#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ১৫
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
৩৩,
হাইওয়ের ওয়াক ওয়ে-র ধারঘেষে ডেইজি ফুলের সমারোহ। শীত নেমেই পরেছে প্রায়। কিছুদিন পর এদের দেখা পাওয়া যাবেনা। সেই বসন্তের অপেক্ষা। রিয়ানা উবু হয়ে দু’হাত মুঠো ভর্তি ফুল তুলে নিলো। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ সামনে নিয়ে ডায়েরী বের করলো। ডায়েরীর পাতায় ফুলগুলো রেখে আবারও ডায়েরী ব্যাগের ভেতর রাখলো। হাঁটতে হাঁটতে সেন্টারের কাছাকাছি এসে একটা কফির বারে ঢুকে পরলো। এক মগ কফি অর্ডার করে দুহাতে মাথা চেপে ধরলো। আজ বড্ড মাথা ব্যথা করছে তার। ইচ্ছে হচ্ছে বাসায় গিয়ে আরাম মতো একটু ঘুমাতে। কিন্তু বাসায় যেতে একটুও মন টানছেনা তার। সাজ্জাদের মুখোমুখি হতে তার একটুও ভালো লাগেনা। ছেলে-টা পাগলের ন্যায় তার মন জয় করার চেষ্টা করছে। অথচ তার একটুও আগ্রহ আসেনা সাজ্জাদের প্রতি। ছেলে-টাকে কষ্ট দিতেও কেমন একটা খারাপ লাগা কাজ করে রিয়ানার। মনে হয় একটু মন নরম করে সাজ্জাদের কথায় নিজেকে একটু বদলাতে। কিন্তু নিজ সত্তা! তাকে কি জবাব দেবে রিয়ানা! একটা মানুষের জন্য নিজের ব্যক্তিত্ব-ই বিসর্জন দিবে? যাকে সে ভালো-ই বাসে না। ভালোবাসলে না হয় অন্য কথা ছিলো। কিন্তু সাজ্জাদের প্রতি তার ভালোবাসার মতো কোনো অনুভূতি-ই অনুভব হয়না। সাজ্জাদ আশেপাশে থাকলে-ই উল্টে বিরক্তি লাগে তার। লোক-টা চলে যায় না কেন! ফোনের স্কিনে তারিখ দেখে নিলো রিয়ানা। সাজ্জাদের ভিসার মেয়াদ ফুরোতে আর ২০দিন বাকি। এরপর! এরপর তো তার মুক্তি। কিন্তু সাজ্জাদকে এই দিন ফেইস করবে কি করে? এমনিই সেদিনের কথার পর গোঁটা একমাস সাজ্জাদের মুখোমুখি হতে, সে কথা বলতে আসলে রিয়ানা ভেতর থেকে বিরক্তি ছাড়া কিছু-ই অনুভব করেনি। কারোর প্রতি অনুভূতি না আসলে! সে কি করবে? সাজ্জাদ যে কেনো বিষয়-টা বুঝতে চায় না! রিয়ানার মাথায় ঢোকেনা। রিয়ানার আকাশ-কুসুম চিন্তার মাঝেই ওয়েটার কফি নিয়ে আসতেই তার সামনে দুম করে কোথা থেকে জানি সাজ্জাদ এসে বসে পরলো। এরপর ওয়েটারের দিকে তাকিয়ে নিজের জন্যও এক মগ কফি অর্ডার দিলো। ওয়েটার চলে যেতেই সাজ্জাদ রিয়ানার দিকে দৃষ্টি মেললো। রিয়ানা কফির মগ হাতে তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাজ্জাদ ঠোঁটের কোণে চমৎকার ভাবে হাসির রেখা ফুঁটিয়ে বললো,
“কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। খেয়ে ফেলো।”
“কফি খাওয়া যায় না। এটা পানীয়, পান করা যায়।”
রিয়ানা বিরক্তিমাখা কণ্ঠে উচ্চারণ করলো। সাজ্জাদের হাসির রেখা প্রশস্ত হলো। বললো,
“সবদিকেই খেয়াল থাকে। শুধু আমার কথা তোমার মনে বেখেয়ালি ভাবে পরে রয়। একটুও খেয়াল করো না।”
“প্লিজ স্টপ। আমি আর সহ্য করতে পারিনা সাজ্জাদ ভাই।”
“একটা কথা কি জানো এটিটিউড কুইন? ”
রিয়ানা এক ভ্রু ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো। কফির মগে চুমুক দিয়ে বললো,
“কি কথা?”
“‘তুমি তোমার জীবদ্দশায় একবার আমার বৃক্ষের মত যত্ন নিলে, আমি আমার পুরো জীবদ্দশায় তোমার জন্য ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো। কখনও ছেড়ে যাবো না। কিন্তু তুমি আমায় ঝড়ে যাওয়া পাতার মতো ছুড়ে মারছো রোজ।”
রিয়ানা মৃদু হাসলো। সাজ্জাদের কথার জবাবে বললো,
“প্রেম করার চেয়ে,প্রেমে পড়ার মুহুর্তগুলো অনেক সুন্দর। এখন প্রেমে পরেছেন বলে, এত অনুভূতি কাজ করছে। প্রেম করতে ধরলে তখন শুধু বিরক্তিই আসবে আমার প্রতি। আমি মানুষ-টাই এমন।”
” তোমার মুখের হাসি হোক সবার জন্য! আর ভালোবাসা হোক প্রিয় আমার জন্য! আমায় একবার ভালোবাসো, প্রেম করতে বলছিনা। বিয়ে করে নিবো সোজা।”
“সহজে পাওয়া হোক সেটা জিনিস বা মানুষ! গুরুত্ব কমে যায়। পাওয়ার পর মনে হয়, পেয়েই তো গেলাম। গুরুত্ব দিলেও আমার। না দিলেও আমার।”
“কথাতেই যত্ন, কথাতেই বিচ্ছেদ রিয়ু। আমার থেকে কখনও গুরুত্বহীন কথা পেলে চলে এসো। বাধা দিবো না।”
“এরপর জমবে হাজারও স্মৃতি। আর কিছু তারিখ আমাদের আজীবন মনে থাকবে হয়তো বিরহে নয়তো ভালোবাসায়। আমি কোন-টায় ভুগবো তখন? ভালোবাসা নাকি বিরহ?”
৩৪,
রিয়ানার বলা কথার মাঝেই সাজ্জাদের কফি এসে যায়। সাজ্জাদ মুচকি হেসে কফির মগ হাতে নিয়ে বলে,
“আর তুমি আমায় যে অবহেলা করছো! আমি চলে গেলে তো এই তারিখগুলো আজীবন আমার মনে থাকবে।”
“ভুলে যাবেন। কিছু জিনিস মনে রাখতে নেই।”
“রাখতে হয়না। থেকে যায়।”
“কথা বাড়িয়ে কাজ নেই। বাসায় চলুন। জানিনা কি করে যেখানে যাই হাজির হয়ে যান।”
“ডাবল মাস্টার্সের জন্য সামার সিজনে এপ্লাই করবো। আমার থেকে পিছু ছুটাতে চাচ্ছো! আমি তোমার পিছু-ই পরে থাকবো। একদিন না একদিন তো ঠিকই আমার উপর মায়া দয়া হবে তোমার।”
“ভুল ধারণা, আমি পাথর। আমার মাঝে এসব অনুভূতি নেই।”
সাজ্জাদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রিয়ানার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“আমায় কি একটু ভালোবাসা যায় না রিয়ানা?”
“গেলে হয়তো ভালোবাসা জন্ম নিতো এতদিনে।”
“আমার অনুপস্থিতি একদিন ভীষণ করে পোড়াবে তোমায়। সেদিন তুমি চাইলেও আমায় তোমার সামনে পাবেনা। কথা বলার জন্য মনের মাঝে হাহাকার করবে! কিন্তু আমার ভয়েজ অব্দি শুনতে পাবে না তুমি।”
রিয়ানা একটু শব্দ করেই হাসলো। সাজ্জাদ আশাহত হলো। এই মেয়ের কোনো কিছুতেই কিছু যায় আসেনা। কেমন নিষ্ঠুরের মতো হাসছে! সাজ্জাদ উঠে দাড়ালো। কফির বিল পে করে বেরিয়ে পরলো। রিয়ানার টা সহ বিল পে করেছে দেখে রিয়ানা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পরলো। দ্রুতপদে এসে সাজ্জাদের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললো,
“যে ভালোবাসার জন্য আমায় নিজেকে বদলাতে হবে! সেই ভালোবাসা আমার চাইনা সাজ্জাদ ভাই।”
“তোমায় তো বদলাতে বলিনি। শুধু বাংলাদেশের সাথে মানানসই ড্রেস পরবে। আর তোমার বদ অভ্যাস গুলো বাদ পরবে বিডিতে গেলে। এই টুকুই। চেষ্টা করে যাচ্ছি রোজ তোমায় একটু নিজের মতো গড়ে তোলার! তুমি সুযোগ দিয়েও দূরেই রয়ে গেলে!”
সাজ্জাদ হাঁটার গতি কমিয়ে দিয়ে বললো কথাটা। রিয়ানা আলতো হেসে দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সেখানে কিছু সাদা গোলাপের গাছ। সেই দিকল তাকিয়ে-ই রিয়ানা বললো,
“ফুল দেখতে সুন্দর বলেই আমরা আকর্ষিত হই তার প্রতি। সে যদি তার ন্যাচার ছেড়ে অন্য কিছুতে পরিণত হয়! তার প্রতি আমাদের কি সেই আগের আগ্রহ থাকবে? তেমনই আমি মনে করি, আমি বদলালে আপনিও বদলে যাবেন। এখন রাগী, বদমেজাজি, বেপরোয়া, উচ্ছৃঙ্খল আমি-কে দেখে পছন্দ করেছিলেন। আমি পাল্টে গেলে আমার সেই নতুন রুপের সাথে আপনার এডজাস্ট করতে কষ্ট হবে। মনে হবে, এই মেয়েকে তো ভালোবাসিনি। আর মানুষ সুখের পাগল, কষ্ট পেলে কষ্টের কারণ-টাকেই উপরে ফেলে। আপনিও আমার প্রতি আগ্রহ হারাবেন।”
রিয়ানা কথা বাড়ালো না আর। হনহনিয়ে হেঁটে বাসার কাছাকাছি আসায় দরজায় দাড়িয়ে কলিং বেল বাঁজালো। আয়াত এসে দরজা খুলে দিতেই বাসায় ঢুকে পরলো। পেছনে পেছনে ঢুকলো সাজ্জাদ। সাজ্জাদের বিমূঢ় দৃষ্টি শুধু রিয়ানায় আবদ্ধ। আয়াত বিষয়-টা খেয়াল করেছে। সে দরজা আঁটকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সাজ্জাদকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“আমরা বেশিরভাগ সময় জীবনে একবার হলেও ভুল মানুষের প্রতি দুর্বল হয়ে পরি সাজ্জাদ ভাই। রিয়ানা আপনার সেই ভুল। মা মারা যাবার পর বড় হওয়ার পাশাপাশি যখন থেকে বুঝেছে বাবার ওর প্রতি ভালোবাসা নেই। অনুভূতি শূণ্য করেছে নিজেকে। আর আপনি সেই অনুভূতি শূণ্য মানুষের মনে জায়গা করতে উঠেপরে লাগলেন? দুনিয়ায় আর মেয়ে পাননি!”
সাজ্জাদ আয়াতের দিকে তাকালো। মলিন হেসে বললো,
“আমরা সবসময় হয়তো ভুল মানুষকেই ভালোবাসি আয়াত।”
এরপর পা বাড়ালো রুমের দিকে। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে সব কথা-ই কানে পরলো রিয়ানার। সে-ও লম্বা এক শ্বাস নিয়ে আনমনে বিরবির করে বললো,
“আজ কষ্ট পাচ্ছেন, একদিন এই ফিরিয়ে দিয়েছি বলে বাহবা দিবেন! বলবেন ভাগ্যিস ফিরিয়ে দিয়েছিলে রিয়ানা। নয়তো আমার ভালো থাকা হারিয়ে যেত।”
৩৪,
ডায়েরীর ভাজে সেই শুকনো ডেইজি ফুলগুলো এক হাতে নাড়াচাড়া করছে রিয়ানা। আজ অনেক মাস পর পুরোনো ডায়েরী নিয়ে বসেছে সে। তার যে রোজ ডায়েরী লেখার স্বভাব ছিলো! ভুলে বসেছিলো প্রায়। কিন্তু ডায়েরী-টা তার সবসময়ের সঙ্গী। যেখানেই যাক, সাথে থাকে। আজ ডায়েরী-টা খুলতেই সেই শুকনো ফুলগুলো নজরে পরায় পুরোনো কিছু কথা মনে পরে গেলো তার। বিছানায় বসে খাটের বোর্ডের সাথে বালিশ হেলান দিয়ে সে আধশোয়া হয়ে বসে ডায়েরীর শুকনো ফুলগুলোয় হাত বুলাচ্ছিলো, আর পুরোনো কথা ভাবছিলো। ডায়েরী-টা বন্ধ করে দিলো রিয়ানা৷ বালিশে মাথা এলিয়ে একহাতে তর্জনী ও বুড়ো আঙুলে কপাল চেঁপে ধরে পরপর কয়েক-টা লম্বা শ্বাস নিলো। ফোন-টা পরে আছে পাশেই। তা অন্য হাতে উঠিয়ে নেটে ঢুকলো। আবারও সাজ্জাদের আইডিতে ঢুকে স্ক্রল করতে করতে ভাবলো,
“আমার কথাগুলো কেমন একটা মিলে যাচ্ছে তাইনা সাজ্জাদ ভাই! শুধু আপনার মুখ থেকে শোনার অপেক্ষা। অদ্ভুত ভাবে আপনার কথাগুলোও মিলে গেলো। আপনাকে সরাসরি দেখার তৃষ্ণা, আপনার ভয়েজ শোনার তীব্র ইচ্ছে! রোজ মনের গহীনে দাফন হচ্ছে। ইশশ, যদি একবার দেখা হতো! মুচঁকি হেঁসে বলতাম, আমার কথা মিললো তো! কিন্তু আপনার কি জবাব আসবে! এই ভয়েই আর মুখোমুখি হওয়ার সাহস হয়না। আপনি ভালো আছেন! এই তো শান্তি।”
“রিয়ু আপু, এই রিয়ু আপু! কোথায় তুমি?”
রোজার গলার স্বরে হাঁক ডাক শুনে উঠে বসলো রিয়ানা। ধরফরিয়ে উঠে বসলো। ডায়েরী-টা বালিশের তলায় চাপা দিলো। রোজা রিয়ানার রুমে ঢুকতে ঢুকতে বিষয়-টা খেয়াল করলো। কিন্তু কিছু বললো না। রিয়ানা রোজাকে দেখে জিগাসা করলো,
“কোনো জরুরী বিষয় রোজা?”
“হ্যাঁ, আম্মু ডাকছে তোমায়। আয়াত আপুকেও। আপু তো রাতের খাবার বানাচ্ছিলো। তাই ফ্রেশ হতে গেছে। তুমিয়ো ঝটপট ফ্রেশ হয়ে একটু ড্রেস পাল্টে নাও প্লিজ! বাসায় বাবা আছে।”
রিয়ানা বিছানা থেকে নেমে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাড়ালো। পরনে শর্ট জিন্স আর লেডিস টিশার্ট। হানিফ সাহেব বাসায় নেই। দু মেয়েকে রেখে উনি গ্রামে গেছেন নিজের মৃত বাবা মায়ের জন্য এতিম বাচ্চাদের খাওয়াবেন বলে। আয়াত যেতে চাইলেও রিয়ার মন সায় দেয়নি। পরে আয়াতও আর যায়নি বোনকে রেখে। এজন্য রিয়ানা বাসায় নিজের ইচ্ছেমতো-ই ড্রেস পরে ঘুরে। জন্মদিনের পর মাঝখানে কেটে গেছে ৫টা দিন। সে বাসাতেই বন্দী। বের হয়না, আবার বাসাতেও কেউ আসেনা। এজন্য নিজের ইচ্ছে মতোই ড্রেস পরে। রিয়ানা আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের উপর হাত রেখে আনমনে বললো,
“কি করবো বলো তো রোজা! বড় হওয়ার পরপরই ওয়েস্টার্ন কালচার, ড্রেসআপ মিশে গেছে নিজ সত্তায়। কমফোর্ট ফিল-টা এসব ড্রেসে-ই সীমাবদ্ধ। এজন্য চাইলেও ইচ্ছে করেনা লং ড্রেস পরতে। তবুও মাঝে মাঝে পড়ি, কারণ এটা জার্মানি না, বাংলাদেশ। এখানে সাধারণ বাঙালি বাবা মা এত শর্ট ড্রেস এলাউ করবেনা এটাই স্বাভাবিক।”
রোজা মুচঁকি হাসলো রিয়ানার কথায়। মেয়ে-টা এতটাও অবুঝ নয় তবে। রিয়ানা ওয়ার্ডরোব থেকে একটা সুতির থ্রিপিস বের করে ওয়াশরুমে গিয়ে পরে নিলো। এরপর বেরিয়ে এসে চুলগুলো পাঞ্চ ক্লিপে আঁটকে নিয়ে রোজাকে বললো,
“চলো যাওয়া যাক!”
চলবে?
ভুলত্রুটি মার্জনীয়, আসসালামু আলাইকুম।