#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ২৯
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
৭২,
শুক্রবার দিন, বেলা এগারোটা। পুরো বাড়ি জুড়ে বিয়ের তোড়জোড় চলছে। একদিকে খাবারের আয়োজন। অন্যদিকে বিয়ের স্টেজ সাজানো হচ্ছে বর-বউ দুজনের জন্যই। বড় ভাইয়ের সাথে অসুস্থ শরীর নিয়েও বড় মেয়ের বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত হানিফ হোসাইন। বারান্দায় কফির মগ হাতে দাড়িয়ে বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গা-টায় সবার ছুটোছুটি দেখছে রিয়ানা। আর মাত্র কিছু সময়! এরপর তার বোন পরের ঘরের ঘরণী হবে। ইশশ! কি রকম বিষাক্ত সুন্দর নারী জীবন। রিয়ানা কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে ঘরে পা রাখলো। সবাই রিফার রুমে ভীড় জমিয়ে আয়াতকে সাজানোয় ব্যস্ত। রিয়ানার ভীর, হইচই পছন্দ নয় বলে তার রুমে তাকে একা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। রুমে পা দিতেই অন্তির মা-কে আর সাজ্জাদের খালাকে দেখে রিয়ানা ভ্রু কুঁচকালো। এনারা এখানে কি করে? ভাবনায় মত্ত হলো সে। রিয়ানাকে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকতে দেখে অন্তির মা বলে উঠলেন,
“কেমন আছো রিয়ানা?”
রিয়ানা সাজ্জাদের বিয়ের সময় জেনেছিলো ইনি অন্তির মা। তাই ভদ্রতার খাতিরে গলার স্বর নরম করেই রিয়ানা জবাব দিলো,
“জি, ভালো আন্টি। আপনি কেমন আছেন?”
“আর কেমন থাকি বলো? মেয়ের সংসার অশান্তি করতে মেয়ে-জামাইয়ের একসময়ের ভালোবাসার মানুষ যখন তার চোখের সামনে এত সুন্দর সাজগোজ করে ঘুরঘুর করে তার মন জয় করে আমার মেয়ের সংসার ভাঙার চেষ্টায় নামে? মেয়ের মা হয়ে কি ভালো থাকতে পারে?”
রিয়ানার বুঝতে বাকি রইলোনা এ বাড়িতে তার উপস্থিতি অন্তির মা ভালো নজরে দেখেননি। না দেখলো তার কি? তারও তো বাড়ি এটা। সে এখানে আসছে মানেই যে সাজ্জাদের পিছনে হাত ধুয়ে নেমেছে! এটা কেমন ধারণা অন্তির মায়ের মনে? রিয়ানা বিষয়-টা ক্লিয়ার করার জন্য বললো,
“স্যরি আন্টি। অন্যের এঁটো জিনিসে আমার নজর থাকে না। আর আপনার মেয়ের সংসার ভাঙলে আমায় বলবেন। নিজ দায়িত্বে সুপার গ্লু দিয়ে লাগিয়ে দিবো। আর যাই হোক! আমাদের হোসাইন পরিবারের ছেলে-মেয়ের এই স্বভাব নেই যে, এক সংসার রেখে অন্য ছেলে বা মেয়ের পিছনে পিছনে দৌড়াবো। যদি তা হত? আপনার মেয়ে থাকত আপনার বাড়ি। আমি থাকতাম সাজ্জাদ হোসাইনের বেডরুমে। কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা, একজনের ইউজ করা জিনিস বা মানুষ আমার পছন্দ না। গা ঘিনঘিন করে। ইন্টারেস্ট আসে না।”
রিয়ানার সোজাসাপটা উত্তরে অন্তির মায়ের মুখ-টা চুপসে গেলো। সরাসরি রিয়ানার করা অপমান উনার বুঝতে বাকি রইলোনা। আরও কিছু বলা মানেই অপমানিত হওয়া। রিয়ানা প্রথম আসার পর তার মেয়ে রিয়ানাকে নিয়ে তার কাছে আলোচনা করেছিলো, যে রিয়ানা ফিরেছে। সাজ্জাদের মন না ঘুরে যায়! পুরুষ মানুষের মন! কখন কোনদিকে ঘুরে! তার মাঝে অন্তির অপকর্ম! সব মিলিয়ে অন্তির ভয় ছিলো সংসার ভাঙার। সেই ভয়-টা তার মায়ের সাথে শেয়ার করায় তার মা এসে রিয়ানাকে কথা শুনিয়ে বাড়ি ছাড়া করানোর বুদ্ধি এঁটেছিলেন। কিন্তু এ মেয়েকে যে কথার আঘাতে টলানো যাবে না? এটা বুঝতে পারেননি অন্তির মা। রিয়ানার জবাবে উনার মুখ-টা দেখার মতো হয়েছে। রিয়ানা তা দেখে মিটমিট করে হাসলো। অন্তির মা জবাব দিচ্ছিলো না বলে সাজ্জাদের খালা বলে উঠলেন,
“হোক এঁটো বা খুঁটো জিনিস রিয়ানা। তোমার তো স্বভাব আছে-ই সব খেয়ে ফেলার। মা-কে খেয়েছো। বাবার মান সম্মান সাজ্জাদের বিয়ে-তে এসে খেয়েছো। জীবিত বাবাকে বেঁচে থাকতেই সম্মানহীন করে জিন্দা লাশ বানিয়েছো। নিজেরও আত্মসম্মান খেয়ে ফেলেছো বোধ হয়। এজন্য যে ছেলে তোমায় একসময় ভালোবাসতো! সে বিয়ে করে সুখের সংসার করছে! তা তোমার সহ্য হয়নি তাইনা? এজন্য এসেছো অন্তির সুখ নষ্ট করতে?”
৭৩,
রিয়ানা মায়ের কথা উঠায় একটু ধাক্কা খেলো। ভেতর থেকে মিইয়ে গেলো যেন। বুকের মাঝে কান্না-রা দলা পাকিয়ে আসছে যেন। রিয়ানা রাগে দুঃখে হাত মুঠো করে কফির মগ ফ্লোরে আছার মারে। আঙুল তুলে সাজ্জাদের খালার দিকে। শাসিয়ে বলে,
“জাস্ট কিপ ইউর মাউথ শাট মিসেস শারিফা চৌধুরী। ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট। আমার লাইফ, আমার সেলফ রেস্পেক্ট নিয়ে কোনো আন্দাজ নেই আপনার। আমায় এভাবে কেউ কথা শোনাক। একদম পছন্দ নয় আমার। বিনাদোষে আমায় অপমান করলে আমি ছেড়ে কথা বলি না। আমি আপনাদের ছেলেকে কখনও বলেছি তাকে ভালোবাসি? কখনও বলেছি অন্তিকে ছেড়ে আমায় গ্রহণ করতে? নাকি আপনাদের আদরের অন্তির মতো স্বামী রেখে পর পুরুষের আশায় সংসার ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে থেকেছি? অন্য কারোর উপর আঙুল তোলার আগে নিজেদের দিক-টা দেখবেন নেক্সট টাইম থেকে ওকে? আমার আত্ম সম্মান এত ঠুনকো না আপনাদের কথায় কমে যাবে। আমি এত বেহায়া নই অন্যের স্বামীর দিকে নজর দিবো। আমার বাবার সম্মান আপনাদের চোখে কমতে পারে। আমার চোখে কমেনি। সাজ্জাদ ভাইয়ের বিয়ের সময় আমার ড্রেস আপ নিয়ে কথা উঠেছিলো। আমার বাবা-বোন আমায় বাঙালিয়ানা শিখাতে পারেনি! এটা নিয়ে আপনারা সেইবারও আঙুল তুলেছিলেন। ভুলে যান কেন আমি এদেশে বড় হইনি। আমি বাঙালি কালচার জেনে কি করবো? আমার লাইফ আমার রুলস। আমি যেভাবে চলবো, তাতে আপনাদের সমস্যা কি? আপনারা আমায় ড্রেস কিনে দেন? নাকি আপনাদের টাকায় খেয়েপরে ওয়েস্টার্ন কালচার শিখেছি? নিজেদের চরকায় তেল দেন না। আমার পিছনে লাগতে আসছেন কেন? তেল বেশি হয়েছে? তো অন্তির পথে ঢালুন না গিয়ে! যেন পিছলে সোজা সাজ্জাদ ভাইয়ের কোলে গিয়ে পরে। আমার পিছনে ঢালতে আসছেন কেন? পিছলে পরবো ভেবেছেন? অথচ আপনারা জানেনও না আমার রাগ আর জেদের মাত্রা কত! জানেনও না আমি ঠিক কি? আপনাদের সস্তার কথা শুনে আমি কাঁদবো। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবো ভেবেছেন। আমার বাপের টাকাও আছে এই বাড়ির ভীদে। আপনাদের টাকা নেই। অতিথি হয়ে এসেছেন। অতিথি হয়ে থাকুন। লিমিট ক্রস করবেন তো! এ বাড়িতে তুফান উঠবে। যত্ত সব আজাইরা মহিলা। নিজের খেয়েপরে খালি অন্যের মেয়ের পিছনে লাগা। এর আগের বার সাজ্জাদ ভাইয়ের বিয়েতে চুপ ছিলাম বলে ভেবেছেন এবারও চুপ থাকবো? সেবার বাবার কথা ভেবে চুপ ছিলাম। এক ড্রেস আপ নিয়ে কথা বলেছিলেন তাতেই আমার বাবা শিক্ষা দিতে পারেনি। যদি জবাব দিতাম? তবে বলতেন মেয়ে মানুষ-ই হয়নি। কিন্তু এবার চুপ থাকলাম না। বাবার কথাও ভাবলাম না। কারণ ঐ যে বললেন বাবার সম্মান খেয়ে ফেলেছি। না খেয়েই যদি শুনতে হয় তবে সম্মান খেয়েই এবার শোনা উচিত বলে মনে করলাম। বুঝতে পেরেছেন? নাউ লীভ ফ্রম মাই রুম। বেরিয়ে যান।”
রিয়ানার তেজের সামনে টিকতে পারলেন না অন্তির মা আর সাজ্জাদের খালা শারিফা চৌধুরী। তড়িঘড়ি করে উঠে রুম ছাড়লেন রিয়ানার। উনারা যেতেই আচমকা রায়াদ ঢুকে পরে রিয়ানার রুমে। রায়াদকে দেখে রিয়ানা প্রশ্নাত্মক চাহনীতে তাকালো। রায়াদ বলে উঠলো,
“এত তেজ বাপরে? স্যরি আমি বাইরে থেকে আপনাদের সব কথা শুনে ফেলেছি। রুমে যেতে ধরে একটু কথা কানে আসে আপনার প্রথম জবাবের। এরপর দাড়িয়ে যাই। আপনার তেজী কন্ঠ! উফফ এত তেজ পান কোথায় বলুন তো?”
রায়াদের চোখেমুখে মুগ্ধতা লক্ষ্য করলো রিয়ানা। সে একটা কথা-ই বুঝলোনা রায়াদ তার সব কথা শুনে ফেলেছে! তবুও সাজ্জাদের তার সম্পর্ক নিয়ে কিছু বললো না যে! তবে কি ডায়েরীর সব ভাষা ট্রান্সলেট করেছে সে? রিয়ানা এই চিন্তায় মগ্ন যখন, রায়াদ তখন একটা আশ্চর্যজনক কাজ করে বসলো। রিয়ানার মুখোমুখি দাড়িয়ে বললো,
“আমায় একটু তেজ ঋণ হিসেবে দিবেন? আপনার তেজ-টা কমিয়ে একটু শান্ত করতাম। এত তেজী মেয়ে এই সমাজে টিকতে পারেনা। প্রতি পদে বিপদে পরে। আমি না হয় তার তেজ নিয়ে একটু ঢাল হতাম!”
রিয়ানা এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো রায়াদের দিকে। রায়াদ কি তার সাথে ফ্লার্ট করছে? এই ভাবনা থেকে রিয়ানা আরও দু কদম এগিয়ে রায়াদের পরনে থাকা ছাইরঙা পাঞ্জাবির কলার ধরে পা উচিয়ে রায়াদের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে বলে,
“ফ্লার্ট কুইনের সাথে ফ্লার্ট করতে আসলে আগে ফ্লার্ট করার স্কিল শিখতে হবে আপনাকে মি: রায়াদ শাহনেওয়াজ। আমার তেজ নিজের মাঝে ধারণ করার শখ তাইনা? চলেন বিয়ে করি। এরপর বাসর করে আমার সব তেজ ঠান্ডা করে দিয়েন আপনার আদরে আদরে।”
রিয়ানা ভেবেছিলো রায়াদ প্রতিবারের ন্যায় লজ্জায় সরে যাবে। কিন্তু না! তার ভাবনাকে অবান্তর করে রায়াদ বিস্মিয় জনক এক কাজ করে বসলো। দুহাতের আঁজলায় রিয়ানার গাল ভরে আলতো স্বরে বললো,
“আমি রাজী। আজ তবে জুবায়ের-আয়াতের বিয়ের পাশাপাশি আমাদের বিয়ে-টাও হোক?”
রিয়ানা থমকালো রায়াদের কথায়। সে তো ফ্লার্ট করে কথাগুলো বলেছিলো। কিন্তু রায়াদ এসব কি বললো? তবে কি তার ভয় সত্যি হলো? রায়াদ তার প্রতি দু্র্বল হচ্ছে! এই ভয়ে বেশ কিছুদিন হলো সে ভীত থাকে। আবার কেউ তাকে ভালোবেসে কষ্ট পাক! একদম চায় না রিয়ানা। সে এক ঝটকায় রায়াদের থেকে দূরে সরে ঝাঁজালো স্বরে বললো,
“আমার তেজে ঝলসে যাবেন। দূরে থাকুন আমার থেকে। তবেই মঙ্গল।”
চলবে?
ভুলত্রুটি মার্জনীয়। আমার প্রিয় একজন মানুষ হসপিটাইলাইজড। দুয়ার আবদার রইলো। মানসিকতা আজ ঠিক নেই। দিতেই চেয়েছিলাম না।এজন্য আজ এতটুকুই। আসসালামু আলাইকুম।