#রাজনীতির_অন্তরালে
#তমসা_চক্রবর্তী
#পর্ব-৪
।। ১৪ ।।
-“কেসটা দিন দিন আরও জটিল হয়ে উঠছে স্যার। এদিকে আর দিন দুয়েকের মধ্যে কেসের সমাধান না হলে আবার রাজনৈতিক চাপও বাড়তে থাকবে”!
টি-টেবিলের ওপর পা রেখে সোফায় শরীরটা হেলিয়ে দিয়ে বন্ধ চোখে কেসের ফ্যাক্টগুলো একের পর এক সাজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল উজান। অরণ্যের কথাগুলো কানে আসতে ধীরে ধীরে চোখ খুললো উজান।
-“সবই তো বুঝলাম ভায়া, কিন্তু এখনো পর্যন্ত পাওয়া সব ফ্যাক্টই ভীষন ভাসা ভাসা।এখনো এমন কোন তথ্যই আমাদের হাতে আসেনি যা আমাদেরকে নিশ্চিতভাবে খুনিকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে”!!
উজানের কথায় সায় দিয়ে অরণ্য বললো,
-“জানেন স্যার,আহেলী আন্টি মানে মিলির মায়ের একটা কথা মুখে সবসময় শুনেছি।আন্টি সবসময় বলেন,’সব তদন্তের একটাই সনাতনী ব্যাকরণ। যা আমাদের মেনে চলতেই হবে। তদন্তের সবথেকে বড় শক্তি হল ‘তথ্য’। তথ্যের সঠিক বিশ্লেষন যদি না করতে পারো তাহলে সাফল্য অধরাই থেকে যাবে।তাই সব তথ্যের মধ্যে থেকে কোনটা জরুরি সেগুলোকে চিহ্নিত করলেই, তদন্তের বৃত্তটা আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসল ছবিটা অনেক পরিষ্কার হয়ে উঠবে’। আমার মনে হয় স্যার, আমাদের সব ফ্যাক্টগুলোকে আবার প্রথম থেকে বিশ্লেষণ করা উচিত।হয়ত নতুন কোনো লিড পাব, যেটা এখনো পর্যন্ত আমাদের চোখে পড়েনি”।
-“ঠিকই বলেছ।চল আর একবার শূন্য থেকে শুরু করি”।
শরীর আর মনের সব ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে পূর্ণ উদ্যমে উজান আর অরণ্য আবার প্রথম থেকে কেসের ফ্যাক্টগুলোকে সাজাতে শুরু করল।
-“মাঝরাতে দরজা খোলার পর প্রথমেই বিধায়কের স্ত্রীর মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে তাকে তারই ওরনা দিয়ে বেঁধে ফেললো আততায়ীরা। তারপর তার চোখের সামনেই বিধায়ক ধীমান অধিকারীর গলায় ফাঁস লাগিয়ে খুন করা হয়।সেই সময় স্বামীকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখে জ্ঞান হারান ইন্দ্রানী দেবী। ওনার জ্ঞান ফেরে, যখন আলম আর সাবীর ওনার চোখে মুখে জল ছিটায়।
প্রথম প্রশ্ন: আলম আর সাবীর কিভাবে অত রাতে ধীমান বাবুর ঘরে পৌঁছাল আর কেনই বা পৌছাল।!! ইন্দ্রানী দেবী তো অজ্ঞান হয়ে ছিলেন।তাহলে ঐ ঘরে যে কোনো অঘটন ঘটেছে সেটা ওরা জানতে পারলো কিভাবে!! কে খবর দিয়েছিল আলম আর সাবীরকে”!!
উজানের প্রশ্নের জবাবে অরণ্য বলে,
-“সাবীরের বয়ান অনুযায়ী, বাইরে কোথাও গেলে,বডিগার্ড হিসেবে ও রাতে দুবার ধীমান অধিকারীর রুমের বাইরে টহল দিয়ে যায়।সেদিনও রাত এগারোটা নাগাদ একবার টহল দিয়ে এসেছিল সাবীর।হালকা করে দরজায় চাপ দিয়ে দেখেছিল দরজা ভিতর থেকেই বন্ধ ছিল। এতটা পথের ধকলে ধীমান বাবু সেদিন খুবই ক্লান্ত ছিলেন। তাই আর ডাকাডাকি না করে নিজের ঘরে ফিরে এসেছিল সাবীর। দ্বিতীয় বার সাবীর আবার ২/৫ এ টহল দিতে যায় রাত দুটো নাগাদ। তখনই ধীমান অধিকারীর ঘরের দরজায় অল্প ফাঁক দেখে ঘরে ঢুকে সাবীর দেখে বিছানার ওপর ধীমান বাবু গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় পড়ে আছেন আর ইন্দ্রানী দেবী বাথরুমের সামনে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছেন। তখনই সাবীর ইন্টারকমে কল করে নিচের ঘরে থেকে আলমকে ডেকে পাঠায়”!!
-“পোস্ট মর্টেম অনুযায়ী ধীমান বাবুর মৃত্যুর সময় কি ছিল”!!
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল উজান।
-“অ্যারাউন্ড রাত বারোটা”!!
-“রাত বারোটা থেকে দু’টো পর্যন্ত ইন্দ্রানী দেবী অজ্ঞান অবস্থায় ছিলেন!!দু’ঘন্টা একটা মানুষ শক্ পেয়ে অজ্ঞান থাকতে পারে”!!
উজানের গলার স্বরে অবিশ্বাসের ছোঁয়া পেয়ে অরণ্য বললো,
-“কোয়াইট আনন্যাচারাল।তবে আরও একটা ব্যাপার বেশ খটকা লাগার মত।আলমের বয়ান অনুযায়ী, ইন্দ্রানী দেবীর লো প্রেশারের সমস্যার জন্য খাওয়া দাওয়া ঠিকঠাক না করলে উনি মাঝে মাঝেই মাথা ঘুরে পড়ে যান এবং কখনো কখনো জ্ঞানও হারিয়ে ফেলেন।তার ওপর ওনার ওভারিয়ান টিউমারের সমস্যাও আছে।তাই উনি ধীমান বাবুর মৃত্যুর দৃশ্য দেখে আতঙ্কে চিৎকার করতে গেলে আততায়ীরা যখন ওনার পেটে লাথি মারে তখন উনি দীর্ঘক্ষনের জন্য অজ্ঞান হয়ে যান।
এখন প্রশ্ন হল, ধীমান বাবুর সেক্রেটারি হিসেবে আলমের কি ইন্দ্রানী দেবীর গাইনো সমস্যা জানার কথা স্যার”!!
-“বাথরুমে লুকিয়ে রাখা মুক্তোটার কথা ভুলে যেও না!! ওই মুক্তটা কার”!!
উদ্বিগ্ন উজানের প্রশ্নের জবাবে অরণ্য বললো,
-“এটাই এখন সবথেকে বড় রহস্য। ইন্দ্রানী দেবী কাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন সেটা জানাটা খুবই জরুরি”!
-“তারপর ধরো, ধীমান অধিকারীর মৃত্যুর পর তাহির হোসেন বেশ কয়েকবার ইন্দ্রানী দেবীকে ফোন করেছিলেন। আবার ডক্টর মল্লিকের বয়ান অনুযায়ী ধীমান অধিকারীর অসুস্থতার ফেক কাগজ বানানোর জন্য ওনাকে তাহির হোসেনই বাধ্য করেছিলেন”!
-“তাহির হোসেনকে এইসব প্রশ্ন করাতে কিন্তু বেশ সুকৌশলে এড়িয়ে গেছে।ওর বয়ান অনুযায়ী, ‘একজন ডাক্তার কার না কার কথায় ধীমান বাবুর অসুস্থতার জাল কাগজপত্র বানিয়েছিলেন, তার আমি কি জানি!এখন সবাই রাজনৈতিক চক্রান্ত করছে। আমাকে ফাঁসানোর জন্য ওই ডাক্তার এখন আমার নাম করছে।আগে প্রমান করুন আমি ওকে এই কাজ করতে বলেছি, তারপর এসব দোষে আমাকে আরোপিত করবেন’।
আর ইন্দ্রানী দেবীকে ফোন করার ব্যাপারে ওনার বক্তব্য হল, ‘ আমাদের এলাকার একজন বিধায়ক মারা গেছেন,আমি শোক প্রকাশ করার জন্য তাঁর স্ত্রীকে ফোন করতে পারিনা!!আজব তো!!এই দুঃসময়ে যদি মানুষ মানুষের পাশে না দাঁড়ায় তাহলে আর কখন দাঁড়াবে’!!
এই তাহির হোসেন কিন্তু পাক্কা খেলোয়াড় স্যার।ওর এগেইনস্টে শক্তপোক্ত প্রমান না পেলে ওকে ছোঁয়াও যাবেনা”!!
-“ঠিকই বলেছ।তবে এই আলম ও কিছু কম যায়না বুঝলে!!সে ও তো বলছে, জন্নত আর তার খুবই ভালো সম্পর্ক। দেড়বছর আগে জন্নতের সাথে তাহিরের বিয়ে হয়। কিন্তু সেটা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ ছিল না। জন্নত বাড়ির অমতে তাহিরের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়েটা করে।তাই প্রায় মাস ছয়েক জন্নতের সাথে কথাবার্তা বন্ধ ছিল আলমের। তারপর আস্তে আস্তে সম্পর্ক আবার ঠিক হলে ওদের নিয়মিত কথাবার্তা শুরু হয়।এমনকি ধীমান বাবুও নাকি জানতেন, যে তাহিরের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী আলমের বোন”।
শুকনো গলায় অরণ্য উজানের কথায় সায় দিয়ে বলে,
-“সবার বক্তব্যই কিন্তু আমাদের গোল গোল ঘুরিয়ে আবার সেই শূন্যতে ফিরিয়ে আনছে স্যার”!!
।। ১৫ ।।
-“ম্যাডাম আপনি কিন্তু সাপের গর্তে হাত দিতে যাচ্ছেন। কোনোভাবে যদি একবার আমাদের ধরে ফেলে তাহলে কিন্তু আর বেঁচে ফিরতে পারবেন না”!!
শান্তনুর উদ্বিগ্ন মুখটার দিকে তাকিয়ে মিলি ওকে আশ্বস্ত করল।
-“এতো ভয় পেলে সাংবাদিকতা করবে কি করে!! চুপচাপ ভিতরে চলো।ভয় নেই”!!
বাড়ির বাইরে থেকে দরজাটা আস্তে করে চাপ দিতেই খুলে গেল। মাটির উঠোন পেরিয়ে দুই ধাপ মাটির সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে দাওয়ায় উঠে গলার স্বর যথাসম্ভব খাদে নামিয়ে মিলি ডেকে উঠলো,
-“সুমনা..”!!
দাওয়ার সামনের ঘরের দরজাটা সন্তর্পনে খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো বছর পঁচিশের এক ভীত সন্ত্রস্ত মহিলা।গায়ের রং ফর্সা, মাথায় তিলক কাটা,গলায় বৈষ্ণব মালা।
-“আবার কেন এসেছেন বলুন তো”!!
সুমনার গলার স্বরে ভীতির ছাপ স্পষ্ট। মিলি ওর কাঁধে হাত রেখে বললো,
-“পাঁচ মিনিটের জন্য কথা বলতে চাই সুমনা।প্লিজ না করো না”!!
এদিক ওদিক তাকিয়ে সুমনা ভীত গলায় বললো,
-“ভিতরে আসুন। এখানে কেউ আপনাদের দেখে ফেললে আর রক্ষে থাকবে না”!!
সুমনার সঙ্গে ঘরের ভিতর ঢুকে এল মিলি আর শান্তনু। হাতের ইশারায় ঘরের মধ্যে রাখা খাটিয়াটা দেখিয়ে সুমনা বলে,
-“বসুন! কিন্তু যা বলার তাড়াতড়ি বলুন।কেউ এসে পড়লে আর রক্ষে নেই”!!
-“তুমি তো এখানে অনেকদিন ধরে আছো সুমনা।আমি জানি, তোমাকে বোলপুরের এক আসর থেকে এখানে প্রায় তুলে আনা হয়েছিল কীর্তন দলের গায়িকা হিসেবে। তুমি তো বিমান বাবুকে প্রতিনিয়ত দেখছো।যদি আমি খুব ভুল না হই তবে ধীমান বাবুর সাথেও নিয়মিত সাক্ষাৎ হত তোমার। তুমি নিশ্চই কিছু বলতে পারবে ওদের সম্পর্কে!! মৌমিতা দেবীর মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল কিছু তো নিশ্চই জানো তুমি”!!
-“আমি কিছু জানি না দিদিমনি। তোমাকে আগেও বলেছিলাম আমি কিছু জানি না।ওরা যদি জানতে পারে আমি তোমাকে ঘরে বসিয়ে কথা বলেছি, আমাকে কেটে ফেলবে দিদিমনি। তোমরা চলে যাও এখান থেকে”!!
হাত জোড় করে মিনতি করতে থাকে সুমনা।মিলি ওর অসহায় মুখটার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে,
-“বেশ চলে যাচ্ছি।তবে তোমায় কয়েকটা কথা জানিয়ে যেতে চাই।তোমার ভাই উচ্চ মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করেছে সুমনা। এবছর কলকাতায় ভালো কলেজে ভর্তিও হয়েছে। আর তোমার মা!!গত পাঁচ বছর ধরে প্রতিদিন বটতলায় শিবের মন্দিরে গিয়ে মাথা ঠুকে আসেন যাতে ভগবান তোমাকে ওদের কাছে আবার ফিরিয়ে দেন”!!
মিলির কথা শুনতে শুনতে সুমনার চোখ ছাপিয়ে বৃষ্টি নামলো। হঠাৎই মিলির হাত দুটো ধরে আক্ষেপ করে উঠে,
-“ধীমান বাবুর চরিত্র নিয়ে আর কি বলব দিদিমনি!! লোকের কাছে আমি মতই কীর্তন দলের গায়িকা হই না কেন,আদপে আমাকে উনি নিজের রক্ষিতাই বানিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু মৌ দিদি তো ওনাদের বাড়ির বৌ ছিল বলো!!ওর সাথেও কি কম অন্যায় করেছেন!!যখন কেউ থাকতো না, মৌ দিদি মাঝে মাঝেই এখানে আসত। আমার কাছে অনেক মনের কথা বলতো।প্রায়ই বলতো, দুই ভাই মিলে আমার জীবনটা শেষ করে দিল’!
এর কিছুদিন পর মৌ দিদির জীবনে এক চিলতে আশার আলো জাগিয়ে এলো অমিত দা। দুজনেই একে অপরের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছিল জানো তো। সেইসময় অমিত দা একদিন এ বাড়িতে এসে আমায় বললো,’ মনা, কানাই কীর্তনীয়ার শেষ কাজটা করেই মৌকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাব’! ওরা দুজন ভালোবেসে সুখে থাকবে এটা ভেবেই আমার খুব ভালো লাগতো জানো দিদিমনি”!!
সুমনা একটু থামতেই শান্তনু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
-“কানাই কীর্তনীয়া!!মানে বিমান বাবু”!!
-“হ্যাঁ। তোমাদের বিমান অধিকারীকে কীর্তন দলের সবাই কানাই কীর্তনীয়াই বলে। একবার শুনেছিলাম ওনাকে ছোটবেলায় নাকি ওনার ঠাকুরদা কানাই বলে ডাকতো”!!
-“কিন্তু অমিত তো ধীমান বাবুর বডিগার্ড ছিলেন!! বিমান বাবুর জন্য ও আবার কি কাজ করতো”!!
মিলি উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করল সুমনাকে।
-“তা ঠিক বলতে পারবো না গো দিদিমনি।তবে অমিত দাকে তো কানাই কীর্তনীয়াই ধীমান বাবুর কাছে কাজে লাগিয়েছিল।আমরা কোন জায়গায় কীর্তন গাইতে যাব তার বরাত তো বরাবর অমিত দাই নিয়ে আসতো”।
শান্তনু আর মিলি নিজেদের মুখ চাওয়া চাওয়ি করল।
-“আচ্ছা সুমনা,বিমান বাবু কি কীর্তন ছাড়া আর কোনো কাজ করেন!!মানে যেখানে অমিত ওনাকে সাহায্য করত”!!
সুমনা একটু ভেবে বললো,
-“নিশ্চিতভাবে বলতে পারবো না গো দিদিমনি।তবে মাঝে মাঝে ওনাকে ফোনে অদ্ভুত সব কথা বলতে শুনেছি।কখনো বলতেন,
‘সামনের অমাবস্যায় পদ্মার ইলিশ আসবে’। আবার কখনো শুনেছি বলছেন, ‘ঢাকের তালে কোমর দোলে’।আর তো তেমন কিছুই মনে করতে পারছি না গো”!!
একটু থেমেই হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যাওয়াতে সুমনা বলে উঠে,
-“তবে বেশিরভাগ কীর্তনের আগের রাতেই উনি ঢোল কাঁধে ফেলে অমিতদার সাথে বেরিয়ে যেতেন। একদিন চুপিচুপি অমিতদাকে জিজ্ঞেস করাতে মুচকি হেসে বলেছিল, ‘পদ্মাপারে ইংলিশ আনতে যাচ্ছি’।
কিন্তু কোনোদিনও কানাই কীর্তনীয়া বা অমিত দাকে ইলিশ হাতে ফিরতে দেখিনি”!!
সুমনার হাতটা হঠাৎ করে ধরে মিলি বলে ওঠে,
-“তোমাদের খোল,করতাল এগুলো কোথায় থাকে জানো তুমি”!!
অবাক হয়ে সুমনা বললো,
-“কেন জানবো না!!এই পাশের ঘরেই তো আছে”!!
মিলি সঙ্গে সঙ্গে ছুটলো পাশের ঘরে, বাদ্য যন্ত্রগুলো চাক্ষুষ করতে। মিনিট খানেক পর আবার এ ঘরে ফিরে আসতে শান্তনু খেয়াল করলো মিলির চোখ দুটো চকচক করছে।ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই মিলিকে সুমনা বলে উঠলো,
-“আর বেশিক্ষণ এখানে থেকো না দিদিমনি, যেকোনো সময় কেউ এসে পড়বে”!!
সুমনার হাত দুটো ধরে মিলি বলে,
-“মৌমিতাকে কে মারল সুমনা”!!
মাথা নিচু করে সুমনা বলে ওঠে,
-“মৌ দিদি মরার আগের দিন রাতে অমিত আর কানাই কীর্তনীয়ার খুব ঝামেলা হয়েছিল।তখন অমিত দাকে উনি বারবার বলছিলেন,’আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার ফল কিন্তু ভালো হবে না অমিত’!
তখন অমিত দাও বীর বিক্রমে বলে,’ বেশি বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু তোমাদের সব গোপন কথা রুলিং পার্টির কাছে ফাঁস করে দেব। এমনিতেই আমি একজনকে তোমাদের কথা সব জানিয়ে রেখেছি। যদি আমার কিছু হয়, তোমরা কেউ বাঁচবে না। তাই ভালোয় ভালোয় আমাকে যেতে দাও বিমান দা’!!
তখন কানাই কীর্তনীয়া শুধু বলেছিলেন,’ আমার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে তুই পার পাবিনা কিন্তু অমিত’!!
এরপর কানাই কীর্তনীয়াকে ধাক্কা মেরে অমিত দা বাইক নিয়ে চলে যায়”।
সুমনা একটু থামলে মিলি ওর কাঁধে হাত রেখে বলে,
-“তুমি চিন্তা করো না সুমনা। তোমাকে আমি খুব শীঘ্রই এখান থেকে বের করে নিয়ে যাব”!
মিলি নিজের ব্যাগটা কাঁধে ফেলে শান্তনুকে উঠতে ইশারা করলো।ওরা দরজার দিকে পা বাড়াতেই পিছন থেকে সুমনা মিলিকে ডেকে বললো,
-“অমিত দাকে ওরা এখনো মারেনি দিদিমনি”!!
আবার সুমনার কাছে ফিরে এল মিলি। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
-“তুমি জানো অমিত কোথায় আছে”!!
কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল সুমনা।
মিলি এরপরেই নিজের ব্যাগ থেকে মুক্তের বাক্সটা বের করে সুমনার সামনে ধরতেই চমকে উঠলো সুমনা। ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল,
-“এ..টা,এটা আপনার কাছে…”!!!
সুমনার হাতটা নিজের হাতের ওপর রাখলো মিলি।
।। ১৬ ।।
-“কি ব্যাপার বলতো অরণ্য রাত নটা বাজতে চললো মিলি এখনো ফিরল না।ফোনটাও সুইচ অফ। অচেনা জায়গায় একা একা কোথায় কি যে করছে মেয়েটা”!!
উজানের চোখে মুখে উদ্বিগ্নতার ছাপ দেখে অরণ্য উত্তর দেয়,
-“আমিও অনেকবার ট্রাই করলাম ফোনে, কিন্তু সুইচ অফ বলছে বারবার।আর কিছুক্ষন দেখি, না ফিরলে তখন ব্যবস্থা নিতে হবে”!!
ঘরের দরজা খুলে বিদ্যুতের গতিতে ঘরে ঢুকল মিলি। ওর পিছন পিছন ধীর পায়ে ঘরে প্রবেশ করল শান্তনু।
-“আমায় খোঁজার জন্য ব্যবস্থা করতে হবে না। কলকাতা থেকে যেটুকু ফোর্স আনিয়েছিস সেই নিয়ে আজ রাতে বেরোনোর ব্যবস্থা কর”!
নিজের কথা শেষ করেই অরণ্যকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আবার ঝড়ের বেগে নিজের ঘরে ফিরে গেল মিলি। অরণ্য আর উজান কিছু বুঝতে না পেরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শান্তনুকেই প্রশ্ন করল,
-“কোথায় গিয়েছিল মিলি!!আর তোমার সাথেই বা কোথায় দেখা হল”!!
-“ধীমান অধিকারীর বাড়ি থেকে বেরিয়েই তো ম্যাডাম আমাকে ফোন করেছিলেন”!!
-“সেই দুপুর থেকে তুমি মিলির সাথে আছো!!একটা ফোন করবে তো!! আমরা এদিকে চিন্তা করছি”!!
উজানের গলায় উষ্মা প্রকাশ পেলে শান্তনু বলে,
-“আমি কি করে জানবো যে ম্যাডাম আপনাদের কিছু না জানিয়েই বেরিয়েছেন”!!
-“তাও ঠিক!! কিন্তু তোমরা গিয়েছিলে কোথায়”!!
-“কোথায় যায়নি জিজ্ঞেস করুন!! বহরমপুর থেকে জলঙ্গী সব একদিনেই ঘুরিয়ে আনলেন ম্যাডাম”!!
-“মানে”!! অরণ্য ভ্রু কুচকালো।
-“মানে আর কি!!প্রথমে করিমপুর,তারপর জলঙ্গী,তারপর বহরমপুর থানা সব ঘুরে এলেন ম্যাডাম”!!
।। ১৭ ।।
‘করিমপুরের বিধায়ক ধীমান অধিকারীর হত্যাকান্ডে ধৃত বিমান অধিকারী আর তার সাগরেদ রজত বৈরাগীকে গ্রেপ্তার করল কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা।বিরোধী পার্টির নেতা ধীমান অধিকারী ও তার ভাই বিমান অধিকারীর সাথে বাংলাদেশ থেকে ভারতে বেআইনি অস্ত্র পাচারকারীদের যোগসূত্রের আভাস পেয়েই গভীর রাতে জলঙ্গীতে অভিযান চালায় গোয়েন্দা দপ্তরের অফিসাররা। গতকাল রাতে বাংলাদেশ থেকে প্রায় কয়েক লক্ষ টাকার বেআইনি অস্ত্র এদেশে পাচার করতে গিয়ে পুলিশের জালে ধরা পড়ে বিমান এবং রজত। জনদরদী নেতা আর কীর্তন দলের গায়কের মুখোশের আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা এই বেআইনি অস্ত্র ব্যবসার কথা ধীমান বাবুর পূর্ব দেহরক্ষী অমিত মারফত কয়েক মাস আগে জেনে ফেলেন বিমান অধিকারীর স্ত্রী মৌমিতা অধিকারী। মৌমিতা দেবী নিজের বাপের বাড়ির লোকজনকে এবিষয়ে অবগত করার চেষ্টা করলে মাস দুয়েক আগে নিজের বাড়িতেই বলপূর্বক ওনাকে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খাইয়ে হত্যা করেন অধিকারী ভাতৃদ্বয়।যদিও নিজের পদকে কাজে লাগিয়ে এই মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে চালানোর যথেষ্ট চেষ্টা করেন ধীমান বাবু। কিন্তু অধিকারী বাড়ির ঠাকুর ঘর থেকে গোয়েন্দারা বাবাকে লেখা মৌমিতা দেবীর একটি চিঠি কাল দুপুরে উদ্ধার করেন।যেখানে মৌমিতা দেবী এক বেআইনি ব্যবসা এবং নিজের প্রাণ সংশয়ের কথা উল্লেখ করেন।
মৌমিতা দেবীর মৃত্যুর পর থেকেই দুই ভাইয়ের সম্পর্কে ফাটল ধরতে শুরু করলে, ধীমান অধিকারী এই বেআইনি অস্ত্র ব্যবসা থেকে বিমান বাবুকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চান। এরপরেই বহরমপুরের এক নামকরা ডাক্তারকে দিয়ে বেআইনিভাবে ধীমান বাবুর মিথ্যা অসুস্থতার রিপোর্ট তৈরি করে ওনাকে কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন বিমান অধিকারী আর তার সাগরেদ রজত বৈরাগী।
এরপর এম এল এ হোস্টেলের রেনভেশনের সুযোগ নিয়ে সিকিউরিটি অফিসারের চোখে ফাঁকি দিয়ে রাতে ধীমান বাবুর রুম পর্যন্ত পৌঁছে যায় বিমান আর রজত। সেখানে ধীমান বাবুর স্ত্রী ইন্দ্রানী দেবীকে শারীরিকভাবে কাহিল করে ওনার চোখের সামনেই বিমান আর রজত মিলে গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করে ধীমান অধিকারীকে।
পুলিশের জেরার মুখে নিজেদের অস্ত্র পাচারের ব্যবসার কথা স্বীকার করলেও ধীমান বাবুকে হত্যার কথা অস্বীকার করেছেন বিমান অধিকারী।বিমান অধিকারী পুলিশের কাছে জানিয়েছেন, যখন যেখানে অস্ত্র চালান করার থাকত, সেখানেই নাম কীর্তনের বায়না ধরা হতো। যেহেতু বেশিরভাগ সময়ই রাজ্যের বাইরে অস্ত্র চালান করার ডিল থাকতো, তাই নিজেদের কীর্তনের খোলের (ঢাক,যা বাজিয়ে কীর্তন গাওয়া হয়) মধ্যে লুকিয়েই বিমান অধিকারী পাচার করতেন এই অস্ত্র।
যদিও বিমান অধিকারীর সব দাবি নস্যাৎ করে দিয়ে এতদিন পর মুখ খোলেন ধীমান বাবুর স্ত্রী ইন্দ্রানী দেবী।ইন্দ্রানী দেবী জানিয়েছেন, ওনার এবং ধীমান বাবুর একমাত্র ছেলেকে প্রতিনিয়ত হত্যার হুমকি দিচ্ছিলেন বিমান অধিকারী।তাই এতদিন মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হন তিনি। এছাড়াও মৌমিতা দেবীর হত্যার দিন থেকে নিখোঁজ ধীমান বাবুর পূর্ব দেহরক্ষী অমিতকেও কাল রাতে ধীমান বাবুর করিমপুরের বাড়ি থেকে অর্ধচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করেছে পুলিশ।অমিতের বয়ান অনুযায়ী, ওদের শেষ কনসাইমেন্টের সব অস্ত্র লুকিয়ে ফেলায় অমিতকে ওরা মারতে পারেনি। প্রতিনিয়ত শারীরিক নির্যাতনের শিকার হলেও নিজের মুখ খোলেনি অমিত।অমিত এও জানায় যে ধীমান বাবুকে হত্যার পরিকল্পনা তার সামনেই করেছিল বিমান আর রজত।
এদিকে পুলিশ সুত্রের খবর অনুযায়ী আজই বহরমপুর আদালতে তোলা হবে বিমান আর রজতকে। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে বিমান আর রজতকে গোয়েন্দা দপ্তর নিজেদের হেফাজতে নেওয়ার পক্ষে আজ তারা আদালতে সওয়াল করবে’!!
মুর্শিদাবাদ টাইমসে শান্তনুর লেখা আর্টিকেলটা পড়ার পর উজান বললো,
-“শান্তনু তো জনগণের সামনে দুই অধিকারী ভাইয়ের মুখোশ একেবারে টেনে খুলে দিয়েছে”!!
-“তা যা বলেছেন স্যার। কিন্তু সকাল সকাল মিলি আর শান্তনু আবার কোথায় বেপাত্তা হল বলুন তো”!!
মুচকি হেসে উজান অরণ্যের উদ্দেশ্যে বললো,
-“এত বছরের বন্ধুত্বের পরেও নিজের বন্ধুকে চিনলে না অরণ্য!! আমরা কেস সলভ হওয়ার খুশিতে যতই উচ্ছাসিত হইনা কেন,একটা কথা জেনে রাখো। এই সাফল্য শুধু মাত্র কয়েনের একপিঠ। আমরা ততটাই দেখলাম যতটা মিলি আমাদের দেখালো।আমি নিশ্চিত কয়েনের অন্য পিঠটা এখন আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে”!!
বিস্মিত চোখে অরণ্য বললো,
-“মানে!! বিমান অধিকারী খুন করেনি বলছেন”!!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উজান উত্তর দিলো,
-“জানি না। হয়ত করেছে বা হয়ত করেনি। কিন্তু এই মুহূর্তে সব তথ্য প্রমাণ বিমান আর রজতের বিরুদ্ধে।আর আদালত তো আমার প্রেডিকশন শুনবে না, শুনবে শুধু তথ্যের বিশ্লেষন।আর সব তথ্যই এই মুহূর্তে চিৎকার করে বলছে,’বিমান অধিকারী ই খুনটা করেছে’!!
কিন্তু আমার ইনটিউশন বলছে,এই কেসে ইন্দ্রানী দেবীর মত মিলিও কাউকে আড়াল করার চেষ্টা করছে”।
উজানের পর্যবেক্ষনের বিপক্ষে এই প্রথমবার নিজের মত প্রকাশ করল অরণ্য।
-“এটা মনে হয় আপনি ঠিক বলেছেন না স্যার। মিলি কেন অপরাধীকে আড়াল করবে!!ওর কি স্বার্থ থাকতে পারে”!!!!
সামান্য হেসে রহস্যময় গলায় উত্তর দিলো উজান।
-“ভুলে যেওনা অরণ্য, আমাদের অনেক আগে থেকেই কিন্তু এই কেসটা মিলি ইনভেস্টিগেট করছে।আর যে কেসে ও একবার হাত দেয় সেটার নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হাল ছাড়ার পাত্রী ও নয়।তাহলে এই কেসটা ও কেন মাঝ পথে ছেড়ে দেবে বলতে পারো!!
আর তোমার মনে আছে কিনা জানিনা,মিলি আমাদের একবার বলেওছিল,’আমি কিন্তু কেসটা এখনো ছেড়ে দিইনি’।
তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই কেসের এমন অনেক তথ্য মিলির কাছে আছে যা ও আমাদের কাছে গোপন করে যাচ্ছে”!!
#ক্রমশ