লাভ_গেম পর্ব 33

0
1056

#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন

৩৩.

টেবিলের উপরে ছোট ছোট দুইটা নোটবুক, বাদামী রঙের মোটা ডায়েরি, কিছু ফাইল পত্র। রুশা বিরস মুখে এসবের সামনে বসে আছে। আদ্রিশ ঘরে ঢুকে রুশাকে এভাবে দেখে বলল,
“এসব কী?”

রুশা টেবিলের উপরে ইশারা করে বলল,
“এখানে কিছু পাইনি।”

আদ্রিশের চোখ পড়ল বাদামী রঙের ডায়েরির দিকে। এখান থেকে একটা পাতা ছিড়েছে যেটা এখনো ওর পকেটে। আদ্রিশ রুশার পাশে বসল। তারপর ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভেবে রুশার দিকে চেয়ে বলল,
“তোমার ভাই কাকে নিয়ে ডিপ্রেসড ছিল? তোমাকে নিয়ে না শানকে?”

রুশার কপাল কুঁচকে এল।
“মানে কী? ভাইয়া আমাদের কাউকে নিয়ে ডিপ্রেসড ছিল না।”

“ছিল তো অবশ্যই। নয়তো আক্ষেপ করার কথা না। আক্ষেপ করে বলত না মানুষ করতে পারিনি।”

রুশা কিছুই বুঝতে পারছে না। উৎসুকভাবে আদ্রিশের দিকে চেয়ে আছে। আদ্রিশ ওকে বুঝতে পেরে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে দেখিয়ে বলল,
“তোমার ভাইয়ের এই ডায়েরি থেকে ছিড়েছি।”

রুশা ওর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বলল,
“তুমি আমার ভাইয়ের ডায়েরিতে কার পারমিশন নিয়ে হাত দিয়েছো? আর পাতা ছিড়েছো কেন? আমি ডায়েরির পাতা ছেড়া দেখেছি কিন্তু তুমি যে ছিড়েছো বুঝতে পারিনি।”

“পারমিশন ছাড়া হাত দেওয়ার জন্য সরি কিন্তু চুপ করে বসে থাকতে পারছিলাম না কারণ এলিগেশন তো আমার নামে আনা হয়েছে তাই। এই পাতাটা খুলে পড় আর বলো আমাকে এই লাইনগুলো লেখার কী কারণ।”

রুশা দ্রুত পাতাটা খুলল। সেখানে জেল পেন দিয়ে গুটিগুটি হাতে লেখা,
“আমি ওকে মানুষ করতে পারিনি। হয়তো আমার শিক্ষায় কমতি ছিল কিন্তু আমার ভালোবাসায় খুঁত ছিল না। আমাকে মাফ করে দিও বাবা, আমাকে মাফ করে দিও মা। আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পারিনি।”

রুশা স্তব্ধ হয়ে চেয়ে আছে লেখাগুলোর দিকে। কাকে নিয়ে এত আক্ষেপ করছে, কেন আকুতি নিয়ে মাফ চাইছে। রুশা ডায়েরি বের করে পাতাটা মেলাল। হ্যা এই ডায়েরির পাতাটা আর লেখাটাও ওর ভাইয়ের। ও তো ভাইয়ের শিক্ষায় বড় হয়েছে, ভাইয়ের সব কথা মেনে চলত, ওকে নিয়ে ভাইয়ের কোন অভিযোগ ছিল না। তাহলে?

আদ্রিশ দ্রুত প্রশ্ন ছুড়ে দিল, “তুমি? তোমাকে নিয়ে আক্ষেপ ছিল?”

রুশা ছলছল চোখে আদ্রিশের দিকে চেয়ে বলল,
“আমি ভাইয়াকে কখনো এতটা হার্ট করিনি যে আমাকে অমানুষ মনে করবে। আমার বিরুদ্ধে তার কোন অভিযোগ ছিল না। সব সময় আমাকে নিয়ে গর্ব করত।”

আদ্রিশ যা বোঝার বুঝে গেল। ও বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজতে হলে সবাইকে অপরাধীর তালিকায় রাখা উচিত। অন্তত মনে মনে।”

“কী বলতে চাইছো?”

“শানকেও সে তালিকায় স্থান দেও। সবার জন্য আইন যেমন সমান তেমনি সবার জন্য তোমার দৃষ্টি ভঙ্গি সমান রাখো।”

রুশা কটাক্ষ করে বলল,
“শান ভাইয়াকে? তুমি কি বলতে চাইছো? শান ভাইয়া এর পেছনে আছে?”

আদ্রিশ বিরক্তি নিয়ে বলল,
“তুমি অযথা রিয়েক্ট করো। আমি বলেছি ও এর পেছনে আছে? বলেছি ওকেও তালিকায় রাখতে।”

“তাই বলে শান ভাইয়া… ”

“তুমি আমাকে সময় ও সুযোগ উভয়ই দিয়েছো নিজেকে প্রমাণ করার। তাই প্লিজ কো-অপারেট। তুমি তো হ্যাকিং জানো, শানের ল্যাপটপটা হ্যাক করতে পারবে?”

“পারব কিন্তু করব না। আমি শান ভাইয়ার ল্যাপটপ কিছুতেই হ্যাংক করব না। তুমি আমাকে ব্যবহার করে তার প্রয়োজনীয় সমস্ত
ডাটা লিক করতে চাইছো।”

“শাট আপ! তুমি একটা মাথা মোটা। কী করে যে সহ্য করছি। উফফ! আমি তোমাকে বলেছি চেক করতে। তুমি ক্লো খুঁজবে। আমাকে হ্যাক করে দিতে বলিনি। এখন বলো তুমি করবে না অন্য ব্যবস্থা নেব?”

রুশা ভেবে দেখল আদ্রিশ যখন একবার বলেছে চেক করেই ছাড়বে। তারচেয়ে বরং ও নিজেই দেখুক। ভাইয়ের প্রয়োজনীয় ডাটা হ্যাক হবে না।
“ঠিক আছে আমি দেখছি।”

“গাইস, নিড টু হ্যাক এ ল্যাপটপ। আই ওয়ান্ট ইউর হেল্প।” রুশা ওর বিদেশে থাকা বন্ধুদের গ্রুপে ছোট্ট করে মেসেজ করল সাহায্য প্রাপ্তির জন্য।
রুশা ল্যাপটপ নিয়ে বসে গেছে। ঘাড় ব্যথা করছে। ডানে-বামে ঘাড় ঘুরিয়ে কফিতে চুমুক দিল। আর্দ্র ঘুমাচ্ছে। রুশার বেশ বিরক্ত লাগছে। সারাদিন ছেলের পেছনে সময় দেওয়ার পর রাতে একটু ঘুমাবে তার জো নেই। খুব ক্লান্ত লাগছে। স্ট্রং সিকিউরিটি দেওয়া তাই যথেষ্ট সময় লাগবে। রুশার রাগ লাগছে। আদ্রিশ অযথা ফালতু কাজে ওকে ফেলে দিয়েছে।

হঠাৎ করে আর্দ্র কেঁদে উঠল। আদ্রিশ ইশারা করে বলল ও দেখছে। আদ্রিশ আর্দ্রকে কোলে তুলে নিল। কিন্তু ওর কান্না থামছে না। রুশা কাজে মন বসাতে পারছে না। ছেলের কান্না উপেক্ষা করে কাজ করা কি সম্ভব। রুশা উঠে গেল। আদ্রিশের কাছ থেকে ওকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে কান্না থামাল। ওকে খাওয়াল। তারপর আবার কোলে নিয়ে পিঠে হাত রেখে হেঁটে হেঁটে ঘুম পাড়াচ্ছে। আর্দ্র ওর ঘাড়ে মাথা রেখে আলতো শব্দ করছে। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর আর্দ্রের নড়াচড়া, শব্দ না পেয়ে আদ্রিশকে ইশারায় জিজ্ঞেস করল,
“ঘুমিয়েছে?”

আদ্রিশ আর্দ্রকে দেখে মাথা নাড়িয়ে না করল। রুশা আবার হাঁটছে। এভাবে কিছুক্ষণ হাঁটার পর আদ্রিশকে আবারও জিজ্ঞেস করল ঘুমিয়েছে কি না। আদ্রিশ জানালো ঘুমিয়েছে। রুশা খুশি হয়ে ওকে শোয়াতে নিয়ে গেল। ধীরে ধীরে ওকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল যাতে না জেগে যায়। হঠাৎ করে আর্দ্রের বন্ধ চোখ খুলে গেল। পিটপিট করে চেয়ে আছে। রুশা আর্দ্রকে দেখে টাস্কি খেল। মাত্রই ঘুমিয়েছে। শুইয়ে দিতেই ঘুম উবে গেল।
“কি রে বাপ! তুই কি আমার কোলে ঘুমাতে চাইছিস? তুই ঘুমাবি আর আমি তোকে নিয়ে হাঁটব? এখন হাঁটার সময় না৷ অনেক রাত হয়েছে ঘুমাও আমার সোনা বাবুটা।”
রুশা ওর বুকে আলতো করে বারবার স্পর্শ করে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ও বড়বড় চোখ করে চেয়ে আছে।

রুশা হতাশ হয়ে বসে পড়ে বলল,
“বাপ-বেটা চুক্তি করেছিস? ঠিক করে নিয়েছিস এই মাঝরাতে আমাকে শান্তি দিবি না। আমার ভালো লাগে না। তোমার ছেলেকে তুমি দেখো। আমি পারব না।”
আদ্রিশের দিকে কাঁদোকাঁদো হয়ে চেয়ে বলল।
আদ্রিশ গিয়ে আর্দ্রের পাশে বসল। ওর হাসি পাচ্ছে রুশার অবস্থা দেখে। আদ্রিশ ছেলের সাথে খেলায় মেতে উঠল। রুশা উঠে চলে গেল নিজের কাজে।

রুশা কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ল্যাপটপের উপরে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আদ্রিশ নিজেও জেগে ছিল আর্দ্র ঘুমিয়ে যাবার পরে। রুশাকে ঘুমিয়ে পড়তে দেখে কিছু বলল না। বুঝতে পারছে ও খুব ক্লান্ত।

ঘাড়ে তরল কিছুর স্পর্শে রুশার ঘুম ভেঙে গেল। রুশা নড়ে-চড়ে মাথা তুলতে গেলে আদ্রিশ ফিসফিস করে বলল,
“হিসস! উঠো না। তোমার ঘাড় ব্যথা করছে তো ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছি। তুমি যেভাবে ছিলে সেভাবে থাকো।”

রুশার এমনিতেই ক্লান্ত লাগছে। তাই আদ্রিশের সাথে তর্ক করার মানে হয় না। রুশা মাথা নিচু করে রাখল।
আদ্রিশ ওর ঘাড়ে ওষুধ লাগিয়ে উঠে গেল।
“গিয়ে শুয়ে পড়। বাকি কাজ আগামীকাল করো।”
রুশা উঠে হাই তুলতে তুলতে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘুমে ওর চোখ ভেঙে যাচ্ছে।

সন্ধ্যা বেলা। রুশা রাগী রাগী ফেস করে আদ্রিশের দিকে চেয়ে আছে।
“কি আছে এখানে? কিছু নেই। অযথা রাতভর খাঠলাম। মাথা ধরে গেছে আমার। ছোট্ট একটা ছেলে নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকি। ব্যবসায়ীক ডাটা, পার্সোনাল কিছু ফাইল ছাড়া কিছু নেই।”

আদ্রিশ রুশার জ্বলজ্বল করা চোখের দিকে চেয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,
“ব্যাপার না। সেলফোন থেকে কিছু পাওয়া যেতে পারে।”

“কোথাও কিছু নেই। তুমি শুধু শুধু এসব করছো। নিজের দোষ ঢাকতে এসব করছো।”

“সেটা প্রমাণ করো। প্রমাণ করো শান নির্দোষ আমি দোষী।”
রুশার মনে জেদ চেপে বসল। ও শানকে নির্দোষ প্রমাণ করবে। আদ্রিশের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিবে কে অপরাধী।
রুশা হনহন করে হেঁটে চলে গেল।

শান আজ দীর্ঘদিন পরে দেশে ফিরেছে। রুশা ভাবছে ওর সাথে দেখা করতে যাবে। মোবাইলে নিজেদের সমস্যা মিটিয়ে নিলেও সামনা-সামনি সেই ঘটনার পর আর দেখা হয়নি।
রুশার আসার খবর শুনে শান বেডরুম থেকে ড্রয়িংরুমে এসে উপস্থিত হয়। রুশা ভাইয়ের দিকে কিছুক্ষণ অপলক নয়নে চেয়ে রইল। শানের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটেছে ওকে দেখে। চেহারায় ম্যাচিয়ুর ভাব এসেছে। গালে বড়বড় দাঁড়ি। আগের চেয়ে শুকিয়ে গেছে। বুঝাই যাচ্ছে অনেক প্রেসার যাচ্ছে ওর উপর।
“ভাইয়া, নিজের কী অবস্থা করেছো?”

“খুব প্রেসারে আছি পিউ। আগে তো ভাইয়া আর আমি মিলে সব সামাল দিতাম কিন্তু এখন একাই আমাকে সব করতে হয়। ভেবেছিলাম সব সহজ। এখন বুঝতে পারছি এত সম্পত্তি আর ব্যবসায় সামলানো কত কষ্ট। ভাইয়া ঠিকই বলতো দেখতে যতটা সহজ, বাস্তবিক অর্থে তা নয়। লন্ডনে ছিলাম দুই মাস। এখন এসেও কাজ। আর ভালো লাগে না।”

রুশা টি টেবিলের উপরে ব্যাগ রেখে বলল,
“তুমি বসো, আমি কফি করে আনছি।”

রুশা রান্নাঘরে চলে গেল। শান ল্যাপটপ খুলে বসল। কিছুক্ষণ পরে দুই মগ কফি নিয়ে ফিরল। শান কফি খেতে খেতে বলল,
“তোর ছেলের কী খবর?”

“ভালো। ওকে তো এখনো দেখলে না। ও একা আদ্রিশের না আমারও ছেলে।”

“জানি কিন্তু মন মানে না। আদ্রিশকে আমার সহ্য হয় না। আমি ওর ধ্বংস দেখতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার বোন তো নিজের ধ্বংস ডেকে এনেছে।”

“ভাইয়া, ওসব বাদ দেও৷ আর্দ্র আমার সব৷ ওর জন্য জীবনটা এখনো এত সুন্দর। এখনো বাঁচতে ইচ্ছে করে। ওকে নিয়ে আসতাম কিন্তু তোমার যদি ভালো না লাগে তাই বাচ্চা ছেলেটাকে রেখে এসেছি। ওর একটু খোঁজ নেই। কল করে দেখি কাঁদছে কি না।”

রুশা ব্যাগটা হাতে নিয়ে মোবাইল খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছে না। সব জায়গায় খুঁজে নিজে নিজে বলছে,
“মোবাইল কোথায় গেল? আমি তো নিয়ে এসেছিলাম।’

শান ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে ওর দিকে চেয়ে বলল,
” কী হয়েছে?”

“মোবাইল পাচ্ছি না।”

“ভালো করে খুঁজে দেখ। বাড়িতে রেখে আসিস নি তো?”

রুশা পুরো ব্যাগ খুঁজে অসহায় মুখ করে বলল,
“নেই৷ কোথায় গেল বুঝতে পারছি না। তোমার মোবাইলটা দিবে একটা কল করব।”

শান মোবাইলের লক খুলে রুশার হাতে নিল। রুশা মোবাইল নিয়ে নাম্বার ডায়েল করে ওঠে গেল। শান আবার ল্যাপটপে মনোযোগ দিল। রুশা কিছুটা দূরে সরে শানের দিকে তাকাল। ও নিজের কাজে ব্যস্ত। রুশাও দ্রুত নিজের কাজ করতে লাগল। কাজ শেষ করে শানের মোবাইল দিয়ে ব্যাগ নিয়ে বলল,
“আর্দ্র কাঁদছে। আমি অন্যদিন আসব৷ আজকে যাচ্ছি।”

“আচ্ছা আসিস।”

রুশা বাড়িতে গিয়ে দ্রুত ল্যাপটপ খুলে বসল। ঘন্টার পর ঘন্টা সময় ব্যয় করে শানের সমস্ত এক্টিভিটি, ফাইল চেক করল। হঠাৎ রুশার চোখ আঁটকে যায়। তারপর বেশি সময় ব্যয় না করে দ্রুত পড়তে লাগল। ওর বুকটা কেঁপে উঠল। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। নড়তে পারছে না। হাত পা জমে যাচ্ছে। শরীর অসার হয়ে আসছে৷

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here