গল্প: লারিসা || পর্ব : দুই
চট করে লারিসার হাত ধরে ফেলে লোকটা। চনমনে দৃষ্টিতে একবার আপাদমস্তক দেখে নেয়। নাক দিয়ে শুঁকে লারিসার দেহের গন্ধ। পরমুহূর্তেই লোকটার চোখমুখে বিদ্রুপের হাসি ভেসে উঠে। লারিসার গা ঘিনঘিন করছে। ইচ্ছে করছে এক ঘুসি দিয়ে লোকটার নাক থেতলে দেয়। কিন্তু তা করা যাবে না। দম আটকে নিজেকে শান্ত রাখে সে। হাতদুটো শক্ত মুষ্টিবদ্ধ রেখে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটা যখন লারিসার পিঠের দিকে হাত বাড়ায় পেছনের হুকটা খুরে ফেলবে বলে তখনও লারিসা শক্ত থাকে। না, এখনই রেগে যাওয়া চলবে না। লারিসা একটা বিশেষ প্রয়োজনে এখানে এসেছে। একটা বিশেষ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এই বিশ্রি সংস্কৃতির লোকদের সাথে মিশেছে। এখনই রেগে গিয়ে সব প্ল্যান নষ্ট করে দেওয়া চলবে না। কিছুতেই না।
লারিসার বুকের উপরের কাপড়টা যে হুকের মাধ্যমে আটকানো, সেই হুক খুলতে গিয়ে হাঁত কাঁপছিল লোকটার। ভয়ে নয়, উত্তেজনায়। তাছাড়া, লোকটার বয়সও তো কম হয়নি। দেখে বোঝা যায় না, এই লোকটার বয়স একাশি বছর।
বুকের কাপড়টা মাটিতে পড়ে গেলে লারিসা দু’হাতে নিজের বুক ঢেকে নেয়। জোরে মাথা নেড়ে পেছনের এলোমেলো সব চুল সামনে নিয়ে আসে। তবুও পুরোটা ঢাকা যায় না। বৃদ্ধ লোকটা ঘনঘন শ্বাস নিয়ে বলে, তোর বয়স কত হলো রে?
লারিসার গলা কাঁপছে। ইচ্ছে করছে লোকটাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। লোকটা লারিসার উদোম পিঠে থাবা মেরে বলে, বলিস না কেন? বয়েস কত তোর?
সা-সাতাশ। কাঁপাকণ্ঠে জবাব দেয় লারিসা। ঘেন্নায় চোখের কোলে জল জমে গেছে। দৃষ্টি ঝাপসা। একটা মেয়ে কখনোই এমন বিশ্রি একটা মানুষের কাছে নিজের দেহ সপে দিতে পারে না। কিন্তু লারিসা পেরে গেল। পারলো ভালোবাসার টানে। যে ভালোবাসা উদ্ধার করতে সে এখানে এসেছে।
একটুক্ষণের মধ্যেই একটা শক্ত শীতল হাত লারিসার কাঁধ ছুঁয়ে যায়। পিঠ বেয়ে নেমে যায় কোমড় অবধি। ফিতেটা খুলে দিলেই পুরোপুরি বিবস্ত্র। এমন সময় কাঁদোকাঁদো গলায় বলে উঠে, গিভ মি সাম টাইম! আমাকে একটু সময় দাও।
থেমে যায় হাতটা। রুষ্ট কণ্ঠস্বরটা বলে, সময়! সময় দিয়ে কী করবি?
লারিসা জবাব দিতে গিয়ে গুনগুন করে কাঁদে। মনে মনে বলে, আমার দেহটা একজনের জন্যই বরাদ্দ ছিল। আজ সেই মানুষটার জন্যই এই দেহ অন্য একজন ভোগ করবে। কেন এমন হবে? কেন আমাকেই এত কঠিন পরীক্ষা দিয়ে ভালোবাসা জয় করতে হবে?
বৃদ্ধ লোকটা লারিসার একগোছা চুল শক্ত করে মুঠোয় ভরে হেঁচকা মোচড় দিয়ে লারিসার মাথাটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। তার ভেজা চোখের দিকে চেয়ে বলে, ভয় লাগছে তোর?
লারিসার দুই হাত বুকের উপর বেঁধে রাখা। তাই চোখ মুছতে পারছে না সে। ফুঁপিয়ে কান্না আসছে তাই কথা বলতেও পারছে না। বৃদ্ধ লোকটা টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। কালো সুতোর মালাটা নিয়ে এসে লারিসার সামনে দাঁড়ায়। লারিসার হাত দু’টো তার বুকের উপর থেকে সরিয়ে নিতে চায়; কিন্তু পারে না। পরে ধমক দিয়ে বলে, এই মেয়ে! হাত সরা!
লারিসা হাত সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। লোকটা দু’হাতে লারিসার বুকের উপর কালো সুতোর মালাটা পরিয়ে দেয়। না, গলায় নয়। ঠিক বুকের উপর দিয়ে পিঠ বরাবর বেধে রাখা। লারিসা তার দেহটা লুকিয়ে রাখার জায়গা পায় না। ঘন ঘৃণিত নিঃশ্বাসে বুক ভরে উঠে তার। বৃদ্ধ লোকটা যখন বিড়বিড় করে কীসব মন্ত্র পড়ে ফু দিতে দিতে সেই মালার উপরে হাত বুলায় তখন ঘেন্নায় লারিসার গা রি-রি করে উঠে। তবুও সহ্য করে যায় সে। যা কিছু হয়ে যাক, পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকা চাই। সবকিছু স্বাভাবিক রেখে প্ল্যানমাফিক এগোবে সে। কিন্তু পরিকল্পনার বাইরে অপ্রত্যাশিত এমন কিছু ঘটে যাবে তা লারিসার জানা ছিল না।
.
যে লোকটা রোবানকে বারবার সাবধান করে দিচ্ছিল, সে এই সাধুদের দলেরই একজন। তার বয়স একশো উনিশ বছর। সর্দার গোছের এই মানুষটি আজ কেন জানি অস্থির হয়ে আছে। কী কারণে যেন তীব্র অস্বস্তি লাগছে তার। কেন জানি মনে হচ্ছে, আজ কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে চলেছে। মনে হচ্ছে, বড়ো কোনো অঘটন ঘটবে আজ। হাঁসফাঁস করতে করতে তিনি উঠানে পায়চারি করছিলেন। যে ঘরে রোবান ঢুকেছে সেই ঘরের দরজা বাইরে থেকে আটকে রাখা হয়েছে, যাতে কেউ চাইলেও পালিয়ে যেতে না পারে। উঠানে অনেক মানুষের জটলা। কেউ গাইছে, কেউ নাচচে, কেউ নেশা করে বুঁদ। শুধুমাত্র একশো উনিশ বছরের এই লোকটি মনোযোগ দিয়ে শুনছে, রোবানকে আটকে রাখা ঘরের দরজায় ভেতর থেকে খুব জোরে আঘাত করা হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কেউ দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। আরো একটু মনোযোগ দেওয়ার পর সেই মেয়েটির চিৎকারও শোনা গেল। কান্নাভেজা চিৎকারটা বাইরের শোরগোলের কাছে কিছুই না। তাই লোকটা আরো একটু এগিয়ে যায়। হ্যাঁ, সত্যিই সেই মেয়েটা চিৎকার দিয়ে বলছে, দরজা খুলো! কেউ সাহায্য করো! কেউ দরজাটা খুলে দাও! বলতে বলতে কেঁদে উঠল মেয়েটা। রোবানের অত্যাচারে সে কাঁদবে এটা সবারই জানা। কিন্তু এই লোকটা ভয় পাচ্ছে এই ভেবে যে, মেয়েটা চিৎকার দিলে রোবান শক্ত হাতে মুখ চেপে ধরার কথা। অথচ এতক্ষণ কাঁদার পরও কেউ তার মুখ চেপে ধরেনি। মেয়েটা এখনও কাঁদতে কাঁদতে দরজা খুলে দিতে বলছে। তাহলে রোবান কোথায়? সে মেয়েটার মুখ চেপে ধরছে না কেন?
চলবে
পরবর্তী পর্বে লারিসার ব্যাকস্টোরি বলব।
মো. ইয়াছিন