#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ১৭
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
৩৮,
পরপর কেটে গেলো আরও দুসপ্তাহর মতো সময়। রিয়ানার দেশে আসার একমাস পূর্ণ হয়ে কেটে গেলো বেশ কিছুদিন। সময় কত দ্রুত বয়ে যায়। মনে হচ্ছে এই তো সেদিন দেশে আসলো। অথচ কত তাড়াতাড়ি একমাসেরও অধিক সময় কেটে গেলো। দিন কে দিন তার নিজের অনুভূতি গুলো কেমন মৃত হওয়ার পথে। কিছুতেই আর আগ্রহ নেই। যে যেমন বলছে, শুনে যাচ্ছে। পছন্দ হলে কথা রাখছে, নতুবা কষ্ট দিচ্ছে সবাইকে। ব্যস এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছে। সকালে উঠে নাস্তা করা, বোনের সাথে খানিকক্ষণ আড্ডা দিয়ে রুমে এসে দুপুরের খাবার খেয়ে নিজের ফ্রেন্ড’সদের সাথে গ্রুপচ্যাটে আড্ডা দেয়। এরপর টুকটাক নিজের মতো সময় কাটায়। সময়-টা যায় হয় বারান্দায় বসে উদায় হয়ে বসে থেকে। নয়তো আকাশে শূণ্য দৃষ্টি মেলে। অথবা কখনও বিকেল-টা কাটে রোজার সাথে। দুবোনে রোজার সাথে বাইরে গিয়ে বাসার আশেপাশে কোনো একটা ফুচকা স্টলে বসে ফুচকা খেয়ে। আবার কখনও কোনো একটা ক্যাফে-তে বা রেস্টুরেন্টে গিয়ে জম্পেশ খাওয়া দাওয়া করে। রাতটুকু তো ঘুমেই কেটে যায়। রিয়ানার একটা ভালো গুণ, যত যন্ত্রণা-ই হোক! ঘুম-টা ছেড়ে যায় না। বিছানায় গা এলিয়ে দিলে ঘুমিয়ে পরে সে। ব্যস এভাবেই দিন চলে যায়। সময়-টা মন্দ না! ভালো-ই কাটছে তার। কিন্তু এখানে এভাবে থাকতে আর ইচ্ছে করছেনা রিয়ানার। মন তো বলছে জার্মানি চলে যেতে। সেখানে গেলে মন খারাপের রেশ হলেই সে নিজের মনমতো ঘুরে বেড়াতো। আর এখানে একপ্রকার বন্দী জীবন। বেরুতে পারবেনা এমন না, কিন্তু রাস্তাঘাট চেনা! এটাই বড় বিষয় হয়ে দাড়িয়ে। ফোনের জিপিএসের সাহায্যে চলতে পারলেও চেনাশোনা আর অচেনা! বিস্তর তফাৎ। হানিফ সাহেব আজও গ্রাম থেকে ফিরেননি। ফিরে আসা-টা জরুরী। এরপর বাবাকে বলে জার্মানির টিকেট কেটে নিয়ে চলে যাবে সে। আয়াত আর হানিফ সাহেব গেলে যাক! না গেলে না যাক। তার কিছু যায় আসেনা৷ সামনে উইন্টার সেমিস্টার আসছে। সে ইউনিভার্সিটিতে এডমিট হয়ে যাবে এবার। সহজ ভাষায় গিউনেজিউম ধাপ শেষ হওয়ার উপর যা শেখানো হয় তার ব্যসিসে ৬মাস একটা প্রজেক্ট হয় কলেজে। সেটা শেষ করেই আপাতত ব্রেকে ছিলো রিয়ানা। আর সেই সুযোগেই তার বাবা দেশে আনলো। এবার গিয়ে ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন নেওয়ার প্রসেস শুরু করবে সে। উইন্টার সিজনে শুরু করলে দেখা যাবে পছন্দের সাবজেক্ট বা পছন্দের ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেতে পেতে সামার সিজন না এসে বসে! মানুষের মন বোঝা নাকি বড্ড বেশি-ই কঠিন! আর মানুষের শরীরের থেকে মনের অসুখ-ও নাকি বেশি! এজন্য তো রিয়ানার ইচ্ছে মনোবিজ্ঞানী হওয়ার। আর পড়াশোনা করতেও চায় এই বিভাগেই। এখন উপরওয়ালা জানেন তার ইচ্ছে পূরণ হবে কিনা! রিয়ানার হাতের ফোন-টা বেজে উঠায় সব ভাবনা-চিন্তার জগতে বিপত্তি ঘটলো। চকিতে ফোনের দিকে তাকালো। ফোনের স্কিনে জ্বলজ্বল করছে সাজ্জাদের নাম। অদ্ভুত! এই লোক-টা এতদিনে এতমাস পর কল দিলো? কি কারণে? বুঝে আসছেনা রিয়ানার। কথা বলে মায়া বাড়াতে চাইলো না সে। কল-টা কেটে দিলো৷ তৎক্ষনাৎ একমিনিটের মাথায় মেসেজ আসলো। রিয়ানা মেসেজ-টা ওপেন করতেই দেখতে পেলো, ‘চাচার অসুখ গুরুতর। আয়াতের কাছে কল দিলাম ধরলো না। বাধ্য হয়ে আপনার কাছে কল দিলাম। সবাই উনাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ায় খবর-টা আমার উপর-ই পৌঁছানোর দায়িত্ব ছিলো। যদি সম্ভব হয় আয়াতের সঙ্গে গ্রামে আসবেন। অথবা তাকে আসতে বলবেন।’
রিয়ানা মেসেজ-টা পড়ে হতভম্বের ন্যায় তাকিয়ে রইলো ফোনের দিকে। বাবা অসুস্থ! কি করে কি হলো? ডিটেইলস জানতে মুহুর্তে কলব্যাক করলো সাজ্জাদের নাম্বারে। কিন্তু এবার তার কৃত কর্মের উল্টো প্রতিক্রিয়া আসলো। ওপাশ থেকে কল-টা কেটে দেওয়া হলো। রিয়ানা এই দুঃসংবাদের মাঝেও চোখের কোণে অশ্রু জমিয়ে হেঁসে ফেললো। আনমনে বিরবির করে বললো,
“অভিমান আজও জমিয়ে রেখেছেন! ফিরিয়ে দেওয়ার দিন আপনি করে বলেছিলেন! আজও বললেন। অথচ আমি যেদিন আপনার তরে এসেছিলাম! চাইলেই পারতেন আপন করে নিতে। কিন্তু আমার জেদের পর আপনার জেদ! দুজনের অনুভূতিকে মনের কবরে দাফন করিয়ে ছাড়লো। তবে এই অভিমান কিসের তরে সাজ্জাদ ভাই!”
রিয়ানা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। চোখের কোণে অশ্রু মুছে আয়াতের রুমের দিকে পা বাড়ালো। উদ্দেশ্য বোনকে বাবার বিষয়-টা অবগত করে সাজ্জাদের কাছে কল করতে বলা। আয়াতের কল অন্তত সে কাটবেনা।
৩৮,
রাতের প্রায় ১টা। রায়াদের মনে বিক্ষিপ্ত অনুভূতির ছড়াছড়ি। একটা কথা বেশ ভাবিয়ে ছাড়ছে তাকে। আজ দুসপ্তাহ যাবত একটা কথা তাকে বেশ করে পিছু নিয়েছে। উঠতে-বসতে, খেতে-শুতে একটা কথা ভীষণ করে ভাবাচ্ছে তাকে। হাতের ফোন-টা নিয়ে সময় খেয়াল না করেই জুবায়েরের কাছে কল লাগালো রায়াদ। একবার, দুবার, তিনবার কল হয়ে কেটে যাওয়ার পর ৪র্থ বারে গিয়ে জুবায়ের কল রিসিভ করলো। রায়াদ কিছু বলবে! তার আগেই জুবায়ের বিস্মিত কণ্ঠে শুধায়,
“এতরাতে এভাবে কল কে দেয় হারামি? ঘুমের বারো’টা বাজাতে শিখলি কবে থেকে? দ্যা গ্রেট রায়াদ শাহনেওয়াজ তো টাইম সম্পর্কে বেশ স্ট্রিক্ট। টাইমলি ঘুমায়। অথচ আজ জেগে থেকে নিজেও ঘুমায়নি! অন্যের ঘুমেরও বারো’,টা বাজিয়ে দিলো! কাহিনী কি?”
“আচ্ছা জুবায়ের, ভালোবাসা একটা মানুষকে বদলাতে পারে তাইনা?”
জুবায়ের আরেক দফা অবাক হলো। কানের কাছ থেকে ফোন নামিয়ে উপুর হয়ে শুয়েছিলো সে। সোজা হয়ে শুয়ে ফোনের স্কিনে নাম্বার-টা ঠিক করে দেখে নিলো। না, রায়াদেরই নাম্বার। কিন্তু কথাবার্তা এরকম অন্যজনের মনে হচ্ছে কেন তার কাছে? গলার স্বরও একই তো লাগলো। সে ফের কানে ফোন ঠেকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“মদ-টদ খেয়েছিস নাকি? তোর গলায় ভালোবাসার কথা? নাকি আমি-ই ড্রিংক করে বসেছি! ভুলভাল শুনছি।”
“চুপ করবি তুই? আমি যা জিগাসা করলাম উত্তর দে।”
রায়াদ জুবায়েরের অভিব্যক্তি শুনে মেজাজ হারিয়ে ক্ষিপ্ত স্বরেই কথা-টা বললো। জুবায়ের আরাম করে বুকের উপর বালিশ নিয়ে ড্রীম লাইটের আলোয় সিলিং ফ্যানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
“ভালোবাসা অবশ্যই মানুষকে বদলায়। ভালোবাসা নিজেও রঙ বদলায়। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়। নিজের রঙ বদল করে ভালোবাসা মানুষকেও বদলে দিতে বা বদলে যেতে বাধ্য করে। একটা চঞ্চল মানুষ দেখা যায় ভালোবেসে নিশ্চুপ হয়ে যায়। আর একটা নিশ্চুপ মানুষ! ভালোবাসা অভাবের জীবনে ভালোবাসা পেয়ে হারালে! সেই যন্ত্রণা লুকাতে নিজের শান্ত স্বভাবকে লুকোতে চঞ্চল হয়ে যায়। অথবা আরও শান্ত হয়ে যায়। ভালোবাসা! সে বড্ড ভয়ংকর সুন্দর বিষয়।”
কথাগুলো বলতে গিয়ে জুবায়েরের গলা ধরে এলো। কণ্ঠ খানিক-টা খাঁদে নেমে এলো তার। রায়াদ বিচলিত হলো। জুবায়েরের শান্ত কণ্ঠ তাকে চিন্তিত করে তুললো। জুবায়ের কি তার থেকে কিছু লুকোচ্ছে! এই কথাগুলোর মাঝে রায়াদ কেমন জানি জুবায়েরের জীবনের কিছু একটা ঘটনা! যেটা সে অবগত নয় বা জুবায়ের বলেনি! এমন কিছু লুকিয়ে আছে। সে তো এক উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেছে। অথচ জুবায়েরের কণ্ঠ এত শান্ত হয়ে এলো! অথচ সে তো বড্ড ছটফটে ছেলে। রায়াদ উদ্বিগ্ন হয়ে জুবায়েরের উদ্দেশ্যে বলে,
“তুই কি আমার থেকে কিছু লুকোচ্ছিস জুবায়ের? তোর গলার স্বর কেন জানি আমায় জানান দিচ্ছে! কথাগুলোয় তোর জীবনের কিছু ঘটনা লুকিয়ে আছে?”
রায়াদের প্রশ্নে হকচকিয়ে যায় জুবায়ের। লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে । মনে মনে ভাবে, ‘তোর মতো বন্ধু পাওয়া সৌভাগ্য রায়াদ শাহনেওয়াজ। গলার স্বর শুনেই বুঝে ফেলিস মনের অবস্থা। অথচ কিছু মানুষকে বুক চিরে মনের অবস্থা দেখালেও মন বুঝবেনা। তারা ভীষণ কষ্টদায়ক মানুষ। ওরা তোর সামনে না আসুক। তোর যা রাগ! আমার কষ্টের কারণ জেনে মে”রে না বসিস। ওরা ভয়ানক মানুষ। আমার নিজেরই ভয় লাগে। এজন্য এতটা দূরে আমি। ওদের ছায়া-ও আর আমার জীবনে জড়ানো নতুন মানুষগুলোর উপর না পরুক।’ এদিকে জুবায়েরকে চুপ থাকতে রায়াদ ফের প্রশ্ন করলো,
“চুপ করে আছিস যে?”
“আরে না! কি সব বলিস? তুই হঠাৎ ভালোবাসা বিষয়ের জানতে উঠেপরে লাগলি? কারণ কি বল শুনি?”
জুবায়ের কথা কাটাতে জবাব-টা দেয়। রায়াদ দম ফেলে। চোখ বন্ধ করে বলে বসে,
“সেদিন রেস্টুরেন্ট থেকে ফেরার পর তুই তো বাসায় গেলি। আমরা সব বাসায় এসে বাসায় ঢোকার পথে রিয়ানা আমার থেকে এক হাত দূরত্বে পাশাপাশি-ই হাঁটছিলো। আয়াত রোজার সাথে গল্প করছিলো, বাবা আর মা তো নিজেদের মতো ব্যস্ত ছিলেন। রিয়ানা একমাত্র বেখেয়ালে সবার পিছনে হাঁটছিলো। চিন্তিত দেখাচ্ছিলো তাকে। হাঁটার ধরণ বেসামাল। যদি পরে যায়! এই ভয়ে পাশাপাশি-ই হাঁটছিলাম। তখনই আমার ভাবনা-কে সত্যি করে উনি পরতে ধরেছিলেন সিড়ি বেয়ে উঠার সময়। ধরে ফেলি। প্রশ্ন করি, ‘এই বয়সে এত কিসের টেনশন! এত চিন্তিত হয়ে হাঁটার দরকার কি? লাইফ-টাকে রঙিন ভাবে সাজানো উচিত। জবাবে সে নিজেকে সামলে বলেছিলো, ‘রঙিন খামে সবসময় রঙিন চিঠি-ই থাকেনা৷ ভালোবাসা নামক বিষ-টাও বিষাদ হয়ে রয়। হোক সেটা জীবন সঙ্গী জনিত ভালোবাসা বা পরিবারের মানুষের ভালোবাসা।’ আমি তো ভালোবাসা জিনিস-টাকে নিয়ে এতটা ভাবিনি। গত কয়েকদিন যাবত ভেবে যাচ্ছি। কিন্তু সঠিক ব্যখ্যা বুঝতে পারছি না। ভালোবাসা তবে এমনও হয়! যে রঙিন এক জীবনে বিষাদে ছেয়ে দেয়?”
জুবায়ের সব শুনে স্মিত হাসলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
“ঐ যে বললাম, ভালোবাসা ভয়ংকর সুন্দর। ভালোবাসা সব পারে সব। মানুষকে কাঠের পুতুল থেকে রঙিন ফানুষ! দু’টোয় বানাতে পারে।”
চলবে?
ভুলত্রুটি মার্জনীয়, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। এজন্য দেরি হলো। আসসালামু আলাইকুম।