#রংধনুতে_প্রেমের_বাড়ি
২
কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে উত্তর দিল চৈতি, আপনি?
লোকটি তখনও আগের মত দাঁড়িয়ে থেকে চাঁদের উদ্দেশ্য বলল, চাঁদ মামুনি তুমি তোমার আম্মুর কাছে যাও তো,তোমার ফুপির সাথে কথা আছে।
চাঁদ মামুর কথায় এক দৌঁড়ে রুমের বাহিরে চলে গেল। চৈতালি এখনও হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে থেকে দেখছে সব। মাথার ঠিক কতখানি উপর দিয়ে যাচ্ছে ঘটনা বুঝে উঠতে পারছে না। লোকটি চৈতালির একদম সামনে এসে সোজাসুজি দাঁড়িয়ে হাত প্যান্টের পকেটে রেখে মুখটা খানিক নিচু করে ভ্রু-নাচিয়ে প্রশ্ন করল, হঠাৎ সারপ্রাইজ হজম হচ্ছে না বুঝি?
-” আপনি আমার বাসায়? চাঁদের মামা মানে!
-” ঝুমুরের বড় ভাই আমি। চয়নের বড় শ্যালক।
লোকটির সহজ বাক্য। কিন্তু চৈতালির হজম করতে ভীষন কষ্ট হচ্ছে। ঝুমুর সম্পর্কে তার বড় ভাইয়ের বউ। চয়ন এবং ঝুমুরের বিয়েটা হয়েছিল প্রেম করে সেজন্য চৈতালির মা বিয়েটা মানেনি। ঘর ছাড়া করেছিল চয়নকে। হঠাৎ একদিন সকালে চৈতালি মাকে ডাকতে গিয়ে দেখে মা এখনও ঘুমিয়ে। সকাল পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকার মহিলা নন চয়নের মা তাহলে আজ হঠাৎ! চৈতালির মনে তখন বাসা বাঁধে এক ঝাঁক ভয়। কাঁপা হাতে মায়ের শরীর স্পর্শ করতেই বুঝে যায় মা তাঁর আর নেই চলে গেছে না ফেরার দেশে। ঠান্ডা শরীরে উষ্ণতা খুঁজে না পেয়ে মেঝেতে লুটে পরে। জবুথবু মুখশ্রী, চোখ মুখে বিভৎস ভয় নিয়ে গগন বিদা’রী চিৎকার দিয়ে উঠে তাৎক্ষণিক। অতীত স্মৃতি মনে হতেই আবারও কণ্ঠে ভীড় জমালো দৃঢ় উৎকণ্ঠা বলল, আমার জানামতে ভাবির ভাই দু’জন। একজনকে আমি দেখেছি। আপনিই তাহলে সেই ঘাড়’ত্যারা, এক’রোখা, ব’জ’মে’জা’জি, ব’দ লোক?
নিজের সম্পর্কে সুন্দর সুন্দর উপাধি পেয়ে নাক মুখ কুঁচকে রাগী গ’লায় হুং’কার ছেড়ে লোকটি বলল, আমার নাম অক্ষর। আমি মোটেও ব’দ লোক নই।
অক্ষর নামটি কানে পৌঁছাতেই স্মরণে আসলো ঝুমুরের কথা। মায়ের মৃত্যুর পর চয়ন তাকে ঢাকা নিজের বাসায় নিয়ে আসে। যেহেতু ঝুমুর সম্পর্কে সে আগে থেকে অবগত নয়। ঝুমুরের কাছ থেকে শুনেছে তারা তিন ভাইবোন। বড় ভাই অক্ষর, তারপর ঝুমুর এবং ছোট ভাই সাক্ষর। সেদিন ভাইদের নাম শুনে হেসে কুটিকুটি চৈতালি। ঝুমুরের মা বাবা এবং সাক্ষর ব্যতীত আর কাউকে সে চিনে না জানে না। তবে অক্ষর সম্পর্কে ঝুমুরের কাছ থেকে শুনেছে লোকটা এক’গে’য়া’মি স্বভাবের। সব সময় নিজের মনমত চলাচল করে। কে কি বলল সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ তাঁর নেই। এক প্রকার রোবট। ব্যাস এটুকুই।
-” কোথায় হারিয়ে গেলেন?
চৈতালি গমগম গলায় অক্ষরের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিজেই প্রশ্ন করল, আপনি আমার বিয়ে কেন হতে দিবেন না? আমরা তো একে অপরকে চিনি না জানি না।
-” সমস্যা নেই চিনে যাব দু’জন দু’জনকে।” অক্ষরের নির্লিপ্ত উত্তর
তে’জস্বী কণ্ঠে চৈতালি বলল, ইয়ার্কি আমি পছন্দ করি না। আমাদের বয়সের পার্থক্য কিন্তু অনেক!
-” তো? আপনি কী জানেন পুরুষ মানুষের বয়স ধরা হয় না। কত আর হবে তেরো বা চৌদ্দ বছরের পার্থক্য। বেশি বয়সের পুরুষরা রোমান্টিক হয়। তাছাড়া তাদের মধ্য বুঝাপড়া ভালো থাকে।
অক্ষরের খামখেয়ালী কথায় বিরক্ত জমলো চৈতালির সফেদ মুখে। অক্ষরের সামনে দাঁড়ানোর বিন্দু পরিমাণ আগ্রহ তাঁর নেই। চরণ দুটি দরজার দিকে রাখতেই শান্ত গলায় অক্ষর বলল, আপনার বিয়ে কিন্তু আমার সাথেই হবে। মতে হোক কিংবা অমতে। বর সেজে আমিই দাঁড়াব আপনার সামনে।
“- আপনি কিন্তু এখন বেশী বেশী করছেন। আমি ভুলে যাব আপনি আমাদের আত্মীয়।
-” কী করবেন! চয়নকে বলে দিবেন? যান বলুন, চয়ন আপনার কথা বিশ্বাস করলেও ঝুমুর কী বিশ্বাস করবে? জীবনেও না। তারপর কি হবে? ঝুমুর এবং চয়নের সংসার ভেঙে যাবে। ফলে কে ভুগবে? চাঁদ! তখন কিন্তু চাঁদ আপনাকেই দায়ী করবে ওর বাবা মা থেকে আলাদা করার জন্য। সহ্য করতে পারবেন তো?
অক্ষরের সহজ-সরল হুমকি। চৈতালি তখন গভীর চিন্তায় ডুব দিল। বুঝল, অক্ষর গভীর জলের মাছ। রাগ দেখিয়ে তারসাথে পেরে উঠা যাবে না। বুদ্ধি দিয়ে লড়তে হবে। ভাইয়ের সংসার ভে’ঙে যাক এধরনের কাজ সে করবে না। চয়ন যেহেতু তাঁর ভাই সেজন্য তাঁর সব কথা মেনে নিবে কিন্তু ঝুমুর? ঝুমুর অবশ্যই অক্ষরের কথার বিপক্ষে যাবে না। সন্তপর্নে তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে মস্তিষ্কে চাপ দিল। আচমকা মুখে ফুটলো এক চিলতে হাসি। কণ্ঠে প্রখরতা বজার রেখে বলল, বিয়াইসাব। এবার জমবে খেলা। সাপ ম’রবে কিন্তু লাঠি ভাঙবে না। ভাই ভাবির সম্পর্ক ঠিক রেখেই ওদের সামনে আপনার মুখোশ বের করব। সময়ের অপেক্ষা শুধু…….!
মাথা ঝাঁকিয়ে হাসলো অক্ষর। ওষ্ঠজোড়া চেপে গা জ্বা’লানো হাসিতে বলল, বেয়াইন অযথা বাড়াবাড়ি করে লাভ নেই। চলুন বিয়ে করে ফেলি। আমার সাথে লাগতে এসে নিজেই না আবার আমার হৃদয়ের রংধনুর প্রেমের বাড়িতে আটকে পড়েন। তখন কিন্তু বের হওয়া ভীষন মুশ’কিল।
-” দেখা যাবে। আপনার মত বুড়ো লোকের প্রেমে চৈতালি পড়বে না। প্রেমিকের কী অভাব পড়েছে যে বুড়ো বিয়াইয়ের প্রেমে পড়ব। কপাল আমার এতও মন্দ নয়।
চৌতালি দ্রুত পা ফেলে রুম থেকে চলে গেল। অক্ষর তখন শান্ত হাসল। এই হাসিতেই রয়েছে একঝাঁক রহস্য।
***
কমলা রঙের ধরণীতে ঝুমঝুমিয়ে আঁধার নামলো। নভোমণ্ডলে্য বুকে ঠাঁই হলো অজস্র নক্ষত্র। সাঁইসাঁই করে বাতাস বইসে। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত এগারোটা বিশ। অক্ষর তখন ব্যাস্ত নিজ কাজে। কাজের বে’ঘা’ত ঘটল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা চয়নের শব্দে।
-” ভাইয়া আসবো?
চোখ থেকে চশমাটা ল্যাপটপের পাশে রেখে কণ্ঠ স্বাভাবিক রেখে অক্ষর বলল, আসো।
কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চয়ন। অক্ষরের চোখে চোখ রাখার সাহস তাঁর কোনো কালে ছিল না। তাঁরর পিছনে একটা কারণ আছে। অক্ষর জানে সে কারণ তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞাসা করল, বসো পাশে। এখন বলো কাজকর্মের কী খবর? ভালো চলছে তো!
অক্ষরের পাশে বসল। চটজলদি উত্তর দিল, আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া ভালো চলছে। আপনার এখানে থাকতে অসুবিধে হচ্ছে না তো?
মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিল অক্ষর। তারপর বলল, ঝুমুর তোমায় কিছু বলেছে? আমি এখানে কেন এসেছি জানো তো?
-” জি ভাইয়া। আপনার যতদিন ইচ্ছে থাকুন এখানে। আমাদের অসুবিধে নেই।
-” সত্যিই কী নেই?
হকচকিয়ে উঠল চয়ন। হাত পা তার রীতিমত কাঁপছে। অনুভব করছে এসি থাকা সত্ত্বেও সে ঘামছে। অক্ষর মনোযোগ সহকারে বোনের স্বামীর দিকে তাকাল। হেসে উঠল মন। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল, তুমি যেতে পার। ভয় পাবার কিছু নেই। আমি তোমার বউয়ের বড় ভাই তাই বলে এত ভয় পাবার কিছু নেই। আমি কী তোমায় দেখে ভয় পাচ্ছি? পাচ্ছি না। তুমিও পেয়েও না নিশ্চিন্তে ঘুম দাও। সকালে অফিসে যেতে হবে তাই তো?
চয়ন ঘাড় বাঁকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মনের গভীরে থাকা ভয় ভীতু খানিক কমিয়ে তিক্ততা বিধলো মুখশ্রীতে। যেন কিছু একটা নিয়ে সে ভীষন চিন্তিত। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও অক্ষরকে থাকতে বলল বাসায়। ঝুমুরকে যদি বলা হয় সে অক্ষরের থাকাকে পছন্দ করছে না তাহলে শুনতে হবে একঝাঁক বকা। শুরু হবে কান্নাকাটি। তাছাড়া অক্ষর যদি জানতে পারে এই বিষয়ে তাহলে তো হলো। এক আকাশ চিন্তা নিয়ে রুমের উদ্দেশ্য হাঁটা ছিল চয়ন। শান্তির খোঁজ তো সেই কবেই হারিয়ে গেছে।
চয়ন চলে যাবার পর দরজা বন্ধ করে বিছানায় এক পাশে বসল অক্ষর। তৃপ্তিময় হাসি ফুটিয়ে ল্যাপটপে নিক্ষেপ করল গভীর শান্ত চোখজোড়া।
-” আপনি কী এখন জেগে আছেন? বেয়াইনসাব!
চৈতালি উদ্বেগ অন্তরিন্দ্রিয় আচমকা শব্দে খানিক বিরক্ত হলো। কন্ঠস্বর ভেসে উঠল ‘চ’ কারান্ত শব্দ। মুঠোফোন হাতে নিয়ে পরিচিত বিপসঙ্কুল লোকটির বার্তা পরিদর্শন করে ছুঁড়ে মারলো বিছানার উপর। সাথে সাথে আরেকটি বার্তার টুং টুং শব্দে মুঠোফোন হাতে নিয়ে দেখল অক্ষর লিখেছে,
-” চাই না সুন্দরী প্রিয়া, চাই না আমি নায়িকা ঐশরিয়া, চাই আমি আপনার মত এক্সপার্ট একটি বুয়া। রাজি হবেন না বেয়াইন!”
রা’গে ক্ষো’ভে ফুঁ’সে উঠল চৈতালি। ফোনটা হাতে নিয়ে ম্যাসেজ পাঠাল, আপনার এই ম্যাসেজ এক্ষুনি ভাবিকে দেখাচ্ছি। ভাবির মুখে আপনার সম্পর্কে যা শুনেছি সবিই মিথ্যা। আপনি একটা গি’রিংগি’বা’জ।
ম্যাসেজ পাঠানোর সাথে সাথেই আরেকটি ম্যাসেজ, আমি কাঁচা খেলোয়াড় নই ম্যাম। আপনার মাথায় বুদ্ধি খুব কম। ছোট বেলায় ডিম, দুধ পছন্দ করতেন না বুঝাই যাচ্ছে। যাইহোক ঘুমিয়ে পড়ুন। আমাকে শা’য়েস্তা করার উপায় সকালে খোঁজার চেষ্টা করবেন। না ঘুমিয়ে থাকলে চোখের নিচে কালি পড়বে, মায়াবী মুখের মায়া কমতে থাকবে, শরীর দূর্বল হবে। এখন আপনার দূর্বল হওয়া চলবে না। শুভ রাত্রি।
চৈতালি গরম চোখে দেখল ম্যাসেজ কিন্তু উত্তর দিলো না। ফোনটা বিছানার এক কোণে রেখে ডুব দিল ঘুমের অচিন রাজ্য। আপাতত অক্ষর নিয়ে সে ভাববে না। তাকে সুস্থ থাকতে হবে। মস্তিষ্ক রাখতে হবে স্বচ্ছ।
***
আকাশের বুক থেকে রাতের আঁধার নিঃশেষ হয়ে ফুটলো আলোকরশ্মি। ভোর বেলায় সূর্যের উদয়ের সময়ে মৃদু সূর্যালোক ছড়িয়ে পরিবেশে। চৈতালি প্রতিদিন ভোর বেলায় ছাদে আসে শান্ত, কোলাহলহীন পরিবেশে নিঃশ্বাস নিতে। মন খারাপের অসুখটা সাথে সাথে হারিয়ে যায় অচিন দেশে। চোখ বন্ধ করে দ্রুত গতিতে নিঃশ্বাস নিচ্ছে ঠিক তখনি অক্ষর তার পিছনে দাঁড়িয়ে বলে, আসুন দুজন মিলে একসাথে নিঃশ্বাস ত্যাগ করি।
চৈতালি চোখে-মুখে তিক্ততা ফুটিয়ে প্রশ্ন করল, সত্যি করে বলুন তো আপনি চাইছেন কী? ম’ত’ল’ব আপনার সুবিধার নয়।
চৈতালির কানে ফিসফিস করে অক্ষর বলল, আমার সন্তানদের জননী বানাতে চাচ্ছি আপনাকে। ম’ত’ল’ব কিন্তু ওতটাও খারাপ নয়।
##চলবে,
®ফারজানা মুমু