লাভ গেম পর্ব-২

0
2001

#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন

২.

রুশা হুড়মুড় করে আদ্রিশের কক্ষে ঢুকে পড়ে। আদ্রিশ ম্যানেজারের সাথে গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং সেড়ে ফাইলপত্রে সাইন করছিল। রুশাকে দেখে আদ্রিশ অবাক হয়ে চেয়ে আছে। রুশাকে অস্বাভাবিক লাগছে।
রুশার পেছনে পেছনে একটা লোক এসে আদ্রিশের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাল।
“স্যার, আমি উনাকে অনেক বার নিষেধ করেছি। বলেছি মিটিং চলছে। কিন্তু উনি শুনেন নি। এখানে আমার কোনো দোষ নেই।”

রুশা আমতা আমতা করে বলল,
“সরি স্যার, আমি জোর করেই ঢুকে পড়েছি। এছাড়া আমার উপায় ছিল না।”

আদ্রিশ রুশার পেছনের লোকটাকে হাত দিয়ে ইশারা করে চলে যেতে বলল। ম্যানেজার ফাইল নিয়ে আদ্রিশের দিকে তাকাল। তারপর আবার রুশার দিকে তাকাল।
“মাইনুল সাহেব আপনার কাজ শেষ। ইউ কেন গো নাও।”

মাইনুল সাহেব থতমত খেয়ে গেল।
“জি স্যার।”

মাইনুল সাহেব চলে যেতেই আদ্রিশ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। রুশার দিকে এগিয়ে আসছে। রুশার ভয়ার্ত চেহারা, কাঁপা কাঁপা ঠোঁট, বারে বারে কানের পেছনে চুল গুজে দেওয়া সবটা দেখায় মত্ত ছিল আদ্রিশ। রুশা ভয়ে ভয়ে দু’পা পিছিয়ে যায়।
“কি বলছিলে?”

“স্যার, আমার নাম রুশা। আমি গতকাল জয়েন করেছি। আমি অফিসের ক্যান্টিনে যাচ্ছিলাম তখন বারান্দায় একটা লোককে মোবাইলে কথা বলতে শুনি। আসলে কাকে বলব, কি বলব বুঝতে পারছিলাম না তাই এখানে চলে এসেছি।”

“কি এমন বলতে শুনলে?”

“স্যার, উনি কোম্পানির ইনফরমেশন পাচার করছিলেন। কীসব তথ্য দিচ্ছিল। আমি নতুন তাই বুঝতে পারিনি। তবে এটুকু বুঝেছি তিনি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিচ্ছিল। চুরের মতো ফিসফিস করে কথা বলছিল।”

আদ্রিশ এতক্ষণ রুশার মধ্যে বিভোর থাকলেও ওর কথা শুনে চমকে যায়। কারণ আদ্রিশের মনে হচ্ছিল কেউ একজন ওদের ইনফরমেশন পাচার করছে। কিন্তু তাকে আইডেনটিফাই করতে পারেনি। তাকে দুদিন যাবত গোপনে খুঁজে যাচ্ছিল।
“কে ছিল সে?”

“স্যার, আমি তো এখানকার কাউকে তেমন চিনি না। আমি উনার নাম জানি না।”

“দেখলে চিনবে?”

“জি স্যার।”

“ওকে।”
আদ্রিশ চিৎকার করে সেজানকে ডাকল।
সেজান দৌড়ে এসে বলল,
“হ্যাঁ, ভাই?”

“অফিসের সবাইকে লাইন করে দাঁড় করাও।”

“ভাই, হটাৎ?”

“আই থিংক আই উইল গেট দ্যাট কালপিট।”

“ওকে ভাই।”

আদ্রিশ রুশাকে বলল,
“এই কথা কেউ যেন না জানে। তবে অপরাধীকে পাওয়া যাবে না আর তোমার লাইফের রিক্স হবে।”

অতঃপর একে একে সবাইকে মনোযোগ দিয়ে দেখে আদ্রিশের সামনে এসে বলল,
“স্যার, এদের মধ্যে কেউ নয়। উনার চুলগুলো অর্ধ কাঁচাপাকা। একটু শর্ট ছিল। গায়ে এস কালার স্যুট ছিল। উনি এখানে নেই।”

“ওকে, নাউ গো।”

রুশা চলে গেল। আদ্রিশ ম্যানেজমেন্টের সাথে দ্রুত মিটিং এরেঞ্জ করতে বলল।

অফিস শেষে টুকটাক কেনাকাটা করে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল রুশা। তখনও রাত হয়নি। সবেমাত্র আঁধার নেমে আসছে। রাস্তায় গাড়ি, লোকজনের কমতি নেই।
হটাৎ করেই কেউ ওর মুখ চেপে ধরে গাড়িতে তুলে নেয়। রুশা ছোটার জন্য ছটফট করছে। ওর মুখ চেপে ধরে রেখেছে একটা লোক। সামনে পেছনে আরো কয়েকজন লোক আছে। গাড়িটা দ্রুত কোথাও এগিয়ে যাচ্ছে। ওকে কে বা কারা এভাবে নিয়ে যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ চলার পর নিরিবিলি একটা পরিত্যক্ত গোডাউনের সামনে গাড়ি থামল। রুশা বুঝতে পেরে গেছে ওকে কিডন্যাপ করা হয়েছে আর সেটা হয়তো মোবাইলে কথা বলা ব্যক্তিকে দেখে ফেলেছে তাই। তাই ছটফট করে লাভ নেই। ওরা ছাড়বে না।

গাড়ি থেকে ওকে নামাতেই আরেকটা গাড়ি এসে থামে। ওরা সবাই অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে তৈরি হয়ে যায়। আদ্রিশ গাড়ি থেকে নেমে বলল,
“ওকে ধরে রেখে লাভ নেই কারণ আমি তাকে পেয়ে গেছি। সে এখন আমার কাছে বন্দী। তাই রুশাকে ছেড়ে দে।”

ওরা আদ্রিশের কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। আর তাছাড়া ওদের উপর অর্ডার আছে মেয়েটাকে কয়েকদিনের জন্য আঁটকে রাখতে। রুশা ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আর একটা ছেলে ওর হাত ধরে রেখেছে। আদ্রিশ ওদের দিকে আগাচ্ছে। ওরা রিভলবার তাক করে রেখেছে। কিন্তু গুলি করতে পারছে না। কারণ গুলি করার অর্ডার পায়নি। তাই করতে পারছে না। যে ছেলেটা রুশার হাত ধরে রেখেছে আদ্রিশ হটাৎ ওর হাতটা ধরে টান মারে। কেউ কিছু বুঝার আগেই ওর হাতটা গাড়ির উপর রেখে তাতে পিন গেঁথে দিল। ছেলেটা আকাশ কাঁপানো চিৎকার দিল। রুশা দু’হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে আছে। না চাইতেও মুখ দিয়ে শব্দ বের হয়ে যাচ্ছে। তাই আরো জোরে চেপে ধরল। ভয়ে থরথর করে সারা শরীর কাঁপছে আর ভাবছে এ কি দেখল।
আদ্রিশ বাকিদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিল। ওরা দূরে সরে গেল। আদ্রিশ রুশার হাত ধরে নিয়ে গাড়িতে বসাল। ওর শরীরের কাঁপুনি আদ্রিশকে জানান দিচ্ছে ও ভয় পেয়েছে। রুশা রোবটের মতো চুপচাপ গিয়ে বসে পড়ল। আদ্রিশ গাড়ি স্টার্ট দিল।

রুশা চুপচাপ বসে আছে। কথা বলছে না। আদ্রিশ ওকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করল। রুশা যেভাবে বসে ছিল সেভাবেই ঠিকানা বলল।
আদ্রিশ ওকে পর্যবেক্ষণ করে ধমক দিয়ে বলল,
“রোবটের মতো বসে আছো কেন? ওর হাতে পিন গেঁথে দেওয়ায় ভয় পেয়ে গেলে আর ওরা যখন কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছিল তখন তো স্বাভাবিক ছিলে।”

রুশা থমথমে কন্ঠে বলল,
“কারণ আমি বুঝে গিয়েছিলাম ওরা আমায় কিডন্যাপ করেছে।”

“তো? হেল্প চাইবে না? নিজেকে রক্ষা করবে না?”

“আমি ওদের থেকে নিজেকে রক্ষা করব কিভাবে? আমি একা একটা মেয়ে। তাই চুপচাপ ছিলাম। তাছাড়া এখানে হেল্প চেয়ে কি লাভ? কে আসবে এই পরিত্যক্ত জায়গায় আমাকে বাঁচাতে? এটা সিনেমা না যে নায়িকা বাঁচাও বাঁচাও বলবে আর নায়ক স্পাইডার ম্যানের মতো এসে তাকে রক্ষা করবে।”
রুশা নাক ফোলাল।

আদ্রিশ বাঁকা হাসল।
“কিন্তু আমি তো তোমাকে রক্ষা করলাম। লাইক এ হিরো। ইজেন্ট ইট?”

রুশার কাশি শুরু হয়ে গেল। আদ্রিশ আবারও হাসল।
“আপনি কি করে জানলেন আমি এখানে?”

“আমি আদ্রিশ। কোনো কিছুই আমার চোখ এড়ায় না। আমি বাজ পাখি।”

রুশার ওর কথার ধরণ ভালো লাগলো না। তাই আর কোনো প্রশ্ন করল না। এছাড়া এসে পড়েছে ও। যা কেনাকাটা করেছিল সব রাস্তায় পড়ে গেছে। সেটা নিয়ে মনে মনে আপসোস করছে।
“এসে পড়েছি। রাখুন।”

আদ্রিশ গাড়ি থামালো। যেখানে গাড়ি থামালো বড় গেটের উপরে লেখা অনাথ আশ্রম। লাইটের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রুশা গাড়ি থেকে নামছে। আদ্রিশও নামলো। রুশা মিষ্টি হেসে বলল,
“ধন্যবাদ।”

আদ্রিশ আরেকবার সাইনবোর্ড দেখল। রুশাকে সেদিকেই যেতে দেখে বলল,
“অনাথ আশ্রম? এটা তোমার বাড়ি?”

“হ্যাঁ। এই অনাথ আশ্রম আমার তৈরি। এই জমি আর বাড়িটা আমার। আপনাদের মতো ধনী লোকের ডোনারে এখানকার বাচ্চাদের খাওয়া, পড়াশোনা হয়। এরাই আমার পরিবার।”

“আর তোমার বাবা-মা?”

“আমার ছেলেবেলায় দু’জন একসাথে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। ভালোবাসাটা বেশি ছিল কি-না। তাই দুজন একসাথেই চলে গেলেন। বাবা-মায়ের সমতূল্য একটা ভাই ছিল সেও মারা গেছে।”

“কিভাবে মারা গেল?”

রুশার চোখে পানি জমেছে। গলা ভার হয়ে গেছে। চোখের কোন থেকে পানি মুছে শক্ত কন্ঠে বলল,
“কার এক্সিডেন্ট।”

“ওহ আচ্ছা। এর মানে তুমি একা?”

“জি।”

“নাহ।”

রুশা চমকে উঠে। আদ্রিশ না বলল কেন? এই না বলার পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে।

আদ্রিশ ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে কানের কাছে শীতল কণ্ঠে বলল,
“তুমি একা নও। আমি আছি তো।”

রুশার সারা শরীর কেঁপে উঠে। কানের লতি এখনো শিরশির করছে। অবাক চোখে আদ্রিশের দিকে তাকাল। সে চোখে অনেক কিছু দেখতে পাচ্ছে। অদ্ভুত চাহুনি। কিছুটা রহস্যময়। রুশার ওকে এখন ঠিক বাজপাখি মনে হচ্ছে। তারপর নিজেকে ছাড়িয়ে এক দৌড়ে গেটের ভেতরে ঢুকে গেল। ওর দিকে আরেকবার চেয়ে তাড়াতাড়ি গেট বন্ধ করে দিল। আদ্রিশ মিটমিট করে হাসছে। সেজান কল করেছে।
“ভাই, ও এখন আপনার জাহান্নামে।”

“হালকা আপ্যায়ন করো। ফাইনাল আপ্যায়ন আমি এসে করব। মেহমান বলে কথা।”

সেজান আলতো হাসল।
“জি ভাই।”

তারপর একটা হকি স্টিক হাতে নিয়ে ওই লোকটার দিকে আগাচ্ছে। লোকটা ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে। তারপর হাত জোর করে বলল,
“স্যার, আমাকে মারবেন না। আমি কিছু করিনি।”

সেজান পা বরাবর হকি স্টিক দিয়ে মারল। লোকটা ব্যথায় চিৎকার করে উঠে। সেজান আরো কয়েকবার মারার পর বলল,
“যদি বাঁচতে চাস, তবে বল কার কাছে নিজেকে বেঁচে দিয়েছিস?”

মেঝেতে পড়ে ছটফট করতে করতে বলল,
“স্যার, বলছি। আমি সব বলছি। জারিফ খান আমাকে টাকা দিয়েছিল।”

“জারিফ? ওহ আচ্ছা। শালার শিক্ষা হয়নি। লাস্ট টাইম ভাই যা করেছে তাতে অন্তত শিক্ষা হওয়া উচিত ছিল। খুব ভুল করে ফেলেছিস। এইবার আর ভাইয়ের হাত থেকে বাঁচবি না।”

আদ্রিশ গিয়ে দেখে সেজান বিরবির করছে। ওর হাতে হকি স্টিক।
“সেজান!”

সেজানের খেয়াল হলো আদ্রিশ এসেছে।
“ভাই, জারিফ। ওর দেখছি লজ্জা নেই। ওকে এইবার এমন একটা শিক্ষা দিতেই হবে যাতে সারাজীবন মনে রাখে।”

আদ্রিশ ওর অফিসের কর্মচারীর দিকে তাকাল। লোকটা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বলল,
“স্যার, আমাকে মাফ করে দিন।”

আদ্রিশ রিভলবার বের করে ঘাড় কাত করে সোজা করে বলল,
“এখানে যে আসে সে ফিরে যায় না।”

“স্যার, দয়া করুন। আমি স্ত্রী, দুজন মেয়ে আছে। আমার কিছু হলে ওরা না খেয়ে মরবে।”

“ওদের দায়িত্ব আমার। কিন্তু আজ তোকে মরতেই হবে। ধোঁকাবাজের একমাত্র শাস্তি মৃত্যু।”

আদ্রিশ ওর মাথায় গুলি করে দিল। লোকটা ঢলে পড়ল।

***

আদ্রিশ শাওয়ার নিয়ে ওয়াশরুমের আয়নার দিকে তাকাল। চুল বেয়ে পানি পড়ছে। ওর কল্পনায় আয়নায় রুশার হাসোজ্জল চেহারাটা ভেসে উঠছে। আদ্রিশ মুচকি হাসল। তারপর নিজের দিকে চেয়ে বলল,
“উনত্রিশ বছরের জীবনের একুশটা একাকিত্ব বছরে তাহলে কেউ আসতে চলেছে।”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here