রহস্যময় সারপ্রাইজ পর্ব ৪

0
288

#রহস্যময়_সারপ্রাইজ
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
পর্ব-৪

জ্যোৎস্নামাখা নিগূঢ় রাত। নিরবতার চাদরে ঢাকা পড়েছে সারা শহর। ঘুম সম্রাটের নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ প্রতিটি মানুষ। এই গহিন রাতে চোখে ঘুম নামলেও ঘুমকে প্রাধান্য না দিয়ে কফি ভর্তি মগ নিয়ে বসেছে স্টাডি রুমের ডেস্কটায়। টেবিল ল্যাম্পের হলদেটে আলোয়ে চোখ বুলাচ্ছে নীল মলাটের ডায়েরির পাতায়। তদন্তের কাজে প্রতিভার ডায়েরিটা পড়া জুরুরি। সারাদিন ব্যস্ততায় পড়ার সময় হয়নি, বাসায় ফেরার সময় নিয়ে এসেছে। ঘুম উজাড় করে এই গহিন রাতে বসল ডায়েরি নিয়ে।

“আমি প্রতিভা মির্জা। শিল্পপতি প্রভাত মির্জা এবং তিহানা জাহানের একমাত্র সন্তান। বাবাই আমার আদর্শ, মা আমার শিক্ষক।
আমার জীবনে এই দুজন মানুষ অপরিমিত স্থান জুড়ে আছে। মা বাবা বাদে আরো দুজন মানুষ আছে যারা আমার শুভাকাঙ্ক্ষী এবং ভালোবাসার মানুষ। যাদের সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক। সে দুজনের একজন হলো আমার বোন, বান্ধবী স্বরূপা। আমার সুখ দুঃখ হাসি কান্নায় যাকে সবসময় পাশে পাই। স্বরূপাকে পেয়েছিলাম দ্বাদশ শ্রেণিতে। সিটি কলেজে ভর্তি হওয়ার বছরখানেক অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিলো তখন। কয়েকজন বন্ধুবান্ধব ও জুটিয়েছিলাম। বেশ চলছিলো দিন। হঠাৎ একদিন ক্লাশে গিয়ে দেখি একটা নতুন মেয়ে এসেছে। ক্লাশের এক কোণে একটা টেবিলে ঘাপটি মেরে বসে আছে। দেখে আমার কেমন যেন মায়া হলো। কাছে গিয়ে কথা বলে জানতে পারলাম, মেয়েটা চট্টগ্রাম থেকে বদলি হয়ে এসেছে এখানে। নাম স্বরূপা,স্বরূপা হাসান। তার বাবা হাসান আলীও একজন শিল্পপতি। আগে চট্রগ্রাম থাকতো। বাবার ব্যবসার কারণে ঢাকা এসেছে। কাকতালীয় বিষয় হচ্ছে, তারা আমাদের এলাকাই বাসা নিয়েছে। শুনে ভীষণ খুশি লাগলো। যাক এলাকার একটা সঙ্গী পেলাম তবে! মেয়েটার শ্যামবর্ণের চেহারায় অদ্ভুত একটা মায়া আছে। যা যে কাউকে গ্রাস করার ক্ষমতা রাখে। শ্যমবর্ণের চেহারায় টানা টানা হরিণী চোখ যেন তার মায়াটা দিগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। মেয়েটাকে এক নজর দেখলে মনে হবে অতীতে কবিরা ঠিক কথাই বলেছেন। রূপের রানী শ্যামবতীরাই। আমি আগ বাড়িয়ে মেয়েটার সাথে কথা বললাম,বন্ধুত্বের হাত বাড়ালাম। এই হাজার মানুষের ভীড়ে একাকীত্ব গ্রাস করে থাকা মেয়েটা যেন আমার বাড়ানো হাত দেখে আকাশের তারা হাতে পেলো। খুশি হয়ে লুফে নিলো। আলাপ হলো, সময়ের পালাবদলে পরিচয় রূপ নিল বন্ধুত্ত্বে। দিন যত অতিবাহিত হতে লাগলো আমাদের বন্ধুত্ব তত গাঢ় হতে লাগলো। আমরা বান্ধবী থেকে বোন হয়ে গেলাম।
স্বরূপা একেবারেই শান্ত স্বভাবের, অল্পভাষী, কোন ঝগড়া ঝাটি কিংবা তর্কেও নেই সে। সারাদিন বইয়ে মুখ গুজে পড়ে থাকে। ওর মাঝে একটা জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব থাকে সবসময় । বিজ্ঞবেশে সব কিছুর সমাধান করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। আমার বেলায় সে সবসময় যত্নবান থাকে। আমার যাতে ভালো হবে সে তাই করে। একদিন আমরা দুজন ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। কেউ গাড়ি নিয়ে বের হইনি। রাস্তা দিয়ে হাটছিলাম। আমি রাস্তার ধারে ছিলাম ও আমার পাশেই ছিলো। হঠাৎ কোথা থেকে একটা গাড়ি আমার দিকে তেড়ে এলো। সম্ভবত চালক ড্রাঙ্ক ছিল। আমি বিষয়টা খেয়াল করি নি। স্বরূপা বিষয়টা খেয়াল করে আমাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তার সাইডে ফেলে দেয়। যার ফলে আমি অক্ষত ছিলাম । আমাকে বাঁচাতে গিয়ে স্বরূপা চরম আহত হয়। মাসখানেক হাসপাতালে ছিলো। তাও তার কোন দুঃখ ছিলো না। প্রচন্ড যন্তনায় যখন হাসপাতালের বেডে কাতরাতো তখনও আমাকে দেখে মুচকি হাসতো। ওর এই আত্মত্যাগ আমাদের সম্পর্ককে আরো গাঢ় করেছিলো।

আজ আমাদের বন্ধুত্বের বয়স বছর চার পার হওয়ার পর ও আজো তেমনি আছে দুজনের বন্ধন। আমি সংসার সামলানোর পাশাপাশি তাকে সময় দিই, সে পড়াশুনার পাশাপাশি আমাকে সময় দেয়। ব্যস্ততা আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করতে পারেনি। আজো আছে অমলিন৷ মাঝে মাঝে রক্তের সম্পর্ক হারিয়ে যায় কিন্তু আত্মার সম্পর্ক হারায় না। আমার আর স্বরূপার সম্পর্ক ও কখনো হারাবে না। মৃত্যুর আগ অবধি অমলিন থাকবে।

স্বরূপার পর আরেকজন, যার সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক। সে হলো আমার ভালোবাসা,আমার প্রেমময় সঙ্গী, তুরাগ। তার সাথে আমার পরিচয়টা বছর আড়াই আগে, শরতের এক পড়ন্ত বিকেলে উত্তরার তুষার শুভ্র কাশফুলের রাজ্যে । ঋতুতে শরতের আগমনের দিন কয়েক পরে আমি আর স্বরূপা গিয়েছিলাম কাশফুলের রাজ্য ভ্রমণে। সাথে অবশ্য আমাদের আরো এক বান্ধবী নিতু ও ছিলো। আমরা লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম। হঠাৎ চোখ গেল সামনে। আমাদের থেকে কয়েক গজ দূরে এক যুবক দশ বারোজন বাচ্চাছেলে মেয়ে নিয়ে গোল হয়ে বসে আছে। কোন একটা ব্যাপার নিয়ে তারা হাসছিলো। বাচ্চাগুলো হয়তো পথশিশু। চেহারায় কেমন রোগারোগা আর অসহায় ভাব। হতে পারে পথশিশুদের নতুন জামা পরিয়ে এখানে ঘুরতে নিয়ে এসেছে ছেলেটা। তবে ছেলেটার চেহারা বেশ আকর্ষণীয়। ফর্সা বৃত্তাকার চিবুকে না কাটা দাঁড়ি, প্রশান্ত চোখ, খাড়া নাক, আর সরু ঠোঁটের সমন্বয়ের চেহারাটা নজর কাড়া। পরনে তার মেঘের ভেলা শার্ট,আর কালো ডেনিম প্যান্ট, হাতে কালো বেল্টের ঘড়ি। মাথাভরতি মসৃণ চুলগুলো যখন বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলো তখন হাত দিয়ে বারবার তা পিছনের দিকে গোছাচ্ছিলো। সেই সাথে মুখ ভর্তি হাসি আর সরু ঠোঁট আর জিহ্বার নড়াচড়ায় গলা থেকে বেরিয়ে তৈরি হওয়া বাক্য, যা নিমিষেই আশেপাশের মানুষগুলোকে হাসির রাজ্যে নিয়ে যায়। সবমিলিয়ে চমৎকার একটা দৃশ্য। ঠিক ফ্রেমে বাধার মতো। ছেলেটাকে এক নজর দেখেই কেমন যেন ভালো লাগা জন্মে গিয়েছিল আমার । চারদিকে তার সমবয়সী ছেলেরা যখন গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরতে ব্যস্ত তখন সে ব্যস্ত অসহায় পথশিশুদের মুখে হাসি ফুঁটাতে। এমনটা ক’জন পারে? জানা নেই আমার। তবে সেদিন সবার মাঝে ওই ছেলেটাকেই আমার অনন্য লেগেছিল। তার রূপ গুন দুটোই আমাকে মুগ্ধ করেছিলো। অদ্ভুত অনুভূতির জন্ম নিয়েছিলো সেই ক্ষণে।
মুগ্ধতার ডুবে গিয়েছিলাম আমি। আমার ঘোর কেটেছিলো স্বরূপা আর নিতুর ঝাকানিতে। আমার তাকানো নিয়ে সেদিন মজা নিয়েছিলো দুজন। সেকি হাসাহাসি তাদের! আর আমি? প্রথমবারের মতো কোন ছেলের ব্যাপার নিয়ে লজ্জায় লাল হয়েছিলাম। ফেরার সময় মৃদুল ভাই এসেছিলো আমাদের নিতে। মৃদুল ভাই হলো স্বরূপার প্রেমিকপুরুষ। তিনি মেডিকেলের ছাত্র। একাদশ শ্রেণী থেকেই রিলেশন শুরু হয়েছে তাদের। আমি মৃদুল ভাইকে যতবারই দেখেছি ততবারই একটা কথাই জিজ্ঞেস করতাম, “ভাই এই নিরামিষ নিয়ে চলেন কিভাবে!”
ভাইয়া প্রতিবারই হেসে জবাব দিতো, “ভালোবাসা বড় বেহিসাবী। কোন নীতি, নিয়ম, হিসেব মানে না। বরং নিজ নীতি ভুলিয়ে দেয়। এই দেখো, তোমার নিরামিষ বান্ধবীর সাথে থেকে থেকে আমিও নিরামিষ হয়ে গিয়েছি। এখন আমার তেমন খারাপ লাগে না। ভালোবাসি তো তাকে। তার ভালো লাগাতেই আমার ভালো লাগা।” মৃদুল ভাইয়ের চমৎকার উত্তর শুনে আমি হাসতাম। ওদিকে আমার নিরামিষ বান্ধবী লজ্জায় লাল নীল হতো। যা মৃদুল ভাইয়ের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির জোগান দিতো।

যাক গে, সে অন্য কথা। আমি ফিরে আসি আমার ভালোবাসার মানুষের সাথে পথ চলার কথায়। সেদিন মৃদুল ভাই এসে আমার ভালোলাগার কথা জানতে পেরে তিনি নিজেই ছেলেটার খোঁজ এনে দিবেন বলে আশ্বাস দিলেন। আমি বেশ খুশি হয়েছিলাম তার কথায়। পরদিন যথারীতি দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই ছেলেটাকে দেখার জন্য চলে গেলাম আবার উত্তরার দিয়া বাড়িতে। সাথে টেনে হিচঁড়ে স্বরূপাকে ও নিলাম। সেদিন ও ছেলেটা এসেছে একদল ছোট বাচ্চা সাথে নিয়ে। সবাইকে নিয়ে কাশফুল রাজ্যের এক ফাঁকা জায়গায় গোল হয়ে বসে আড্ডার আসর জমিয়েছে। ছেলেটা গল্প করছে আর তার কথায় বাচ্চা গুলো হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। মৃদুল ভাই থেকে কোন খবর না পেয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম নিজেই গিয়ে তার সাথে পরিচিত হবো। ভালোলাগা এসেছে জীবনে, তাকে উড়ে যেতে দিবো না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুঠোবন্দি করবো। এ ভেবেই আমি চুপিচুপি ছেলেটার পিছনে গিয়ে অন্যদিকে ফিরে বসে পড়লাম। এমন একটা ভাব করলাম যেন আমি ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে গেছি আর এখানে বসে জিরিয়ে নিচ্ছি। ছেলেটা কৌতুক শোনাচ্ছিল বাচ্চাদের। রসিক মানুষের রসের কথা শুনে আমি ও বেশ হেসেছিলাম। আড্ডা মাঝে আমি আগ বাড়িয়ে কথা বললাম, বাহানা ছিল পানি। ক্লান্ত ভঙিতে বলেছিলাম, পানি আছে আপনার কাছে?”
আড্ডায় ব্যাঘাত ঘটায় ছেলেটা বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকালেও খানিক বাদে নিজের পানির বোতল এগিয়ে দিয়েছিল। পানির পান করে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে আমি নিজের পরিচয় দিলাম। ছেলেটার পরিচয় জানতে চাইলাম। জবাবে ছেলেটা হেসে উত্তর দিলো,
” আমি তুরাগ আহমেদ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে পড়ছি। এ ছাড়া দেয়ার মতো তেমন কোন পরিচয় নেই।”

‘তুরাগ! নাইস নেম’মনে মনে আওড়ালাম। তারপর ফিরতি হাসি দিয়ে বললাম আমি,
” তা আপনি এখানে কী করেন? আর এই বাচ্চারা কারা?”

তুরাগ তার মুখের হাসি বজায় রেখে সহজ ভাবে উত্তর দিল,
” এরা সবাই এতিম। এতিমখানায় থাকে। বাবা মা আত্মীয় স্বজন নেই। ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার ও কেউ নেই। তাই আমিই ওদের প্রতিদিন এখানে নিয়ে আসি। তারপর জমিয়ে আড্ডা দিই। আমিও এতিম, এতিমখানায় বেড়ে উঠেছি। সেখানেই এখন শিক্ষকতা করি। তাদের কষ্ট বুঝি তাই একটু আধটু খুশি রাখার চেষ্টা করি।”

তুরাগ এতিম শুনে খারাপ লাগলো। পরিচয় জানতে চাওয়াটা উচিত হয়নি ভেবে নিজেকে বকলাম তারপর মলিন মুখে বললাম,
“সরি আসলে আমি জানতাম না।”
তুরাগ তার হাসি বজায় রেখেই বললো,
” আরে না, সরি হওয়ার কিছু নেই। আপনি নিজেকে দোষী ভাববেন না। সত্য হজম করতে পারি আমি। হজমশক্তি বেশ আমার।”

আমি চুপ করে রইলাম। তুরাগ আবারো হেসে বললো,
” সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। ফিরতে হবে। আজ তবে আসি?”
আমি মাথা নাড়ালাম। তুরাগ বাচ্চাদের নিয়ে গল্প করতে করতে চলে গেলো। আমি মনে মনে বললাম, কী অমায়িক ব্যবহার তার!

পরদিন থেকে নিয়ম করে প্রতিদিন দিয়া বাড়ি চলে যেতাম। আর তুরাগের আড্ডায় যোগ দিতাম। কদিনের মাঝেই আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। কথা এবং নাম্বার আদান প্রদান হলো।বন্ধুত্বটা বেশ ভালোই চলছিলো। প্রেমের প্রস্তাব আমিই দিয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তুরাগ আমার প্রস্তাব গ্রহণ করবে। কিন্তু আমাদের ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে আমাদের দুজনের লেভেলের কথা ভেবে সাথে সাথে আমাকে ফিরিয়ে দিলো তুরাগ। আমি ও অনড়, তুরাগকে ভালোবাসা গ্রহণ করানোর পণ করলাম। আমি তার পিছনে আঠার মতো লেগে গেলাম। পাগলামী, হুমকি, কান্নাকাটি সব প্রকারে ভালোবাসা প্রকাশ করেছিলাম। না পেরে পনেরোদিনের মাথায় তুরাগ আমাকে একসেপ্ট করেছে। মন ও আদান-প্রদান হয়ে গেলো অবশেষে। শুরু হলো আমাদের ভালোবাসার পথচলা। প্রতিদিন দুজনের ভার্সিটি শেষে রিক্সা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে বসে বাদাম খাওয়া, সপ্তাহে একদিন সিনেমা দেখা। সবমিলিয়ে ভালোই চলছিলো দিনকাল। তুরাগ এতিম খানায় পড়াতো। বিনিময়ে কোন টাকা নিতো না। শুধু সেখানে থাকতো। পাশাপাশি কয়েকটা টিউশনি করাতো। টিউশনির খরচ দিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতো। মাঝে মাঝে আমাকে এটা সেটা কিনে দিতো। আমার চাওয়া পাওয়া বেশি ছিলো না। অল্পতেই খুশি হতাম। সম্পর্কে কোন অভিযোগ ছিলো না, দুজনই দুজনকে বুঝতাম। দুজনার ভালোবাসাটা বেশ ছিলো। তুরাগ প্রচন্ড চঞ্চল আর হাস্যরসী মানুষ । সারাক্ষণ সবাইকে হাসাতো। আমাকেও কখনও মন খারাপ করতে দিতো না।
তার মনটা একবারেই সচ্চ। মনে মুখে এক কথা। কোন ধোঁয়াশা নেই। দিন যত যেতে লাগলো তার প্রতি আমার মুগ্ধতা আর ভালোবাসা বেড়েই চলছিলো। কেটে গেলো দুটো শরৎ। চমৎকার ছিলো সময়টা। তুরাগ মাস্টার্স শেষ কমপ্লিট করে একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি পেলো। সম্পর্কের দুই বছর পর আমি বাসায় জানালাম তুরাগের কথা। আমার বাবাই মা সবসময় আমার খুশিতেই খুশি থাকতো। তাই তারা বিনা বাক্যে মেনে নিলেন।
বিয়েটা ঘটা করে হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু এক বখাটের বখাটেপনার কারণে হুটহাট বিয়ে হয়ে গেলো আমাদের। বিয়ের দিনই তুরাগ আর আমি গিয়ে উঠলাম তুরাগের কিস্তিতে কেনা মিরপুরের ফ্ল্যাটে। আমাদের ছোট্ট একটা সংসার হলো। সুখের মাঝে ছ’মাস কেটে গেলো। আমাদের বন্ধন ভালোবাসা আজো তেমনি আছে যেমনটা প্রেমের প্রথমে ছিলো।
ঝড়টা এলো আকস্মিক, তুরাগের এক্সিডেন্টে হলো। সে এখন হুইলচেয়ারের বন্দী। নিজে নিজে চলতে পারে না। তাকে দেখলে আমার কলিজা কেঁপে ওঠে। আমি প্রতি মুহুর্ত আপ্রাণ চেষ্টা করি তার খেয়াল রাখার। আমি চাই সে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাক। তাকে যে আমার অনেক বড় সারপ্রাইজ দেয়ার আছে! মাস খানেক আগেই জেনেছি, আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন আসতে চলেছে। এই খবরটা তুরাগকে দিবো। তবে তা বিশেষ ভাবে। মাসখানেক পরেই তুরাগের জন্মদিন। সেদিনই তাকে এই সারপ্রাইজটা দিবো। তুরাগ কী রিয়েকশন দিবে ভাবতেই আমার খুশিতে মনটা নেচে উঠছে। নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে তুরাগ? আমার ভালোবাসার খাঁচায় আরেক পাখি যুক্ত হবে। সেও থাকবে আমার পছন্দের তালিকা জুড়ে। তাকে নিয়েও লিখবো কখনো।”

এত টুকু পড়ার পর অধরা ডায়েরি বন্ধ করে দিল। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। আজ আর পড়া সম্ভব নয়। উঠে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল, তৎক্ষনাৎ ঘুম ঝেকে এলো চোখে। ঘুম ভাঙল সকালে সাতটায়। নাস্তা সেরে তৈরি হয়ে থানায় চলে গেল। নিজ কেবিনে বসে ডায়েরি খুলল।

“অতি পছন্দের মানুষের তালিকা শেষে আসে অতি অপছন্দের মানুষের তালিকা। আমার লাইফের সবচেয়ে অপছন্দ,সোজা কথায় বললে ঘৃণিত মানুষের তালিকা জুড়ে একজনই বিচরন করে। সে হলো অভিলাষ। আমার জীবনের সকল দুঃখ কষ্টের কারণ এই একজন মানুষ। সেই স্কুল জীবন থেকে আমাকে উত্ত্যক্ত করে আসছে। আমি সেই স্কুল জীবন থেকেই তাকে এড়িয়ে চলি। তাও সে আমার পিছু ছাড়ে না। তার কারণে আমি আয়োজন ছাড়াই তড়িঘড়ি করে তুরাগকে বিয়ে করেছি। তার আচরণের কারণে তাকে জেলে দিয়েছে বাবাই। ভেবেছিলাম বিয়ের পর অভিলাষ নামক ঝামেলাটা পিছু ছাড়বে। কিন্তু নাহ, জেল থেকে বেরিয়েই সে আবার তার অসভ্যতা শুরু করেছে।”

অধরার চোখে মুখে কৌতুহল, বিস্ময়। চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে আসায় টান টান উত্তেজনা কাজ করল। সে রুদ্ধশ্বাসে পড়ে ফেলল বাকি অংশ।

“এখন তো রীতিমতো মতো তুরাগকে খুন করার হুমকি দেয়। বলে আমি যেন তুরাগকে ডিভোর্স দিয়ে তাকে বিয়ে করে ফেলি। না হলে সে তুরাগ, আমাকে, আমার পরিবারের সবাইকে খুন করে ফেলবে। দিনকে দিন তার অসভ্যতা বেড়েই চলেছে। আমার কয়েকটা ছবি বাজে ভাবে এডিট করে আমাকে পাঠিয়েছে। অশ্লীল ছবিতে শরীরে আমার মাথা বসিয়ে দিয়েছে। দেখে মনে হয় যেন মানুষটা আমিই। অভিলাষ প্রতিদিন একটা করে ছবি আমাকে পাঠিয়ে হুমকি দেয়, আমাকে দুই মাস সময় দিয়েছে এরিমাঝে তুরাগকে ছেড়ে তার কাছে না গেলে তুরাগকে খুন করবে। আর আমি এসব কাউকে জানালে ছবিগুলো ভাইরাল করে দিবে। লজ্জায় ভয়ে এইসব কথা আমি কাউকে বলতে পারি না। বাবাই আর তুরাগ ওর সাথে ঝামেলা করবে। শেষে অভিলাষ তুরাগের ক্ষতি করে ফেলবে। এসব ভেবে আমি চুপ আছি। খুবই অশান্তির মাঝে দিন কাটছে আমার। না সইতে পারছি আর না বলতে পারছি। আমি তো তুরাগকে ছাড়তে পারবো না। না জানি অভিলাষ আমাদের কী ক্ষতি করে। কী হয় আমাদের শেষ পরিণতি?”

এর পর আর লেখা নেই। অধরা উলটে পালটে দেখল, আর কোন লেখা পেল না। প্রতিভা এই ডায়েরিটা মাস খানেক আগে লিখেছে। কারণ ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা,
উৎসর্গঃ আমার আগত সন্তান।
ধারণা করা যায়, প্রেগন্যান্সির খবর জানার পর আগত সন্তানকে উৎসর্গ করে প্রতিভা ডায়েরিটা লিখেছে। ভবিষ্যতে প্রতিভা তার সন্তানকে ডায়েরি উপহার দিবে বলে হয়তো সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

প্রতিভার ডায়েরি পড়ে অধরা খানিক ভাবলো। তারপর কাউকে ফোন করে আদেশ করল,
“সব ইউনিটকে খবর দিন। চারদিকে পুলিশ মোতায়ন করুন। যত দ্রুত পারেন অভিলাষকে গ্রেফতার করতে হবে।”

ফোন রেখে ডায়েরিটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো অধরা। তারপর গায়ে জড়ানো সাদা শার্টটা টেনে ঠিক করে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। জিহাদকে ইশারায় তাকে অনুসরণ করতে বলল। ইশারা বুঝে জিহাদ অধরার পিছন পিছন ছুটলো। জিহাদ গাড়িতে উঠে বলল,
“কোথায় যাচ্ছি ম্যাডাম?”
“অভিলাষের বাসা তল্লাসি করতে হবে। এখন আমাদের সন্দেহের তালিকায় শীর্ষে আছে সে। ”
“আচ্ছা।”
“আর মালিক সমিতির সবার উপর নজর রাখতে বলেছিলাম। রিপোর্ট কী?”
“ম্যাডাম কয়েকজন পুলিশ তাদের উপর নজর রাখছে। একটু আগে তারা জানিয়েছে, মালিক সমিতির সভাপতিসহ পাঁচজন কাল রাতের আঁধারে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বর্ডার হয়ে ভারত চলে গিয়েছে।”

অধরা কড়া গলায় বলল,
“এত নিরপত্তার পরও কিভাবে পালালো!”
“ম্যাডাম, তারা সবাই ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলো। কেউ মহিলা আর কেউ বুড়ি সেজে বাসা থেকে বের হয়েছে। আমাদের লোক যখন তাদের ফলো করছিলো। তখন তারা মেলায় গিয়ে হাজার লোকের মাঝে মিশে গিয়েছে। যার ফলে তাদের আর পাওয়া যায় নি।”
মিনমিনে গলায় বললো জিহাদ। অধরা একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,
“যাকে খানিক সন্দেহ করি সেই পালায়! তাও অভিযোগ আনার আগেই। এরা টের পায় কিভাবে! আর মালিক সমিতির সভাপতি নিশ্চয়ই এসবে যুক্ত ছিলো। না হয় পালালো কেনো!”

****
অভিলাষের বসা তল্লাসি করার পর বেরিয়ে এলো আরো কিছু চমকপ্রদ সূত্র। যা হয়তো মামলা সমাধানে সাহায্য করবে। অভিলাষের রুমে ডুকতেই সবার চোখ পড়লো মেঝেতে পড়ে থাকা র‍্যাপিং পেপারের উপর । প্রতিভার লাশের উপর মোড়ানো র‍্যাপিং পেপারের মতোই কিছু কাটাছেঁড়া র‍্যাপিং পেপার এলোমেলো অবস্থায় পড়ে আছে মেঝেতে। নীল র‍্যাপিং পেপারের পাশে দুইটা সালমন কালার পেপার এবং একটা সাদা নেমকার্ড ও আছে। একই রকমের কাগজ প্রতিভার লাশের সাথে পাওয়া গিয়েছিলো। র‍্যাপিং পেপার,স্কেচ টেপ,কাচি সব এখনো মেঝেতে পড়ে আছে। অনায়েসে বলা যায়, এখানে বসে কেউ কোন গিফট প্যাক করেছে। অধরা কাটা ছেঁড়া কালার পেপারের কাছে গেলো। হাটু ভেঙে বসে কালার পেপার হাতে নিয়ে তাতে সুক্ষ্ম দৃষ্টি দিল। সাথে সাথে তার দৃষ্টিতে বিস্ময় দেখা দিল। সালমন কালারের দুটো কালার পেপারের একটা কালার পেপারের এক পাশে চতুর্ভুজাকৃতি করে ফাঁকা। যা কেটে নেয়া হয়েছে। সেটা হয়তো কিছু লিখে কেটে গিফট বক্সে আটকানো হয়েছে! অধরা খেয়াল করে দেখলো প্রথম কালার পেপারের নিচে থাকা কালার পেপারটায় লেখার অবয়ব দেখা যাচ্ছে। একটা পেপারের উপর আরেকটা পেপার রেখে খুব চাপ দিয়ে লিখলে নিচের পেপারটায় ও লেখা বসে যায়।

কালি না বসলেও ছাপ খানিক স্পষ্ট পড়া যায়। নিচের পেপারের সেই লিখাটার ছাপাংশ দেখা যাচ্ছে যা অধরার লাশের সাথে পাওয়া গিয়েছিলো। চিরকুটে লেখা সেই কথা গুলো এখানে ও লেখা আছে। তারমানে অভিলাষ এখানে বসেই চিরকুট লিখেছে,প্যাকেট করেছে! তবে কি সেই দশ মিনিট সময়ে লাশের প্যাকেট নয় লাশ নিয়ে আসা হয়েছে? তারপর বাসায় নিজের রুমে এনে আগে থেকে কিনে রাখা জিনিস পত্র দিয়ে লাশ প্যাক করা হয়েছে? সেটাও কিভাবে হয়? বাসায় তো অভিলাষের মা বাবা ও থাকে। তাদের সামনে কিভাবে লাশ আনবে! আচ্ছা, কোথাও তারা ও এসবে যুক্ত না তো! তেমন হতেও পারে কারণ প্রতিভার এমন নিখুঁত সাজ কোন ছেলের দ্বারা সম্ভব নয়। নিশ্চিত সাজটা কোন নারীই সাজিয়েছিল। আর খবর নিয়ে জানা গেছে অভিলাষের মা অতীতে একজন বিউটিশিয়ান ছিলেন। পার্লারে কাজ ও করতেন। পরে অবশ্য ছেড়ে দিয়েছেন। তার দ্বারা এসব অসম্ভব নয়।

অভিলাষের রুম তল্লাশি করে পাওয়া গেলো দুটো রিসিট। একটা ড্রেস কেনার রিসিট। যাতে ড্রেসের মূল্য এবং ক্রেতার নামের স্থানে অভিলাষের নাম নিবদ্ধ। আরেকটা অলংকারের সাথে দেয়া রিসিট। যাতে ক্রেতা অভিলাষের নাম আর তার কেনা একটা নেকলেস সেট এবং মোটা অঙ্কের একটা মূল্য লেখা আছে। দুটো জিনিসই কেনা হয়েছে প্রতিভা খুন হওয়ার দুদিন আগে। রিসিট দুটো, কালার পেপার, র‍্যাপিং পেপার যেন অভিলাষের খুনী হওয়ার সন্দেহকে আরো গাঢ় করে দেয়। তবে অভিলাষ একা নয় তার সহযোগী ও কেউ আছে। কারণ একজনের দ্বারা কখনোই এত কিছু সম্ভব নয়।

অভিলাষের রুমে মামলা সমন্ধীয় আরো কয়েকটা জিনিস পাওয়া গেছে। তা হলো অভলাষের ডায়েরি। ডায়েরি জুড়ে প্রতিভার বিচরণ। ডায়েরির প্রথম দিকের প্রতিটা লাইনে প্রতিভার প্রতি অভলাষের ভালোবাসা ব্যক্ত করেছে। অর্ধেক জুড়ে শুধু নিজের প্রেম প্রকাশ করেছে অভিলাষ। শেষের দিকে তা পরিণত হয়েছে রাগ আর ক্ষোভে। ডায়েরিতে অভিলাষ লিখেছে সে তুরাগকে হত্যাচেষ্টায় গাড়িচাপা দিয়েছে। ভেবেছিল তুরাগ মারা যাবে, কিন্তু বেঁচে যাওয়া আফসোস প্রকাশ করেছে সে। প্রতিভাকে হত্যার হুমকি ও দিয়েছে।

শেষের দিকের লেখাগুলো অভিলাষের জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর লেখা, অধরা আন্দাজ করলো।
ডায়েরি পড়ে আরো স্পষ্ট হলো যে অভিলাষই খুনী। প্রতিভা আর তুরাগের প্রতি তার অনেক ক্ষোভ। তুরাগকে খুন করতে চেয়েছিলো। কিন্তু ভাগ্যক্রমে তুরাগ বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু প্রতিভাকে কোন ঝুঁকি না নিয়ে জানে মেরে দিয়েছে। তবে একটা সন্দেহ থেকেই যায় সেটা হলো, প্রতিভার হাতের লেখা। চিরকুটে প্রতিভার হাতের লেখা আসলো কিভাবে? প্রতিভাকে খুন করে অভিলাষ নিজ বাসায় এনে লাশ প্যাক করেছে। র‍্যাপিং পেপারের সাথে সাথে চিরকুট লিখেছে। প্রতিভাকে যদি মৃতই আনা হয় তবে প্রতিভা নিজের হাতে লিখলো কিভাবে! কোথাও প্রতিভাকে জীবিত এনে এখানে মারা হয় নি তো! কিন্তু সেটাও কিভাবে সম্ভব! ফরেনসিক রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিভার মৃত্যু হয়েছে রাত তিনটা নাগাদ। লাশ আনা হয়েছে চারটায়। সে হিসেবে মৃতই এনেছে প্রতিভাকে। কিন্তু কথা হচ্ছে মৃত ব্যক্তির হাতের লেখা আসলো কিভাবে! এখানেই রহস্য। কিভাবে কী হয়েছে ঝট খুলবে অভলাষকে ধরতে পারলে। কিন্তু অভিলাষ তো নাগালের বাইরের। পুলিশ চারদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না তাকে। তবে, আশা করা যায় শীঘ্রই পাওয়া যাবে তাকে, একবার হাতের নাগালে ফেলে, সব রহস্য উন্মোচন হবে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here