ! প্রায় তিনহাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাণিটাকে চোখ দেখেই চিনতে পারে সে। একটা মাঝারী আকারের নেকড়ে! তবে এ-অঞ্চলের নেকড়েগুলো খুব সাধারণ নয়। এরা মাংসাশী। মাংস খেয়ে ক্ষুধা মেটায় এমন একটা প্রাণী মাত্র তিনহাত দূরত্বে! ভীত দৃষ্টিতে প্রাণীটার চোখের দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকে মেয়েটি। একটুও নড়ে না। সামান্য অসতর্ক হলেই প্রাণীটা এক লাফে উড়ে এসে ঘাড় ছিঁড়ে ফেলতে পারে।
নেকড়েটা এক পা বাড়ায়। আস্তে আস্তে। যেন পায়ের নিচে পিষে যাওয়া মরা পাতাগুলোও টের না পায়। সন্তর্পণে এক পা এগিয়ে আবার পাথুরে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। চারিদিকের গা ছমছম নিঃস্তব্ধতায় নেকড়ের গলার গরগর শব্দ পলাতক আসামির মতো দাগ কেটে যায়। মেয়েটা, যার পেটে অসহ্য যন্ত্রণা, প্রায় মরে যাওয়ার উপক্রম, ঘামে ভিজে গেছে জীর্ণ-দুর্বল শরীর, চোখদু’টো অতিশয় ক্লান্ত এমন অবস্থায় আনন্দের হাসি ফুটে উঠে মেয়েটির মুখে। এখনও সে নেকড়ের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। গাঢ় অন্ধকারে নেকড়েটার চোখদু’টো আলোকিত মার্বেলের মতো দেখাচ্ছে। নেকড়েটা হয়তো এক্ষুণি মেয়েটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে; এই ভয়ে কখন যে সে সন্তান প্রসব করেছে তা সে নিজেও জানে না!
মা হতে পারা কী যে আনন্দের তা শুধু একজন মা-ই বলতে পারবেন।
মা হওয়ার আগে একটি মেয়ে কেবলই মেয়ে। তার হাসি, আহ্লাদ, আনন্দ, বেদনা সব নিজেকে নিয়েই। কিন্তু মা হবার পর সে আর তার থাকে না। সে হয়ে যায় তার সন্তানের। এমনকি নিজের প্রাণটুকুও পারলে সে তার সন্তানকে দিয়ে দেয়…
মা হবার আনন্দেই মেয়েটির চোখদু’টো আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠে। মাটিতে পড়ে থাকা বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিতে গেলে পরে যদি নেকড়েটা হামলা করে বসে সেই ভয়ে সে স্থির হয়ে রয়। নেকড়ে চলে গেলে কোলে নেওয়া যাবে। কিন্তু হঠাৎ তার মনে হয়, বাচ্চাটা কাঁদছে না কেন! মরা বাচ্চা হলো না তো আবার!
এবার নেকড়ের ভয় মাথা থেকে উবে যায়। দৃষ্টি খসে পড়ে চট করে। সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চা শিশুটার দিকে তাকিয়ে বুক কেঁপে উঠে তার। বাচ্চাটা যে নড়ছেও না! তবে কি…
হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নেবে তার আগেই নেকড়েটা গরগর শব্দ করে ধীর পায়ে এগিয়ে এল। মাটিতে শুয়ে থাকা নিশ্চল বাচ্চা শিশুটাকে জিহ্বা দিয়ে চেটে দিয়ে থমকে গেল। মা’টা ভয়ে বাচ্চাকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল কিন্তু নেকড়ে তা দিলো না। গর্জন করে হাত সরিয়ে দিয়ে বাচ্চাটাকে জিহ্বা দিয়ে চাটতে লাগল। তারপর হঠাৎ কী মনে করে যেন বাচ্চাটাকে মুখের ভেতর তুলে নিল। মা’টা প্রথমে আর্তনাদ করে উঠেছিল। কিন্তু পরমুহূর্তেই সে অবাক হয়ে গেল। কারণ নেকড়েটা বাচ্চার কোনো ক্ষতি করছে না। বরং বাচ্চাটাকে তার মায়ের কোলে তুলে দিচ্ছে! মা দু’হাতে আগলে নিলে নেকড়েটা শেষবার বাচ্চাটাকে চেটে নিল। তারপর কেমন অদ্ভুত স্বরে গরগর আওয়াজ তুলে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
চলবে
মো. ইয়াছিন
গল্পের সাইজ নিয়ে কেউ কিছু বলবেন না প্লিজ। কাল থেকে সঠিক শব্দসংখ্যা ব্যবহার করা হবে। শুভকামনা।