লাভ_গেম পর্ব 30

0
1433

#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন

৩০.

দুদিন যাবৎ হাসপাতাল থেকে ফিরেছে রুশা। কিন্তু এখনো ঠিকমতো সুস্থ হয়নি। সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকে। শুধু ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় বিছানা থেকে নামে। আদ্রিশ ওর তত্ত্বাবধানের জন্য একজন নার্স রেখে দিয়েছে। ও যতটুকু না অসুস্থ তার চেয়ে আদ্রিশ ওকে বেশি অসুস্থ বানিয়ে দিয়েছে।
বেবি সারাক্ষণ আদ্রিশ, সেজান, কথা আর মিজান চাচার কাছে থাকে। ওরাই ওর দেখভাল করে। সারাক্ষণ ওদের কোলে কোলে থাকে। খাওয়ার সময় শুধু রুশার কাছে দেয়। রুশা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বেবির কিছুই ওকে করতে দিবে না আদ্রিশ। ও কিছুদিনের জন্য অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আদ্রিশ ছেলেকে যত দেখে ততই অদ্ভুত অনুভূতি হয়। একটা মায়া আচ্ছন্ন করে রাখে। সন্তান আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত। আদ্রিশ জানতো ও ওর বাচ্চাদের খুব ভালো বাসবে কিন্তু এতটা ভালো বাসবে জানা ছিল না। চোখের আড়াল হতে দিতে ইচ্ছে করে না। আদ্রিশ কিছুদিন আগেও ভাবতো রুশার চেয়ে বেশি কাউকে ভালো বাসতে পারবে না কিন্তু এখন মনে হয় এই ছেলের চেয়ে বড় কেউ নেই, কিছু নেই, ওর জন্য সব পারবে। ছেলে যখন কাঁদে মনে হয় ওর কলিজাটা কেউ কেটে ফেলছে। দিনে কম করে একশো চুমু দেয় ওর গালে, চোখে, কপালে, নাকে। সেজান হিসেব রাখে আর হাসাহাসি করে। আদ্রিশ তখন ওর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায়।
রুশা ছেলেকে খাইয়ে কপালে চুমু দিলেই কথা বলল,
“আপু, ওর নাম চুমু কুমার রেখে দেও। যে হারে তুমি আর ভাইয়া ওকে চুমু দিচ্ছো তাতে ওর আসল নাম হারিয়ে যাবে। নাম হবে চুমু কুমার। যখন কলেজে যাবে মেয়েরা পেছনে লাইন মারবে আর ডাকবে ওগো আমার চুমু কুমার!”

রুশা ওর কথা শুনে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। আদ্রিশ ওর হাসির মাঝে ঘরে ঢুকে। ছেলে হাত পা নাড়াচ্ছে। বড় বড় চোখ করে চেয়ে আছে। গভীর ভাবে মাথার উপরের ছাদটা দেখছে। আদ্রিশ ওর কাছে এসে কপালে চুমু দিয়ে বলল,
“আমার বাবাটা কী করে?”

কথা রুশার দিকে তাকাল। রুশা আবারও হাসতে লাগল। কথা সামনের ডাবল সোফায় বসে ছিল। বসা থেকে উঠে বলল,
“লে, প্রতি লাইনে একটা করে চুমু। আমি তোমাদের চুমু দেখতে দেখতে ক্লান্ত। না জানি বাচ্চা ছেলেটার কী অবস্থা। আমি শিওর, ও না পারছে বলতে আর না পারছে সইতে।”

কথা বিরবির করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আদ্রিশ কথার যাওয়ার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। ওর মাথায় কিছুই ঢুকল না। রুশার হাসি থামছে না।

আদ্রিশ রুশাকে হাসতে দেখে দিল এক ধমক।
“এত হাসছো কেন? অপারেশনের জায়গায় টান পড়ছে না? হাসি থামাও। নয়তো এক মাসের জন্য হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে আসব।”

রুশা হাসি থামিয়ে দিল। ওর অপারেশনের জায়গায় আসলেই একটু ব্যথা করছে। রুশা ঠিক করে শুয়ে পড়ল। আদ্রিশ ওর কুঁচকানো
মুখ দেখে কিছু বুঝল। তারপর বিছানার অপর পাশে গিয়ে বসল। রুশাকে কিছু না বলেই ওর জামায় হাত দিল। রুশা চোখ বড়বড় করে বলল,
“কী!”

আদ্রিশ ওর কথার উত্তর না দিয়ে জামা তুলে পেট দেখল। এখনো ঘা শুকায়নি। আদ্রিশ ওর ঘায়ের স্থান দেখে চমকে উঠে। কত বিভৎস ভাবে মানুষ মেরেছে। কখনও ভয় লাগেনি। রুশা জামা নামিয়ে ফেলল।
“এখনো শুকাচ্ছে না কেন? আর কতদিন লাগবে?”

রুশা মিনমিন করে বলল,
“একটু সময় লাগবে। আমার জন্য তোমাকে এত ভাবতে হবে না।”

আদ্রিশ বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি আমার ছেলের জন্য ভাবছি। ওকে তো এখনো কোলে নিয়ে হাঁটলে না।”

“তাতে কী? ওকে কোলে নেওয়ার মানুষের অভাব আছে? তাছাড়া আমাকে বিছানা থেকে নামতে দিলেই হয়। আমি ঢের ওকে কোলে নিয়ে হাঁটতে পারব।”

“পায়ের পাতা মেঝেতে রাখতে পারো না। হাঁটবে কী করে? ভালো করে খেয়ে দেয়ে শরীরের দূর্বলতা কমাও। তারপর নাহয় বড় বড় কথা বলবে।”

আদ্রিশ ছেলের দিকে একবার চেয়ে ঘর থেকে চলে গেল। রুশা বিরবির করে বলছে,
“মুখে স্বীকার করবে না। মুখে স্বীকার করলে ইগোর কম পড়ে যাবে না।”

.

কেটে গেছে দুই মাস। রুশা এখন পুরোপুরি সুস্থ। ওর ঘরে শিফট হয়ে গেছে। ছেলের নাম রেখেছে রওনক আফসান আর্দ্র। আদ্রিশ মনে করে ওদের ছেলে ওদের ঘরে রওনক নিয়ে এসেছে। রুশা আর ওকে একসাথে করেছে। তাই ওর নাম রওনক আফসান রেখেছে৷ আর রুশা আদ্রিশের নাম মিলিয়ে রেখেছে আর্দ্র। আর্দ্র ঘুমাচ্ছে। রুশা আর্দ্রের ছোট ছোট জামাগুলো ভাজ করছে। আদ্রিশ অফিসের কাজ করছে। ছেলের অজুহাতে এই ঘরেই থাকে। দীর্ঘদিন অফিসে যাওয়া হয় না। সেজান সব দেখাশোনা করে। আদ্রিশ ঘরে বসে অফিসের তদারকি যতটুকু সম্ভব করছে।
কথা এখন এখানেই থাকে। রুশা ওকে রেখে দিয়েছে। আশ্রমে অন্য শিক্ষিকার ব্যবস্থা করেছে। কথা আবার পড়াশোনা শুরু করেছে। ইউনিভার্সিটিতে যায়। ওদের ঘরের দরজা খোলাই ছিল। কথা দরজায় টোকা দেয়। কিছুক্ষণ আগে ভার্সিটি থেকে ফিরেছে। পুরোটা দিন আর্দ্রকে কোলে নেয়নি। তাই ফ্রেশ হয়েই চলে এসেছে ওকে দেখতে।

রুশা মুচকি হেসে ওর দিকে চেয়ে বলল,
“খালা মনির আর্দ্র ঘুমাচ্ছে। খালা মনি ভার্সিটি থেকে এসেছে এখন একটু রেস্ট নিক।”

কথা দরজায় হাত রেখে বলল,
“ও উঠলে আমাকে ডাকবে কিন্তু।”

“আচ্ছা, ডাকব। মাত্র ঘুমিয়েছে। এখুনি উঠবে না নিশ্চিত থাকো।”

কথা মন খারাপ করে ঘুরে চলে যেতে নেয় তখনই আর্দ্র উঠে যায়৷ চোখ মেলে চারপাশ দেখছে। চারপাশে দেখে যখন পরিচিত কোনো মুখ দেখতে পেল না তখন কান্না শুরু করে দিল। ওর এই অভ্যাস। ঘুম ভাঙার পর চারদিক দেখবে তারপর কাঁদতে শুরু করবে।
ওর কান্নার শব্দ শুনে কথা হেসে ফেলল। তারপর ঘুরেই দৌঁড়ে রুশা কোলে নেওয়ার আগেই কোলে নিয়ে নিল। কোলে নিয়ে কান্না থামাচ্ছে।

রুশা মুচকি হেসে বলল,
“তোমার কোলে যাওয়ার জন্যই উঠেছে, খালা মনি যে এসেছে সেটা স্বপ্নে পেয়েছে।”
রুশা বলেই খিলখিল করে হাসতে লাগল। কথা সেসব পাত্তা না দিয়ে আর্দ্রকে আদর করছে। নানান কথা বলছে। আদ্রিশ এক পলক দেখে আবার কাজে মনোযোগ দিল। কিছুক্ষণ পরে সেজান এসে হাজির। ওকে দরজার সামনে দেখে রুশা ভেতরে আসতে বলল। কথা এক পলক সেজানকে দেখল। তারপর আবার আর্দ্রের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত।

সেজান আড়চোখে একবার কথার দিকে চেয়ে রুশাকে বলল,
“ভাবি, আর্দ্রকে আমার কোলে দিতে বলো। গতকাল থেকে ওকে কোলে নেই নি। দেখিও নি।”

কথা জবাব দিল,
“লাইনে থাকুন। আমি আজকে সারাদিন ওকে কোলে নেইনি। মাত্র নিলাম। আমার মন ভরে গেলে আপনি আসবেন।”

“তুমি তো নিয়েছো। আমি গতকাল থেকে ওকে নেইনি। এমনকি দেখিনি।”

“আমি এতকিছু জানি না। আমি দেব না ওকে।”

“দেব না মানে কী? ভাবি কিছু বলেন। আর্দ্র কী ওর বাচ্চা? আমার ভাইয়ের ছেলে আমি নেব। ওকে বিয়ে করে নিজের বাচ্চা নিয়ে বসে থাকতে বলুন।”

কথা রেগেমেগে আর্দ্রকে দিয়ে দিল সেজানের কাছে। তারপর গাল ফুলিয়ে রুশাকে বলল,
“আপু, তুমি না আমার জন্য ছেলে দেখেছিলে সে কি বিয়ে করে ফেলেছে? যদি করে ফেলে তাহলে অন্য ছেলে দেখো। আমি বিয়ে করব। আমার বাচ্চা চাই। তারপর নিজের বাচ্চা সারাদিন কোলে নিয়ে থাকব। কেউ এত কথা শোনাতে পারবে না। কোল থেকেও নিতে পারবে না।”

রুশা বিছানায় বসে পায়ের উপর পা তুলে বলল,
“যদি সেজান ভাইয়ের সাথে বিয়ে দেই? না সেজান ভাইয়ের সাথে বিয়ে দেওয়া যাবে না। তাহলে দু’জন বাচ্চা নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে দিবে। তার থেকে অন্য ছেলে দেখি। কি বলেন সেজান ভাই?”

সেজান আদ্রিশের সামনে এসব বলায় কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ল। গলা খাকাড়ি দিয়ে আমতা আমতা করে বলল,
“আমি কী জানি।”
আদ্রিশের কেমন উদ্ভট লাগছে সবকিছু। এছাড়া মনে হচ্ছে কিছু একটা চলছে যা ও জানে না। সেজানের ভরকে যাওয়া মুখ, রুশার মুখ টিপে হাসা, কথার লজ্জা পাওয়া। কথা লজ্জা পেয়ে ঘর থেকে চলে গেল। সেজানও আর্দ্রকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে চলে গেল।

আদ্রিশ উৎসুকভাবে রুশার দিকে চেয়ে আছে। রুশা ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
“কী?”

“কী চলছে?”

“আমি কী জানি।”
রুশাও ঘর থেকে চলে গেল। আদ্রিশের মাথায় কিছু একটা ঘুরছে। কিন্তু বুঝতে পারছে না।

.

গভীর রাত। রুশা আর্দ্রের উপর হাত রেখে ঘুমাচ্ছে। কাজ শেষ করে আদ্রিশ ঘুমাতে এসেছে। চোখ পড়ল রুশার দিকে। অদ্ভুত মায়াবী লাগছে। ওকে ছুয়ে দেওয়ার লোভ জাগল মনে। আদ্রিশ নিজের অজান্তেই রুশার কাছে চলে গেল। রুশার ঘুমন্ত মুখ দেখে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল। ওর গালে কিস করল। রুশা সাথে সাথে চোখ মেলল। আদ্রিশ হকচকিয়ে গেল। ও জানে রুশার ঘুম পাতলা তবুও এমন একটা ভুল করে ফেলল। সরে যেতে গেলেই রুশা ওর কলার চেপে ধরল। এতে দু’জন আরো কাছাকাছি চলে এল। দু’জনের উষ্ণ নিশ্বাস একে অপরের উপর পড়ছে।

রুশা দাঁত খিচিয়ে বলল,
“কী চলছে এসব? তুমি এখানে কেন?”

আদ্রিশ নিজের কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করল।
“ছেলে জেগে যাবে।”

“জেগে যাক। তুমি এখানে কেন? আমার গালে কিস করলে কেন?”

আদ্রিশ থমথমে মুখে বলল,
“করেছি তো কী হয়েছে? নিজের বউকেই করেছি। অন্য কেউ নয়।”

“কীসের বউ? এখানে আনার পর তো বলেছিলে সম্পর্ক সব শেষ। তাহলে এখন কীসের বউ আমি?”

“জানি না আমি। তোমাকে ঘৃণা করার কথা হলেও ঘৃণা করতে পারি না। কি করব আমি?”

রুশা আদ্রিশের কলার ছেড়ে দিল। ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে চেয়ে আছে। আদ্রিশ আচমকা রুশাকে জড়িয়ে ধরল। রুশা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল না। ফিসফিস করে বলল,
“তুমি সব সময় আমাকে ভালো বেসে এসেছো। ইনফ্যাক্ট এখনো বাসো। কিন্তু তুমি আমার ভালোবাসার যোগ্য তো? তুমি আমার অনেক ক্ষতি করেছো। ওসব নাহয় বাদ দিলাম তুমি আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলেছো। এমনকি নিজের বাচ্চাকেও….।”
রুশার গলা ধরে আসছে৷ আদ্রিশ ওকে ছেড়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।

কথা ছাদে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছে। সেজান ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। কথা গুনগুন করছে। ওর খোলা চুল এলোমেলো হয়ে উড়ছে। কথা কারো অস্তিত্ব অনুভব করে ভয় পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল। সেজানকে দেখে ভয়টা কমে গেলেও বুকটা ধুকপুক করছে। ভেবেছিল কে না কে।
সেজান ওর ভয়ার্ত মুখটা না দেখেই বলল,
” কি করছো এখানে এত রাতে?”

“কিছু না। এমনি এসেছিলাম। গুড নাইট।”
কথা ওকে পাস কাটিয়ে চলে গেল। সেজান ওকে পেছনে থেকে দাঁড়াতে বলছে। কথা দাঁড়াচ্ছে না। ছাদ থেকে নেমে বিরক্তি নিয়ে কথা বলল,
“কী চাই আপনার? বিরক্ত লাগছে।”

“কথা, তুমি এভাবে আমাকে এভয়েড করো কেন? আমার কথা তো শোনো। আমি জানি তুমি আমার উপর রেগে আছো। কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম।”

“আমি আপনার উপর কেন রাগ করব? এসব আপনার ভুল ধারণা। আমার ঘুম পেয়েছে। পেছনে পেছনে আসবেন না। রাতের বেলায় পেছনে আসতে পারেন অথচ দিনের বেলায় চিনেনই না। বহুরূপী লোক।”
কথা রাগ দেখিয়ে চলে গেল। সেজান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হতাশ হয়ে নিজের ঘরে যাবে তখনই আদ্রিশকে দেখতে পেল। আদ্রিশকে দেখে আমতা আমতা করছে। সেজান বুঝতে পারছে না আদ্রিশ কতটুকু শুনেছে আর কি বুঝেছে।
“ভাই, আপনি?”

আদ্রিশ উত্তরে বলল,
“তাহলে এই ব্যাপার?”

সেজান মাথা নিচু করে নিল।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here