#রংধনুর_রঙ_কালো
২৬.
বাহিরে শীতল বাতাস। শীতকাল আসতে বেশি দেরি নেই। তবে মেলবোর্নের আবহাওয়ায় এখন বৃষ্টির প্রভাব বেশি। অরিন বারান্দার কোণ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিক এখন শব্দশূন্য। ইলহান ঘুমিয়ে পড়েছে বহুক্ষণ আগে। অরিন আজকে বারান্দাতেই শুয়েছে। তার ঘুম আসছে না। আগামীকাল একটা নতুন দিন শুরু হবে। বাবা-মা বাংলাদেশে ফিরে যাবেন। অরিনও এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। আর কোনোদিন আসা হবে না। ইলহান সোফিয়াকে বিয়ে করে নিবে। এর আগে ইলহানের সাথে তার ডিভোর্সটাও হয়ে যাবে। তারপর অরিন কোথায় যাবে? কি করবে? অন্বয়ের সাথে বাংলাদেশে ফিরে যাবে? মা-বাবা, ভাইয়া সবাই যখন জানবে অরিন ডিভোর্স নিয়েছে তখন তাদের রিয়েকশন কেমন হবে? কষ্ট পাবে? আচ্ছা সবাই কি ডিভোর্সের জন্য অরিনকেই অপরাধী মনে করবে? অপরাধটা কি শুধুই অরিনের? সে অবহেলিত জীবন নিয়ে বাঁচতে চায়নি। এটা তো কোনো অপরাধ নয়।এইযে সে এতোবার করে ডিভোর্সের কথা ইলহানকে বলেছে। কই, ইলহান তো একবারও বললো না,” চলো না অরিন, ডিভোর্সের চিন্তা আমরা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলি। আমাদের সম্পর্কটা তো শুধু কাগজে- কলমে সীমাবদ্ধ না। আমাদের তো চিরবন্ধনের সম্পর্ক, হৃদয়ের সম্পর্ক, আত্মিক সম্পর্ক! শুধু কাগজে একটা সাইন করেই কি তুমি নিজের হৃদয় থেকে আমার অস্তিত্ব মুছে ফেলতে পারবে? বললেই হলো? সবকিছু চুলোয় যাক, সমুদ্রে ভেসে যাক, শুধু আমরা আবার এক হয়ে যাই। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। তোমার বিশ্বাস ভেঙেছি, বার-বার মিথ্যে বলেছি, তোমাকে ঠকিয়েছি, কিন্তু এইবার তো বুঝতে পেরেছি! এখন শুধু ভালোবাসবো। আর কখনও ঠকাবো না। যদি ঠকাই, তাহলে তুমি নিজহাতে আমার শিরচ্ছেদ করবে৷ আমি কিচ্ছু বলবো না। আমাকে ক্ষমা করো অরিন। এ পৃথিবীতে অনেক নারী সংস্পর্শে গিয়েছি আমি। কিন্তু বিশ্বাস করো, তারা কেউই আমার শরীর ছাড়া অন্যকিছু ছুঁতে পারেনি। শুধু তুমি পেরেছো। আমার মনের মালিকানা দখল করে নিয়েছো। আমি শুধুই তোমাকে ভালোবেসেছি। সারাজীবন তাই বাসবো।”
অরিনের দুইচোখের কোণায় অশ্রুপাত ধেয়ে চললো। সে মুখে হাত দিয়ে নিঃশব্দে অনেকক্ষণ কাঁদলো। ইলহান তাকে এসব কিছুই বলেনি। এমনকি তার কাছে শেষবারের মতো ক্ষমাও চায়নি৷ নিজের ভুলের জন্য একবারও সরাসরি অনুতপ্ততা প্রকাশ করেনি। সোফিয়াকে বিয়ে করার ইচ্ছা ইলহানের ষোলআনা। হোক বাচ্চার জন্য, কিন্তু বিয়ে তো সে অন্য নারীকেই করতে যাচ্ছে। এমন দিন কোনো মেয়ের জীবনে না আসুক। জীবিত অবস্থায় নিজের স্বামীর অন্য নারীর সাথে বিয়ের দৃশ্য দেখার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। অরিনকে যেই যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে সেই যন্ত্রণা এ পৃথিবীতে যেনো আর কেউ না পায়।অরিন খোলা আকাশের দিকে দৃষ্টি মেললো। সকাল কখন আসবে? কিংবা আদৌ আসবে কি? এই ঘোর অন্ধকারের রাত ছাঁপিয়ে তার জীবন নতুন ভোর দেখবে কি? কালো রঙধনুর রঙের মেলা আবার রঙিন হয়ে ধরা দিবে কি?
এয়ারপোর্টে শায়িখ-নুসাইবাকে সিঅফ করতে অরিন-ইলহান একসাথেই এসেছে। একসাথে হয়তো এটাই তাদের শেষযাত্রা। অরিন এয়ারপোর্ট থেকে আর বাসায় যাবে না। সরাসরি চলে যাবে তার ভাড়াকৃত হোটেলে। এরপর ডিভোর্সের ঝামেলা মিটে গেলে সে বাংলাদেশে ফিরে যাবে। এই অভিশপ্ত দেশের মাটিতে আর কোনোদিন পা রাখবে না। কোনোদিন না! নুসাইবা অরিনের গালে হাত রেখে স্নেহভরা কণ্ঠে উপদেশ দিলেন,
” ভালো থাকিস মা। নিজের যত্ন নিবি। আর একদম ওই বাঁদরকে লাই দিবি না। ছেলেটা এইখানে এসে অনেক বিগড়ে গেছে। ওকে টাইট দিয়ে রাখবি। কোনো ঝামেলা করলেই আমার কাছে বিচার দিবি। নো কম্প্রোমাইজ। ”
অরিন সামান্য হাসলো। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। জীবনের সেরা কম্প্রোমাইজটা তো সে করেই ফেলেছে। একটু পরেই একটা খুব বিরক্তিকর কান্ড ঘটলো। ইলহানের মা-বাবা চলে যাচ্ছেন শুনে সোফিয়াও এয়ারপোর্টে এসে হাজির। তারপর সবার সামনে পা ধরে টানাটানি শুরু করলো। শায়িখ সাহেবের পা ধরে সে ছাড়তেই চাইছে না। শায়িখ সাহেব যথেষ্ট বিব্রত হলেন।
” আরে, এই মেয়ে। তোমার কি হয়েছে? পাঁয়ে ধরে রেখেছো কেনো?”
সোফিয়া অশ্রুসজল চোখে বললো,” আপনারা চলে যাচ্ছেন আন্টি-আঙ্কেল? আমার খুবই খারাপ লাগছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে৷ তাই ছুটে এসেছি আপনাদের দোয়া নিতে। আপনারা না থাকলেও আপনাদের দোয়া আমার সাথে থাকবে। অন্তত এই ভেবে আমি একটু খুশি হতে পারবো। আমাকে দোয়া করে দিন আঙ্কেল। অনেক দোয়া করে দিন।”
নুসাইবা এতোবেশি বিরক্ত হলেন যে সেই জায়গা থেকে তৎক্ষণাৎ সরে গেলেন। অরিনকেও ইশারায় ডাকলেন তাঁর সঙ্গে যাওয়ার জন্য। অরিন তার শ্বাশুড়িমায়ের সাথে গেল। নুসাইবা চেয়ারে বসে অরিনকে বললেন,” ঢং দেখেছো মেয়েটার? শোনো অরিন, এই মেয়েকে কিন্তু তুমি ইলহানের সাথে একটুও মিশতে দিবে না। এই মেয়ে চূড়ান্ত বিপজ্জনক। এইসব বিষয়ে তুমি অনেক বোকা। আমি খেয়াল করেছি। এই মেয়েটা প্রথমদিন থেকেই আমাকে আর তোমার বাবাকে পটানোর চেষ্টা করছে। ইলহানের সাথেও কেমন রসিয়ে রসিয়ে কথা বলে। গাঁয়ের উপর ঢলে পড়ে। ছি, ছি! এই অরিন, তুমি নিজের স্বামীকে হাতে রাখতে পারো না? এই ধরণের মেয়ের সাথে মিশতে দাও কেনো? আজকে বাসায় গিয়ে ইলহানের সাথে এ বিষয়ে অবশ্যই ঝগড়া করবে। ভালো করে ইলহানকে বুঝিয়ে দিবে ও যদি এই মেয়ের সাথে মিশে তাহলে তুমি আর ওর সাথে থাকবে না। এরকম ঝগড়া মাঝে মাঝে একটু করতে হয় বুঝেছো? এই ধরণের মেয়েরা হচ্ছে কালসাপ। মানুষের সংসার ভাঙার জন্য ফণা তুলে বসে থাকে। তাই সাবধান করে দিলাম তোমাকে। খবরদার! এই মেয়েকে কখনও বাসায় ঢুকিতে দিও না কিন্তু।”
অরিন নুসাইবার কথার কোনো সরাসরি জবাব দিল না। নিজের মনেই বলে গেল,” সংসার ভাঙতে আর কিছু বাকি নেই মা। আপনার ধারণা একদম সঠিক হয়েছে। সোফিয়ার জন্যই আমাদের সংসার ভেঙে গেছে। কিন্তু একহাতে কি তালি বাজে মা? সোফিয়ার তো একার কোনো দোষ নেই। আপনার ছেলেও যে সমানভাবে দোষী! আর তাকে শাসনে রাখার কথা বলছেন? সেই অধিকারটুকুও তো সে আমাকে কোনোদিন দেয়নি।”
সোফিয়ার সাথে তার পারসোনাল এসিসট্যান্ট টুয়ার্ড এসেছিল। অরিনের চিনতে অসুবিধা হয়নি। এটাই সেই ছেলে যাকে সোফিয়া বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল অরিনকে হত্যা করার জন্য। এই কথা যদি এখন ইলহানকে অরিন জানিয়ে দেয় তাহলে কি হবে সোফিয়ার? আসলে কিছুই হবে না। ইলহান তার বাচ্চার মাকে কখনও কিছু বলবে না!
সোফিয়া পেন্সিল হিল পড়ে এয়ারপোর্টে এসেছে। নিজের ইচ্ছামতো লাফ-ঝাপ করছে৷ কারণ শায়িখ সাহেব বাংলাদেশী পাঁচশো টাকার নোট সোফিয়ার হাতে তুলে দিয়েছেন। এইটা হলো দশমিনিট পাঁয়ে ধরে বসে থাকার পারিশ্রমিক। সোফিয়া জানে না এই নোটে কয় ডলার আছে। কিন্তু সে এমন ভাব করছে যেনো কোটি কোটি ডলারের নোট হাতে পেয়েছে। হয়তো অরিনকে জ্বালানোর জন্যই সে বার-বার টাকার নোটটা নিয়ে আশেপাশে ঘুরছে। কি অদ্ভুত মেয়ে! সে কি ভাবছে অরিন এই পাঁচশো টাকার জন্য সোফিয়াকে হিংসা করবে? যেখানে তার স্বামী সংসার সবকিছুই সে সোফিয়াকে দান করে দিয়েছে সেখানে একটা পাঁচশোটাকার নোট দেখিয়ে সোফিয়া তাকে লোভ লাগানোর চেষ্টা করছে? খুবই হাস্যকর ব্যাপার! সোফিয়া টুয়ার্ডকে নিয়ে এসেছিল শায়িখ-নুসাইবার সাথে এয়ারপোর্টে ফটোশ্যুট করার জন্য। এই ছবি তার ম্যাগাজিনে বের হবে। নুসাইবা ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতেই চাচ্ছেন না। সোফিয়া অনেক তোষামোদ করে রাজি করিয়েছে। টুয়ার্ড ছবি তোলার সময় ইলহান ফিসফিস করে বললো,” তোমার ম্যাডামের সমস্যা কি? সে কেনো লাফালাফি করতে এয়ারপোর্টে এসেছে? এই অবস্থায় ওর এতো হুড়োহুড়ি করা কি ঠিক হচ্ছে? মা-বাবা ফ্লাইটে উঠে গেলেই ওকে বাসায় নিয়ে যাবে।একদম বাসা থেকে বের হতে দিবে না। কোনো কেয়ার নেই মেয়েটার। শুধু দৌড়াদৌড়ি,লাফালাফি! আবার পড়েছে পেন্সিল হিল। হঠাৎ ঠাস করে পড়লেই তো সর্বনাশ!”
” আপনি এসব কি বলছেন স্যার? ম্যাম তো আজ সকালেই নয়শোবার স্কিপিং করেছেন। তখন কোনো সমস্যা হয়নি। এইটুকু লাফালাফিতে আর ম্যামের কি হবে?”
ইলহানের চক্ষু চড়কগাছ। ক্ষীপ্ত হয়ে বললো,” কি? প্রেগন্যান্ট অবস্থায় স্কিপিং? তাও নয়শোবার? আমি বুঝতে পারছি না তুমি পাগল নাকি তোমার ম্যাম পাগল?”
টুয়ার্ড ভ্রু কুচকে বললো,” স্যরি স্যার? কে প্রেগন্যান্ট? ম্যাম? স্যার আপনি কি জোক করছেন? ম্যাম কেনো প্রেগন্যান্ট হবেন? তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ এবং স্বাভাবিক!”
চলবে
– Sidratul Muntaz