লাজুকপাতা পর্ব-৩+৪

0
157

#লাজুকপাতা
#পর্ব-৩
নাবিদ দের বাড়িটা পুরোনো আমলের। তিনতলা বাড়ি। একতলা আর তিন তলাটা ভাড়া দেয়া। দোতলায় নাবিদ রা থাকে। আমার শ্বশুর আরামপ্রিয় লোক। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বাড়ি আর একখানা দোকান ছাড়া নিজে কিছুই করে উঠতে পারেন নি। সেই আরামপ্রিয় স্বভাব পেয়েছেন আমার ভাসুর জামিল

বাড়িতে আসার দুদিনের মধ্যেই টের পেলাম আমার শাশুড়ী রাগী মানুষ। তার মেজাজ সম্ভবত সবসময় ই খারাপ থাকে। তার কাছ থেকে তার বড় ছেলে আর বউয়ের গল্প শুনলাম।

জামিল ভাই মানে আমার ভাসুর বিয়ে করেছিলেন ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে। তখন তেমন কিছু করতেন না। অথচ ভাবী বেশ অবস্থাপন্ন ফ্যামিলির মেয়ে। বিয়ের পর পর ভাবী জমজ সন্তানের জন্ম দিলেন। দুটো ফুটফুটে দুষ্ট মেয়ে। ওদের নাম টাপুর টুপুর। আর ভাবীর নাম টুম্পা। টাপুর, টুপুরের বয়স এখন পাঁচ। জামিল ভাই এখনো কিছু করেন না। আজ করব, কাল করব বলে পাঁচ টা বছর কাটিয়ে দিলেন। উল্টো ভাবীর টিউশনির টাকা নিয়ে বাইরে খরচ করে বেড়ান।

মাস দুয়েক আগে চূড়ান্তরকম ঝগড়া করে ভাবী বাড়ি ছাড়েন। আমার বিয়ের আগের দিন জামিল ভাইকে তালাকনামা পাঠিয়েছেন। সেই সঙ্গে জানিয়েছেন যে টাপুর টুপুর এর দায়িত্ব সে নিবে না।

***
এই বাড়িতে দুটো সপ্তাহ কাটিয়ে ফেললাম। নাবিদ একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। সকালে ঘুম থেকে উঠে যায়, ফিরে সন্ধ্যেবেলা। সন্ধ্যেবেলা যখন ফিরে তখন তার মেজাজ থাকে বিক্ষিপ্ত। আমাকে আম্মা শিখিয়ে দিয়েছেন নাবিদ এলে যেন শরবত, তোয়ালে এগুলো এগিয়ে দেই। প্রথম দিন শরবতের গ্লাস দেখে নাবিদ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

“এই শীতে কেউ শরবত খায়?”

আমি বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম। পরের দিন চা বানিয়ে নিয়ে গেলাম। দারুচিনি, এলাচি দিয়ে চা। সেটা দেখে আগের দিনের মতো কপাল কুঁচকে বলল,

“এখন চা খেলে ভাত কখন খাব?”

আমি গতদিনের তুলনায় আরও দ্বিগুণ বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। নাবিদও কেমন যেন অন্যচোখে তাকিয়ে থাকে কিছুসময়।

**
এই বাড়িতে নাবিদ আর জামিল ভাই ছাড়া আর একটা ফোন আমার আম্মার কাছে থাকে। সেই ফোনে মা আর পরী আপা একদিন পর পর ফোন করেন। আম্মা সামনেই থাকেন বেশীরভাগ সময়। মা ফোন করেন, কেমন আছস! কি দিয়া ভাত খাইছ! জামাইর সাথে সব ঠিক আছে। মায়ের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আমি লজ্জায় পড়ে যাই। আম্মা বিরক্ত হন সম্ভবত। এখনো ওনার রাগ কিংবা মেজাজ আমার সঙ্গে দেখান নি। তবে অন্যদের সঙ্গে দেখিয়েছেন। বিশেষ করে মনির সঙ্গে।

মনি মুক্তা দুজনের আমি আলাদা নাম দিয়েছি। মনির নাম কুটিলা আর মুক্তার নাম জটিলা। মুক্তার নাম জটিলা দেবার কারণ হলো ওরও প্রায় সময়ই নাবিদের মতো কপাল কুঁচকানো থাকে। সামনেই এসএসসি পরীক্ষা। দিন রাত পড়াশোনা করে। মাঝরাতেও গুনগুন করে পড়ার শব্দ পাই আমার ঘর থেকে।

আর মনির নাম কুটিলা দেয়ার কারণ হলো ওর স্বভাব। কোনো এক বিচিত্র কারণে ও আমাকে পছন্দ করছে না। ওদের সঙ্গে ভাব করতে গিয়েও আমি বিশেষ পাত্তা পাই নি।

এই বাড়িতে যাদের সঙ্গে আমার গলায় গলায় ভাব হয়েছে তারা হলো টাপুর টুপুর। কী যে দুষ্ট বাচ্চা দুটো। আমার শাশুড়ী সামলাতে গিয়ে অস্থির হয়ে যায়। ওদের সঙ্গে আমার ভালোই ভাব হয়েছে। ওরা আমার ঘরে এসে হুটোপুটি করেও আনন্দ পায়, আমারও তেমন খারাপ লাগে না।

***
আমার ঘর টা ছোট। তবে ছোট্ট একটু বারান্দা আছে। ঘরে মাঝারি সাইজের দুজনের ঘুমানোর মতো খাট, আলমারি আর একটা টেবিল। টেবিল টা অবশ্য নাবিদের। সেখানে ওর কম্পিউটার, চার্জার, বইপত্র এসব থাকে। ওর কালেকশনে বেশ ভালো বইও আছে। অলস দুপুরে কিছু করার না থাকলে তখন বই পড়া হয়।

নাবিদের সাথে আমার সম্পর্ক এখনো অতটা আন্তরিকতার না। আমি চেষ্টা করি সকালে উঠে চা’টা করে দেবার। চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে নাবিদ প্রতিদিনই বলে,

“এতো সকালে ওঠার তো দরকার নেই জরী। তুমি ঘুমাতে।”

এই বাড়িতে সকালের খাবারে ভাত হয়। পাতলা মসুর ডাল, আলুভর্তা আর ডিম। একটা ডিম কে তিন ভাগ করা হয়। নাবিদ যাওয়ার সময় বক্সে করে ভাত নিয়েও যায়। গতরাতের তরকারি থেকে একটু তরকারি আর ডাল।

রান্নাবান্না আম্মা করেন। একটা দুটো তরকারির বেশী করেন না। তরকারিও প্রায় দিন একইরকম। কাজের একজন লোক আছে। সে এসে কাপড় ধোঁয়া, ঘর মোছা, থালাবাসন ধোঁয়া এগুলো করেন।

আমাকে এখনো কোনো কাজ আম্মা করতে দেন নি। কিছু করার কথা বললেও বলে,

“আর কয়টা দিন যাক। নাইলে তো বাপের বাড়িতে মোবাইল কইরা বলবা যে শাশুড়ী এরমধ্যে ঘরের কাজে লাগাই দিছে। ”

আমিও আর কিছুতে যাই না। আমার শ্বশুর মুখচোরা মানুষ। তিনি আমার সঙ্গে অতো সহজ হতে পারেন নি। একটু দূরে দূরে থাকেন।

জামিল ভাই সকালে খেয়ে বেরিয়ে যান আর রাতে ফিরে নি:শব্দে খেয়ে ঘুমাতে যান। তবে তাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আমাকে দেখে হেসে জিজ্ঞেস করেন,

“জরী ঘুমাও নাই? আসলে একটু কাজ ছিলো বুঝলা… একটা কাজের কথা চলতেছে। আল্লাহ চাইলে একটা বন্দোবস্ত হবে।”

আমি স্মিত হাসি। মনে মনে বলি, আল্লাহ সব সহজ করে দিক। টাপুর টুপুরের মা ফিরে আসুক। মেয়েদুটো আক্ষেপ নিয়ে বড় না হোক।

***
প্রায় পনেরো দিন পর নাবিদ আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

“তোমার কিছু লাগবে?”

আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম,

“কী?”

“কিছু লাগবে কি না!”

আমার তখন পরী আপার কথা মনে পড়ে। আপা বলেছিল পড়াশোনার ব্যাপারে কথা বলতে। কিন্তু আমি বলতে পারি না। আমার ভয় হয়।

নাবিদ আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে কী ভাবে কে জানে! আলমারি থেকে চারটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে হাতে দেয়। বলে,

“এটা রাখো। ”

আমি লাগবে না বলতে গিয়েও বলতে পারি না। যন্ত্রের মতো টাকাটা নেই। নাবিদ ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে যায়। হঠাৎ ফিরে এসে বলে,

“তুমি পড়তে চাও আরও? ”

আমি তাকিয়ে রইলাম। নাবিদ আমার প্রশ্নের জবাবের অপেক্ষায় আছে। আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।

“তোমার আপা বলল। তুমি নাকি ভয়ে বলতে পারছ না। এতে ভয়ের কি আছে! আজব তো!”

চলবে…

#লাজুকপাতা
#পর্ব-৪
মাস পেরোনোর আগেই আমার রান্নাঘরে ঢোকার সৌভাগ্য হলো। আমাকে অবশ্য পরী আপা বুদ্ধি দিলো। রাগে গজগজ করতে করতে বলল,

“জরী শোন, শ্বশুরবাড়ি মামাবাড়ি না। খেয়েদেয়ে পড়ে পড়ে ঘুমানো ভালো কথা না। শাশুড়ী এখন কিছু বলছেন না মানে সবসময় ই চুপ করে থাকবে এমন না। তুই আগ বাড়িয়ে কাজ কর।”

আমি আগ বাড়িয়ে টুকটাক কাজ করতে লাগলাম। আলু,পিয়াজ, মরিচ টা কেটে দেই। বোতলে খাবার পানি ভরে রাখি। বিছানা, বালিশ গুলো ঝেড়েমুছে পরিস্কার করি। আম্মা অবশ্য প্রথমদিকে বললেন,

“থাক, তোমার কিছু করা লাগবে না। আর কয়টা দিন যাক। ”

তার গলার স্বরে মনে হয় বলার জন্যই বলা। আসলে সেও চায় আমি তাকে সাহায্য করি।

যেদিন প্রথম রান্নার সুযোগ পেলাম সেদিন আম্মা একটু অসুস্থ ছিলেন। সন্ধ্যে থেকে বিছানায় শুয়ে আছেন। আমিই গিয়ে বললাম,

“আম্মা আজকে আমি রান্না করি?”

আম্মা আমার দিকে না তাকিয়েই জবাব দিলেন,

“তুমি রাঁধতে পারো? আচ্ছা করো। আলু সেদ্ধ দাও, আর ভাত করো। আজ সবাই আলুভর্তা আর মরিচ ভর্তা খাবে। আমি রোজ রোজ পারি না।”

আমি তার কথার অবাধ্য হয়ে অনেক কিছু রান্না করে ফেললাম। আলু ভাজা, ঘন করে মসুর ডাল, পেপে দিয়ে মুরগিরর ঝোল, বেগুন দিয়ে একটা তরকারি।

খাবার টেবিলে আম্মা এত পদ দেখে চোখ কপালে তুলে বললেন,

“এতকিছু তুমি রানলা? ক্যামনে পারলা!”

আমি হাসলাম। রান্নাটুকু হাতে ধরে মা আর চাচিমা’ই শিখিয়েছেন। শুধু রূপ দিয়ে কী আর সংসার চলে! তবে পরী আপা, নিরু আপাদের মতো সেলাই,ফোড়াই শেখার সুযোগ আমার হয় নি। আমি সেই সময় টা কাটাতাম বইয়ের সঙ্গে।

আমার রান্না করা খাবার খেয়ে নাবিদ প্রথমেই বলল,

“জরী রান্না করছে। ওর রান্নার হাত তো ভীষণ ভালো। মাঝেমধ্যে ওরে রাঁধতে দিও মা, তোমারও কষ্ট কম হবে আর আমাদেরও সুবিধা হবে।”

নাবিদের কথা আম্মার মন:পুত হলো না। তিনি আমার সামনে মুখ ফুলিয়ে কপাল কুঁচকে থাকলেও কিছু বললেন না। রান্নাঘরে থালাবাসনের আওয়াজে বুঝলাম যে জড়বস্তুর উপর দিয়েই রাগ টা ঝাড়ছেন।

আমার ননদ কুটিলা রান্না নিয়ে কিছু না বললেও জটিলা বলে ফেলল,

“তোমার রান্না ভালো হইছে ভাবী। মায়ের সামনে বলিনাই। মায়ের রান্নায় তো মাঝেমধ্যে হলুদ এতো দেয় যে মুখেও তোলা যায় না। তার চোপার ভয়ে আমরা তো কিছু বলিও না।”

মুক্তার কথার ধরনে আমি হেসে ফেললাম। ওর সঙ্গে আমার একটু একটু ভাব হচ্ছে৷ একমাস বাদেই ওর পরীক্ষা শুরু। পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ টেনশনে আছে। অংক ভুলে যায়। সম্পাদ্য আঁকতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে অবস্থা একাকার। আমিই ওকে একটু দেখিয়ে দেবার চেষ্টা করি। সেই সুবাদেই বোধহয় ও আমাকে একটু পছন্দ করে।

কুটিলা তার স্বভাবেই আছে। সে নিজের মতোই থাকে। এস এসসি দুইবার দিয়েও পাশ করতে পারে নি। প্রথমবার পাঁচ সাবজেক্টে ফেল করার পর দ্বিতীয়বার আবারও পরীক্ষায় বসানো হয়। সেইবার ছয় সাবজেক্টে ফেল করেছে। আম্মা এর পিছনে আর খরচ করতে চান না। ওরও পড়াশোনায় তেমন মন নেই। সাজগোজেই বেশী মন৷

***
দুপুরে খাবার পর সবাই ঘুমায়। টাপুর টুপুর কে অনেক কষ্টে ঘুমের অভ্যাস করিয়েছি। আগে নাকি ওরা ঘুমাতো। ভাবী যাওয়ার পর মেয়ে দুটো আরও বিচ্ছু হয়ে গেছে।

আমার ঘুম হয় না। নাবিদের বইগুলো থেকে বেছে বেছে কিছু বই পড়া হচ্ছে। আজ আর বই নিলাম না। বারান্দায় এমনিই বসলাম। গ্রিল গলে সোনালী রোদ পড়েছে। এই বছর শীতও মনে হয় বেশি দিন থাকবে।

বিয়ের এই একমাসে আমি নিজেকে অন্যরকম ভাবে আবিষ্কার করলাম। আমার মধ্যে এই ঘর, এই সংসারের মানুষ জনকে আপন করে নেয়ার তাড়না আছে। বাপের বাড়িতে আমি প্রায় একাই ছিলাম। অথচ এই বাড়ির মানুষজনের ভালোবাসা পাওয়ার লোভ জন্মে গেছে।

আর নাবিদ! সে এক অন্য মানুষ। আমার বিবাহিত বন্ধুদের কাছে স্বামীর ভালো, মন্দ যে গুণকীর্তন শুনেছি নাবিদ সেদিক থেকে একদম আলাদা। বিছানায় ঘুমানোর সময় মাঝখানে বেশ দূরত্ব থাকে। দুজনের কম্বলও আলাদা। তবুও প্রায় প্রতিদিনই আমার পায়ের কাছের কম্বল ঠিক করে দেয়। কি লাগবে না লাগবে সেদিকেও ভীষণ নজর। তবুও আমার মনে হয় কোথাও কোনো কিন্তু আছে। কিছু অংক সরল মনে হলেও মেলাতে পারি না।

আমার বিয়েটা আচমকা হয় নি। অনেক দিন ধরে কথাবার্তা চলছিল। টেস্ট পরীক্ষার পর চাচাজানের মাথায় ভুত চাপলো জরীর বিয়ে দিতে হবে। আমার মামাশ্বশুর তার পূর্বপরিচিত। তার মাধ্যমেই বিয়ের কথাবার্তা এগোয়। আমার ছবি পাঠানো হয়। ছবি দেখে সবাই পছন্দ করে। কথা হয় একদিন দেখতে আসবে। সব আয়োজন ঠিকঠাক, মা চাচিরা পিঠা বানাচ্ছেন, ঘর গোছাচ্ছেন। এই বৈঠকেই বিয়ে হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।

কিন্তু আসার দুদিন আগেই জানান যে তারা আসতে পারবে না। একটু সমস্যা আছে। কিছুদিন পর জানানো হয় যে ছেলের একটু সময় লাগবে। চাকরি তো বেশীদিন না, হাতে আরও একটু পয়সাপাতি জমুক।

চাচাজান একটু নরম হলেন। আমার পরীক্ষা পর্যন্ত চুপই ছিলেন৷ পরীক্ষার পর আবারও বিয়ের তোড়জোড় শুরু হলো। নাবিদ দের ওখান থেকে সরাসরি কিছু বলে না। অন্য জায়গায় সম্বন্ধ দেখা হচ্ছে। এরমধ্যে আমার মামাশ্বশুর গিয়ে জানালেন যে তার ভাগ্নের জন্য এই মেয়েই চাই।

আমাকে সেদিন মুক্তাও বলল,

“মায়ের ইচ্ছে ছিলো শহুরে মেয়ে আনার। কিন্তু ছোট্ট ভাই বলল জরীর সঙ্গে বিয়ে না হইলে সে আর কাউকেই বিয়ে করবে না। ”

চলবে….

(অপ্রেমের গল্পটা যেভাবে শেষ হয়েছিলো এর প্রি অর্ডার চলছে। শিগগিরই প্রি অর্ডার করুন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here