লাভ গেম পর্ব-২৯

0
907

#লাভ_গেম(বেবি স্পেশাল)
#ফাবিহা_নওশীন

২৯.

সকাল থেকেই রুশার শরীর মেজমেজ করছে। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। থেমে থেমে পেটে ব্যথা হচ্ছে। কথা আশ্রম যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। আশ্রমে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। আজ যেতেই হবে। কথা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কানে দুল পরতে পরতে বলল,
“আপু, কোন কিছু প্রয়োজন হলে কাউকে ডেকো। আমি সবাইকে বলে যাব তোমার দিকে খেয়াল রাখতে। পানি আর মোবাইল হাতের কাছে রেখেছি। একা একা উঠে কোথাও যাবে না। আগামীকাল তোমার ডেট।এই একটা দিন সাবধানে থাকবা। আমি যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি চলে আসব।”

রুশা আধশোয়া হয়ে মুচকি হেসে বলল,
“কথা, এত চিন্তা করো না। তুমি যাও। কাজ শেষ করে আসবে। তাড়াহুড়োর প্রয়োজন নেই।”
কথা বিছানার উপরে থেকে লেডিস্ ব্যাগটা হাতে নিয়ে রুশার দিকে মুচকি হেসে বিদায় নিল।
ও যেতেই রুশার মলিন মুখে পেটে হাত রাখল। ও বুঝতে পারছে না ওর এমন লাগছে কেন। তারপর আবার শুয়ে পড়ল। ঘন্টাখানেক পরে ব্যথাটা চাড়া দিয়ে উঠল। আজগুবি চিন্তাভাবনা মাথায় প্রবেশ করতেই খিঁচুনি উঠে যাচ্ছে। শ্বাস নিতে পারছে না। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। রুশা বেড সাইড টেবিল থেকে পানি নিয়ে খেল। তারপর আবার শুয়ে পড়ল। কিন্তু এখন ব্যথায় নড়তে পারছে না। হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নেওয়ার চেষ্টা করছে। কাউকে ডাকবে মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। শুধু জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। মোবাইলটা ধরতে পারছে না আর না কেউ এই ঘরে আসছে। রুশা মাথা উঁচু করে দরজার দিকে তাকাল। ওর মনে হচ্ছে এই ঘরে কখনো কেউ আসবে না আর ওর অবস্থা জানবে না। রুশার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। মোবাইলটা আঙুলের স্পর্শ পেয়েছে। রুশা আরেকটু চেষ্টা করছে। নিজেকে বোঝাচ্ছে আর সাহস জোগাচ্ছে ওকে পারতেই হবে। কিন্তু সে আশাও নিভে গেল। হাতের স্পর্শ পেয়ে মোবাইলটা নিচে পড়ে গেল। রুশার অসহায়ত্ব আরো বেড়ে গেল। ও ব্যথায় ছটফট করছে আর কাঁদছে। তারপর মাথায় আসলো পানির গ্লাসটা নিচে ফেলতে হবে। রুশা আবারও নিজেকে সামলালো। সাহস জুগিয়ে আরেকটু চেষ্টা করছে।

আদ্রিশ অফিসের জন্য বের হচ্ছে। কিছু পড়ার শব্দে স্থির হয়ে দাঁড়াল। তারপর ভাবল রুশা হয়তো রাগ করে কিছু ছুড়াছুড়ি করছে। ওর অফিসের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে তাই আর সেদিকে যাওয়ার কথা ভাবল না। তারপর দেখা যাবে দু’জনের মধ্যে ঝগড়া লেগে যাবে।
আদ্রিশ তাই কোট হাতে অফিসের জন্য বের হয়ে গেল। রুশা ছটফট করছে আর কাঁদছে। মৃদুস্বরে বিরবির করছে। বিরবির করে কিছু বলছে। গোঙ্গানি দিচ্ছে। কপাল বেয়ে চিকন ঘামের রেখা ফুটে উঠেছে।
আদ্রিশ কি মনে করে আবার ফিরে এল। রুশাকে দেখার জন্য ওর ঘরের দরজার সামনে এলো। দরজা ভেড়ানো ছিল। আদ্রিশ দরজায় টোকা দিতে চেয়েও দেয় না। আস্তে আস্তে দরজা খুলে। দরজা খুলতেই ওর চোখ যায় বিছানার দিকে। যেখানে রুশা হাত পা নাড়িয়ে ছটফট করছে। আদ্রিশ হাতের কোট ফেলে রুশার কাছে দৌঁড়ে যায়। আতংকিত হয়ে ওর দিকে তাকাল। আদ্রিশকে দেখে রুশার প্রাণ ফিরে এল। আদ্রিশ রুশার হাতের তালুতে হাত ঘঁষছে।
বিচলিত, ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
“কী হয়েছে তোমার এমন করছো কেন?”

রুশা বিরবির করে বলল,
“আদ্রিশ…!”

“হ্যা, হ্যা, বলো আমি শুনছি। বলো কী বলবে? কী হয়েছে তোমার?”

“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি শ্বাস নিতে পারছি না। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চলো।”

আদ্রিশ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। কী করবে বুঝতে পারছে না। রুশার অবস্থা ওকে নার্ভাস করে দিয়েছে। চেঁচিয়ে সবাইকে ডাকছে আর রুশার চোখের পানি মুছে দিচ্ছে। রুশাকে পাজা কোলে নিয়ে বলল,
“আমি আছি কিছু হবে না তোমার। আমরা এখুনি হাসপাতালে যাব।”

আদ্রিশ রুশাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হতেই কাজের লোকেরা দৌঁড়াতে শুরু করল। গাড়ির দরজা খুলে দিল। ওর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গাড়িতে তুলে দিল। রুশার খিঁচুনি বেড়ে যাচ্ছে। রুশার অবস্থা দেখে আদ্রিশের নিজেকে অসহায় লাগছে। হাসপাতালে কল করল। সব কিছু ব্যবস্থা করে রাখল। যাতে রুশাকে নেওয়ার সাথে সাথে চিকিৎসা শুরু করে দেয়। আদ্রিশ রুশাকে আগলে রেখেছে নিজের সাথে। রুশা আদ্রিশের একটা হাত নিজের হাতে চেপে ধরেছে। ওর চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
“রুশা, আরেকটু কষ্ট করো। আমরা চলে এসেছি। বিশ্বাস করো তোমার এই অবস্থা আমি দেখতে পারছি না। আমি সহ্য করতে পারছি না।”
আদ্রিশ আঙুল দিয়ে চোখের কোনের পানি মুছল যা রুশার চোখে পড়েনি।

হাসপাতালে রুশাকে নিতেই ট্রিটমেন্ট শুরু হয়ে গেল। সেজান আর কথাও চলে এসেছে। কথার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। তাই এসে থেকে মাথা নিচু করে রেখেছে। ডাক্তার বের হয়ে এসেছে। আদ্রিশের কাছে এসে বলল,
“পেসেন্টের অবস্থা ভালো না। খিঁচ উঠছে বারবার।”

আদ্রিশ ডাক্তারের কলার চেপে ধরে চেঁচিয়ে বলল,
“ভালো না মানে কী? ওর এখানেই চেকাপ হয়েছে। সব সময় তো বলে এসেছেন সব নর্মাল আর এখন বলছেন ভালো না। কেন?”

সেজান ওকে ছাড়িয়ে নিল। ডাক্তারকে বলল,
“আমার স্ত্রীর কিছু হলে হাসপাতাল জ্বালিয়ে দেব। এতদিন সব ঠিক ঠিক বলে ভুল চিকিৎসা দিয়েছে এরা। এদের আমি ছাড়ব না। ”

ডাক্তার ঘাবড়ে যাওয়া কন্ঠে বলল,
“আসলে স্যার, মেম কোন ট্রমার মধ্যে চলে গেছেন। বিরবির করে বলছেন আমার বাচ্চা কাউকে দেব না। কেউ নিতে পারবে না। মনে হচ্ছে মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত। উনার মনে কোন ঘটনা বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। আমরা ওটিতে নিয়ে যাচ্ছি।”
কথা আর সেজান দুজনেই আদ্রিশের দিকে তাকাল। ওদের তিনজনের কারো বুঝতে বাকি নেই ঘটনাটা।

কথা আমতা আমতা করে বলল,
“আপু কয়েকদিন ধরে অনেক ডিস্টার্ব ছিল। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারত না। তার মনে একটা ভয় জেঁকে বসেছিল আপনি তার বাচ্চাকে যদি ছিনিয়ে নেন। আমি অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু রুশা আপু তো মা। আর মায়ের মনে সব সময় সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তা লেগেই থাকে। রুশা আপুর ক্ষেত্রেও তাই।”

আদ্রিশ জানে ওকে কি করতে হবে। ওটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেজান আর কথা একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে আদ্রিশকে অনুসরণ করল। আদ্রিশ জোর করে ওটির ভেতরে ঢুকে গেল। ডাক্তার, নার্স অপারেশনের ব্যবস্থা করছে৷ আদ্রিশকে দেখে তারা রেগে গেলেন এভাবে ওটিতে প্রবেশ করার জন্য। আদ্রিশ কাউকে পরোয়া না করে কোন বাঁধা না মেনে রুশার কাছে চলে গেল। ওর গালে হাত রেখে কানের কাছে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
“রুশা, আমাকে শুনতে পাচ্ছো? আমি আদ্রিশ। আমি জানি তুমি আমাকে শুনতে
পাচ্ছো। তোমার বেবি তোমারই থাকবে। ওকে কেউ কেড়ে নিবে না। সব সময় তোমার সাথে থাকবে। আমি চাই তুমি আর আমাদের বেবি সুস্থ ভাবে আমার বাড়িতে প্রবেশ করো। আর কিছু চাই না আমি। তোমার বেবি তোমার সাথে থাকবে আমি প্রমিস করছি। একটু শান্ত হও। আর আমি প্রমিস করলে সেই প্রমিস রাখি তুমি জানো।”

রুশা বন্ধ চোখে ঠোঁট নাড়াচ্ছে। আদ্রিশ উঠে দাঁড়াল। রুশার দিকে আরেকবার তাকাল।

কথা একটা বেঞ্চির উপর বসে আছে। অপেক্ষা করছে বেবির জন্য। অপেক্ষা করছে কখন শুনবে বেবি আর রুশা দুজনেই ভালো আছে। ওর মাথাটা ধরে আছে। কিছুক্ষণ পর পর চোখ মুখ কুকঁড়াচ্ছে। সেজান ওয়ান টাইম গ্লাসে কফি এনে ওর সামনে ধরল। কথা মাথা তুলে স্বাভাবিকভাবেই বলল,
“আমি কফি খাব না সেজান ভাই। ধন্যবাদ।”
তারপর আবার দু-হাত গালে দিয়ে মাথা নিচু করে রইল। সেজান কি করবে বুঝতে পারছে না। কথা ওকে এভাবে ইগ্নোর করছে ওর ভালো লাগছে না। এটা হাসপাতাল আর রুশার এই অবস্থা তাই চুপ করে আছে নয়তো কথাকে দুটো কড়া কথা শুনিয়ে দিত। ওটি থেকে তোয়ালে পেঁচিয়ে একজন নার্স বের হয়ে এল। কথা দৌঁড়ে গিয়ে বাবুকে কোলে তুলে নিল।

নার্স মুচকি হেসে বলল,
“কংগ্রাচুলেশন! আপনার ছেলে হয়েছে। মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর।”

সেজান আর কথা বেবিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও আদ্রিশ বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করল,
“আমার স্ত্রী?”

“উনি ঘুমাচ্ছেন। ডাক্তারের সাথে উনার বিষয়ে কথা বলে নিবেন। উনি অনেক দূর্বল। শরীরের কন্ডিশন ভালো না। আমি আসছি।”

“আমি ওকে একটু দেখতে পারি?”

“জি অবশ্যই।”

আদ্রিশ, কথা আর সেজানের দিকে চেয়ে বলল,
“আমার ছেলেকে দেখো। আমি রুশাকে একটু দেখে আসি।”

তারপর জবারের অপেক্ষা না করে আদ্রিশ রুশার সাথে দেখা করতে চলে গেল। রুশা ঘুমাচ্ছে। ধীরে ধীরে আদ্রিশ রুশার কাছে এগিয়ে গেল। ওর কপালে ঠোঁট ছুইয়ে বলল,
“এত বড় লড়াইতে যখন জিতে ফিরেছো তখন তুমি এক তুড়িতে সুস্থ হয়ে যাবে। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আমার ঘরে রওনক আনার জন্য। আমাদের ছেলেটা নাকি অনেক সুন্দর হয়েছে। এই দেখেছো ওকে তো এখনো দেখিই নি। আমি ওকে দেখে আসি। তুমি তাড়াতাড়ি জেগে যাও।”

আদ্রিশ রুশার গালে হাত ছুইয়ে উঠে দাঁড়াল। গন্তব্য সদ্য জন্ম নেওয়া ছেলেকে ছুয়ে দেখার। আদ্রিশ অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছে ছেলেকে কোলে নেওয়ার। এত সুন্দর রাজপুত্রকে দেখে ওর চোখে পানি এসে পড়েছে। কোলে নেওয়ার লোভ জেগেছে৷ কিন্তু ওকে কোলেই নিতে পারছে না। ওর ভয় লাগছে। কোলে নিলে যদি ব্যথা পায়। কথা বারবার হেসে কুটিকুটি হচ্ছে আর সেজানের ধমক খাচ্ছে।

রুশাকে বেডে সিফট করা হয়েছে। শুয়ে শুয়ে আদ্রিশকে দেখছে। বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আহ্লাদী কন্ঠে কি যেন বলছে। রুশা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কথা ওকে দেখতে ভেতরে এলে রুশা বলল,
“আদ্রিশের আমাকে নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। একবার দেখতেও এলো না।”

কথা অবাক হয়ে বলল,
“কি যে বলো আপু। আদ্রিশ ভাইয়া বাচ্চাকে দেখার আগে, কোলে নেওয়ার আগে তোমার কন্ডিশন জিজ্ঞেস করেছে। তোমার সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে তোমাকে দেখে গেছেন। ডাক্তারের সাথে তোমার শারীরের অবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন। আমাকেও এখন এখানে পাঠালো তোমাকে দেখতে। ডাক্তার যখন বলেছে তোমার শরীরের কন্ডিশন ভালো না, তার কলার চেপে ধরেছে। অপারেশনের পুরোটা সময় অস্থির অস্থির করেছে। আর মাত্রই ছেলেকে কোলে নিল। জানো ভাইয়া কি বলে তার বাচ্চাকে কোলে নিতে ভয় লাগে,এত নরম শরীর উনার শক্ত হাতের স্পর্শে যদি ব্যথা পায়। কত সেন্সেটিভ দেখেছো? ছেলেকে খুব আদরে রাখবেন ভাইয়া। ভাইয়া তোমাকে খুব ভালোবাসে আপু।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here