#রাজনীতির_অন্তরালে
#তমসা_চক্রবর্তী
#অন্তিম_পর্ব
।। ১৮ ।।
-“একটা কথা জিজ্ঞেস করব, সত্যি সত্যি উত্তর দেবেন ম্যাডাম”!!
নিজেরর বাইকের পিছনের সিটে বসা মিলিকে প্রশ্নটা করেই ফেললো শান্তনু।এই মুহূর্তে ওদের গন্তব্য প্রয়াত ধীমান অধিকারীর বাড়ি।কারনটা যদিও শান্তনুর অজানা।
গতকালই করিমপুর থেকে জলঙ্গী হয়ে বহরমপুর ফেরার পথে মিলি বারবার শান্তনুকে অনুরোধ করেছিল যাতে সুমনার কথা কেউ কোনোভাবেই না জানতে পারে। বিশেষ করে উজান বা অরণ্যের কাছে সুমনার বিষয়ে সম্পূর্ণ গোপনীয়তা রাখার জন্য শান্তনুকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনুরোধ করেছিল মিলি। এমনকি কাল বিমান অধিকারী আর রজত বৈরাগী পুলিশের জালে ধরা পড়ার আগেই পুরো কেসটা কিভাবে নিউজ পেপারে রিপ্রেজেন্ট করতে হবে সে বিষয়েও মিলি শান্তনুকে অবগত করেছিল। যদিও মিলিকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে শান্তনু সুমনার বিষয় পুরোপুরি গোপনীয়তা বজায় রেখেছে, কিন্তু নিজের কর্মকান্ডের কারণ সম্পর্কে শান্তনুকে এখনো সম্পূর্ণ অন্ধকারেই রেখেছে মিলি।তাই শান্তনুর করা প্রশ্নকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মিলি বললো,
-“এক কাজ কর শান্তনু!!এখনি ধীমান বাবুর বাড়ি না গিয়ে চলো একটু গঙ্গার ধারে ঘুরে আসি”!!
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উল্টে শান্তনুর কাছে এমন অদ্ভুত আবদার করায় ব্রেকের ওপর জোর বাড়িয়ে বাইকটা দাঁড় করালো শান্তনু।
-“এখন গঙ্গার ধারে যাবেন!! কিন্তু কেন”!!
মুচকি হেসে উত্তর দিল মিলি,
-“একটু নিরিবিলি পরিবেশ প্রয়োজন বুঝলে!! তাছাড়া, তোমার মনের মধ্যে যে প্রশ্নগুলো গিজগিজ করছে আমায় যে তার উত্তরগুলোও দিতে হবে শান্তনু”!!
মিলির জবাবে আর কথা না বাড়িয়ে লুকিং গ্লাসে চোখ রেখে একবার পিছনে বসা মিলির মুখটা দেখে নিয়ে বাইক ঘুরিয়ে গঙ্গার ঘাটের দিকে এগিয়ে চললো শান্তনু।।
।। ১৯ ।।
-“কি সুন্দর জায়গাটা”!!
বেশ অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে গঙ্গার একেবারে কাছাকাছি এসে দাঁড়াল মিলি আর শান্তনু। মিলির চোখ মুখের ঔজ্বল্য দেখে শান্তনুর আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না গঙ্গা পারের এমন মনোরম দৃশ্য দেখে সে যারপরনাই উচ্ছ্বসিত। মিলির উচ্ছাস ওর গলার স্বরেও প্রকাশ পেল।
-“জানো শান্তনু,কলকাতা শহরে তো সচরাচর গঙ্গার ঘাটগুলোতে এমন শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে পাওয়াই যায় না।তাই এমন শান্ত, মনোরম পরিবেশ পেলে প্রাণ ভরে প্রকৃতিকে উপলব্ধি করার লোভ আমি সচরাচর সামলে উঠতে পারিনা। জায়গাটার নাম কি গো”!!
-“এই জায়গাটাকে রাধার ঘাট বলে ম্যাডাম”!!
তীরে দাঁড়িয়ে গঙ্গার অপরীসীম সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতেই মিলির চোখ পড়ল ঘাটে বাঁধা নৌকাগুলোর ওপর।
-“আমি বুঝতে পারছি,তুমি হয়ত আমার কাজকর্ম দেখে মনে মনে আমার মস্তিকের সুস্থতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করছো,তবুও আমার একটা শেষ অনুরোধ রাখবে!! প্লিজ”!!
মিলিকে নিজের কথাটা সম্পূর্ণ করার সুযোগ না দিয়ে ওকে অবাক করে ঘাটে বাঁধা এক নৌকার মাঝির সাথে কথা বলতে এগিয়ে গেল শান্তনু।মিনিট খানেক বাদে ফিরে এসে বললো,
-“চলুন ম্যাডাম।এক ঘন্টার জন্য নৌকা বিহারের ব্যবস্থা করে ফেলেছি। এবার না হয় গঙ্গায় ভাসতে ভাসতে মন খুলে প্রকৃতিকে উপভোগ করবেন”!!
নৌকা ঘাট পেরিয়ে নদীর স্রোতে এঁকেবেঁকে কোমর দুলিয়ে সূর্যের কোমল আলোয়, দূর কুয়াশার দিকে ভাসতে থাকলো। মিলিকে বেশ কিছুক্ষণ আনমনা দেখে শান্তনু নিজের নীরবতা ভঙ্গ করল।
-“এবার আশা করি আমাদের কথা বলতে আর কোনো অসুবিধা নেই ম্যাডাম”!!
শান্তনুর কথায় সম্বিত ফিরল মিলির। মিলির সপ্রশ্ন চাহনি দেখে শান্তনু হালকা হেসে বলে উঠলো,
-“মানলাম আপনি ডিটেকটিভ, কিন্তু আমিও যে পেশায় ক্রাইম রিপোর্টার ম্যাডাম। সেটা ভুলে গেলে কি করে হবে”!!
-“তুমি কি বলতে চাইছো একটু খোলসা করে বলবে প্লিজ”!!
মিলির প্রশ্নের উত্তরে শান্তনু বলে,
-“সকালে যখন গেস্ট হাউসের সামনে থেকে আপনাকে পিকআপ করলাম, তখন থেকেই লক্ষ্য করেছিলাম এক মূর্তিমান স্কুটি নিয়ে আমাদের ফলো করছে। প্রথমদিকে ব্যাপারটাকে অতটা পাত্তা দিইনি। কিন্তু তারপর যখন আপনি বললেন গঙ্গার ধারে ঘুরতে যাবেন তখন তাকেও স্কুটি ঘুরিয়ে আমাদের পিছন পিছন আসতে দেখে নিশ্চিত হলাম যে আমাদের ফলো করা হচ্ছে।তাই আপনাকে ৭২ ধাপিতে নিয়ে না গিয়ে রাধার ঘাটেই এলাম।আমি নিশ্চিত ছিলাম যে নৌকা দেখলেই আপনি নৌকায় চড়ার প্রস্তাব দেবেন। কারন এই মুহূর্তে মাঝ গঙ্গাই মনে হয় কথা বলার জন্য সবথেকে নিরাপদ এবং উপযুক্ত জায়গা, তাই না ম্যাডাম”!!
মনে মনে শান্তনুর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষন ক্ষমতার ভূয়সী প্রশংসা করল মিলি। এতোটা হয়তো ও নিজেও শান্তনুর কাছে আশা করেনি। নিজের গলার স্বরেও সেই উচ্ছাস মাখিয়ে মিলি বলে উঠলো,
-“ব্রাভো রিপোর্টার ব্রাভো!! তুমি অযথাই এখানে পড়ে থেকে নিজের প্রতিভা নষ্ট করছো শান্তনু।ইউ শুড কাম টু কলকাতা”!!
নিজের প্রশংসায় সামান্য লজ্জা পেলেও শান্তনু মিলিকে প্রসঙ্গ পরিবর্তন না করতে দিয়ে প্রশ্ন করল,
-“অপরাধী তো কাল রাতেই ধরা পড়ে গেছে।তাহলে আজ কেন কেউ আমাদের ফলো করছে ম্যাডাম? আর কেনই বা করছে”!!
লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলো মিলি।
-“অপরাধী নয় শান্তনু,আজ আইনের এক রক্ষকের চোখ আমায় নজরবন্দী করতে চাইছে’!
মিলির জবাবে শান্তনু জোর চমকালো। বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করল,
-“আইনের রক্ষক!! তাহলে কি..”!!
মুখে শুকনো হাসি ঝুলিয়ে মিলি বলে,
-“হ্যাঁ শান্তনু।আজ সকাল থেকে আই পি এস উজান রায়ের লোকেরাই আমাদের ফলো করছিল”!!
।। ২০ ।।
-“আজ থেকে মাস দেড়েক আগে সত্যনারায়ন বাবু মানে মৌমিতা অধিকারীর বাবা নিজের মেয়ের হত্যার সুবিচার চাইতে আমার মায়ের কাছে আসেন। যদিও উনি জানতেন,এক ভয়াবহ অ্যাক্সিডেন্টের পর দীর্ঘ আট বছর আমার মা কোনো কেস লড়েননি। কিন্তু সেদিন সত্যনারায়ন বাবু ছিলেন অপারগ।কারন শহরের কোনো উকিল ই এম এল এ ধীমান অধিকারীকে চটিয়ে সত্যবাবুর মতো সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে রাজি হননি।তাই আমার মা আহেলী গঙ্গোপাধ্যায়ই ছিলেন সত্যবাবুর শেষ ভরসা।
অনেক কষ্টে সেদিন আমরা সবাই মাকে নিজের প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে আবার কোর্টে গিয়ে দাঁড়াতে রাজি করাই।যদিও মা সেদিন আমার কাছে শর্ত রেখেছিল যদি আমি বহরমপুর এসে এই কেসটা আগে ইনভেস্টিগেট করে কোর্টে পেশ করার জন্য যাবতীয় তথ্য যোগাড় করতে পারি তবেই মা কেসটা লড়বে।মাকে দেওয়া কথা মতো আমি প্রায় মাস দেড়েক আগে বহরমপুরে আসি।
সেবার আমি কি কি প্রতিকুলতার মুখোমুখি হয়েছিলাম তা তোমার অনেকটাই জানা শান্তনু। একদিকে তাহিরের লোকেরা ধীমান বাবুকে অপরাধী হিসেবে আমার কাছে প্লট করতে চাইছে, কিন্তু যেহেতু সেরকম কোনো শক্তপোক্ত প্রমান ওরা ধীমান বাবুর এগেইনস্টে জোগাড় করতে পারেনি, তাই ওরা আমাকে বিভিন্নভাবে মিসগাইড করে আমার তদন্তটাই বরবাদ করে দিতে চাইছিল।
যদিও প্রথম থেকেই আমার চোখে অধিকারী বাড়ির সবার বয়ানেই একটা অসঙ্গতি ধরা পড়েছিল।সব থেকে বেশি অসঙ্গতি ছিল ইন্দ্রানী দেবীর বক্তব্যে।উনি বারবার বলেছিলেন,’আমি সেদিন বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম।তাই কি ঘটেছিল বলতে পারবো না’!! অন্যদিকে আমি যে পুলিশের থেকে সাহায্য নেব,সে গুড়ে তো বালি!! পুলিশ তো একটাই কথা আওরে যাচ্ছিল,’ মৌমিতা দেবী ডিপ্রেশনের রুগী ছিলেন। ওনার চিকিৎসাও চলছিল।আর তাছাড়া উনি অমিত বলে একটি লোকের সাথে পরকিয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সেই সম্পর্কের কথা বাড়ির লোকজন জেনে ফেলায়,ডিপ্রশনের অনেকগুলো ওষুধ খেয়েই উনি আত্মহত্যা করেছেন’।
এই একই কথা সবার মুখে শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে হয়ত দু’একদিন পর আমিও তদন্ত বন্ধ করে কলকাতায় ফিরে যেতাম। কিন্তু তখনই একদিন দুপুরে এক অজানা নম্বর থেকে একটা ফোন আসে আমার কাছে । সেই ফোনকলে এক ব্যক্তি আমাকে জানায়,’মৌমিতা অধিকারীর হত্যা রহস্যের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে করিমপুরে।যদি সত্যি এই রহস্যের কিনারা করতে চান,তাহলে বহরমপুরে সময় নষ্ট না করে করিমপুরে যান’।
তদন্তের সমাধান যখন সমীকরণের সরল নিয়ম মেনে এগিয়ে চলে না তখন প্রত্যেক তদন্তকারীর কাছে একটাই পথ খোলা থাকে। ‘যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই’। তাই এক অজানা ফোন কলকে সম্বল করে আমিও ছাই উড়িয়ে দেখতে কার্তিক মাসের সেই পড়ন্ত বিকেলে পৌঁছে যাই করিমপুরে। করিমপুরে গিয়ে বিভিন্ন লোকজন মারফত জানতে পারি, নিজেদের পৈতৃক বাড়ি সেখানে থাকলেও ধীমান বাবু অথবা বিমান বাবু করিমপুর এলেই বেশির ভাগ সময় কানাই কীর্তনিয়া মানে বিমান বাবুর কীর্তন দলের আখারাতেই কাটান।তাই লোকজনের থেকে ঠিকানা জোগাড় করে আমিও পৌঁছে গেলাম বিমান বাবুর কীর্তন দলের আখারাতে। সেখানেই প্রথমবার আমার দেখা হয় সুমনার সাথে।
সেদিন আমার হাজারো প্রশ্নকে উপেক্ষা করে আমাকে প্রায় দূর দূর করে দোর গোড়া থেকেই তাড়িয়ে দিয়েছিল সুমনা।তবে সুমনা তাড়িয়ে দিয়েছিল বলাটা হয়তো ভুল হবে। আসলে কানাই কীর্তনীয়ার দলের কিছু লোকজন সেদিন আখারাতেই উপস্থিত ছিল।হয়ত খানিকটা তাদের ভয়েই সেদিন আমাকে কুয়ো পার থেকে হাত ধরে টানতে টানতে দরজার বাইরে বের করে দেয় সুমনা। তারপরই আমার মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে দেয়।
দরজার বাইরে দিশাহীনভাবে প্রায় মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎই আমি উপলব্ধি করি, আমার হাতে দলা পাকানো একটা কাগজ। আমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার সময় কোনো এক ফাঁকে আমার হাতে গুঁজে দিয়েছিল সুমনা।প্রবল আগ্রহে কাগজটা খুলে দেখতে যাব, হঠাৎ চোখ পড়ল আখারার ছাদে।কাপড় তুলতে আসার আছিলায় ছাদে এসে দাঁড়িয়েছিল সুমনা। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই ইশারায় শুধু আমাকে চলে যেতে বলে।
একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে হাঁফিয়ে উঠেছিল মিলি।একটু থেমে ব্যাগের ভিতর থেকে জলের বোতলটা বের করল। কিন্তু শান্তনুর আর তর সইছিল না। মিলিকে জল খাওয়ার বিরতি নিতে দেখেও সে প্রশ্ন করে বসল,
-“কি ছিল ওই কাগজে”!!
মনে মনে শান্তনুর উত্তেজনাটা টের পেয়ে মুচকি হাসল মিলি।ব্যাগের ভিতরের চেন খুলে একটা দোমরানো মোচরানো কাগজের টুকরো শান্তনুর হাতে তুলে দিল। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে কাগজটা খুলে ফেললো শান্তনু।
‘মিনতি মাঝি,
নাচান সাহা রোড, রূপপুর
বিনুরিয়া, বোলপুর, বীরভূম’
-“এটাতো একটা ঠিকানা! কিন্তু এই মিনতি মাঝি আবার কে”!!
।। ২১ ।।
-“সুমনার সাথে দেখা হওয়ার পরেরদিন সকালেই আমি কলকাতা ফিরে যাই। আর আমার ফিরে যাওয়ার সাথে সাথেই মৌমিতা অধিকারীর মৃত্যুর কেসও প্রায় ধামাচাপা পড়ে যায়।কারণ ততদিনে ধীমান অধিকারী তার তুরুপের তাস খেলতে শুরু করে দিয়েছিলেন”!!
-“ত্রাণ তহবিলের অর্থ তছরূপের বিরুদ্ধে মহামিছিলের আয়োজন”?
মন্ত্র মুগ্ধের মতো মিলির কথা শুনতে থাকা শান্তনু নিজের উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে মিলির কথার মাঝেই ব্যাঘাত ঘটায়।যদিও ওর প্রশ্নের জবাবে মিলি হালকা হেসে বলে,
-“দেয়ার ইউ গো!! একদমই তাই”!!
-“এবার বুঝলাম!! এদিকে ধীমান অধিকারী মহামিছিলের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আর ওদিকে আপনি বীরভূমের ওই ঠিকানায় যোগাযোগ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।তাই তো”!
চোখের ইশারায় শান্তনুর কথায় সায় জানিয়ে মিলি আবার বলতে থাকে,
-“এখান থেকে কলকাতায় ফিরে যাওয়ার একদিন পরই আমি সকালের গনদেবতা ধরে বোলপুর পৌছাই।তারপর সেখান থেকে একটা অটো বুক করি রূপপুরের জন্য।কিছুটা আমার সৌভাগ্যই বলতে পারো শান্তনু, যে অটোর ড্রাইভার মন্টুবাবু রূপপুরেরই বাসিন্দা ছিল।
-“আরিব্বাস!!সে তো দারুন ব্যাপার।তা মিনতি মাঝির ব্যাপারে কিছু জানতে পেরেছিলেন ওনার কাছ থেকে”!!
শান্তনুর প্রশ্নের জবাবে মিলি ওর কাছে বোলপুরের ঘটনার চিত্রায়ন শুরু করল।
-“তাই অটো বোলপুর স্টেশন চত্বর ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরই মন্টুবাবু লুকিং গ্লাসে বেশ সপ্রশ্ন চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন,
-‘আপনি কি রূপপুরে বেরাতে এসেছেন দিদিমনি’!!
আমি তখন ঘুরিয়ে ওনাকে প্রশ্ন করি,
-‘কেন বলুন তো’!!
উনি তখন খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে ইতস্ততভাবেই জবাব দেন,
-‘না আসলে অনেক টুরিস্টকেই দেখি ভীরভাট্টা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য রূপপুরে রিসর্ট বুক করে থাকে। কিন্তু তারা সাধারণত সদল বলে আসেন। আর তাছাড়া তাদের সাথে অল্প হলেও কিছু লাগেজ থাকে। আপনি একা এসেছেন তাও আবার ব্যাগপত্র ছাড়া তাই কৌতুহল বশত প্রশ্ন করে ফেলেছি।কিছু মনে করবেন না।
আসলে আমার বাড়িও তো ওই রূপপুরে,তাই যদি কারুর বাড়ি যাওয়ার হয় বলবেন আমি সেখানেই নামিয়ে দিয়ে আসব’!!
এমন লোভনীয় প্রস্তাব কি আর ছেড়ে দেওয়া যায় বলো!! ভাবলাম এই ভদ্রলোকের থেকেই না হয় কেসের লিটারেচার সার্ভেটা সেরে নিই।তাই সরাসরি প্রশ্ন করলাম ওনাকে,
-“মিনতি মাঝির বাড়ি চেনেন আপনি”!!
মন্টুবাবু আবার লুকিং গ্লাসে আমায় বেশ অবাক চোখে দেখে নিয়ে বললেন,
-“তাই বলুন!! আপনি তাহলে রিপোর্টার!! কিন্তু এতদিন পড়ে মিনু বৌদির ঘরে আসলেন যে!!বাকিরা তো সেই কবেই ছবি তুলে, ইন্টারভিউ নিয়ে ফিরে গেছেন”!!
এতো মহা মুশকিলে পড়া গেল। বেশ কয়েক মূহুর্ত মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করে মনে করার চেষ্টা করলাম, গত কয়েক মাসে মিনতি মাঝি বলে কারুর নাম কোনো নিউজ পেপারে পড়েছি কিনা। কিন্তু সে চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে আমাকে শেষমেশ ছলনার আশ্রয় নিতেই হল। খানিকটা আমতা আমতা করেই ওনাকে উত্তর দিলাম,
-‘আসলে আগেরবার আমাদের যে সাংবাদিক খবরটা করেছিলেন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে এবার আমি এসেছি খবরটা ফলোআপ করতে’!!
-‘ওহ্!!তাই বলুন।তাই তো ভাবছি, উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট তো সেই কোন জুন মাসে বেরিয়ে গেছে, জয়েন্টের রেজাল্টও বেরিয়ে গেছে সেই কবে! তাহলে এখন আবার সাংবাদিক কেন’!!
মন্টুবাবুর মুখে উচ্চ মাধ্যমিকের কথাটা শুনেই আমার মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলো আস্তে আস্তে উত্তেজিত হয়ে উঠল। সত্যিই তো, এবার তো রূপপুর বয়েজ স্কুলের সুমন মাঝি উচ্চমাধ্যমিকে রাজ্যে তৃতীয় হয়েছিল। শুধু তাই নয় ওদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ হওয়া সত্ত্বেও ছেলেটি উইদাউট এনি টিউশন জয়েন্টে সিক্সথ পজিশন পেয়েছিল।এই নিয়ে বেশ কয়েকদিন টিভি চ্যানেলে ভালোই হইহই হয়েছিল। তারমানে সুমন মাঝি আসলে মিনতি মাঝির ছেলে!! কিন্তু এই কেসের সাথে এদের কি সম্পর্ক! এরকম বেশ কিছু প্রশ্ন মাথায় গিজগিজ করতে থাকলে উত্তরের আশায় আমি মন্টুবাবুকে বললাম,
-‘আসলে আমাদের নিউজ পেপার সুমনের স্ট্রাগলটা নিয়ে একটা স্টোরি করতে চাইছে। আপনি তো নিশ্চই ওদের ভালো করেই চেনেন দাদা।কিছু বলুন না ওদের পরিবার সম্পর্কে’!!
ভদ্রলোক বেশ উৎসাহ নিয়েই শুরু করলেন।
-‘কি আর বলব দিদিমনি। সুমনের কপালটা ছোট থেকেই খারাপ। সুমনের যখন বছর তিনেক বয়স তখনই এক দুর্ঘটনায় ওর বাবা মারা গেলে মিনু বৌদি দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে একেবারে জলে পড়ে যায়। কাজ বলতে তো হারান দা, মানে সুমনের বাবা এখানকার পঞ্চায়েত প্রধান দীনেশ পালের বাড়িতে গাড়ি চালাতো।তাই হারান দার মৃত্যুর পর মিনু বৌদি দীনেশ বাবুর কাছেই গেছিলো একটা কাজের আশায়। দীনেশ বাবুও তখন না করেননি। মিনু বৌদিকে ওনার একমাত্র মেয়ে ইন্দ্রানীর দেখাশোনার কাজে বহাল করে দেন’।
এতটুকু শুনেই আমার শিরায় উপশিরায় তখন অ্যাড্রিনালিনের ক্ষরণ বেড়ে গেছে।আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলাম,
-‘ইন্দ্রানী মানে করিমপুরের বিধায়ক ধীমান অধিকারীর স্ত্রী’!!
ভদ্রলোক মনে হয় আমার জ্ঞানের ভান্ডার দেখে বেশ খুশি হলেন। বললেন,
-‘ঠিকই বলেছেন।তবে আমি যখনকার কথা বলছি তখন ইন্দু মায়ের বয়স বছর তেরো চোদ্দো হবে।তা দীনেশ বাবুর বাড়িতে ওনার মা মরা মেয়েটাকে দেখাশোনা করার কাজ পেয়ে মিনু বৌদির সংসার মেয়ে মনা আর ছেলে সুমনকে নিয়ে মোটামুটি হেসে খেলেই চলতে থাকে। ওদিকে দীনেশ বাবুর বাড়িতে কাজ করার সুবাদে ইন্দু মায়ের সাথে মিনু বৌদির মেয়ে মনারও বেশ ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। আর সেটাই কাল হলো মেয়েটার জীবনে।
এর কয়েক বছর পর ইন্দু মায়ের বয়স যখন বছর কুড়ি, তখন তার বিয়ে হয়ে যায় ওই ধীমান অধিকারীর সাথে। সেই সময় মনার বয়স বছর পনেরো আর সুমনের বয়স বড়ো জোর দশ।যদিও দীনেশ বাবু ভালো লোক ছিলেন।তাই মিনু বৌদিকে ইন্দু মায়ের বিয়ের পর বাড়ির অন্য কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সুমন ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভালো হওয়ার কারণে ওকে নিয়ে মিনু বৌদির বরাবরই অনেক আশা ছিল।যদিও মনার বিয়ের চিন্তায় তখন থেকেই ঘুম উড়েছিল বৌদির।গ্রামের সব লোক এমনকি দীনেশ বাবুও বলেছিলেন, ‘অমন লক্ষী প্রতিমার মত রং রূপ আর মা সরস্বতীর মতো গলা যে মেয়ের তার বিয়ে নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না বৌদি’।
কিন্তু পোড়া কপালের জ্বালা কি আর এত সহজে শেষ হওয়ার।ইন্দু মায়ের বিয়ের বছর চারেকের মাথায় হঠাৎ করেই রাতে বুকের ব্যাথা উঠে মারা যান দীনেশ বাবু।আর দীনেশ বাবুর মৃত্যুর পরই ওনার জামাইয়ের আসল চেহারাটা বেরিয়ে এলো।শ্বশুরের কাজে এসে মনার গলায় কৃষ্ণ নাম শুনে ওকে রাতের অন্ধকারে গ্রাম থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। গ্রামের কিছু লোককে নিয়ে মিনু বৌদি থানা পুলিশের দোর গোড়ায় অনেক জুতো ঘষেছিল গো দিদিমনি। কিন্তু বিধির বিধান কি আর খন্ডানো যায়!! রাজনৈতিক নেতাগুলো তো পুলিশ, আইন, আদালত সব নিজেদের পকেটস্থ করে বসে থাকে।তাই মনার ব্যাপারে পুলিশ বিশেষ কিছুই করেনি।উল্টে ওকে প্রতি পদে বদনাম করেছিল পুলিশ।মিনু বৌদি থানায় গেলেই তাকে শুনতে হতো,কোন ভাতারের সাথে মুখ কালো করে মেয়ে পালিয়েছে তার নেই ঠিক এখন পুলিশ কি করবে!!
এইসব শুনতে শুনতে বেচারি মিনু বৌদি ও আস্তে আস্তে সব ভগবানের নামে ছেড়ে দিয়ে থানায় যাওয়া বন্ধ করে দিল।
ওদিকে বাবার কাজের পর সেই যে ইন্দু মা লজ্জায় রূপপুর ছেড়ে শ্বশুর ঘরে ফিরে গেল আর কখনো এ গ্রামে ফিরে এলো না।বছর দুয়েক আগে একবার খবর পাওয়া গিয়েছিল মনা নাকি কানাই কীর্তনীয়ার কীর্তন দলের সাথে গান গাইছে। সেই শুনে সুমনকে নিয়ে মিনু বৌদি বহরমপুরে ছুটেছিল। কিন্তু সেখানে কি হয়েছিল বলতে পারবো নাকো।তবে লোক মুখে শুনেছিলাম, ইন্দু মা স্বামী শ্বশুর ঘরকে লুকিয়ে ওদের নিয়ে মনার কাছে গিয়েছিল। কিন্তু মনাই নাকি ফিরে আসতে চায়নি’!
মন্টুবাবুর মুখে পুরো ঘটনাটা শোনার পর মিনতি দেবীর সাথে কথা বলে জানতে পারি, ধীমান বাবু যে শুধু মৌমিতাকেই প্রতিনিয়ত ধর্ষন করতেন তা নয়।সেই একই অবস্থা সুমনারও ছিল।তাই সুমনা মায়ের সাথে এই গ্রামে আর ফিরে আসতে চায়নি।
আর ইন্দ্রানী দেবীর কথা জিজ্ঞেস করতে বলেছিলেন, ‘সে তো নিজেই রোজ জ্বলে পুড়ে মরছে গো মা। তাকে আর কি দোষারোপ করব বলো দেখি।আজ যে আমার ছেলেটা ভালো করে পড়াশোনা করে যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেছে সে তো ইন্দু মায়েরই দয়া। গত পাঁচ বছর প্রতি মাসে আমার সংসার চালানোর টাকা তো সেই পাঠিয়েছে গো।না হলে তো কবেই আমরা না খেতি পেয়ে মরে যেতাম’!!
এরপর কলকাতায় ফিরে এসে যখন কেসের সব ফ্যাক্টগুলো মায়ের সাথে আলোচনা করছি তখনই মা আমায় প্রশ্ন করে,’তোকে বহরমপুর থেকে করিমপুরে যাওয়ার জন্য ফোনটা কে করেছিল মিলি’!!
তখনই আমার টনক নড়ে। সত্যিই তো এত জরুরি একটা প্রশ্ন আমার মাথাতেই আসেনি!!সাথে সাথেই এক বন্ধুর সাহায্যে টেলিফোন কম্পানি থেকে নম্বরটা ট্রেস করালাম।দেখা গেল নম্বরটা কোনো এক সর্বজিৎ বাগচীর নামে রেজিস্টার্ড, কিন্তু ঠিকানাটা রূপপুরের।ঠিক করলাম আবার রূপপুরে ফিরে যাব,এই সর্বজিৎ বাগচীকে খুঁজে বের করার জন্য। কিন্তু তার মধ্যেই খবর পেলাম এম এল এ হোস্টেলে ধীমান অধিকারী খুন হয়েছেন।
।। ২২ ।।
-“অরণ্য স্যার আর উজান স্যার তাহলে আপনার এই আগের তদন্তের বিষয়ে একেবারেই অবগত নন”!!
অল্প হেসে শান্তনুকে উত্তর দেয় মিলি।
-“না একেবারেই অবগত নয়। হয়ত জানাতাম, কিন্তু সেদিন এম.এল.এ হোস্টেলে তদন্ত করতে গিয়ে যখন ইন্দ্রানী দেবীর স্পায়ের বোতল থেকে মুক্তোটা খুঁজে পাই, তখনই মনে হচ্ছিল এইরকমই একটা মুক্তোর আংটি আমি যেন কারোর হাতে দেখেছি। কিন্তু কার হাতে সেটা কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না”!!
-“সুমনার হাতে!!কালই তো যখন ওর হাতটা নিজের হাতে রেখেছিলেন তখনই তো দেখলাম”!
উত্তেজনায় ফুটতে থাকা শান্তনুকে শান্ত করে মিলি বলে,
-“ঠিকই বলেছো।তবে সেদিন সুমনার নামটা সঙ্গে সঙ্গে মনে আসেনি। শুধু একটা কথাই বারবার মনে হচ্ছিল,’ইন্দ্রানী দেবী কাকে আড়াল করার চেষ্টা করছে’!!
এই প্রশ্নের উত্তর পেতেই অরণ্যের সাথে হোস্টেলের সব স্টাফকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য নিচের হলঘরে এলাম। একে একে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যখন প্রায় শেষের দিকে, তখনই ঘরে ঢুকল এক বছর আঠারো উনিশের ছেলে। ছেলেটিকে দেখেই চমকে উঠলাম আমি।যদিও অরণ্যের সামনে ওকে দু চারটে ফরম্যাল প্রশ্ন করেই ছেড়ে দিয়েছিলিম। শুধু ওখান থেকে চলে আসার আগে একটা চিরকুটে আমার ফোন নম্বর আর অ্যাডড্রেসটা লুকিয়ে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে আসি।
সেদিন বিকেলেই ছেলেটির ফোন আসে আমার কাছে। তারপরই ওকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসি।ছেলেটা কে বুঝতে পারলে শান্তনু ঞ!!
বড় বড় চোখে জবাব দিলো শান্তনু।
-“সুমন মাঝি”!!
-“একদম ঠিক।আমাদের বাড়িতে পৌঁছানোর পরেই কাঁদতে শুরু করে দেয় সুমন। কিছুক্ষন পর আমার মা ওকে আশ্বস্ত করলে একটু ধাতস্থ হয়ে ও যা বললো তা কিছুটা এইরকম।
‘বছর দুয়েক আগে যখন ও আর ওর মা সুমনাকে ফিরিয়ে আনতে গিয়েছিল তখনই দুই দিদির দুরাবস্থা ওকে ভীষন ভাবে নাড়া দেয়। শুধু সুমনা নয় ইন্দ্রানীও নাকি প্রতি বছর সুমনকে ভাইফোঁটা দিত,রাখীও পড়াতো। সেই দিদিদের এই অবস্থা দেখে সুমন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি।
রূপপুরে ফিরে এসে এই পুরো ঘটনাটা সুমন জানিয়েছিল সুমনার ছোটবেলার বন্ধু জিতকে।এই জিতই হলো সর্বজিৎ বাগচী। সেই হয়ত একমাত্র মানুষ যে সুমনাকে ফিরিয়ে আনার জন্য গত পাঁচ বছর ধরে সবরকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল।তার সাহায্যেই গত পাঁচ বছর ধরে ইন্দ্রানী দেবী মিনতি মাঝিকে মাসে মাসে টাকাও পাঠাতেন।
এই সব কিছুর মাঝেই মৌমিতা অধিকারীর মৃত্যু আর অমিতের নিরুদ্দেশের ঘটনা ঘটলে সর্বজিতের কাছে আবার একটা সুযোগ আসে সুমনাকে উদ্ধার করার। ইন্দ্রানী দেবীর সহায়তায় সর্বজিৎ যোগ দিল ধীমান বাবুর দেহরক্ষী হিসেবে”!!
ছানাবড়ার মতো বড় বড় চোখ করে শান্তনু প্রশ্ন করল,
-“সা..বী..র”!!
চোখের ইশারায় আবার শান্তনুর কথায় সায় জানালো মিলি।
-“সর্বজিতের উদ্দেশ্য ছিল এক ঢিলে দুই পাখি মারার।সুমনার দুই ধর্ষক ধীমান অধিকারী আর বিমান অধিকারীকে এক সাথে শাস্তি দেওয়াই ছিল সর্বজিতের একমাত্র লক্ষ্য।সেই মতোই বিমান বাবুর নাম করে ডাক্তারের থেকে ফেক রিপোর্ট আর প্রেসক্রিপশন বানানো, ওনাকে এম এল এ হোস্টেলে টেনে এনে ধীমান বাবুর গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করা সবই করেছিল সর্বজিৎ। যদিও অবশ্যই ইন্দ্রানী দেবীর সাহায্যেই সে করছিল কাজগুলো। কারন আলমকে কাজে লাগিয়ে ইন্দ্রানী দেবীই তাহির হোসেনের রেকমেন্ডেশনে সুমনকে এম এল এ হোস্টেলের এই পার্ট টাইম কাজটা পাইয়ে দিয়েছিলেন।
সেদিন এম এল এ হোস্টেলের ওই রুমে রাতে সুমনও উপস্থিত ছিল।যদিও সে কেবলমাত্র তার ইন্দু দিদিকে বেঁধে ফেলার নাটকেই সামিল ছিল। কিন্তু কোনভাবে সেই কাজটা করতে গিয়েই সুমনের হাতের আংটি থেকে ওই মুক্তোটা খুলে পড়ে যায়।আর তাই সুমনকে আড়াল করতেই ইন্দ্রানী দেবী ওই মুক্তো নিজের স্পায়ের বোতলে লুকিয়ে ফেলেন”!!
-“তাহলে আপনার আবার বহরমপুর আসা,এই বেআইনি অস্ত্রের ঘটনা এগুলো কি…”!!
-“বেআইনি অস্ত্রের ব্যবসা তো একেবারে খাঁটি ঘটনা শান্তনু। দীর্ঘদিন ধরে দুই অধিকারী ভাই মিলে এই বেআইনি অস্ত্র পাচারে জড়িত।
আর আমি এবার বহরমপুরে ফিরে আসি অমিত আর মৌমিতার মৃত্যুর আসল কারণ খুঁজতে।আর সেই কারনটা খুঁজে পাই সুমনার সাথে কথা বলে।সত্যিই অমিতের থেকে মৌমিতা এই ব্যবসার কথা জেনে ফেলার জন্যই তাকে বেঘোরে প্রাণটা দিতে হলো।হয়ত অমিতকেও মেরে দিত ওরা। কিন্তু কনসাইমেন্টের বেশ কিছু অস্ত্র ও নিজের কাছে লুকিয়ে ফেলায় ওকে মারতে পারেনি অধিকারীরা”!!
-“কিন্তু ম্যাডাম, অপরাধীদের আড়াল করাটা কি সত্যিই উচিত হল”!!
শান্তনুর আমতা আমতা প্রশ্নের জবাবে দৃঢ় গলায় জবাব দিল মিলি।
-“তুমি ভাবতেই পারো আমি অপরাধীকে আড়াল করে অন্যায় করলাম।তাও আমি, আমি আড়াল করব এই মানুষগুলোকে। কারন আইনের কাজ অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া। কিন্তু ইন্দ্রানী দেবী, সুমনা, সর্বজিৎ, সুমন, মিনতি দেবী বিনা অপরাধে এত বছর যে শাস্তি পেয়ে এসেছে তারপর ওদের জন্য আর কোনো শাস্তি বরাদ্দ থাকতেই পারেনা!!
তাছাড়া আমি নাই ধীমান অধিকারীর মৃত্যু নিয়ে দুঃখিত আর নাই বিমান অধিকারীর ধরা পড়া নিয়ে চিন্তিত। মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা দুজন ধর্ষক, দুজন স্মাগলার শাস্তি পেয়েছে এটাই বড় কথা।আর আইনও আত্মরক্ষার তাগিদে করা অপরাধকে অপরাধ মানে না শান্তনু।তাই কয়েকজন নিরাপরাধ মানুষকে এই নরক থেকে বের করে আবার নতুন করে বাঁচতে সাহায্য করাটা যদি আইনের চোখে অপরাধ হয় তাহলে তুমি আমাকে অপরাধী ভাবতেই পারো। কিন্তু আমার বিবেক এই মানুষগুলোকে কাঠগড়ায় তুলতে সায় দেয়নি শান্তনু”!!
-“কিন্তু পুলিশ যদি সুমনা পর্যন্ত পৌঁছে যায়”!!
-“আশা করছি সুমনার হদিশ পুলিশ পাবেনা।কাল রাতেই সুমনাকে সর্বজিৎ এক নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিয়েছে। আমাদের চারপাশে আমরা কত সো কলড প্রোগ্রেসিভ মানুষ দেখি বলো! কিন্তু তার মধ্যে ক’জন আছে বলতো যারা সর্বজিতের মতো এমন উজার করে কাউকে ভালোবাসতে পারে!আমি নিশ্চিত সর্বজিতের ভালোবাসা আর সান্নিধ্য সুমনাকে খুব তাড়াতাড়িই আবার জীবনের মুল স্রোতে ফিরিয়ে আনবে “!!
-“আর সর্বজিতের কি হবে ম্যাডাম। পুলিশ যদি কোনভাবে ওকে ধরে ফেলে”!!
নৌকার পাটাতনে উঠে দাঁড়াল মিলি। রহস্যময়ী হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বললো,
-“কোন সর্বজিতের কথা বলছো শান্তনু!!আমি তো কোনো সর্বজিতকে চিনি না, তুমি চেনো নাকি”!!
মিলির জবাবের অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পেরে আর কথা বাড়ালো না শান্তনু। মুহূর্ত খানেক চুপ থাকার পর সেও পাটাতনে উঠে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে একটা খাম বের করে মিলির হাতে দিল।
-“কি এটা”!!
-“খুলেই দেখুন না”!!
খামের ভিতর থেকে কাগজটা সযত্নে বের করে চোখ বুলিয়ে নিতেই মিলির চোখে মুখ স্বভাবতই উচ্ছাসিত হয়ে উঠল।
-“এটা তো বাংলার একটা লিডিং নিউজ চ্যানেল!! ওরা তোমাকে সামনের মাস থেকে অ্যাস আ ক্রাইম রিপোর্টার জয়েন করতে বলেছে!!ইউ অ্যাকচুয়ালি ডিসার্ভ ইট শান্তনু।আই অ্যাম সো হ্যাপি ফর ইউ”!!
-“আশা করি কলকাতায় গিয়ে কাজে যোগ দিলে আপনার আরও কিছু কেস অ্যাসিস্ট করতে পারব।তখন কিন্তু না করলেও শুনব না। কিন্তু ম্যাডাম, এখনো একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে খচখচ করছে।যদি অভয় দেন জিজ্ঞেস করি তাহলে”!!
-“খচখচ যখন করছে, তখন জিজ্ঞেস করেই ফেলো”!!
-“এই কেসটার জন্য আপনার আর উজান স্যারের সম্পর্কে কোনো আঁচ…”!!
শান্তনুর অসমাপ্ত প্রশ্নটাকে শেষ করতে না দিয়েই উত্তর দিল মিলি।
-“আমার আর উজানের সম্পর্কটা কোনো কেসের বেড়াজালে সীমাবদ্ধ নয় শান্তনু। আমরা দুজনেই নিজেদের কাজের জায়গায় ভীষন পেশাদার, ভীষন ঐকান্তিক। কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা কাজ, পেশাদারিত্ব,কেস সবকিছু ছাপিয়ে।অনেকটা সর্বজিৎ আর সুমনার মতোই।উজান হৃদয় উজাড় করেই ভালোবাসে আমায়। আই পি এস উজান রায় আর মিলির উজানের তফাৎটা কলকাতায় এসে আমাদের সাথে কাজ করতে শুরু করলে বুঝতে পারবে।বুঝলেন মিস্টার ক্রিমিনাল রিপোর্টার”!!
নৌকো মাঝ গঙ্গা থেকে ধীরে ধীরে রাধার ঘাটের দিকে এগিয়ে যেতে থাকল।শীতের মিটে রোদ গায়ে মেখে নৌকা বিহারের শেষ মুহূর্তটুকুর স্বাদ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে থাকল মিলি। নৌকা যত ঘাটের কাছে এগিয়ে আসতে থাকল ততই দূর থেকে ভেসে আসা গানের কথাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
এটা গল্প কার, দেখো লিখছে কে?
ভুলে অন্ধকার আলো শিখছে কে?
কিছু আবদারের জানি নেই মানে
তোর সঙ্গে আজ আমাকে নে।
এগিয়ে দে, এগিয়ে দে
দু’ এক পা এগিয়ে দে
হাঁটতে চাই কয়েক পা তোর সাথে
এগিয়ে দে, এগিয়ে দে
দু’ এক পা এগিয়ে দে
হাঁটতে চাই কয়েক পা তোর সাথে।।
#সমাপ্ত