#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ৩০
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
৭৪,
বউ সাজে স্টেজে বসে আছে আয়াত। পাশে রোজা আর রিফা-কে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আয়াত চারপাশে তাকিয়ে ইতি-উতি করে বোনকে খুঁজে চলেছে। এই মেয়ে-টা কোথায় ডুবে থাকে? কে জানে! এত বড় ছাঁদ। তার দেখা কোথাও নেই। বরপক্ষ-ও এসে পরেছে। জুবায়ের তার মুখোমুখি অন্য স্টেজে বসা। তার পাশে রায়াদের পাশাপাশি জুবায়েরের দুই ভাই বসেছে। মাঝখানের ফাঁকা জায়গা-টায় আত্মীয়-স্বজন মানুষজনের আনাগোনা চলছে। বরপক্ষের সাথে আসা মানুষজনকে খাওয়া দাওয়া করানোর পর্ব চলছে। এর পরপর-ই বিয়ে পরিয়ে হয়তো বিদায় হবপ তার। অথচ বোনের পদচিহ্ন তার নজরে পরছে না। আয়াতে দম বন্ধকর অনুভূতি হচ্ছে বোন ব্যতিত এখানে বসে থাকতে। আর মাত্র কিছু সময়। একটা সাইন এবং তিন কবুল বলার পরিবর্তে সম্পূর্ণ অপরিচিত কতগুলো মানুষের অধিকার জন্মে যাবে তার উপর। এরপর! এরপর কি চাইলেও পারবে বোনকে দেখার শখ হতেই দেখতে আসতে? রিয়ানা তো নিশ্চিত চলে যাবে জার্মানি। তাকে তো দেশে-ই থাকতে হবে। এই সময় টুকু কি তার সাথে থাকা যায় না? থাকলে কি এমন ক্ষতি হবে? আয়াতের মন-ট ভার হয়ে আসলো। অশ্রুতে চোখ টলমল করতেই মাথা-টা নিচু করে নিলো আয়াত। তখন-ই রিফা হাতের কনুই দিয়ে আয়াতকে খোঁচা দিলো। আয়াত মাথা তুলে তার পানে তাকাতেই রিফা চোখ দিয়ে ইশারা করলো ছাঁদে প্রবেশের দরজার দিকে তাকাতে। আয়াত তাকাতেই অশ্রু চোখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটিয়ে তুললো। রিয়ানা তার দিকে এগিয়প আসছে। কিন্তু পরনে সাদা শাড়ি! লাল-খয়েরী ব্লাউজের সাথে সম্পূর্ণ এক সাদা শাড়ি পরেছে সে। বা-পাশে সিঁথি করে চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া। ঠোঁটে লিপস্টিকে ছোঁয়া। একহাতে ব্রেসলেট, অন্য হাত ভর্তি গোল্ডেন আর লাল-খয়েরী রঙের মিশ্রণ করে পরা চুড়ি। লম্বা মেয়ে-টাকে এই সাজেও অসম্ভব সুন্দর লাগছে। কিন্তু বোনের বিয়ে-তে কে সাদা শাড়ি পরে? এই মেয়ের কি ভীমরতি চেপেছে মাথায়? আয়াত একহাতে চোখের কোণপ জমা জল মুছলো। রিয়ানা তার সামনে এসে দাড়াতেই মন খারাপ করে বললো,
“এক আমি, বিয়ের জন্য গায়ে চাপিয়েছি লাল বেনারসি। আর তুই বোনের বিয়েতে পরেছিস সাদা শাড়ি। এটা কি শোক বাড়ি মনে হচ্ছে তোর কাছে?”
“তো কি শাড়ি কোমড়ে গুঁজে নাচতে বলছিস? আমার বোন আমায় ছেড়ে পরের ঘরে যাবে! আমি মনের সুখে রঙ-বেরঙের সাজে ঘুরবো তাই না? স্যরি আমার মনে এত সুখ নেই আপু।”
রিয়ানা সোজাসাপ্টা উত্তর দিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে হাতের ফোনে মনোযোগ নিবেশ করলো। আয়াত হতাশ হয়ে দম ফেললো। যাক তবু তার চোখের সামনে এসে বসেছে এই বেশি। সে আর কিছু বলে বোনকে ঘাটালো না। কখন আবার দুম করে উঠে চলে যায়! তার তো ঠিক নেই। সে ধীর স্বরে শুধালো,
“শাড়ি কে পড়িয়ে দিলো তোকে?”
“অন্তি ভাবী।”
“কিহহ?”
রিফা অবাক হয়ে জিগাসা করলো। রিয়ানা ফোন থেকে মাথা তুলে রিফার দিকে তাকিয়ে বললো,
“এতে এত অবাক হওয়ার কি আছে? আমি ওর পাকা ধানে মই দেইনি যে, আমায় শাড়ি পরিয়ে দিলে ওর হাত ক্ষয় হয়ে যাবে।”
“সে রকম কিছু মীন করিনি রিয়ু। সবসময় তোমায় বাঁকা চোখে দেখে। সে তোমায় শাড়ি পরিয়েছে! একটু অবাক হলাম।”
“সেসব বাদ দাও। আপুকে কিন্তু শাড়িতে দারুণ মানায়। এক তো এত লম্বা। এরমাঝে শাড়ি পরেছে। কত্ত কিউট লাগছে।”
রোজা ওদের কথার মাঝে ফোঁড়ন কেটে কথা-টা বললো। রিফা উঠে এসে রিয়ানার পিছনে দাড়িয়ে রিয়ানার কাঁধে হাত রেখে বললো,
“ছোট আমাদের দুজনের। কিন্তু হাইটে আমাদের ছাড়িয়ে গেছে। এত লম্বা হতে কে বলেছিলো হুহ?”
“হাইট আমি বাড়াইনি আপু। উপরওয়ালা দিয়েছেন।”
রিয়ানা বললো, এরপর ফের দৃষ্টি আবদ্ধ করলো ফোনে। রিফা দমে গিয়ে বসলো নিজের স্থানে। রোজার সাথে এমনি গল্পে মেতে উঠলো।
৭৫,
জুবায়ের স্টেজে বসে বারবার আড়চোখে আয়াতের দিকে তাকাচ্ছিলো। সন্ধ্যা নামার পথে। বিয়ে-টা পরিয়ে বাড়ি পৌছাতে পারলে বাঁচে যেন। এরপর বউভাত সেরে আয়াতকে নিয়ে সোজা ঢাকা চলে যাবে। বাড়িতে তার ছোট-মার অশান্তি আর ভালো লাগছেনা তার। অথচ তার বাবাকে বুঝাতেই পারলো না এ অব্দি যে, সে বাড়িতে কেন থাকেনা। সকালবেলায় বিয়ের সাজের পাগড়ি পড়াতে গিয়ে তার বাবা তাকে জিগাসা করেছিলো, বউ নিয়ে বাড়িতে থাকবে তো? সে সোজা জবাব দিয়েছে ঢাকায় চলে যাবে। এই কারণে তার বাবার সাথে কয়েক দফা কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে। ভাগ্যিস বেশি মানুষ-জন ডাকা হয়নি বিয়েতে। নয়তো মানুষের মাঝে বাবা ছেলের কথা নিয়ে ছিহ্ ছিহ্ রব উঠে যেত। জুবায়ের যখন এসব ভাবনায় ব্যস্ত! রায়াদ তাকে কাঁধ দিয়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
“কি ভাবছিস তুই?”
“কিছু ভাবছি না।”
“স্পষ্ট দেখলাম ভাবনায় মত্ত ছিলি। কিছু হয়েছে সিরিয়াস ইস্যু?
” গ্রাম তো! বিয়ে-টা তাড়াতাড়ি পরিয়ে বাড়ি ফিরতে পারলে হতো।”
“কেন? ধৈর্য সইছে না বউকে কাছে পাওয়ার জন্য? ”
রায়াদ ঠোঁট টিপে হেসে বললো কথাটা। জুবায়ের চোখ পাকিয়ে তাকালো। তখন-ই কাজী সাহেব সহ মুরব্বী-রা সকলে উপস্থিত হলো। সাজ্জাদকেও লক্ষ্য করলো রিয়ানা। পাশে অন্তি। দুজনকে আজ দারুণ মানিয়েছে। এদের মাঝে রিয়ানা তো ৩য় ব্যক্তি হয়ে ঢোকেনি! তবে তাকে কেন এত কথা শুনতে হলো? রিয়ানা চেয়ার ছেড়ে ছাঁদের এক কোণায় গিয়ে দাড়ালো। কাজী সাহেব মুরুব্বীদের অনুমতি নিয়ে প্রথমে আয়াতের কাছে গিয়ে বসলেন। আরিফ হোসাইন, হানিফ হোসাইন দু ভাইয়ে মিলে মেয়ের দুপাশে বসলেন। রিফা, রোজা তাদের দেখে উঠে গেছে। কাজী সাহেব রেজিস্ট্রি পেপার সাজিয়ে আয়াতের সাইন নিয়ে ইসলামিক ভাবে বিয়ে পড়ানোর নিয়ম কানুন পরে আয়াতকে কবুল বলতে বললে সে জলভরা দৃষ্টিতে একবার বাবার দিকে, এরপর বড় চাচার দিকে, ইয়াসিন সাহেবের দিকে তাকিয়ে আসিফা বেগম এবং ফাতেহা খানমকে খুঁজলো আয়াত। পেলোনা তাদের। মা নেই, মা সমতূল্য দুজন মানুষ-ই তো আছে তার। জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাদের উপস্থিতি না পেয়ে যে-ই হতাশ হয়ে চোখ নামিয়ে নিবে? ছাঁদের দরজায় তাদের চোখে পরলো। চোখে জল ঠোঁটে হাসি নিয়ে আয়াত সাজ্জাদকেও একবার দেখলো। বড় ভাইয়ের ছায়া-টা যতটুকু সম্ভব এই মানুষের থেকেই পেয়েছে। এরপর আয়াতের দৃষ্টি গেলো রিয়ানার দিকে। রিয়ানাও হাতের ইশারায় বললো কবুল বলতে। আয়াতকে চুপ করে থাকতে দেখে হানিফ হোসাইন বললেন,
“মা, কাজী সাহেব যা বলতে বলেন। বল! চুপ করে আছিস কেন? আমি কি জোড় করে তোর বিয়ে দিচ্ছি তবে?”
আয়াতের চোখ দিয়ে ঝড়ঝড়িয়ে জল পরলো। সে দুহাতে তা মুছে মাথা দুদিকে দুলিয়ে না বোধক জবাব বুঝালো। কাঁপা গলায় কবুল বলে দিলো। এরপর আরও দুবার কবুল বলতে বলা হলে বলে দেয় আয়াত। কাজী সাহেব এরপর উঠে সোজা জুবায়েরের কাছে গেলেন। আয়াতের মতোই তারও সাইন নিয়ে কবুল বলতে বলা হলে জুবায়ের সময় নিলো না। উপস্থিত দাদু এবং বাবাকে দেখে আয়াতের দিকে দৃষ্টি ফেলে একদমে তিনবার কবুল বলে দিলো। এরপর উপস্থিত সবার মাঝে আলহামদুলিল্লাহ বলার কলরব উঠলো। সাজ্জাদ সবার মাঝে খোরমা বিলি করে দিলো। বিয়ের কাগজ পত্রে সাক্ষীদের সাইন নিয়ে নিজের পাওয়া বুঝে নিয়ে কাজী সাহেব বিয়ে বাড়ি ছাড়লেন। তিনি যাওয়ার পর আয়াত এবং জুবায়েরকে পাশাপাশি বসানো হলো। রিফা এবং রোজা মিষ্টি এনে দুজনকে মিষ্টি খাইয়ে দিলো। সাজ্জাদ তখন এসে তাড়া দিয়ে বললো,
“রিফা আয়াত এবং জুবায়েরকে নিয়ে নিচে আয়। ওদের খাওয়া দাওয়া বাকি। তোরাও আয় খেতে বসবি।”
৭৬,
রিফা ভাইয়ের কথায় মাথায় নাড়ায়। রায়াদকে ইশারায় ডেকে জুবায়েরের সাথে নিচে যেতে বলে আয়াতকে রোজা এবং রিফা দুজনের দু-পাশে দাড়িয়ে নিয়ে যায়। অন্তি রিয়ানাকে একপাশে দাড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে গিয়ে বলে,
“নিচে যাবে না? তুমিও তো কিছু খাওনি। সারাদিনে কফি খেয়ে-ই আছো।”
রিয়ানা উল্টোদিক ফিরে ছাদের রেলিঙ এ হাত রেখে আকাশে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে ছিলো। অন্তির কথা কানে যেতে-ই সে ফিরে তাকালো। বললো,
“আমি খেয়েছি কি খাইনি! খেয়াল রাখছেন যে?”
“ঐ যে বাড়ির বউ! বাড়ির সদস্য কে খেলো না খেলো আমার দায়িত্ব খেয়াল রাখা।”
“অন্তি ভাবী?”
রিয়ানা শীতল কণ্ঠে ডেকে উঠলো। অন্তির ভেতর-টা হু হু করে উঠলো রিয়ানার এত শান্ত কণ্ঠে ডাক শুনে। সে কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“বলো!”
রিয়ানা আচমকা এক কাজ করে বসলো। সে অন্তিকে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। অন্তির কাঁধে থুতুনী রেখে চোখ বন্ধ করলো। অন্তি নিজের কাঁধে রিয়ানার চোখের গরম জলের উপস্থিতি টের পেলো। সে কাঁপা হাতে রিয়ানার পিঠে হাত রেখে রিয়ানার মতো জড়িয়ে ধরলো। এক হাত মাথায় বুলিয়ে বললো,
“এই পাগলি মেয়ে! কাঁদছো কেন? বোন চলে যাবে বলে কষ্ট হচ্ছে? মেয়ে মানুষ! পরের ঘরে যেতেই হয়। তোমাকেও একদিন যেতে হবে। কেঁদো না প্লিজ!”
“আপনি এখনও আমার উপর ক্ষোভ জমিয়ে রেখেছেন তাই না? বিশ্বাস করুন আমি সাজ্জাদ ভাইকে একটুও ভালোবাসি না। আমি তাকে কখনও ভালোবাসি বলিনি। আমি জানি সাজ্জাদ ভাইয়ের আমার প্রতি মায়া, একটা সফট কর্ণার তৈরি হয়েছিলো। এটা বুঝেই আমি দূরে সরিয়ে দিয়েছি সবসময়। কখনও তার কথা গুরুত্ব দেইনি। তারপরও আপনার মা আর ফুফু আমায় কথা শোনালো। আমি মানতে পারিনি। তাদের অপমান করেছি। তারা অকারণে এসব বলবেনা। আপনার সংসার আমি নষ্ট করবো! এই ভয় থেকে-ই উনারা এসব বলেছেন আমি বুঝেছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন! আমি বিন্দুমাত্র তাকে নিয়ে ভাবিনি। আগেই ভাবিনি। এখন কি করে ভাববো? এখন তো উনি বিবাহিত। অবিবাহিত হলেও ভাবতাম না। আপনি প্লিজ উনাদের একটু বোঝাবেন। আমি সব শুনতে রাজী আছি। মা বিষয় কোনো কথা শুনতে রাজী নই। উনারা আমার মা তুলে কথা বলেছেন। আমার মায়ের ছায়া দেওয়া বোনের শিক্ষা নিয়েও কথা শুনিয়েছেন। আমি শক্ত হলেও এসব কথা সইতে পারিনা। আপনার মনে যদি ভ্রান্ত ধারণা থাকে আপনার বরকে আমি কেড়ে নিবো? এমন ধারণা রাখবেন না। অনুরোধ রইলো।”
রিয়ানা একদমে কথাগুলো বললো। চোখ বুজে মনে মনে ভাবলো, ‘ক্ষমা করুন ভাবী। একটা মিথ্যা বললাম। ঐ মানুষকে আমিও ভালোবাসছিলাম। তবে তার বিয়ের পর থেকে সব অনুভূতি মেরে ফেলেছি তার প্রতি।” অন্তিকে ছেড়ে চোখ মুছে শাড়ি উঁচিয়ে নিচে যেতে ছুট লাগালো। দরজায় আচমকা মুখোমুখি হলো সাজ্জাদের। সে এসেছিলো অন্তি আর রিয়ানাকে খাবার টেবিলে না পেয়ে ডাকতে। রিয়ানা তার দিকে এক পলক তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। অন্তি হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছে তখনও। মাথায় ঘুরছে রিয়ানার কথাগুলো। তার মা আর ফুফু এসে এসব করেছে? একদম ঠিক করেনি। আয়াতের বিদায় হোক! এরপর দুজনকে যদি না কথা শুনিয়েছে! রিয়ানা প্রথম যখন আসে! ভয়ে বলেছিলো মাকে রিয়ানার কথা। পরে সব বুঝে এটাও তো জানিয়েছিলো যে রিয়ানা ওমন মেয়ে নয়। সে খারাপ হলেও রিয়ানা যথেষ্ট আত্মসম্মান বোধ সম্পন্ন মেয়ে। তার সংসারে ভাঙন কখনও ধরাবেনা। তারপরও তার মা আর ছোটো ফুফু এসব করেছে? অন্তি রাগের সহিত নিচে যাবে বলে ঘুরতেই সাজ্জাদকে দেখে বলে,
“আপনি এখানে?”
“তোমাদের ডাকতে আসছিলাম। চলো, খাবে চলো।”
সাজ্জাদ হাঁটা ধরলে অন্তিও তার পিছু পিছু যায়। খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে আয়াতের বিদায়ের সময় এসে যায়। হানিফ হোসাইন বরের গাড়ির সামনে দাড়িয়ে জুবায়েরের হাতে আদরের কন্যা আয়াতের হাত তুলে দিয়ে বলেন,
“আমার কলিজার অর্ধেক তোমায় দিয়ে দিলাম বাবা। আগলে রেখো, অযত্ন করো না কখনও। ফুলের মতো মানুষ করেছি আমার বড় রাজকন্যাকে। ঝড়ে যেতে দিও না কখনও।”
“এটা বলতে পারবোনা বাবা যে, সবসময় সুখে রাখতে পারবো। কারণ জীবনের মোড় কখন কোনদিকে যায়! তার ঠিক নেই। তবে আপনার রাজকন্যাকে ইনশা আল্লাহ রাণীর মতো করে রাখার চেষ্টা করবো ওয়াদা করলাম।”
জুবায়ের স্মিত হেসে জবাব দেয় হানিফ হোসাইনকে। আয়াত বাবা, বড় চাচা, চাচী, ফাতেহা খানমকে জড়িয়ে কেঁদে দেয়। রিফা,রোজা কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। রিয়ানাকে খুঁজে কোথায় পায় না। তার চোখ রিয়ানাকে খুঁজতেই রিয়ানা কোথা থেকে জানি হাজির হয়। সে এসে বোনের গলায় একটা লকেট সহ মালা পরিয়ে জড়িয়ে ধরে। কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
“কাঁদবি না আপা৷ আমার আপা স্ট্রং গার্ল। ছিচকাঁদুনে নয়। আগামীকাল আবার দেখা হবে। এক রাতের বিষয়। মিস করলে লকেট খুলে দেখিস। বাবা, আমি, তুই এখানে একসাথে থাকবো আজীবন।”
রিয়ানা কথাটুকু বলেই বোনকে ছেড়ে ভীর ঠেলে বেরিয়ে আসলো। বোনের সামনে না কাঁদলেও সরে এসে চোখ মুছলো। দীর্ঘ সময় নিয়ে কয়েক-টা শ্বাস নিয়ে নিজের কান্না চাপার চেষ্টায় মত্ত হলো। হানিফ হোসাইন কন্যা এবং কন্যা জামাইকে গাড়িতে তুলে দিলে গাড়ি চলতে শুরু করে। আয়াত জানালা দিয়ে যতক্ষণ দেখা যায়! দেখলো সবাইকে। এরপর গাড়িতে বসে সীটে গা এলিয়ে দিলো। চোখ দিয়ে নিরবে অশ্রু ঝড়ছে। জুবায়ের তা লক্ষ্য করে আয়াতের দুচোখ মুছিয়ে দিলো। আয়াতের একহাত হাতের মুঠোয় নিয়ে অন্য হাতে মাথা-টা বুকের মাঝে চেপে ধরে বললো,
“স্যরি অনুমতি ছাড়া স্পর্শ করে ফেললাম। তবে কথা দিলাম এভাবেই আগলে রাখার চেষ্টা করবো।”
আয়াত জবাবে কিছু বললো না। শুধু জুবায়েরের হাত-টা শক্ত করে মুঠো করে ধরলো। রায়াদ ছাঁদে দাড়িয়ে ছিলো। দাড়িয়ে বিদায় দেখছিলো। আয়াতের বিদায় হতেই সে অন্ধকারে তারায় উজ্জল আকাশে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
“আপনার কথাগুলো আমি রাখবো আয়াত। আপনার আত্মার টুকরাকে আগলে রাখার চেষ্টায় নামবো। ওয়াদা রইলো রায়াদ শাহনেওয়াজের।”
৭৮,
আয়াতের বিদায় হতেই অন্তি তার মা আর খালার জন্য থাকার ব্যবস্থা যো রুমে করা হয়েছিলো! সেখানে এসে মা খালার সব কিছু গুছিয়ে নিলো। অন্তির মা বাইরে আসিফা বেগমদের সাথে বসেছিলো। রুমে এসে মেয়ে-র এহেন কান্ড দেখে বললেন,
“কিরে কি করছিস এসব?”
“রেডি হও। বাড়ি ফিরবে। ছোটো ফুফু কোথায়? তাকেও ডাক। সাথে নিয়ে যাও। তোমার বাসায় রেখো। সকালে বলবে চলে যেতে।”
“মানে! কি সব যা তা বলছিস? এই রাতে বাড়ি যাবো মানে?”
“তোমার মেয়ে জামাইয়ের গাড়ি আছে মা। আর বেশি গাড়ি ভাড়া দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়ার এবলিটিও আছে। তোমায় কি বলেছিলাম আমার বাড়ি এসে আমার বড় ননদের বিয়ে-তে এসে আমার ছোটো ননদকে ছোটো ফুফুর সাথে মিলে কথা শোনাতে? তোমায় প্রথমে আমার নিজের হীন কাজের জন্য ভয়ে বলেছিলাম ভয় করছে রিয়ানা ওকে কেড়ে না নয়ে? পরে বলিনি! ও এমন নয়। আমার মন ছোটো, মানসিকতা ছোটো। এজন্য ভয় পেয়েছি। ও ভালো একটা মেয়ে। তোমার মেয়ে খারাপ। নিজের ভুল শুধরাতে নেমেছি! আর তুমি নিজের মেয়ের ভুল রেখে কোন মুখে অন্যের মেয়েকে কথা শোনাও? এজন্য বলি আমার এত আত্মসম্মান আর লজ্জা কম কেন? আমার মা স্বয়ং নিজেই তো এমন। লজ্জাহীন আর আত্মসম্মান হীন। তোমাদের বাড়ি তো যাই-ই না। বাবাও আমার উপর রাগ করে আসেন না। তুমিও ভুলেও পা ফেলবেনা এ বাড়িতে। একটা নিরঅপরাধ মেয়েকে কথা শোনাও? আমার ভুল আমি তোমাকে বলেছিলাম ওসব কথা। তা ধরে বসে আছো? অথচ পরের বলা কথাগুলো হুঁশে নেই? চলে যাও আমার বাড়ি থেকে। থাকার দরকার নেই তোমার। যথাযথ শিক্ষা আমায় দিতে পারোনি বলে এভাবে আমার দ্বারা এত মানুষ অপমানিত আর কষ্ট পাচ্ছে। মা হয় সন্তানের প্রথম শিক্ষিকা। এমন শিক্ষায় গড়েছো! আমার উঁচু গলায় গর্ব করে কথা বলার মতো মুখ নেই। ঘৃণা লাগছে আজ নিজের প্রতি।”
অন্তি কথাগুলো বলে ঝড়ঝড়িয়ে চোখের পানি ছেড়ে দেয়। সাজ্জাদ বাইরে-ই ছিলো। সেও ছাঁদে রিয়ানার সব কথা শুনেছে। এজন্য অন্তির পিছু এসেছিলো যে মা মেয়ে কি বলে শুনতে। এসে অন্তির মুখে এসব কথা শুনে, অন্তিকে কাঁদতে দেখে সাজ্জাদ ঘরে আসলো। অন্তিকে সামলে গলার স্বর কঠিন করে বললো,
“যে মানুষ আমার বাড়ির মেয়ে-কে বিনা দোষে এমন অপমান করে! তার ঠাই এখানে হবার নয়। দোষ আমার ছিলো৷ দোষ অন্তিরও আছে। শুধরে যখন ভালো থাকতে চাচ্ছি? আপনার নাক না গলালেই চলছিলো না? বাইরে গাড়ি ঠিক করা আছে। ব্যাগ উঠান, চলে যান খালাকে নিয়ে। আপনাদের সহ্য হচ্ছে না এই বাড়িতে।”
অন্তির মা মেয়ে এবং মেয়ে-জামাইয়ের কাছে অপমানে লজ্জায় আর দাড়ালেন না। ব্যাগ উঠিয়ে ছোটো ননদকে ডেকে বাড়ি ছাড়লেন। আসিফা বেগম ভাই বউ এবং বোনকে এভাবে চলে যেতে দেখে পিছু যেতে যেতে বললেন,
“তোরা এভাবে হুট করে চলে যাচ্ছিস কেন? কি হলো?”
অন্তির মা স্বামীর কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে গাড়িতে চড়ে বসলেন। ছোটো ননদকে নিয়ে বেরুনোর সময়-ই বলেছিলেন চুপ থাকতে। গাড়িতে বসে সব বলবেন। শারিফা চৌধুরী এজন্য চুপ ছিলেন। ওনারা চলে যেতেই সাজ্জাদ আর অন্তি ড্রইং রুমে আসে। মায়ের হাপিত্যেশ দেখে সাজ্জাদ বলে,
“সুখের সংসারে ছাড়পোকা না থাকাই ভালো মা। বোন আর ভাই-বউকে নিয়ে আলুথালু করার শখ তো নিজের বাপের বাড়ি গিয়ে করো।”
আসিফা বেগম ছেলের কথার আগামাথা না বুঝে শুধালেন,
“কি বলছিস এসব?”
“কিছু নয়। সকালে বলবো। আপাতত যাও সবাই রেস্ট করো।”
সাজ্জাদ কথা-টা বলেই অন্তিকে ইশারায় বোঝালো রুমে আসতে। ড্রইং রুমে উপস্থিত সকলে আর মাথা ঘামালেন না। অতিথি সব চলে যাওয়ায় যে যার রুমের দিকে পা বাড়ালো। আত্মীয়-স্বজন সব বাড়ি কাছাকাছি হওয়ায় খাওয়া দাওয়া করে জামাই দেখেই চলে গেছে। তাই বাড়ি একপ্রকার ফাঁকা-ই বলা চলে।
এদিকে রিয়ানা পুরো বাড়ি নিদ্রায় মগ্ন হলে রুম থেকে বেরিয়ে ছাঁদে আসে। ছাঁদের মাঝ বরাবর হাঁটু মুড়ে বসে চিৎকার করে কান্না করে বসে। হাহাকার সহিত কান্না করতে করতে বলে,
“আপা রে! আমার আর সহ্য হচ্ছে না। আমিও তো মানুষ। আর কত সহ্য করবো? মা চলে গেছে। এক তুই আদর করতি। বাবা তো আদর করে না। আগলায় না। আমি বাঁচব কি করে? আমার অসুখ হলে! আমার মন খারাপ থাকলে আমায় কে ভালো করে তুলবে? আমার মন খারাপ হলে এসে বলবে, চল মন ভালো করে দিই? আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আপা। আমি নিজের সাথে নিজে লড়াই করে দিনদিন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছি। সবার সামনে নিজেকে শক্ত রেখে চললেও ভেতরে ভেতরে আমি শেষ আপা। আর কত মানুষ হারাবো? আমি আর পারছিনা এসব সহ্য করতে। একটু এসে আমায় আগলে ধর না! আমার বুকের ভেতর টায় জ্বালাপোড়া করছে ভীষণ।”
“আমি কি এই জ্বালাপোড়া কমানোর দায়িত্ব নিতে পারি না রিয়ানা? আপনার আপা যে আমায় বলে গেছে আপনার দায়িত্ব নিতে! আমায় কি সুযোগ দেওয়া যায় না আপনাকে আগলে নেওয়ার?”
আচমকা কান্নার মাঝে রায়াদের গলার স্বর শুনে রিয়ানা চোখ তুলে তাকায়। রায়াদও তার সামনে হাঁটু ভেঙে বসেছে। সে তাকাতেই রায়াদ দুঃসাহসিক এক কাজ করে বসলো। রিয়ানার চোখের জল মুছে দিয়ে বুকের মাঝে জাপ্টে ধরলো রিয়ানাকে। ফিসফিস করে বললো,
“আপনাকে আমি ভালোবাসি না। কিন্তু আপনার কষ্টগুলোও সহ্য হচ্ছে না। একটু আগলে রাখি একটু সময়? এরপর আপনি শান্ত হলে ছেড়ে দিবো। আপনার অনুমতি পেলে একদিন সারাজীবনের জন্য ধরার অধিকার তৈরি করে নিবো। একসময় ভালোবেসে ফেলবো। আমাকে কি সুযোগ দিবেন?”
চলবে?
ভুলত্রুটি মার্জনীয়, রিচেইক করিনি। আসসালামু আলাইকুম।