রজনীগন্ধা, পর্ব:১৫

0
962

রজনীগন্ধা- ১৫
অলিন্দ্রিয়া রুহি

-আমি নাছির উদ্দীন। আপনি কী মিঃ অভি বলছেন?

ঠোঁট থেকে সিগারেট সরিয়ে অভি ঝট করে উঠে দাঁড়াল। ভ্রু কুঁচকে ফোনের ওপাশে থাকা নাছির উদ্দীনকে উত্তর করল,
-জি, অভি বলছিলাম। কিন্তু আপনি কে?

-বলতাম তো, আমি নাছির উদ্দীন।

-কোন নাছির উদ্দীন?

-আদ্র মেশতাকের ম্যানেজার।

-আদ্র মেশতাক?

সঙ্গে সঙ্গেই আদ্র মেশতাক কে তা মনে পড়ে গেল অভির। তবে কী রজনীর কোনো খবর বলার জন্য ফোন দিয়েছে সে? উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠল অভি। আশেপাশে তাকাল, দোকানে মান্যতা গিজগিজ করছে। আধখাওয়া সিগারেটের বিল দ্রুত দোকানদারের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো আদ্র। পথে হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করল,
-আপনি আমাকে ফোন দিছেন কেন?

-আপনার সঙ্গে আদ্র স্যার দেখা করতে চাইছেন। আপনি আসবেন, নাকি আমরাই আসবো আপনার কাছে?

একটু ভেবে অভি জবাব দিলো,
-আমিই আসবো। কোথায়?

-ঠিকানা আপনার ফোনে ম্যাসেজ করে দিয়ে দিচ্ছি। চলে আসবেন যত দ্রুত সম্ভব।

ফোন কাটার পরও অনেকক্ষণ ফোন হাতেই দাঁড়িয়ে রইলো অভি, স্তব্ধতা গ্রাস করেছে তাকে পুরোপুরি। হঠাৎ করে নাছির উদ্দীন তাকে কেন ফোন করল, আর কেনই বা দেখা করতে চাইছে! বিষয়টি স্পষ্ট বোধগম্য না হলেও এর সাথে রজনীর নামটা জড়িয়ে আছে বিধায়ই সে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। একবার যেতেই হবে তাকে। টুং করে ফোনে ম্যাসেজ নোটিফিকেশন বেজে উঠল। অভি চেয়ে দেখলো, নাছির উদ্দীন ঠিকানা পাঠিয়ে দিয়েছেন। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল অভি। দশটা তেইশ বাজছে। পকেটে যথেষ্ট টাকা আছে। এখনি একবার ঘুরে আসা যায় ওখান থেকে…

দেখতে বাড়ির মতো লাগলেও এটা আদ্র’র বাড়ি না, স্পষ্ট বুঝতে পারছে অভি। কোনো ফার্ম হাউস, নইলে অফিস টফিস কিছু। কিন্তু এখানে ডেকে আনানোর মানেটা কী! অভি ভেবেছিল ঠিকানাটা বাসার। রজনীকেও হয়তো দেখতে পারবে। কিন্তু তা তো হলো না! হতাশ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক ফুঁড়ে তার। কেমন আছে রজনী? জানতে চাইলো অবচেতন মন।

খুট করে একটা শব্দ হতেই নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলো। আদ্র রুমে ঢুকতেই চোখ জোড়া ছানাবড়া হয়ে উঠল তার। টিভির পর্দায়ও এত সুদর্শন দেখায় না আদ্রকে। গালে ছোট ছোট গর্ত আছে। ডিম্পল বলে না ওগুলোকে?

-কেমন আছেন মিঃ অভি?

হাসিমুখে প্রশ্ন করলো আদ্র। ঘোর কাটে অভির। মাথা ঝাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।
ক্ষীণ গলায় উত্তর দিল,
-জি, আলহামদুলিল্লাহ।

-আমি কেমন আছি, জানতে চাইবেন না?

-নায়ক মানুষ,ভালো আছেন- এটা তো জানা কথাই।

-হা হা হা, নায়ক-নায়িকা ভালো থাকে, সুখে থাকে, এমনটাই ধারণা সাধারণ জনগণের। তাই না অভি সাহেব?

-হুঁ।

-কিন্তু ধারণাটি ভুল। মিডিয়ায় হাসিমুখে কাজ করা মানেই সে ভেতর থেকে অনেক সুখী একজন মানুষ- এমন ভাবা আসলে ঠিক না। সে যাইহোক, আমি আলহামদুলিল্লাহ সুখেই আছি, ভালো আছি। বলতে পারেন বেশ আছি।

-জি বুঝলাম, কিন্তু আমাকে এভাবে হঠাৎ ডাকলেন যে!

-কারণ আছে। কারণ ছাড়া এই পৃথিবীতে কিছুই ঘটে না, জানেন তো?

-হুঁ।

-গুড। কারণটা বলি। ভণিতা আমার পছন্দ না, সবসময় স্ট্রেট ফরোয়ার্ড চলতে পছন্দ করি। আপনাকে এখানে ডাকানোর কারণ হচ্ছে, রজনী আপনাকে তালাক দিতে চাইছে। সেই ব্যাপারেই আপনার সঙ্গে কথা।বলা।

ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলেও বাহিরে স্বাভাবিক ভাবেই বসে রইলো অভি। নিজের কানকে বিশ্বাস না করার কোনো কারণ নেই। সে তো প্রথম বউকে তালাক না দিয়েই আরেকটি বিয়ের করে ফেলেছে। সেখানে রজনী তাকে তালাক দিয়ে নতুন জীবনে পা রাখতে চাইছে- তাকে আঁটকে দেওয়ার বা বাধা দেওয়ার সে কে? কেউ না…
ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল অভি। অস্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-আমার পক্ষ থেকে কোনো সমস্যা নেই।

একটু অবাক হলো আদ্র।ভেবেছিল অভিকে মানানোর জন্য একটু বেগ পোহাতে হবে। কিছু টাকাও রেডি করে রেখেছিল। টাকার উপর বড় জিনিস আর কীইবা হতে পারে এই দুনিয়ায়? কিন্তু এক বাক্যে অভি রাজী হয়ে যাবে, তা ভাবতে পারেনি।

-শিউর?

-হ্যাঁ, রজনী কী আমার সাথে কথা বলবে এই ব্যাপারে?

-তার বলার দরকার নেই। আমি তো বলছিই। আমি তার থেকে মতামত নিয়েই স্টেপ নিচ্ছি। ঠিক আছে। আমি সব কাগজপত্র গুছিয়ে আর উকিলের সঙ্গে কথা বলে আপনাকে ফোন করব আবার। আপনি কষ্ট করে আপনাদের কাবিন নামা আমাকে দিতে পারবেন?

-কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দিলে চলবে?

-চলবে।

-আচ্ছা। উঠি তাহলে…

-শুনুন, কিছু মনে করবেন না। আমি কিছু ক্যাশ…

হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিলো অভি। ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করে বলল,
-সবসময় টাকাপয়সাই বড় হয় না। ওর সঙ্গে আমি অন্যায় করেছি, এই বোধ আমার হয়েছে। কথাটা কষ্ট করে ওকে জানিয়ে দিবেন। ওর বাকি জীবনটা ভালো কাটুক, সুখে কাটুক, দোয়া করি।

অভি বেরিয়ে গেল। অভির ব্যাপারে যেটুকু রাগ আদ্র’র মনে ছিল, তা পুরোপুরি ধুঁয়েমুছে গেল। সবাই সবসময় খারাপ থাকে না। সময় মানুষকে পরিবর্তন করে দেয় ধীরে ধীরে…

-সারাদিন কোথায় ছিলে শুনি?

ঘরে ফিরেই দোলার হম্বিতম্বি ভাব অভিকে বিরক্তির চরম শিখরে তুলে দিলেও নিশ্চুপ রইলো সে। শরীর থেকে ঘামে ভেজা জবজবে শার্ট টা খুলে বাথরুমে ঢুকলো বিনাবাক্য ব্যয়ে… সঙ্গে সঙ্গে অভির ফোনের উপর হামলে পড়ল দোলা। আলাদা হওয়ার পর থেকে প্রায়ই এই কাজটি করে সে। কে ফোন দেয়, অভি কাকে ফোন দেয়, সবকিছু ঘেটেঘুটে দেখে। অথচ এই সন্দেহপ্রবন মনই যে সংসার নষ্টের পেছনে দায়ী- তা দেখেও দেখছে না।

কল লিস্টে অনেক আননোন নাম্বার, সব নাম্বার চিনলো না। এত গুলো নাম্বার নিয়ে জেরা করাও সম্ভব না বিধায় ম্যাসেজ বক্সে ঢুকলো সে। নাছির উদ্দীনের ম্যাসেজটি দেখতে পেয়ে ভ্রু কুঁচকে এলো তার।
অভি বাথরুম থেকে বের হতেই দোলা বলে উঠল,
-তুমি কী নায়কের বাসায় গেছিলা?

-বাসায় না, অফিসে।

শান্ত কণ্ঠেই জবাব দিলো অভি। এখানে লুকোচুরির তো কিছু নেই!

-কেন??

-ডাকাইছিল।

-কীজন্যে?

-তালাকের বিষয়ে কথা বলতে। রজনীকে তালাক দিবো আমি।

-এতদিন পর হঠাৎ তালাকের শখ জাগলো?

-আমার থেকে জাগেনি। রজনীই চায়। নাহলে আদ্র সাহেবের সঙ্গে বিয়ে করাটা কেমন দেখাবে না?

-ওওওও!

ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবলো দোলা। তারপর অভির দিকে এগিয়ে এসে খুশিতে গদগদ কণ্ঠে বলল,
-তুমি ভুলেও তালাক দিবা না। বলবা যে তোমারে টাকা দিতে। টাকা দিলেই তালাক দিবা। পঞ্চাশ লাখের নিচে এক টাকাও কম নিবা না, বুঝছো? নায়ক মানুষ, সম্মান আছে না একটা। সম্মানের ভয়ে ঠিকই তোমার শর্ত মানবো। নইলে বলবা, তুমি সারা দুনিয়ায় জানাইয়া দিবা যে রজনী তোমার বউ লাগে, আর তোমারে তালাক না দিয়াই নায়কের লগে বিয়া বইছে। আর এইটাও কইবা, রজনী আর নায়কের অবৈধ সম্পর্ক আছে, রজনীর পেটেও অবৈধ বাচ্চা আছে নায়কের। নাইলে এতবড় নায়ক ওরে বিয়া করার লইগা পাগল হইয়া গেল কেন? আবার সবার সামনেই ওইদিন না অজ্ঞান হইয়া গেছিল? টিভিতে দেখাইছে তো… পোয়াতি দেইখাই তো অজ্ঞান হইছে বুঝো নাই? এগুলা কইলেই দেখবা নায়ককে থরথর কইরা কাঁপবো। তখন পঞ্চাশ লাখ কেন, এক কোটি চাইলেও দিয়া দিবো। কী বুঝছো তুমি?

এতদিনে যে কাজটি করা উচিত ছিল, তবুও করেনি অভি, আর সেই কাজটি করার আগে এক দন্ডও ভাবলো না সে। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে কষিয়ে দোলার গালে চড় মেরে বসলো। ভনভন করে উঠল মাথাটা। কয়েক কদম পিছিয়ে বিছানায় বসে পড়ল সে। মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,
-ও বাবা গো..

রক্তচক্ষু করে চোখ তুলে তাকাতেই অভি বাঘের মতো ঝাপিয়ে পড়ল তার উপর। গলা টিপে ধরলো দু’হাতে…

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here