#রহস্যময়_সারপ্রাইজ
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
#শেষ পর্ব
পুলিশ ভ্যানে হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় বসে আছে তুরাগ, স্বরূপা,অভিলাষ, শিলা,মৃদুল ও কৌশিক। সবারই চেহারায় পরাজয়ের হতাশা, অসুস্থতার মলিনতা আর অপরাধবোধ ফুটে উঠেছে। দশ দিনের রিমান্ডে চালানো শাস্তির ধকল এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। রিমান্ড টর্চারে সবাই জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছে। ভালোই টর্চার হয়েছে, তা তাদের চেহারায় লক্ষণীয়। কারো চেহারায় আগের মতো দৃঢ়তা কিংবা উজ্জ্বলতার দেখা যাচ্ছে না। কাউকে আর মায়াবী লাগছে না। সবার চোখের নিচে কালো দাগ, শুকিয়ে চোয়ালে হাড় যেন উঁকি দিচ্ছে। ঠিকমতো দাঁড়াতেও কষ্ট হচ্ছে। কয়েকজন পুলিশ সবাইকে ধরে নিয়ে গেছে।
ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের উপর টর্চার কম হয়েছে। তাতেও তারা নিজেদের নেতিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারেনি। আজ আদালতের শুনানি শুনে তারা আরো নেতিয়ে গেল।
সমস্ত প্রমাণ আসামীদের বিরুদ্ধে থাকায় আদালত সবার সাজা শুনিয়েছে। তুরাগ, অভিলাষ,মৃদুল,কৌশিককে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে নারীদের ফাঁসির আদেশ দেয়া হলেও কখনো ফাঁসি কার্যকর করা হয় নি। নারী আসামীদের সাধারণত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। সে হিসেবে স্বরূপা আর শিলাকে ও সাজা হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দণ্ডিত করার আদেশ দেয়া হয়েছে। স্বরূপার সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। শিলা মাস তিনেকের গর্ভবতী হওয়ায় এবং এতসবে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায় তাকে বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও খুনে ও খুনীদের সহযোগিতা করায় ফরেনসিক ল্যাবের পাঁচজন ডাক্তার, মানষিক হাসপাতালের একজন ডাক্তার ও নার্সকে জরিমানা-সহ দু’বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়েছে।
আদালতে ফাঁসির রায় শুনানোর পর থেকে সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছে স্বরূপা আর শিলা। তারা প্রিয়জনের মৃত্যুর আভাস মেনে নিতে পারছে না। শিলা তো কিছুক্ষণ পর পর পেটে হাত দিয়ে অভিলাষের দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠছে। অভিলাষ তখন অন্যদিকে ফিরে চোখের পানি লুকাতে ব্যস্ত। স্বরূপা স্থির দৃষ্টিতে তুরাগের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে তার । তুরাগ মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে কান্না দমিয়ে রাখছে। যদিও তা পারছে না। অবাধ্য অশ্রুগুলো গড়িয়ে পড়ার সিদ্ধন্তে অটল। তারা নিজ সিদ্ধান্ত মতোই গড়িয়ে পড়ছে।
কৌশিক থমথমে চেহারা নিয়ে বসে আছে। আদালত চত্বরে দেখা মা বোনের করুণ চেহারা চোখের উপর ভেসে উঠছে বারবার! বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে। সত্যিই লোভ আর প্রতিশোধের মন মানুষিকতা, নেশা কিংবা সাপ পোষার মতো। মানুষকে সর্বস্বান্ত করে ছাড়ে। খানিক সুখ দিলেও পরে সাপুড়ের পালিত সাপের মতো নিজেকেই ছোবল মারে। পালিত সাপের কামড়েই মৃত্যু হয় তার। ভালোই তো ছিলাম। বাবা, মা আর ক্লাস নাইন পড়ুয়া ছোট বোনটাকে নিয়ে বেশ সুখেই ছিলাম। ডাক্তার হয়ে বের হওয়ার পর কতই না সুনাম অর্জন করেছিলাম। বাবা মা, বোনের গর্বের কারণ হয়েছিলাম। হঠাৎ লোভ নামক বিষধর সাপ এসে ভাগ্যের খাতায় ধরা দিল। সেই সাপ পুষতে গিয়েই সব হারালাম। একবারেই ঘৃন্য কাজ করলাম, ঘৃণা কুড়ালাম, অতঃপর নিজেকে ধ্বংস করলাম। একদিন সকালে চায়ের কাপ হাতে পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষরের খুনির ফাঁসির আদেশ শিরোনাম দেখে মানুষের মূল্যবোধের পরিবর্তন চাওয়া আমিই দুদিন পর তেমনি শিরোনাম হব! মানুষ ঘৃণ্য চোখ বুলিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে? এটা কি হওয়ার ছিল! আমি সবসময় চাইতাম আমার আদরের ছোট্ট বোন কৌশানীকে সুখী করতে। দুনিয়ায় সব সুখ এনে দিতে। কিন্তু সেই চাওয়াকে অগ্রাহ্য করে আমি কি করলাম! তাকে নরকীয় জীবন দিলাম! এখন সবাই নিশ্চিয়ই তাকে দেখলেই বলবে, খুনীর বোন! আমাকে নিয়ে গর্ব করা আমার বোনটা তখন অপমানে মরে যেতে চাইবে। আমার বাবা মা? তারা তো জীবন্ত লাশ হয়ে যাবে! আমার একটা কাজে আমার আশেপাশে সবার জীবন নরক করে দিল! এইজন্যই বলে, কোন অপরাধ করার আগে হাজার বার ভাবো। কারণ অপরাধ করলে শাস্তি পাবে তুমি। তোমাকে শাস্তি পেতে দেখে শান্তি নামক শব্দটা উঠে যাবে তোমার পরিবারের। তারাও শাস্তি পাবে। এমন হাজারো ভাবনা নিয়ে জীবন সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত কৌশিক।
অপরদিকে মৃদুল মাথা নিচু করে চোখের জ্বল ফেলছে। আদালত চত্বর থেকে পুলিশ ভ্যানে উঠানোর আগে তার দিকে তাকিয়ে আঁচলে মুখ গুজে মায়ের কান্না করার দৃশ্যটা বারবার চোখে ভাসছে। বুকটা ফেটে যাচ্ছে। মা বারবার চিৎকার করে বলছিল, বাবা বলনা ওরা মিথ্যা বলছে,তুই এসব করিস নি? আমার কত ভালো ছেলে ছিলি তুই। এসব করতে পারিস না। মায়ের কথার উত্তর ছিল না তার কাছে। শুধু মাথাটা বাকিয়ে এক নজর মাকে দেখে মাথা নিচু করে সামনে চলে গেল। সেই নজরে মায়ের পাশে ছোট্ট বোন মৃধাকে ও চোখে পড়েছিল। কেমন করুন চোখে তাকিয়েছিলো! এই বোনের মলিন মুখ না দেখার জন্যইতো সে এত খারাপ কাজ করল। অথচ কাজের কাজ কিছুই হলো না। উল্টো বোনটাকে নরকিয়ে জীবন উপহার দিলো। এটা কি হওয়ার ছিলো!
সবাই যখন ভাবনার গহীনে বিরাজ করছে তখন পুলিশ ভ্যানের দরজা ঘেঁষে বসা নিতিন বলল,
“একটা চমকপ্রদ তথ্য শুনবেন সবাই? বিশেষ করে তুরাগ, অভিলাষ আর স্বরূপা। ”
নিতিনের কথায় সবাই ভাবনা থেকে বের হয়ে নিতিনের দিকে তাকাল। নিতিনের অপজিট সিটে বসা অধরাও এক রাশ কৌতুহল নিয়ে নিতিনের দিকে তাকাল। নিতিন বলল,
“মি. তুরাগ,অভিলাষ, আর মিসেস স্বরূপা আপনারা বাবা মায়ের খুনি ভেবে যাকে এবং যার মেয়েকে মেরেছেন মূলত তিনি আপনাদের বাবা মাকে খুন করেন নি।”
নিতিনের কথায় সবাই বিস্ময় হলো। অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইল।
সবার বিস্ময়ের মাত্রা বাড়াতে বিস্তারিত বলল নিতিন,
“অতীব দুঃখের সাথে বলছি যে, প্রভাত মির্জার সাথে সিহাব বিশ্বাসের ইয়াবা প্রচার নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকলেও মূলত সিহাব বিশ্বাস এবং তার স্ত্রী শতরূপা মেহেক বীণাকে প্রভাত মির্জা খুন করেন নি। তিনি এসবে জড়িত ছিলেন না। প্রভাত মির্জার দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে আপনাদের চাচা পলাশ বিশ্বাস সিহাব বিশ্বাস এবং তার স্ত্রীকে খুন করেছেন। সব কলা কৌশল তিনিই করেছেন। প্রথমে হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়েছেন। পরে আপনাদের কাছে প্রভাত মির্জাকে খুনী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।”
স্বরূপা অস্ফুটস্বরে বলল, “চাচা!”
তুরাগ অবিশ্বাস্য স্বরে বলল, কিন্তু চাচা এমনটা কেন করবে?”
নিতিন উত্তর দিল,
” কারণ হিসেবে সিহাব বিশ্বাসের রাজশাহীর শহরাঞ্চলে একটা জমিকে দায়ী করা যায়। এই জমির প্রতি শুরু থেকেই লোভ ছিলো পলাশ বিশ্বাসের। তাই আপনার বাবা মাকে মারলেন। তারপর স্বরূপাকে দত্তক দিলেন। তারপর অভিলাষকেও দত্তক দিলেন। তুরাগকে শহর ছাড়া করতে অভিলাষের ঢাকার থাকার কথা বললেন। তার বিশ্বাস ছিলো, অভিলাষের কথা শুনে তুরাগ ঢাকা চলে যাবে। তারপর সবকিছুই তার। কোন বাধা নেই। হলোও তাই। আপনারা সবাই চলে গেলেন। পলাশ বিশ্বাস সিহাব বিশ্বাসের সব সহায় সম্পত্তি কব্জা করলেন। যেই জমির জন্য সিহাব বিশ্বাস এবং তার স্ত্রী খুন হলেন সেই জমিতে এখন শোভা পাচ্ছে পলাশ শপিংমল। পলাশ বিশ্বাস বেঁচে থাকলে আপনাদের সাথে তারও ফাঁসি হতো, কিছু খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, তিনি বছর পাঁচেক আগেই মারা গিয়েছেন। আফসোস তার শাস্তি এ পারে দেয়া গেল না, অপারে পাবেন নিশ্চিত। ”
” ফলাফল দাঁড়ায়, একটা ভুল তথ্যের জন্য দুটো নির্দোষ মানুষের জীবন গেল। এত পরিকল্পনা করার আগে একটাবার যদি পেছু ফিরে ঘটনা উদঘাটন করে দেখতে তবে হয়তো দুটো প্রাণ যেত না। “রাগত স্বরে বলল অধরা। চোখে মুখে আফসোসের রেখা ভাসছে।
সবসময় হাসি লেগে থাকা নিতিনের চেহারা এ পর্যায়ে গম্ভীর হলো। রাশভারী গলায় বলল,
” দুটো নয় তিনটি প্রাণ যেত না। শুধু প্রভাত মির্জা আর প্রতিভা মির্জা মরেনি। তিহানা জাহান ও মারা গেছেন। আদালত চত্ত্বরে থাকতেই আমার কাছে খবর এসেছে তিহানা জাহান তৃতীয়বারের মতো স্ট্রোক করেছেন। এবং ঘন্টাখানেকের মাঝেই মারা গেছেন। প্রথমবার তিনি মাইনর এট্যাক করেছেন প্রভাত মির্জার নিখোঁজ হওয়ার পর। যা ধরা যায় নি। দ্বিতীয়বার করেছেন স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে। এতদিন তার ঠিকমতো হুশ ছিল না। কাল রাতে তার অবস্থা কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। কিন্তু আজ সকালে কোন একভাবে তিনি জেনে যান যে তারা স্বামী আর মেয়েকে তুরাগ,স্বরূপা খুন করেছে। যাদের তিনি নিজের সন্তানের মতো ভাবতেন। বেশ ধাক্কা খেলেন। তারপর ধাক্কা সইতে না পেরে তৃতীয়বারের মতো স্ট্রোক করে ঘন্টাখানেকের মাঝে মারা গেলেন। তার মৃত্যুর জন্যও এরাই দায়ী। সঠিক তথ্য না জেনে একটা পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছে। প্রতিভা বড় হওয়ার পর থেকে প্রভাত মির্জা স ছেড়ে দিয়ে সৎ মানুষ হয়ে গেছেন।”
নিতিনের চোখে মুখে রাগের শিখা দেখা গেল। এই প্রথম তাকে রাগতে দেখা গেলো। রাগে চেহারাটা ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। অধরা নিতিনের দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
” এদের নাম ‘বিশ্বাস’ না রেখে অবিশ্বাস রাখা উচিত ছিলো। বিশ্বাস নাম নিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। প্রথমে পলাশ বিশ্বাস, তারপর এরা সবাই করল প্রতিভার সাথে। তারপর করল পুরো দেশবাসীর সাথে৷”
থেমে আফসোসের সুরে বলল,
” মানুষের ধ্বংস মানুষ নিজেরাই ডেকে আনে। সম্পত্তি নামক ভয়ংকর সাপ সদৃশ জিনিসটা তার ভয়ংকর ছোবলে সব ধ্বংস করল। আহ্! প্রতিভারা বাবা মেয়ে শুধু শিকার হলো। কোন দোষ ছিল না তাদের। ভাবতেই খারাপ লাগছে। ”
এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অধরা।
নিতিন নিজের রাগ সামলে সবার দিকে একবার তাকাল। এস এই ভি তখনো বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে আছে। সবাই বাকরূদ্ধ। কারো মুখে কোন কথা নেই। তারা কী করতে চেয়েছে আর কি করেছে তাদের নিজেদেরই খেয়াল নেই। নিতিন সবার দিকে তাকিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তুরাগের দিকে তাকিয়ে ব্যথিত স্বরে বলল,
” মি.তুরাগ আপনাদের প্রতিশোধের দাবানলে জ্বলে প্রতিভার সাথে সাথে আপনাদের বাচ্চাটাও জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেল। বাবা হয়ে সন্তানকে নিজের হাতে খুন করলেন! কী নির্মমতা! ”
নিতিনের কথায় তুরাগের মনের মলিনতা বৃদ্ধি পেল। হু হু করে কেঁদে দিল।
★
দেখতে দেখতে ফাঁসির দিন এসে গেল। অনেক আকুতি মিনতির পর ফাঁসির আগে তুরাগ আর অভিলাষকে একি মামলার আসামী শিলা এবং স্বরূপার সাথে দেখা করতে দেয়া হয়। যাকে বলে শেষ দেখা। শেষ দেখার পুরো মুহুর্তটা ছিল হৃদয়বিদারক। শেষ দেখা করতে এসে তুরাগ আর অভিলাষ তাদের প্রিয়তমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। চোখ বেয়ে অঝোরে জ্বল ঝরছিল। আর তাদের প্রিয়তমারা? তারা তো গগনবিদারী বিলাপ জুড়ে দিয়েছিল। আহ্! এ দেখা শেষ দেখা। আর দেখা হবে না! আজকের পর থেকে এই মানুষ দুটোর মুখখানা আর দৃশ্যমান হবে না! তারা শুধুই স্মৃতিতে বন্দি থাকবে, বাস্তবে কোন অস্তিত্ব থাকবে না ভাবতেই গায়ে কাটা দিচ্ছে দুই যুগলের।
তুরাগ স্বরূপার হাত ধরে কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
“ভালো থেকো, নিজের খেয়াল রেখো! নিজের যত্ন নিও। কান্নাকাটি করো না।”
স্বরূপা তো কেঁদেই ব্যাকুল। কী জবাব দিবে সে!
অভিলাষ শিলার হাত ধরে ভেজা গলায় বলল,
” হৃদি নিজের এবং আমাদের সন্তানের খেয়াল রেখো। আমি তো ওকে দেখতে পারব না। তুমি দেখে রেখো। জেলখানার এই নরকীয় জীবনের মাঝে না রেখে তোমার মায়ের কাছে কিংবা আমার মায়ের কাছে দিয়ে দিও। পৃথিবীতে এলে তাকে বলে দিও, তার বাবা তাকে অনেক ভালোবাসতো।”
বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল । আর শিলা প্রতিত্তোরে ভেজা গলায় বলল,
” তোমাকে ছাড়া আমি নিঃস্ব চঞ্চল। আমি বাঁচব না, আমি মরে যাব।”
এমন হৃদস্পর্শিক বাক্যলাপের মাঝে শেষ হলো দুই যুগলের অন্তিম সাক্ষাৎ। বিদায়ের পর শিলা আর স্বরূপা খুব কাঁদল। যথারীতি রাত আট টা নাগাদ তুরাগ,অভিলাষ, মৃদুল, কৌশিক এই চারজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তবে পরদিন কারাগার থেকে চারটি নয় মোট ছয়টি লাশ বের করা হয়। তুরাগ, অভিলাষের মৃত্যুর পর সে রাতেই জেল খানার শিকের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে শিলা আর স্বরূপা। একসাথে পরপারে পাড়ি জমায় চারজনই। ইহজাগতে চারজন সুখে থাকার কথা থাকলেও নিজেদের কৃত কর্ম তা হতে দিল না। কৃতকর্মের ফল হিসেবে পরপারে পাড়ি জমাল। যদি তারা অপরাধ না করতো তবে কতোই না সুখী হতো!
শিলা,স্বরূপার মৃত্যুর সাথে সাথে মুছে গেল সব। মামলাও নিষ্পত্তি হয়ে গেল। লোভ, প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা কতগুলো জীবন কতগুলো পরিবার ধ্বংসের কারণ হলো! মানুষের মাঝে আজ মূল্যবোধের বড়ই অভাব। তাই তো মানুষ কোন বিষয়কে সহজ ভাবে না নিয়ে কঠিন ভাবে নিয়ে নিজের এবং আশেপাশের মানুষদের ধ্বংসের মুখে দাঁড় করায়।
★
বেশ খোশমেজাজে আছে অধরা। অবশেষে প্রতিভাকে ন্যায়বিচার দিতে পারল তারা। বিশ্বাসঘাতকরা শাস্তি পেল তবে। ভাবতেই খুশি লাগছে তার।
ফুরফুরে মেজাজে নিজ কেবিন থেকে বের হলো। গায়ে জড়ানো সালমন কালার শার্ট,শার্টের হাতা কনুই অবধি জড়ানো, ফর্সা হাতে সোনালী চেইনের ডায়াল ঘড়ি। পরনে ব্ল্যাক ডেনিম প্যান্ট, বুক অবধি চুল পনিটেইল বাধা। একবারেই ফর্মাল লুক। আজ কেসের কাজ ছিল না বিধায় সিভিল ড্রেসেই এসেছে। এখন সে যাবে পুলিশের হেড অফিসে। উদ্দেশ্য, কয়েকদিনের ছুটি নেয়া। বিগত সময়ে প্রতিভা কেস নিয়ে যা দৌড়াদৌড়ি করেছে ক’দিন বিশ্রাম না করলেই নয়। শরীরটাও একটু আরাম চায়। অধরা ভেবে নিয়েছে কম হলেও সপ্তাহখানেকের ছুটি নিয়ে পরিবারের সাথে সময় কাটাবে। পেশার বাইরে ব্যক্তিগত জীবনটা উপভোগ করবে। পারলে দু’একটা ডে ট্যুর ও দিবে। আহ্! কতদিন ঘুরতে যাওয়া হয়না। এবার আর কোন বাধা নেই। ঘুরতে যাওয়ার কথা ভাবতেই আনন্দে মনটা নেচে উঠল। এখন ছুটি পেলেই হয়।
“হেই, ইন্সপেক্টর? ”
থানা গেট অবধি আসতেই পিছন ডাক পড়ল অধরার। অধরা থেমে গিয়ে পিছন ঘুরল। দেখল তার পিছনে নিতিন দাঁড়িয়ে আছে। অধরা নিতিনকে দেখে ভ্রু কুঁচকাল। নিতিনের এখানে থাকার কথা নয়। কেসে সমাধানের সাথে সাথে এই থানায় তার কাজ শেষ তবে সে কেনো এলো সেটা বুঝতে পারছে না অধরা। অধরাকে দাঁড়াতে দেখে নিতিন অধরা সামনে এসে দাঁড়াল। গ্রীন কালার শার্টের সাথে গ্রে কালার প্যান্ট পড়েছে। ফর্সা শরীরে রং দুটো বেশ মানিয়েছে। চোখ মুখে প্রশান্তির আভা লেগে আছে। ঠোঁটের কোনে হাসি। সেই হাসির খানিক আভা চোখে লেগেছে। নিতিনের চেহারাই বলে দিচ্ছে এই মুহুর্তে বেশ খুশি সে।
অধরা ভ্রুজোড়া আরো কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে বলল,
“মি. নিতিন আপনি এই সময়, এখানে!
নিতিন অধরার কুঁচকানো ভ্রু দিকে তাকিয়ে হাসল। হেসে কোমল স্বরে ডাকল,
“মিসেস অধরা?”
নিতিনের কথায় অধরা চারপাশে চোখ বুলাল। তারপর নিতিনের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো। বিস্ময়ে উপর নিচ করে বলল,
” হোয়াট! কিসের মিসেস, কার মিসেস?”
নিতিন মোলায়েম গলায় সহজ স্বীকারোক্তি দিল,
“অবশ্যই আমার মিসেস। অন ডিউটিতে কি ভুলে বসেছো না কি অস্বীকার করছো?”
অধরা বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। নিতিন থেকে বোধহয় এমন কিছু আশা করেনি। অধরার বিস্ময়মাখা চোখে দৃষ্টি রেখে নিতিন বলল,
” আমরা দুজনেই অফ ডিউটিতে আছি এখন। সুতরাং, এখন পার্সোনাল লাইফ সিস্টেমটা অন করাই যায়, তাই না মিসেস নিতিন সরকার?”
অধরা বিস্মিত, সন্দেহী চোখে তাকিয়ে বলল,
“বুঝলাম না। কিসের অফ ডিউটি?”
নিতিন পকেট থেকে একটা ভাজ করা কাগজ বের করে ভাজ খুলে অধরার সামনে মেলে ধরল। অধরা কৌতুহল চোখে কাগজের মাঝে কালো কালির লেখা গুলোয় চোখ বুলাল। হেড অফিস থেকে আগত বার্তা। যাতে বলা হয়েছে নিতিন আর অধরাকে মাসখানেকের জন্য কর্মবিরতি দেয়া হয়েছে নিজ জীবন উপভোগের জন্য। তাদের ছুটি শুরু হয়েছে আজ সকাল থেকে। কাগজটায় চোখ বুলিয়ে অধরা অবাক চোখ নিতিনের দিকে তাকাল।
নিতিন প্যান্টের পকেটে দুহাত গুজে চমৎকার হেসে বলল,
” আমার প্রেয়সী মনে মনে খুব আশা করেছিল, এই চ্যালেঞ্জিং কেস সমাধান হলে সে ঘুরতে যাবে। তাই স্ত্রীর মনে আশা পূরণ করার ছোট্ট প্রয়াশ। ”
বিস্ময় ঠেলে অধরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মুচকি হেসে বললো,
“থ্যাংকস নিতিন। এই ছুটিটার দরকার ছিলো। আসামীদের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে ভুলে গিয়েছি, থানার বাইরে আলাদা একটা জীবন আছে আমার।তারপর বলো, লম্বা ছুটি তো পেয়েছো এবার পরিকল্পনা কী?”
নিতিন প্রিয়তমার চোখে চোখে রাখল। ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
“বিয়ের বছর গড়ালেও দেশা রক্ষা করতে গিয়ে সংসার করা আর হয়ে উঠলো না। ভাবছি ক’টাদিন সংসার করব। টিপিক্যাল হাজবেন্ড হব। এই ধারা? চলো না এই মাস খানেক সময়ে লাভ বার্ডস হয়ে যাই?”
অধরা তার গেজ দাঁত বের করে মায়াবী হাসি দিয়ে নিতিনের হাত ধরে বলল,
” আইডিয়া মন্দ না। চলো, যাওয়া যাক? ”
“চলো।”
অধরার হাত জড়িয়ে বলল নিতিন। তারপর হেসে পা বাড়াল দুজন।
নিতিন অধরার যাওয়ার পর তাদের পিছনে ঠাস করে কিছু পড়ার শব্দ হলো। মূলত, গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা জিহাদ সেন্সলেস হয়ে নিচে পড়ে গিয়েছে। অধরার কেবিনে ফোন ফেলে এসেছিল। তা ফেরত দিতেই অধরার পিছন পিছন এসেছিল। কিন্তু গেটের কাছে যেতেই নিতিন অধরার রসায়ন দেখে সে ভালোই ধাক্কা খেয়েছে। কারণ এতদিন কাজ করেও সে জানতো না এরা স্বামী স্ত্রী। এমনকি কেউ জানে না। দুজনেই বিবাহিত তা জানে কিন্তু তাদের স্ত্রী,আর স্বামী কে জানতো না। কাজের সময় পারিবারিক বিষয় টানা পছন্দ নয় অধরার। কাজের সময় কাজ, এর বাইরে কিছু নয়।
কী ব্যবহার দুজনার! সন্দেহ করার কোন পথ আছে? কেউ ঘূনাক্ষরেও বলবে এরা স্বামী স্ত্রী! জিহাদ জ্ঞান হারানোর আগে একটাই কথা বলছিল,
” মির্জা মার্ডার কেস থেকে এরা দুজন বেশি রহস্যময়। এসআইভি থেকে ও এরা বেশি অভিনয়ে পরিপক্ক। এই কেসের সবচেয়ে সারপ্রাইজিং নিউজ হলো নিতিন অধরার স্বামী স্ত্রী হওয়া। এটাই মূল রহস্যময় সারপ্রাইজ। যার আন্দাজ কেউ করতে পারেনি ।”
সমাপ্ত…