রহস্যময় সারপ্রাইজ পর্ব ৬

0
300

#রহস্যময়_সারপ্রাইজ
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
#পর্ব-৬

অধরা নিজ মনে তুরাগের নাম আওড়িয়ে জিহাদকে ডাক দিল। জিহাদ অধরার কেবিনে আসার পর দেখল অধরা খাতা কলম হাতে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে। তা দেখে জিহাদ ভ্রু কুঁচকাল। কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে বলল,
” আপনাকে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে ম্যাডাম। কিছু হয়েছে কী?”
অধরা আনমনে বলল,
” চিরকুটের সংখ্যাটার মানে বের করতে পেরেছি। ”
“২০১ এর মানে কী, ম্যডাম?”
কৌতুহলী কন্ঠে বলল জিহাদ। অধরা চিন্তিত কন্ঠে উত্তর দিল,
” তুরাগ…

অধরাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বিস্মিত চোখে চেঁচিয়ে বলল জিহাদ,
” সাংঘাতিক! তুরাগ খুন করেছে? কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব? তুরাগের তো পা অচল। সে কিভাবে এসব করতে পারে? আর কারো সাহায্যে করলে কেনোই বা করেছে? নিজের স্ত্রীকে এভাবে মারল কেনো! কী কারণ, এত নাটকীয়তা কেনো?”

কথার মাঝে ফোঁড়ন দেয়ায় অধরার চোখে মুখে বিরক্তির আভা দেখা গেলো। যেন জিহাদ বিরক্তিকর কোন কথা বলে ফেলেছে। অধরা ভ্রু কুঁচকে বিরক্তিঘন স্বরে বলল,
“আমি বলেছি তুরাগ খুন করেছে? আমার কথাটা তো শেষ করতে দিবে, নাকি!”

অধরার কথায় জিহাদ চুপসে গেল। মিনমিনে স্বরে বলল,
“স্যরি,ম্যাডাম! আসোলে খুব কৌতুহল কাজ করছিল তাই আর কী, নিজের কৌতুহলকে দমিয়ে রাখতে পারি নি।”

“ব্যাপার না। তবে নেক্সট টাইম আগে পুরো কথা শুনবে, তারপর রিয়েক্ট করবে। বাক্যের এক শব্দ শুনে পুরো বাক্য নিজ মনে আন্দাজ না করে পুরো বাক্য শুনে তারপর বাক্যের ভাবার্থ বের করা উচিত। গট ইট?”
গম্ভীর গলায় বলল অধরা। জিহাদ মাথা নিচু করে বলল,
“ইয়েস ম্যাডাম।”
“যাক হোক মূল কথায় আসি, তুরাগ এখন কোথায় আছে, জানো?”
“আমি যতটুকু জানি, তুরাগ এখন প্রভাত মির্জার বাড়িতে আছে। স্ত্রী মারা যাওয়ার শোকে পাথর হয়ে গিয়েছে সে। তা ছাড়া সে এতিম মানুষ কোন আত্মীয় স্বজন নেই। তাই প্রভাত মির্জা তুরাগকে তার বাসায় নিয়ে গেছেন। ”

জিহাদের দীর্ঘ উত্তর শুনে অধরা এবারো মনে মনে বিরক্ত হলো। যেখানে তিন শব্দে উত্তর দেয়া যেতো সেখানে তিন লাইন ব্যবহারের কী মানে! এই জিহাদটা সবসময় বাড়িয়েই কথা বলে। মনের বিরক্তিটা মনেই চেপে রাখল, প্রকাশ করল না। গম্ভীরমুখে বলল,
” ধানমন্ডি থানা পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে তুরাগের নিরপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ…

“তুরাগ যদি খুনী হয়, তবে তাকে গ্রেফতার না করে তার নিরপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে কেনো?”
আবারো ফোঁড়ন কাটল জিহাদ। অধরা এবার যেন বিরক্তির উচ্চ সীমায় পৌঁছে গেল। সে কড়া চোখে জিহাদের দিকে তাকাল। অধরার দৃষ্টি দেখে জিহাদ বুঝতে পারল যে সে আবারও ভুল করে ফেলেছে। ভীত ঢোক গিলে নিরবতার চাদরে স্বর ঢাকল। খানিক বাদে মিনমিনে গলায় বলল,
“স্যরি ম্যাডাম!”

অধরা এবার বেল বাজিয়ে আদাবরকে ডাক দিল। আদাবরকে দিয়ে প্রতিভা মামলা তদন্তের সাথে যুক্ত সবাইকে কেবিনে আসতে বলল। সবাই আসার পর অধরা গম্ভীর গলায় বলল,
” আমার কথা শেষ না হওয়া কেউ কথা বলবেন না। মনোযোগ দিয়ে কথা শুনবেন, আমি কথা বলতে বলার পর বলবেন।”
“জ্বি, ম্যাডাম।” বলে সবাই সায় জানাল।

অধরা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তার চেহারার গম্ভীর্যতা ধরে রেখে বলল,
” ফরেনসিক ল্যাব থেকে ফোন এসেছে। সকালে পাওয়া পোঁড়া লাশটা অভিলাষের, তা নিশ্চিত করা হয়েছে। মামলা জটিল থেকে জটিলতর হতে যাচ্ছে। মামলার শুরুতে মালিক সমিতিকে সন্দেহ করেছিলাম, পরপরই তারা পালালো। দারোয়ানকে সন্দেহ করলাম সে নির্দোষ বের হলো। এরপর প্রমাণের ভিত্তিতে অভিলাষকে সন্দেহ এবং আটক করলাম। রিমান্ড শেষে ও তার থেকে তেমন কোন তথ্য পাওয়া গেলো না। উল্টো সে অপহরণ হয়ে খুন হলো। এতে বুঝা গেলো অভিলাষকে ফাঁসানো হয়েছে। মামলা ঘুরানোর গুটি হিসেবে ব্যবহার করেছে অভিলাষকে। সব কিছু অভিলাষের উপর চাপিয়ে খুনী আড়ালে থেকে গেছে।

অভিলাষের লাশের সাথে একটা চিরকুট পাওয়া গিয়েছে। খুনী আমাদের উদ্দেশ্যে অভিলাষের মাধ্যমে চিরকুট পাঠিয়েছে। চিরকুট দ্বারা খুনী আমাদের কিছু একটা বলেছে এমনটাই আমার ধারণা ছিল। চিরকুটে লেখা ছিল একটা সংখ্যা আর একটা ইমুজি। সংখ্যাটা হল,’২০১’। একটা সংখ্যা দ্বারা কী বুঝিয়েছে এই কথাটা চিরকুট দেখার পর থেকে আমার মাথায় ঘুরছিল। সূত্র নিয়ে গবেষণা শুরু করলাম। ‘২০১’ সংখ্যাটা বিশ্লেষণ করলাম, ভাঙলাম। অনেক চিন্তা গবেষণার পর অবশেষে ২০১ দিয়ে তারা কী মিন করেছে তা ধরতে পেরেছি।”

অধরা থামল। সবার দিকে একপলক চোখ বুলাল। উপস্থিত সবার চোখে কৌতুহল। ছুটে বেড়াচ্ছে প্রশ্নের দল। কিন্তু কেউ অধরার ভয়ে মুখ খুলতে পারছে না। সবার কৌতুহল দেখে অধরা মুচকি হাসল।
তারপর বলল,
“সবার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। কৌতুহল দমিয়ে রাখুন। ২০১ সংখ্যা দ্বারা বুঝানো হয়েছে তাদের পরবর্তী শিকার তুরাগ। অর্থাৎ অভিলাষের পর খুন হবে তুরাগ। খুনী খুবই চালাক আর দূরন্ত। সবকিছুই নিখুঁত ভাবে করছে। এতটাই সতর্কতার সাথে করছে যে কোন সূত্র থাকছে না। আমাদের ভীষণভাবে ঘুরাচ্ছে সে। আমরা মালিক সমিতিকে সন্দেহ করলাম, তারা পালিয়েছে। হতে পারে খুনী তাদের জোর পূর্বক দেশছাড়া করেছে, যাতে তারা আমাদের হাতে না লাগে! অভিলাষের ব্যাপারের মতো ভাবতে গেলে তেমনি হয়েছে। অভিলাষকে আমরা সন্দেহ, আটক এবং রিমান্ডে নিলাম। মূলত, আমাদের সন্দেহটা অমূলক ছিল। অভিলাষ খুনের তালিকায় ছিল না। খুনী নিজেকে বাঁচাতে অভিলাষকে খুনী হিসেবে উপস্থাপন করেছে। সবকিছু এমনভাবে সাজিয়েছে যে অভিলাষকেই খুনি ভাবতে বাধ্য। অভিলাষ নির্দোষ ছিল। কারণ অভিলাষ খুনের সাথে যুক্ত থাকলে তাকে মারা হতো না। অভিলাষকে ফাঁসানো হয়েছে। অভিলাষ হয়তো খুনীদের ব্যাপারে টুকটাক জানতো। খুনীদের সম্পর্কে এখন মুখ না খুললেও পরে মুখ খুলতে পারে এই ভেবে অভিলাষকেও খুন করা হয়েছে। এমনটাই ধারণা আমার । এরপর প্রশ্ন উঠবে, অভিলাষ আর মালিক সমিতির কেউ খুন না করলে খুন কে করেছে? কোথাও এই খুন তুরাগ করেনি তো? এই সন্দেহটা খানিক উঁকি দিয়েছিলো আমার ও মনে। আর তা অভিলাষের লাশ দেখার পরপরই। কিন্তু চিরকুট দেখে সেটাও স্পষ্ট হয়ে গেল। নাহ, খুন তুরাগ ও করেনি। কারণ তুরাগ খুন করলে নেক্সট টার্গেট নিজে হতো না। এখন আমাদের কাজ হচ্ছে প্রথমে তুরাগের নিরপত্তার ব্যবস্থা করা এবং যত দ্রুত সম্ভব খুনীকে বের করা। খুনী ভীষণ চালাক, সুযোগ পেলে সুক্ষ্মভাবে তুরাগকে ও খুন করবে। কেউ টের পাবে না। তাই আমাদের সবার চোখ কান খোলা রেখে ভাবতে হবে। শুরু থেকে ভেবে দেখতে হবে কোথাও কোন সূত্র রেখে এসেছি কি না। সামান্যতম সন্দেহের কিছু চোখে পড়লেও আমাকে জানাবেন সবাই । প্রমাণ সব আবার চেক দিন। ঠিকাছে?”
” জ্বি ম্যাডাম। ”
সবাই সায় জানালো। অধরা তার চেয়ারে বসে বলল,
“এবার কারো কোন প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন। আছে কারো প্রশ্ন?”

জিহাদ আমতাআমতা করছে। তার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরছে। করা ঠিক হবে কি না ভাবছে। অধরা সবার দিকে একবার তাকাল। তারপর জিহাদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“জিহাদ তোমার কোন প্রশ্ন আছে? থাকলে নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করো।”

অধরার কাছ থেকে অনুমতি পেয়ে জিহাদের চোখে মুখে খুশির ঝিলিক খেলে গেল। যেন সে আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। খুশিমনেই জিহাদ বলল,
“ম্যাডাম আপনি ‘২০১’ এর মানে কিভাবে বের করলেন? ”

অধরা মুচকি হেসে বলল,
“১৪+৫+২৪+২০+২০+১+১৮+৭+৫+২০+২০+২১+১৮+১+৭ যোগ করে দেখো তো যোগফল কত হয়?”

জিহাদ মিনিট দুয়েক সময় নিয়ে মনে মনে যোগ করে বলল,
“যোগফল ‘২০১’ হয়। কিন্তু এই সংখ্যাগুলো কোথা থেকে আসল, ম্যাডাম? ”

অধরা মুচকি হেসে একটা খাতা জিহাদের দিয়ে বাড়িয়ে দিল। জিহাদ খাতাটা নিয়ে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে অধরার দিকে তাকাল। অধরা টেবিলের মাঝে থাকা মাটি রঙের কলমদানি থেকে একটা কলম নিয়ে জিহাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“কলম নাও আর আমি যা বলছি তা লিখো। আমার সমাধান করে দেখানো থেকে তুমি নিজে সমাধান করলে মজা পাবে বেশি।”

কৌতুহলী হয়ে জিহাদ কলম নিল। অধরা বলল,
“খাতায় একটা ইংরেজি বাক্য লিখো। আর হ্যাঁ, সব অক্ষরের মাঝে বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁক রাখবে। ”
“ঠিকাছে মেডাম।”
চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল জিহাদ। সে বুঝতে পারছে না অধরার মাথায় কী চলছে। কী করতে বলছে তাকে,সে পারবে কি না! অধরা ছাড়া উপস্থিত সবাই জিহাদের আশেপাশে এসে দাঁড়াল। সবার দৃষ্টি অধরার দিকে। তারা অসীম কৌতুহল নিয়ে অধরার মুখের বাক্যটি শুনার অপেক্ষায় আছে। অধরা নিজের আলিশান চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে বলল,
“লিখো, Next target turag.”

অধরার কথা মতো জিহাদ একটা সাদা পৃষ্ঠার মধ্যভাগে বড় বড় করে ইংরেজি অক্ষরে লিখল, ‘ Next target turag.’ লেখা শেষে বলল,
“লিখেছি ম্যাডাম। এবার কী করবো?”
“এবার ইংরেজি অক্ষরগুলোকে অংকে রূপান্তর করো। এই যেমন, এন অক্ষরটা অংকে নিলে হবে চৌদ্দ। অর্থাৎ এন অক্ষরটা গানিতিক সংখ্যায় চৌদ্দ নাম্বারে পড়ে। বাক্যের এই গানিতিক নাম্বারগুলো বের করে অক্ষরের নিচে বসাও। ”
“জ্বি ম্যাডাম। ” বলে জিহাদ তার টাস্ক আরম্ভ করল।

সবার দৃষ্টি এখন জিহাদের হাতের খাতাটায়। সবাই কৌতূহল নিয়ে দেখছে। কেউ কেউ আবার জিহাদকে সাহায্য ও করছে। মিনিট তিনেকের মাঝে জিহাদ সব সংখ্যা বসাল।
” N e x t T a r g e t
১৪ ৫ ২৪ ২০ ২০ ১ ১৮ ৭ ৫ ২০

T u r a g
২০ ২১ ১৮ ১ ৭ ”
খাতায় বসানো অংকগুলোয় একবার চোখ বুলাল জিহাদ। তারপর বলল,
“নাম্বার বসিয়েছি ম্যাডাম।”
“এবার যোগ করো।”
দুই আঙুলে কলম ঘুরাতে ঘুরাতে বলল অধরা। আদাবর খাতার দিকে সেকেন্ড ত্রিশেক তাকিয়ে বলল,
“ম্যাডাম, যোগফল দুই শত এক হয়।”

অধরা তার গালে টোল পড়া হাসিটাকে উপস্থিত করল । হেসেই বলল,
“এটাই সমাধান।”

আধরার কথা শুনে জিহাদ বড় বড় চোখ করে একবার অধরার দিকে তাকাল। তারপর খাতার দিকে তাকিয়ে সংখ্যাগুলোকে যোগ করলো। হ্যাঁ, যোগফল ‘২০১’ ই হয়। তারমানে চিরকুটে দেয়া ২০১ নাম্বারটার মানে হচ্ছে Next target Turag! জিহাদের এই মুহুর্তে অধরাকে স্যালুট দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। ‘কী ব্রিলিয়ান্ট ম্যাডাম! এত প্যাঁচালো অংক কিভাবে বুঝে গেলো! আমি এই সংখ্যাটার দিকে পাঁচদিন তাকিয়ে থাকলে ও এই ব্যাখা বের করতে পারবো না। এমনি এমনি এত অল্প বয়স সাব-ইন্সপেক্টর হননি,আর বিপিএম পদক পান নি।ট্যালেন্ট আছে বলেই পেয়েছেন। আই প্রাউড অফ ইউ ম্যাডাম।’ গর্বভরে বিড়বিড়াল জিহাদ।

উপস্থিত সবাই অধরার বুদ্ধিমত্তা দেখে বিস্মিত আর মুগ্ধ হল। আদাবর তো হেসে বলেই দিল,
“আপনি খুবই ব্রিলিয়ান্ট, ম্যাডাম।”

অধরা আদাবরের কথায় এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
” আমি নিজেকে ব্রিলিয়ান্ট তখনই বলতে পারব যখন প্রতিভার কেসের মতো চ্যালেঞ্জিং কেসগুলো অতি সহজে সলভ করতে পারব। সেই দিনটা তাড়াতাড়ি আসুক। ”

বলে অধরা থামল। তারপর বাঁ হাতের কব্জির উপর পরে থাকা তামাটে রঙের চেইনের ঘড়িটায় চোখ বুলিয়ে বলল,
“যাই হোক, কাজের কথায় আসি। এখন বাজে দুপুর দুইটা। বিকেল চারটার মাঝে প্রভাত মির্জার বাড়িতে পুলিশ মোতায়ন করতে হবে। আমার ধারণা খুনী তুরাগের উপর রাতে হামলা করবে। সেই কারনেই আমাদের আগে থেকে সতর্ক থাকতে হবে। বিকেল থেকে প্রভাত মির্জার বাড়িতে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলে খুনী খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না।
তুরাগের বর্তমান অবস্থান প্রভাত মির্জার বাড়িতে। প্রভাত মির্জার বাড়ি ধানমন্ডি। যা আমার থানার আওতায় পড়ে না। তাই আমাদের কোন পদক্ষেপ নিতে হলে ধানমন্ডি থানার সাথে যোগাযোগ করে তাদের সহযোগিতায় পদক্ষেপ নিতে হবে। ধানমন্ডি থানা পুলিশের সাথে আমি যোগাযোগ করে বিকেল চারটার আগে সব ঠিকঠাক করব। যেহেতু মামলাটা সমাধানের দায়িত্ব নিয়েছি। তাই খুনী এবং খুনের প্রক্রিয়ার ধারণা সবার থেকে আমার বেশি। সেইজন্য আমাকেও সেখানে থাকতে হবে। আমি ধানমন্ডি থানার পুলিশ থেকে অনুমতি নিয়ে সেখানে যাব। আমার সাথে থাকবে আমার টিম মানে আপনারা সবাই। আমরা সবাই ছদ্মবেশ ধরে প্রভাত মির্জার বাড়ির আশেপাশে লুকিয়ে থাকব। যাতে খুনী এলে পাকড়াও করতে পারি। সবাই প্রস্তুত থাকুন। সব ঠিকঠাক করে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আমরা ধানমন্ডির মির্জা হাউজের সামনে থাকবো। এর মাঝে কেউ থানার বাইরে যাবেন না। আমাদের এখন মূল লক্ষ্য প্রতিভার খুনীকে হাতে নাতে গ্রেফতার করা। বুঝেছেন সবাই?”

“জ্বি, ম্যাডাম।” বসে সবাই একসাথে সায় জানাল।

**

সব ঠিকঠাক করে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ অধরা ও তার টিম ছদ্মবেশ ধারণ করে মির্জা হাউজের কাছে পৌঁছাল এবং অধরার নির্দেশ মোতাবেক বাড়ির চারপাশে কোণাকানা বেছে নিয়ে আড়াল হয়ে লুকিয়ে পড়ল। সবার কানে ওয়ারলেস ইয়ারফোন।যা দিয়ে সবাই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ কলে কন্টাক্ট করছে। অধরার নির্দেশ কেউ বিন্দুমাত্র সন্দেহের কিছু দেখলে সাথে সাথে যেন অধরা এবং দল সদস্যদের জানায়। অধরা এবং তার দল বাদে ধানমন্ডি থানার কিছু পুলিশ ও মির্জা হাউজের পাশে টহলরত আছে। যারা সেই বিকেল চারটায় এসে হাজির হয়েছে।

রাত আটটা নাগাদ অধরার নাম্বারে একটা কল এলো, একটা আননোন নাম্বার থেকে। ভাইব্রেশনের আওয়াজ পেয়ে ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে ভ্রু কুঁচকে তাকাল অধরা। কাজের সময় বিরক্ত করায় বেজায় বিরক্ত সে। তাছাড়া এই সময় কে কল দিবে!
ভাবতে ভাবতে কল কেটে গেলো। সেকেন্ড দশেক পর আবারও বেজে উঠল ফোন। অধরা খানিক ভেবে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ কল ডিসকানেক্ট করে ফোনটা রিসিভ করল। হ্যালো বলার আগেই অপাশ থেকে কান্নার আওয়াজে ভেসে আসল। কান্নার আওয়াজে আবারও ভ্রু কুঁচকাল অধরা। আওয়াজটা বুঝার চেষ্টা করল, আসলে কাঁদছেটা কে! কন্ঠটাতো অচেনা লাগছে। তবে কে হতে পারে আর কাঁদছেই বা কেনো! না এর উত্তর পেতে হলে কান্নারত এই বয়স্ক কন্ঠের মানুষটির সাথে কথা বলতে হবে। এই ভেবেই গলা ঝেড়ে মৃদু স্বরে বলল,
“হ্যালো কে বলছেন?”
অপাশ থেকে ভেজা গলার আওয়াজ আসল,
“আআমমি ততিহহানা। প্প্রত্তিবভার মমা…

ভেজা গলার অস্পষ্ট কথাগুলো বুঝতে অসুবিধা হল না অধরা। ‘প্রতিভার মা’ কথাটা কানে বাজতেই অধরা চমকে গেল। তিহানা জাহান তাকে কল দিল কেনো? আর কাঁদছেনই বা কেন? তবে কি তারা আসার আগেই অঘটন ঘটে গেলো? ভাবতেই আঁতকে উঠল অধরা। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
” কী হয়েছে? সব ঠিক আছে? ”
“কিচ্ছু ঠিক নেই ম্যাডাম। আমার সব শেষ হয়ে গেলো!”
কান্নামাখা গলায় বললেন তিহানা জাহান। অধরা উদ্ধিগ্ন হয়ে বলল,
“কী হয়েছে বলুন?”
“ওদের নিয়ে গেছে। ওদের ও প্রতিভার মতো মেরে দিবে…তুমি কিছু করো মা?
বলেই আবারো শব্দ করে কান্না জুড়ে দিলেন তিহানা জাহান। অধরা ঘটনার খানিক আঁচ করতে পেরেছে। পুরোপুরি জানতে প্রশ্ন করল,
” কাদের নিয়ে গেছে? দেখুন, পুরো ঘটনা আমাকে খুলে বলুন। না হলে আমি বুঝবো কিভাবে আর সমাধান করবো কিভাবে? আপনি শান্ত হোন, আর ঘটনা বিস্তারিতভাবে বলুন।”

তিহানা জাহান নাক টেনে খানিকের মধ্যে নিজের কান্নাকে ভিতরে দমালেন। তারপর বলা শুরু করলেন,
” তুরাগের পায়ের চেকাপ করানোর কথা ছিলো আজ। সেইজন্যই প্রভাত তুরাগকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছে। এখনো ফিরেনি। তাদের ফোনও বন্ধ। আমি বুঝতে পারছিনা কী করবো।”
“গিয়েছিলো কখন?”
“দুপুরের খাবার খেয়ে বেরিয়েছে। ঘন্টা তিনেকের মাঝে ফিরে আসার কথা। আমি কৌশিককে কল দিয়েছি। কিন্তু কৌশিক বলল ওরা নাকি হাসপাতালে যায় নি।”
” আপনি আমাকে আগে জানাননি কেনো?”
“আমি ভেবেছি ওরা হয়তো যানজট বা কোন কাজে আটকে গেছে সেইজন্য দেরি হচ্ছে। তাই আমি সন্ধ্যা অবধি অপেক্ষা করেছি। যখন আসছে না তখন কৌশিককে কল দিলাম সে জানালো তাদের না যাওয়ার কথা। তারপর আমি স্বরূপাদের বাসায় কল দিলাম। তারা জানালো সেখানেও যায় নি।”

“স্বরূপাদের বাসায় যাওয়ার কথা ছিলো?”
“না ছিলো না। আসলে স্বরূপা আমাদের বাসায় ছিল। প্রভাতরা যাওয়ার সময় স্বরূপাকে তাদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তাই আমি ভেবেছিলাম হয়তো স্বরূপা বাসায় নেমে গিয়ে জোর করে প্রভাতদের ও নিয়ে গেছে।”

অবাক হয়ে অধরা বলল,
“স্বরূপাও তুরাগদের সাথে ছিলো! ওরা ক’জন বেরিয়েছে? ”
“স্বরূপা, তুরাগ প্রভাত,শিলা একসাথে বেরিয়েছে। ”
“তিনজনের কথা না হয় বুঝলাম কিন্তু শিলা কেনো ওদের সাথে গেলো?”
সন্দিহান হয়ে বলল অধরা। তিহানা জাহান বললেন,
“তুরাগ কারো সাহায্য ছাড়া একা একা চলাফেরা করতে পারে না। তাকে ধরে ধরে নিয়ে যেতে হয়। প্রভাত তুরাগকে একা সামাল দিতে পারবে না তাই শিলাকেও নিয়ে গেছে।”

“চারজনই নিখোঁজ! আল্লাহ ! ”
বিস্ময়ে বলল অধরা। তার গলা বেজে যাচ্ছে। খুনী তুরাগকে একা নয় তুরাগের সাথে থাকা বাকিদের ও খুন করবে! তবে কি, সে এদের কাউকেই বাঁচাতে পারবে না! শিট! দুপুরে কেনো বের হলো না৷ চিরকুটের মানে বুঝার সাথে সাথে পদক্ষেপ নিলে এমন হতো না। না জানি এতক্ষণে সবাইকে শেষ করে দিয়েছে কিনা! অধরার শিরদাঁড়া দাঁড়িয়ে গেল। বিস্ময় আর হারের আভাস তাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। তাও যথাসম্ভব নিজেকে স্বভাবিক করার চেষ্টা করল। এত তাড়াতাড়ি তাকে হারলে চলবে না। খুনীকে সে ধরেই ছাড়বে,আর সর্বাত্মক চেষ্টা করবে এদের সবাইকে বাঁচানোর জন্য। নিজেকে স্বাভাবিক করে ঠান্ডা মাথায় তিহানা জাহানের বলা সব কথা একবার মনে করলো। তারপর প্রশ্ন করল,
” তুরাগরা সবাই ঠিক কয়টায় বেরিয়েছে? ”
“লাঞ্চের পর। সঠিক সময় মনে নেই। আনুমানিক আড়াইটা কী তিনটা হবে?”
“তাদের সাথে শেষ কখন কথা হয়েছে আপনার ? আর চারজনের কার সাথে কথা হয়েছে? ”
“কারো সাথে কথা হয় নি। তারা নিরাপদভাবে চলে আসবে এই ভেবে চারটার আগে আর কল করিনি আমি। ”
“তাদের নাম্বার বন্ধ পাচ্ছেন কখন থেকে?”
“সাড়ে চারটা থেকে আমি প্রভাতকে ফোন করলে ফোন বন্ধ পাই। তখনই তারা যাওয়ার পর প্রথম কলটা করেছিলাম। ফিরছে কিনা জিজ্ঞেস করতে।”
“বাকি সবার ফোনে ট্রাই করেছিলেন?”
“হ্যাঁ, সবার ফোন বন্ধ আসছিলো।”

ফিরতি ভাবনায় ডুবল অধরা। নানাবিধ চিন্তা শেষে প্রশ্ন করল,
“আচ্ছা, এই কৌশিক কে?”
“আমার বোনের ছেলে। সে হাড়ের ডাক্তার। তুরাগের চিকিৎসা কৌশিকই করছে। প্রতিভা তো চলে গিয়েছে। আমি প্রভাত, তুরাগ আর স্বরূপাকে নিয়ে কোনমতে বেঁচে আছি। মা, ওদের বাঁচাও। না হলে আমি বাঁচব না । আমি একেবারেই নিঃস্ব হয়ে যাব। আমার মন বলছে ওরা বিপদে আছে। ওদের বাঁচাও!” আকুতি মিনতি করে কেঁদে কেঁদে বললেন তিহানা। অধরা আশ্বাস দিয়ে বলল,
“শান্ত হোন। আমি দেখছি ব্যাপারটা।”

বলে ফোন রেখে দিল অধরা। তারপর এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হোয়াটসঅ্যাপ কলে যুক্ত হয়ে বলল,
” সবাই বেরিয়ে আসুন। মির্জার হাইজের মূল ফটকে এসে দাঁড়ান। ”

টিমের সবাই ভেবেছে অধরা খুনীকে ধরে ফেলেছে তাই খুনিকে দেখার কৌতুহল নিয়ে খুব দ্রুত প্রভাত মির্জার বাড়ির দরজায় হাজির হলো। অধরাকে একা দেখে সবাই ভ্রু কুঁচকাল। জিহাদ বলল,
“খুনী কোথায় ম্যাডাম? আপনি তাকে পাকড়াও করেন নি?”

অধরা ফ্যাকাশে মুখে সবাইকে খানিক আগে ঘটা ঘটনা খুলে বলল। সব শুনে সবার মুখে হতাশা নেমে এলো। আদাবর চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
” মামলাটা দিনকে দিন জটিল হচ্ছে। যেন কোন গোলকধাঁধায় গিয়ে আটকে গিয়েছে। খুনী সম্পর্কে কোনভাবেই আঁচ করা যাচ্ছে না।”
অধরা গম্ভীর মুখে বলল,
“খুনী ভয়ংকর চতুর। সবার সব মুভমেন্ট তার মুখস্থ। আজ আমরা এখানে আসব জানে সে, তাই আমরা আসার আগে যখন তুরাগরা বের হলো তখন সুযোগ বুঝে সবাইকে অপহরণ করে ফেলল। তবে সে যেমনই হোক আমরা তাকে বের করবোই।”

জিহাদ ভাবুক কন্ঠে বলল,
“ম্যাডাম একটা কথা মাথায় ঢুকছে না আমার। তুরাগ আর প্রভাত মির্জার আর স্বরূপার নিখোঁজ হওয়ার কথা মানা যায়। কারণ খুনীর সাথে শুধু প্রতিভা নয় হয়তো এদের ও শত্রুতা ছিলো। তাই তাদের খুন করার পায়তারা করেছে। কিন্তু শিলা তো নির্দোষ, তাকে কেনো খুব করবে? একটা কাজের মেয়ের সাথে কার কী শত্রুতা থাকতে পারে? খুনী কে? আর কেনোইবা খুব করছে? এই কেসের ব্যাপারে কথা উঠলে আমার নিজেকে পাগল পাগল মনে হয়। এত রহস্য কেনো! এর শেষ কোথায়?”

” রহস্য আর সমস্যা দুটো তৈরি হয় সমাধানের জন্য। সমাধানই এদের পূর্ণতা। আমাদের সেই পূর্ণতাকে খুঁজে বের করতে হবে। আমার বিশ্বাস আমি পারব। পারতেই হবে আমাকে। অধরা আনান নাম আমার। হারতে শিখিনি আমি,জয়কে চিনিয়ে আনতে শিখেছি । এবারও জয় আনবোই আমি। খুনী যেই হোক তার মুখোশ উন্মোচন করেই ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। দেটস মাই চ্যালেঞ্জ। ”
দৃঢ় কন্ঠে বলল অধরা। উপস্থিত সবাই এই আশা মনে নিয়েই এক চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সবার ভাবনাতে একটা কথাই ঘুরছে, খুনী কে? এই খুনের আসল রহস্য কী? মুখোশের আড়ালে কে আছে?

চলবে……

খুনি কে? কোন সন্দেহ? এবং সন্দেহের পেছনে যুক্তি কী?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here