#রংধনুতে_প্রেমের_বাড়ি
#পর্ব_৮
#ফারজানা_মুমু
থমকে দাঁড়াল ঝুমুরের পা। প্রশ্ন করল, আমাকে কেন বিয়ে করল চয়ন?
দরজার সামনে ঝুমুরকে দেখে দুজনেই অবাক হলো। চয়নের চোখে ভয়। অক্ষর কিছু মুহূর্ত নিরবতা পালন করে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, তোকে ভালোবাসে চয়ন। সবসময় হাসিখুশি রাখতে চায় সেজন্যই বিয়ে করেছে? ফিল্মের নায়িকাদের মত সিরিয়াস হচ্ছিস কেন?
চয়ন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। জীবনে প্রথম কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিকে তাকাল অক্ষরের পানে।
দাদাভাইয়ের কাছ থেকে উত্তর শোনে লজ্জা পেল ঝুমুর। বাটি বিছানার উপরে রেখে তাড়াহুড়োয় বলল, বাদাম এনেছি তোমরা খেয়ে নিও। আমি আসছি কাজ আছে।
ঝুমুর দ্রুত পা ফেলে রুম থেকে চলে গেল। চয়ন ঠোঁট ছেড়ে জোরে শ্বাস নিয়ে বলল, ধন্যবাদ স্যার।
-” তোমার ধন্যবাদ পাবার জন্য আমি মিথ্যা বলিনি চয়ন। ঝুমুরের মুখে হাসি ফোটানোর জন্যই বলেছি। আমরা সহজ-সরল বোনের সাথে তুমি যে খেলাটা খেলেছো তারজন্য আমি তোমায় কখনোই ক্ষমা করব না।
-” ভালোবাসাটা অন্যায় ছিল স্যার?
-” ভালোবাসা অন্যায় নয় কিন্তু তোমার উদ্দেশ্যটা ঠিক ছিল না।
গাল ফুলিয়ে দম নিলো চয়ন। গমগম গলায় বলল, আমার উদ্দেশ্য ঠিক না থাকলেও আমি অন্য কারো পরিবারে সমস্যা সৃষ্টি করি নাই। এখন আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আপনার বোনকে মন থেকেই আমি ভালোবাসি। শুরু থেকে জীবনের শেষ অব্দি বেসে যাব কিন্তু আপনি! আপনি যে আমার মায়ের সাথে আমার দূরত্ব সৃষ্টি করেছিলেন তা কী মিটবে?
-” তোমার মায়ের সাথে আমি তোমার দুরত্ব সৃষ্টি করিনি চয়ন বরং তুমি নিজেই দূরত্ব সৃষ্টি করেছ। বারবার মিথ্যা বলে ঠকিয়েছ। মানুষটির সম্মান নষ্ট করেছ, বিশ্বাস ভেঙেছ। উচুঁ মাথা নিচু করে দিয়েছ। তারপরেও বলছো তুমি অন্যায় করোনি? মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওনি তোমায় না খবর পাঠিয়ে আমায় পাঠাতো তখন তুমি কেন রাগ মনে পুষে রাখলে? পা ধরে ক্ষমা চেয়ে দেখতে মানুষটি তোমায় ক্ষমা করে কি-না। তবে হ্যাঁ আন্টি আমায় বলেছে, তোমার জন্য ওনার মনে রাগ ছিল না, ছিল অভিমান। মায়েরা সন্তানদের প্রতি রাগ করে থাকতে পারে না। কারণ মায়েরা চায় না সন্তান তাদের কষ্টে থাকুক, অভিশাপের মুখে জ্বলে পুড়ুক।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল অক্ষর। চয়ন মাথা নিচু করে রাখল। তারপর তাচ্ছিল্য ভরা কণ্ঠে বলল, আমার মায়ের প্রতি আপনার বেশ দরদ কিন্তু আপনার বাবার প্রতি আপনার দরদ নেই কেন? বড় ছেলে হিসেবে ওনার পাশে থাকা আপনার দায়িত্ত্ব কর্তব্যর মধ্য পরে না স্যার?
ঠোঁট চেপে হাসল অক্ষর। গভীর চোখ জোড়া চয়নের চোখের দিকে নিক্ষেপ করে বলল, তুমি বুঝবে না চয়ন। সময় হোক তখন নিজের চোখে না হয় দেখে নিবে।
***
পড়ায় মনযোগ দিতে পারছে না চৈতি। বারবার মনে হচ্ছে স্যার বুঝি এই খাতাটা দেখল। অক্ষর না হয়ে অন্য ছেলে যদি হতো তাহলে চয়ন আপত্তি করত না। কিন্তু অক্ষরকে নিয়ে ঘোর আপত্তি চয়নের। হয়তো বড় শ্যালক, বয়সের তুলনায় অনেক বড়। আপত্তি হবারই কথা কিন্তু প্রেম সে তো বেশ বেহায়া। ফোনটা হাতে নিয়ে অক্ষকের ফোনে ম্যাসেজ পাঠাল,
” ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে জলদি ছাদে আসুন।
-” প্রেম নিবেদন করবেন বুঝি? তাহলে আমায় আর যুদ্ধ করতে হচ্ছে না।
-” স্বপ্ন না দেখে তাড়াতাড়ি ছাদে আসুন। দরকার আছে।
-” পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করুন ম্যাম। আসছি।
রুম থেকে বের হয়ে সোজা ছাদে চলে গেল চৈতি। কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি সেকারণে স্যাতস্যাতে হয়ে আছে ছাদ। গাছের পাতা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একাকার। এখনও বাতাসের বেগ কমেনি। এলোমেলো চুলগুলো উড়িয়ে দিচ্ছে বারংবার। ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা টানার বৃথা চেষ্টা। কপাল কুঁচকে আকাশের দিকে তাকাল। কালো আকাশের বুকে কালো মেঘ। একটু পরেই নামবে রিনঝিনিয়ে সুর তুলে বৃষ্টি। বৃষ্টিতে সমস্যা না থাকলেও বজ্রপাতে ভীষন সমস্যা। ঝুমুর নিশ্চয় কিছুক্ষণের মধ্যে রুমে চলে আসবে। আজ সারারাত ঝুমুর থাকবে চৈতির সাথে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল সেদিনের রাতের কথা। লজ্জায় লাল হলো গাল। শান্তা থাকলে বলতো, চৈতি তোর গাল দুটো খুব সুন্দর লাগছে আয় টেনে দি। এক্ষুনি কিস করে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
আবারও লজ্জায় শিউরে উঠল চৈতি। ভাবলো অক্ষর এখন তাকে দেখে কী বলতো? ঠোঁটকাটা লোক সুবাদে নিশ্চয় শান্তার থেকেও এক কাঠি উপরের কথা বলবে। মনে-মনে ভাবনাগুলো তাকে ভীষন লজ্জা দিচ্ছে। জিভে কামড় দিয়ে বলল, ছি চৈতি, ঠোঁটকাটা লোকদের সাথে থাকতে থাকতে অসভ্য হয়ে যাচ্ছিস।
পিছন থেকে অক্ষরের কন্ঠস্বর ভেসে আসলো
-” কী ভেবে লজ্জা পাচ্ছেন ম্যাম? বিয়ের পরের রাতগুলোর কথা ভেবে?
দৃষ্টি নিচু করে উত্তর দিল চৈতি, বাজে কথা বন্ধ করেন। আমার লজ্জা লাগছে।
-” তাই বুঝি? এখন লজ্জাবতীকে দেখার জন্য জরুরি তলবে ডেকেছেন ম্যাম? আকাশের অবস্থা খুবই বাজে। সকালে দেখলে হবে না লজ্জাবতীকে?
আবারও লজ্জায় হিমশিম খেল চৈতি। মনেমনে মারাত্মক কিছু বাক্য ব্যয় করে উত্তর দিল, শান্তা আমাদের অনেক বড় বিপদে ফেলেছে।
-” আপনার ওই বান্ধবী তো বিপদের বড় বোন। উল্টাপাল্টা কাজ করা ছাড়া আর হবি নেই। বলুন কী বিপদে ফেলেছে?
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সব ঘটনা খুলে বলল চৈতি। কাহিনী শুনে চোখে মুখে উৎকন্ঠা প্রকাশ না করে স্বাভাবিক ভাবেই বলল, এখানে সমস্যা কোথায় খোঁজে পেলাম না।
চোখ দুটো বড় বড় করে বলল চৈতি, ভাইয়া জানলে কী হবে জানেন?
-” হ্যাঁ জানি তো খুশি হবে সে। এতদিন আমি তাকে ছোট বোনের জামাই হিসেবে প্যারা দিয়ে এসেছি এখন সেও আমায় ছোট বোনের হবু বর হিসেবে প্যারা দিবে। শোধবোধ।
কপালে চিন্তার ভাঁজ। আদলে রাগের পূর্ণ আভাস। মুখ ফুলিয়ে রক্তিম সুরে শুধাল, আপনার সাথে পরামর্শ করা আমার ভুল হয়েছে। বিপদ যেহেতু আমার রক্ষা সেহেতু নিজেকেই করতে হবে।
চৈতি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। অক্ষর শক্ত হাতে চেপে ধরল চৈতির হাত। একদম কাছে এসে এলোমেলো চুলগুলোকে স্পর্শ করে ঠোঁটে আঙ্গুল ঘুরিয়ে নেশাময় কণ্ঠে বলল, চিন্তা করবেন না। চয়ন কিছু জানতে পারবে না।
-” কীভাবে?
-” আমিই বুঝে নিবো। আপনি বরং চিন্তা মুক্ত থাকুন।
তারপর চৈতির চিবুকে স্পর্শ করে চোখে চোখ রেখে নেশালো সুরে আবারও বলল, তোমারে যে চাহিয়াছে ভুলে একদিন,
সে জানে তোমারে ভোলা কত যে কঠিন। “(কালেক্টেড)
*****
কান্তা মুখ ভার করে বসে আছে। পরীক্ষা শেষ হলো আজ কিন্তু আদলে নেই খুশির জোয়ার। কারণ বিয়ের কথা চলছে বাসায়। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, সম্পর্কে তার কাজিন । বিজয় কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে প্রশ্ন করল, আমার বাবা মাকে পাঠাব?
-” বাবা মেনে নিবে না হয়তো!
-” হয়তো বলে শব্দ হয় না কান্তা। ওনাদের একবার আমাদের সম্পর্কের কথা বলে দেখো। হতে পারে সম্মতি দিয়ে দিবেন তারা।
-” সত্যিই বলব?
-” হুম। শান্তা- জয়ের কথাও বলতে পারো। যমজ পাত্র, রাজি হবার সম্ভবনা রয়েছে।
-” আচ্ছা।
কথাগুলো বলে ফোন কাটল কান্তা। তারপর ভয়ে-ভয়ে বাবা মায়ের রুমে প্রবেশ করল। মেয়েকে রুমে আসতে দেখে মুমিন হোক প্রশ্ন ছুঁড়লেন, বলবে কিছু?
আশপাশ না ভেবেই বলে উঠল কান্তা,বাবা আমি একজনকে ভালোবাসি। বিয়ে আমি তাকেই করতে চাই।
মুমিন হোক অবাক হলেন। শান্তা যদি বলতো তাহলে হয়তো অবাক হতেন না কিন্তু বলেছে কান্তা। সহজ-সরল শান্ত মেয়েটি আজ ভালোবাসার কথা জানান দিচ্ছে। হজম হতে সময় লাগলো। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আবারও মেয়েকে প্রশ্ন করল, ছেলেটি কে?
-” ওর নাম বিজয়। নিজেদের ব্যাবসা আছে। বাবা মায়ের বড় ছেলে। তবে বিজয়ের যমজ ভাই আছে জয়, শান্তা জয়কে পছন্দ করে।
মুহূর্তেই বো’ম ফাটলো যেন। মুমিন হোক সময় নিয়ে হজম করে সহজ গলায় বললেন, তাহলে আমি তোমার ফুপিকে কী জবাব দিবো? বলব ইঞ্জিনিয়ার ছেলেকে ছেড়ে ব্যাবসায়ী ছেলে বেছে নিয়েছি? সম্পর্ক ভালো থাকবে?
চশমাটা ঠিক করে কঠিন কণ্ঠে বলে উঠল, সম্পর্ক ভালো থাকবে না কেন আব্বু? আমার নিজস্ব মতামত থাকতে পারে না? বিয়েটা তো পুতুলখেলা নয় যে আজ বিয়ে কাল চলে আসবো। সারাজীবনের ব্যাপার। তাছাড়া বিজয় ছাড়া স্বামী হিসেবে আমি অন্য কোনো ছেলেকে মানতে পারব না। তোমরা নিশ্চয় জোর করে আমায় বিয়ে দিবে না? আমায় অসুখী হতে তোমরা দেখতে পারবে?
মেয়ের এহেন বক্তব্য শোনে মুমিন হোক শান্ত গলায় বললেন, পরশু বিজয়ের পরিবারকে বলবে আসার জন্য। ভালো পরিবার, ভালো পাত্র যদি হয় তাহলে তোমাদের দুবোনকে একসাথে বিয়ে দিবো জয় ও বিজয়ের সঙ্গে। কথা দিলাম।
কান্তা অশ্রু নয়নে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। মুমিন হোক স্মিথ হেসে রুমে যেতে বললেন। শান্তা দরজার আড়ালে শুনলো সব। খুশিতে গদগদ হয়ে রুমের ভিতরে প্রবেশ করে বলল, আব্বু তুমি কত ভালো। দেখো আমাদের যত আত্মীয় স্বজন আছে সবাই চমকে যাবে। যমজ ভাই, যমজ বোন, ওয়াও কত্ত সুন্দর। তুমি একসাথে যমজ নাতি নাতনী পাবে। ব্যাপারটা সুন্দর না!
স্মিথ হাসিটা জোরালো হলো। মেয়েদের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর কণ্ঠে বললেন, তোমরা সুখী হলেই আমি খুশি । তোমরা দুজন ছাড়া আমাদের আর কেউ আছে? সবসময় হাসিখুশি থাক এই কামনা করি। আর শুনো বাবা মায়েরা সন্তানদের খুশি রাখার জন্য সবকিছু করতে পারে। জীবনের রক্ত পানি করে শুধু সন্তানদের খুশি রাখার জন্য।
*****
অফিস রুমে মুখোমুখি বসে আছে অক্ষর-চয়ন। অক্ষরের হাতে প্রমোশন লেটার। চয়ন গভীর চোখ দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে। এক আকাশ কষ্ট বুকের ভিতর জমা রেখে ম্লান হেসে বলল, অবশেষে আমি তাকে ছুঁতে পারলাম কিন্তু আফসোস আমার মা দেখে যেতে পারলো না।
-” এটার জন্যই তো আমার বোনকে বিয়ে করেছিলে চয়ন। কিন্তু তুমি হয়তো ভুলে গেছ আমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কাজ করিনা। আমার বোনকে বিয়ে করলেই প্রমোশন লেটার পেয়ে যাবে ভাবনাটা ভুল তোমার।
-” কিন্তু এখন আমি নিজের যোগ্যতায় লেটার পেয়েছি। ভুলে গেছেন?
-” ভুলিনি। তবে নিজের ভুলটা যদি আগে বুঝতে তাহলে আন্টির সাথে তোমার ভুল বুঝাবুঝি হতো না।
-” কথায় আছে “ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না” না বুঝে লোভের বশবর্তী হয়ে কাজটা আমার জীবনের সবচে বড় অভিশাপ।
চয়নের আফসোস মুখখানি দেখে কিছু বলল না অক্ষর। প্রমোশন লেটার হাতে ধরিয়ে অফিস থেকে বের হলো। চৈতি ফোন দিয়েছে দেখা করবে। এখনকার সময় শুধু প্রেয়সীর জন্য বরাদ্দ।
রাস্তায় পানি জমেছে। সারারাত আকাশের অঝোর কান্না বৃক্ষবটে ধুলোবালি পরিষ্কার করে দিয়েছে। টুপটুপ পানি পড়ছে সবুজ পাতা থেকে। সবুজ কাচের দেয়াল। সবুজ রঙ করা কাঠের বেঞ্চ। কাচের গায়ে বড় বড় অক্ষরে লিখা, “গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান”। জায়গাটা বাস স্টেশন। শুভ্র রঙের জামা পরিহিতা শুভ্র পরীকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বসে থাকতে দেখে বক্ষস্থলে শীতল হাওয়া বয়ে গেল। অক্ষর চৈতির সামনে দাঁড়িয়ে গভীর চোখে নেশা ছড়িয়ে মধুর কণ্ঠে বলল,
সে হিম রজনীর জ্যোৎস্না মাখা
সিক্ত শুভ্র ফুল,
সে নীল আকাশের গানের পাখি
বাদলা শীতল হাওয়ার দোল৷
##চলবে,
®ফারজানা মুমু
[