গল্প: লারিসা || পর্ব : তিন
ব্যাকস্টোরি।
তাদের কালচারে আই লাভ ইউ মানে উইল ইউ বি মাইন উইদাউট ম্যারেজ?
অর্থাৎ বিয়ে ছাড়া তুমি আমার হবে? সেদেশে এই বিষয়টা কমন। কিন্তু এই সহজ বিষয়টাই জঘন্য লাগে লারিসার। তাইতো একুশ বসন্ত পেরিয়ে যাবার পরও নিঃসঙ্গ জীবন পার করছিল সে। বাবা-মা’র ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে বহু আগে। ডিভোর্সের পর বাবা চলে গেছেন জার্মানিতে। মা ক্যালিফোর্নিয়ায়। লারিসা একা বাস করে এখানে। তবে গত সাত বছরের অভিজ্ঞতায় একবারও নিজেকে একা লাগেনি তার। এই নির্জন দ্বীপ। এখানকার শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ। এই কোমল, শান্ত জল। অস্তমিত সূর্য। সবকিছুই যেন লারিসার আপনজন। এই পরিবেশের সকল উপাদান যেন লারিসার পরিবারের একেকজন সদস্য।
দ্বীপে ছোট্ট একটি কফিশপ চালায় লারিসা। কফি, চকোলেট, বার্গার ইত্যাদি বেচাবিক্রি করতে করতে দিন কেটে যায় তার। রাত নেমে এলে সে এক কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ঘরে ফেরে। ভোরবেলা আবার চলে আসে এখানে। এরকম করে কেটে গেছে সাতটি বছর। কিন্তু একদিন একটা মানুষ, একজন অতি সাধারণ মানুষের আগমন হলো লারিসার জীবনে। তখন থেকেই লারিসার জীবনের পরিবর্তন শুরু…
সেদিন বিকেলবেলা মেঘলা থমথমে আকাশ আর ধু-ধু শীতল হাওয়া পুরো দ্বীপটাকে গ্রাস করে ফেলেছিল। ফাঁকা কফিশপে বসে আনমনে মা-বাবার কথা ভাবছিল লারিসা। এমন সময় হঠাৎ একটা লোক উদ্-ভ্রান্তের মতো শপে ঢুকল। লম্বায় প্রায় সাড়ে ছ’ ফুট সিনা উঁচু করা মানুষটা। বয়স কমিবেশি ছাব্বিশ কিংবা সাতাশ হবে। হতদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকতেই লারিসা উঠে দাঁড়ায়। কী লাগবে স্যার? বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন মানুষটা গুনগুন করে বলে, পানি লাগবে, পানি। এক গামলা পানি।
এক গামলা? লারিসা অবাক হয়। এখানে এসে এর আগে কেউ এত পানি চায়নি। সবাই একগ্লাস পানিই চায়। কিন্তু এই মানুষটা এক গামলা পানি দিয়ে কী করবে? কৌতূহলে কপাল কুঁচকে যায় লারিসার। তাকে ইতস্তত করতে দেখে ছেলেটা ফের বলে, জলদি এক গামলা পানি দাও। সম্ভব হলে এক পুকুর পানি এনে দাও, প্লিজ।
এক পুকুর!
লারিসা অবাক হয়ে ছেলেটার চোখের দিকে তাকায়। টকটকে লালবর্ণ চোখদু’টো দিয়ে যেন আগুনের উল্কি বেরোচ্ছে। নাক দিয়ে ফোৎ ফোৎ শব্দ করছে। অস্বস্তিতে ছেয়ে গেছে তার পুরোটা দেহ। নাকে মরিচ লাগিয়ে দেওয়া ষাঁড়ের মতো ফোঁস ফোঁস করছে দেখে লারিসা আর দেরি করে না। ছুটে গিয়ে এক জগ পানি এনে দেয়। সে ভেবেছিল ছেলেটার হয়তো খুব বেশি পানির পিপাসা পেয়েছে। কিন্তু না, ছেলেটা একফোঁটা পানি খেল না। বরং পুরোটাই ঢেলে দিলো নিজের মাথায়! কান্ড দেখে লারিসার চোখ গোল। একপ্রকার চেঁচিয়ে সে বলে, এটা কী হলো!
ছেলেটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আরো এক জগ পানি চেয়ে বলে, গায়ে আগুন ধরে গেছে। আরো পানি লাগবে। আরো।
লারিসা ভীষণ রাগে ফোঁস করে বলে, গোসল করলে সমুদ্রে ঝাঁপ দিন। এখানে এসে এমন করার কী আছে?
সমুদ্রে! আঁতকে উঠে ছেলেটা। বলে, সমুদ্রেই তো নেমেছিলাম। কিন্তু সেই পানিতে আগুন ধরে গেছে। আমার গা পুড়ে ছাই। এই দেখুন ধোঁয়া বেরোচ্ছে গা থেকে। উফ্! এক্ষুণি পানি এনে দিন প্লিজ!
লারিসা থতমত খেয়ে যায়। শপ থেকে মাথা বের করে সামনের ওই গভীর সমুদ্রের দিকে তাকায়। বিকেলের শান্ত জল একরকম থেমে আছে। সূর্যটা ডুবে গেছে প্রায়। পেছনে ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করে লারিসা, কই আগুন? কোথায় আগুন?
আগুন ওই পানিতে। সমুদ্রের পানিতে আগুন। ভয়াবহ আগুন।
ছেলেটার হাঁপানি দেখে মনে হয়, সে সত্যি বলছে। কিন্তু পানিতে আগুন লাগবে কী করে? ব্যাপারটা একটু ভাবিয়ে তুলেছিল লারিসাকে। আনমনে সে সমুদ্রের দিকে তাকাচ্ছিল এমন সময় পেছন থেকে পানি পড়ার শব্দ শোনা গেল। রুদ্ধশ্বাসে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে, ছেলেটা এক কেতলি ফুটন্ত গরম পানি নিজের গায়ে ঢেলে দিয়েছে। অন্য কেউ হলে চেঁচিয়ে মরত। গায়ের চামড়া পুড়ে যেত। অথচ ছেলেটা শান্ত হয়ে বলছে, আঃ! আরাম লাগছে!
এরপর লারিসা আর কথাই বলতে পারেনি। ছেলেটা ভেজা শরীর নিয়েই টেবিলে বসে পড়ে। লারিসা তখন শপের মূল দরজায় হা করে দাঁড়ানো। ছেলেটা আনাড়ি ইংরেজিতে বলে, একপেট খাবার হবে? আমার কাছে কিন্তু ডলার নেই। কাজ করে দেব। বিনিময়ে একপেট খাবার দেওয়া যাবে আমাকে?
তারপর নিশ্চল চোখে লারিসার দিকে চেয়ে থাকে। নিতান্ত সহজ আবেদন। খাবার দিন, বিনিময়ে কাজ করে দেব। লারিসা খাবার দিলো। এক বসায় তিনজন মানুষের খাবার একাই সাফ করে দিলো ছেলেটা। তারপর লম্বা হাই তুলে টেবিলের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।
.
রাতের তখন প্রায় সাড়ে নয়টা। লারিসা শপ বন্ধ করবে। কিন্তু সেই ছেলেটা তখনও টেবিলে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে। লারিসা একবার কাছে গিয়ে মৃদু আওয়াজ দিয়েছে, এক্সকিউজ মি? শুনছেন? এই যে! হ্যালো!
কিন্তু ছেলেটার নড়াচড়া নেই। রাতের যখন এগারোটা তখন উদ্বেগে আরো একবার ডাকাডাকি করতে চেয়েছিল লারিসা। কারণ এই নির্জন দ্বিপে এত রাতে একজন অপরিচিত লোকের সাথে তার মতো একটি মেয়ে একদম নিরাপদ নয়। তার উপর ছেলেটার ভাবভঙ্গি, কথাবার্তা একদমই স্বাভাবিক মনে হয়নি। এমতাবস্থায় কী করা উচিত? ঘুমন্ত ছেলেটাকে শপে রেখেই শপ ক্লোজ করে চলে যাওয়া? না কি তাকে ঘুমন্ত অবস্থায়ই টেনে বের করে দিয়ে…
ধপ করে ছেলেটার মুখোমুখি চেয়ারে বসে পড়ে লারিসা। সিদ্ধান্ত নেয়, আজকের রাতটা এখানেই কাটাবে সে। পুরো রাত জেগে থেকে শপ পাহাড়া দেবে, নিজেকে পাহাড়া দেবে। যাতে করে এই ছেলেটার মনে যদি কোনো কু-মতলব থাকে তাহলে নিজেকে বাঁচিয়ে নিতে পারে। কিন্তু এই একটা রাত লারিসার জীবন এতটা পরিবর্তন করে দেবে তা কল্পনারও বাইরে ছিল তার। এমন কিছু ঘটে যাবে এমনটা স্বপ্নেও ভাবেনি সে।
লারিসা ঘুমঘুম চোখে চেয়ে থাকে ছেলেটার দিকে। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে তাকিয়ে ছেলেটার অদ্ভুত কান্ডগুলোর কথা ভাবে। সমুদ্রের জলে আগুন ধরেছে। সেই জল লেগে ছেলেটার গা পুড়ে যাচ্ছিল। পরে ফুটন্ত গরম পানিতে তার দেহ শীতল হয়। যে পানি কারোর গায়ে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে চামড়া পুড়ে যাওয়ার কথা সেই পানি গায়ে ঢেলে ছেলেটা বলেছে, আঃ! আরাম লাগছে!
চলবে
পরবর্তী পর্বে লারিসার ব্যাকস্টোরি বলব।
মো. ইয়াছিন