রংধনুতে প্রেমের বাড়ি পর্ব ১৫

0
501

#রংধনুতে_প্রেমের_বাড়ি
#পর্ব_১৫
#ফারজানা_মুমু

পুরো বাড়ি আলোয় ঝলমলে। মরিচ বাতিগুলো জ্বলছে নিমছে। দখিনা বাতাসের গতি মৃদু। আকাশে গোলাকার চাঁদ। চাঁদের আলো ছড়িয়ে আছে কালো আকাশের বিশাল বুকে। ফুটেছে শতশত নক্ষত্র। একঝাঁক নক্ষত্রের একজন ভাই যেন চাঁদ আগলে ধরে রেখেছে। চৈতি অক্ষরের কথা মত উত্তর দিকটায় চলে আসে। পুরো বাড়িতে লাইটিং থাকলেও এদিকটায় আলো নেই। অন্ধকারের মাঝে চাঁদের আলোক রশ্মি। চৈতি সামনে এগুলো। ক্ষীণ গলায় বলল, আপনি কোথায়?

অক্ষরের সাড়াশব্দ নেই। ঝোপঝাড়ে একা দাঁড়িয়ে চৈতি। এখন ভয় হচ্ছে ভীষন। ভয়ার্ত কন্ঠে আবারও বলল, আমি ভয় পাচ্ছি অক্ষর সাহেব।

শীতল ঠান্ডা স্পর্শ কাঁধে পড়ল। চৈতি বেদিশা হয়ে পিছন ঘুরে অক্ষরকে দেখে ভয়ে জড়িয়ে ধরল শুনতে পেল হৃদয়ের দড়াম-দড়াম শব্দ। অক্ষরের কণ্ঠে মাদকতা ছড়িয়ে পড়েছে। বলল, আমি থাকতে আপনি ভয় কেন পাচ্ছেন চৈতি?

মাথা উঠাল চৈতি। শুরু হলো হৃদদেশের উথাল-পাথাল ঢেউ। সাগরের বুকে নীরব রাতের ঢেউয়ের কলকল ছন্দ শুনতে পেল আবারও। ভীতু গলায় বলল, আপনি খুবই নি’ষ্ঠুর। কথা দিয়ে কথা রাখেন না।

অক্ষর বলল, আমি অনেক খারাপ চৈতি। কথা দিয়ে কথা রাখতে পারি না। ভাবছি জব ছেড়ে বউয়ের আঁচল ধরে সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়াব। বউয়ের ভাই তো পুলিশ অফিসার সমস্যা নাই বলব মাস শেষে হাত খরচ পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। অফারটা দারুণ না?
-” আপনি আবারও মজা করছেন আমার সাথে? আমি বলেছি কী জব ছেড়ে দিন?
-” জব না ছাড়লে যে আমি আপনার সময় দিতে পারবো না ম্যাম।
-” তাই বলে একটুও না?

চৈতির কণ্ঠে তীব্র অভিমান। অক্ষর অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, একটু অবশ্য পারব ম্যাম। এখন বলুন আমায় কী নতুন বরের মত লাগছে?

অক্ষরের কথায় চৈতি মনোযোগ দিয়ে দেখল। চাঁদের আলোয় অক্ষরের গায়ে হলুদ পাঞ্জাবী ও গোল্ডেন কটি ঝলঝল করছে। মৃদু বাতাসে স্পাইক করা চুল উড়ছে। জোড়া ভ্রু,তির্যক গম্ভীর দুচোখ, সুন্দর ওষ্ঠ, চিবুকে গর্ত,চাপ দাঁড়ি ছোট ছোট করে ছাঁটাই করা।

চৈতি চোখ না নামিয়েই বলল,
-” আপনাকে আজ আমার দেখা প্রথম সুন্দর পুরুষ মনে হচ্ছে। আমি এর আগে কখনোই আপনার মত সুন্দর পুরুষ দেখিনি। আমার চোখে একমাত্র সুন্দর ব্যক্তিগত মানুষটি আপনি।

চৈতিকে এক হাতে নিজের বুকে জড়িয়ে মাথার চুলে চুমু এঁকে বলল, কারণ আমি তোমার স্বামী। তাই জন্য তুমি সুন্দর পুরুষ আগে দেখনি। একজন নারীর কাছে প্রেমময় সুন্দর পুরুষ তার স্বামীই হয়। বাবা হয় আদর্শ পুরুষ। ভাই হয় দায়িত্ববান পুরুষ।

অক্ষরের পরশ চোখ বুজে অনুভব করল চৈতি তারপর স্মিথ হেসে বলল, আমায় কেমন দেখাচ্ছে বললেন না তো?

কিছু সময় নিয়ে অক্ষর বলল, সন্ধ্যার ঘনিয়ে আসা আলোর মাঝে এক বিন্দু রশ্মি, শতশত নক্ষত্রের মাঝে একটি মাত্র চাঁদ, ফুটন্ত গোলাপের মত সুন্দর,পবিত্র আমার চৈতি। আপনাকে প্রতি মুহূর্তে দেখেই মনে হয় আমি আপনার প্রেমে প্রতিদিন পড়ি। প্রতি সেকেন্ডে আপনাকে নতুন করে ভালোবাসি। আমার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকুন সারাজীবন চৈতি, যদি হারিয়ে যাই অন্যকারো মাঝে আমি আপনায় ভাগ হতে দেখতে পারবো না।

শেষের কথাগুলো বলার সময় অক্ষরের গলা ধরে আসল। অজান্তেই কেঁপে উঠল চৈতি। অক্ষরের মুখে হাত দিয়ে বলল, আমায় একা রাখার চিন্তা ভুলেও আনবেন না। ভালোবেসে বিয়ে করেছি একশো বছর সংসার করার জন্য। বৃদ্ধ বয়সে দুজন দুজনার শক্তি হওয়ার জন্য। সংসার করার আগেই আমায় ধোঁকা দিতে চাচ্ছেন? আমি কিন্তু কষ্ট পাচ্ছি অক্ষর। প্লিজ আমায় কষ্ট দিবেন না।

অপরাধী কণ্ঠে বলল অক্ষর, সরি আর বলব না প্লিজ কষ্ট পাবেন না। আপনার কষ্ট আমার হৃদয়ে তী’রের মত বিঁ’ধে।

সময় চলল দুজনা। দুঃখ কষ্টকে বিদায় জানিয়ে অক্ষর শুকনো বকুল ফুলের মালা চৈতির হাতে দিয়ে বলল, কলেজে যাওয়ার সময় রাস্তায় পড়ে গেছিল আমি সযত্নে নিজের বক্ষে রেখেছি এতদিন। আজ আপনার জিনিস আপনার হাতে তুলে দিতে পেরে আমি মুক্তি পেলাম।

বকুল ফুলের মালার দিকে তাকিয়ে রইল চৈতি অনেকক্ষণ। সময়টা তখন সে ইন্টার প্রথম বর্ষে নতুন ভর্তি হয়েছিল। চৈতি সবসময় হেঁটে যাওয়া আসা করতো। গ্রামের শর্টকার্ট রাস্তায় দিয়ে কলেজে যাবার পথে দেখল ধানের জমির পাশেই বকুল গাছে ফুল ধরেছে। কলেজে না গিয়ে পলিথিনে করে অনেকগুলো ফুল কুড়িয়ে আনে। সেদিন কলেজে না যাওয়ার জন্য মায়ের হাতে বে’ধা’রা’ম মা’র খেতে হয়েছিল। রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে মায়ের রুম থেকে সুঁই সুতা এনে গেঁথে ফেলে সুন্দর একটি মালা। তারপরের দিন সকালে কলেজে যাবার পথে শখ করে মালা হাতে পেঁচিয়ে বের হয়। ক্লাস করার সময় হঠাৎ দেখতে পায় হাতে মালা নেই। সেদিন চারটে ক্লাস করে কলেজ ফাঁকি দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য যাত্রা দেয়। পুরো রাস্তা খোঁজে খোঁজে যখন মালার দেখা পায়না আশাহত হয়ে বাড়ি ফিরে। আজ অক্ষরের হাতে মালা দেখে প্রশ্ন করে,
-” তারমানে আপনি পেয়েছিলেন আমার মালা?

অক্ষর মাথা দুলিয়ে বলে, আপনাকে দেখতে গিয়েছিলাম। বট গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখলাম আপনি চলে যাচ্ছেন কিন্তু হঠাৎ আপনার হাত থেকে কিছু একটা পরে। আপনি চলে যাবার পর আমি কুড়িয়ে আনি। জানেন সারারাত আমি মালাটা বুকে রেখে ঘুমিয়ে ছিলাম। মনে হচ্ছিল আপনি আমার পাশে আছেন।
-” তাহলে মালাটা আপনার কাছেই থাকুক। আমি যেদিন সম্পর্ণভাবে আপনার হব সেদিন নাহয় মালাটা আমায় দিন। মালা ছাড়া থাকতে আপনার কষ্ট হবে।

অক্ষর নিষেধ করল না। সত্যি বলতে বকুল ফুলের মালাটা সাথে নিয়ে ঘুমানো অভ্যাস হয়ে গেছে তার। পাঞ্জাবির পকেটে মালাটা রেখে বলল, চলুন বাসার ভিতরে যাওয়া যাক। অনুষ্ঠান কিন্তু শেষ হওয়ার পথে।

চৈতি সম্মতি দিল। আজ সে ভীষন খুশী। আনন্দে আত্মহারা প্রায়। মন পাখিটা ছলাৎ-ছলাৎ নিত্য করতে ব্যাস্ত। হঠাৎ এত খুশির কারণ শুধুই অক্ষর। তাঁর ব্যাক্তিগত মানুষ।

হলুদের পোগ্রাম শেষ হতে চলল। অক্ষর চৈতির দু’গালে যত্ন সহকারে হলুদ লাগিয়ে বিদায় নিল। শান্তা-কান্তার হাতে মেহেদি দেওয়া হয়েছে। দুজন আজ খুবই খুশি। কয়েক ঘন্টা পর ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাবে বলে।

রাতের আঁধার ফুরিয়ে আলোর দেখা মিলল। অলস ঘুমকে বিদায় জানিয়ে ফ্রেশ হতে চলল চৈতি। ঘুমিয়েছে কয়েক ঘন্টা পূর্বে। বিয়ে বাড়ি বলে কথা ঘুম হয় কি সহজে। শরীরকে টেনে হিচড়ে বিছানা থেকে নামানোর জন্য কম যুদ্ধ করতে হয়নি তার। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল শান্তা-কান্তা এখনও ঘুমে বিভোর।
-” এই যে বিয়ের কনেরা উঠুন তাড়াতাড়ি। আর কত ঘুমাবেন? বর পক্ষরা চলে এসেছে প্রায়!

চৈতির কথা শোনে হকচকিয়ে উঠে কান্তা। শান্তাকে টেনে হিচড়ে ঘুম থেকে তুলে। বিরক্তি নিয়ে শান্তা বলে, দেখ আজকেই শুধু ঘুমাতে পারব বিয়ের পর জয় বলেছে ঘুমুতে দিবে না সো নো ডিস্টার্ব।

শান্তার লাগামহীন কথায় কান্তা-চৈতি হেসে দিল। আবারও টেনে তুলে শান্তাকে উদ্দেশ্য করে চৈতি বলল, তুই ভালো হবি না কোনোদিন? কিসব উলটা পালটা কথা বলছিস? বিয়ের আগেই যদি এমন কথা বলিস তাহলে বিয়ের পর কী বলবি আগেই বুঝা যাচ্ছে। লজ্জা তো একটু রাখ।

দুহাতে দুজনের কাঁধে হাত রাখল শান্তা। মুখে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে বলল, তোদের বলব না তো কাদের বলব বল তো? তোরা তো কিছুই শিখিয়ে পড়িয়ে দিলি না যাও নিজে নিজে একটু-আধটু শিখেছি তাও সমস্যা? বিয়ের পর জামাই বলবে আনরোমান্টিক বউ বিয়ে করে আনছি। তখন আমার সাথে শুরু হবে ঝগড়া। তখন যদি আমার সংসার ভেঙে যায় তোদের জামাই দিবি আমায় বল? দিবি না। তাহলে এখন উপদেশ না দিয়ে শিখে রাখ বিয়ের পর কাজে আসবে।

কথাগুলো বলেই ফিক করে হেসে দিল শান্তা। কান্তা ও চৈতি যোগ দিল। অনেকটা সময় নিয়ে মজা মশকারি করল তিনজন। তারপর চল ফ্রেশ হতে। একটু পরেই পার্লারে যেতে হবে। পার্লার থেকে সোজা কমিনিউটি সেন্টার।

চৈতি আজ লেহেঙ্গা পড়েছে ইচ্ছে ছিল লাল কয়েরী বেনারসি শাড়ি পরতে কিন্তু লজ্জায় পড়ল না। বিয়ে বাড়ীতে মানুষের গিজগিজ সেখানে বউ সেজে থাকার মানেই হয় না। সিম্পল সাজলো আজ। ভারী সাজ তার পছন্দ নয়। শান্তা-কান্তা অনেক আগেই চলে গেছে কমিনিউটি সেন্টারে। চৈতি যায়নি। অক্ষর বলেছে সে নিয়ে যাবে। সুন্দর পরিপাটি সেজে অপেক্ষা করছে অক্ষরের জন্য। অক্ষর আসল। দেখেই বুঝা যাচ্ছে ডিউটি শেষ করে এসেছে। চৈতি হতাশ কণ্ঠে প্রশ্ন করল, আজ না ছুটি নিয়েছেন?
-” আমার আর ছুটি! আচ্ছা এসব কথা বাদ দিন চলুন যাওয়া যাক।

চৈতি অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আমায় কেমন লাগছে বললেন না তো?

শান্ত চোখে তাকাল অক্ষর। শ্যামলা মুখশ্রী এলোমেলো। ঠোঁটজোড়া কাঁপছে দ্রুত। বলতে গিয়েও থেমে যাচ্ছে গলদেশ। চৈতি এক পলক পর্যবেক্ষক করে প্রশ্ন করল, আপনি ঠিক আছেন তো?

গলার স্বর নামিয়ে অক্ষর বলল, আমার কী হবে? আমি ঠিক আছি। চলুন তাড়াতাড়ি!
-” আমায় কেমন দেখাচ্ছে বললেন না কেন?

শান্ত কণ্ঠে বলল, সুন্দর।

হতাশ হলো চৈতি। অক্ষরের কাছ থেকে সুন্দর বাক্য প্রশংসা সে শুনতে চায়নি। তটস্থ করল মনকে। শক্ত সুরে বলল, শুধুই সুন্দর আর কিছু নয়?

জোরালো কণ্ঠে বলল অক্ষর, সময় বেশি নেই চৈতি। আপনার ভাই চলে আসতে পারে। তাড়াতাড়ি উঠুন।

অক্ষরের কথা শুনে চৈতি অবাক হলো। তাড়াতাড়ি বাইকের পিছনে বসতেই কেউ একজন খপ করে তার হাত চেপে ধরলো। কণ্ঠে তেজ রেখে বলল, খবরদার চৈতি তুই ভুলেও এই লোকটার সাথে মিশবি না। অক্ষর স্যার একজন খু’নী।

শেষ বাক্য বলার পরপরেই বিদ্যুৎ চমকালো চৈতির ছোট্ট মনে। বিস্ময় নিয়ে বলল, কী বলছ ভাইয়া? অক্ষর খু’নী হতেই পারে না। ওনি ভীষন ভালো একজন মানুষ।

তাচ্ছিল্য হাসি দিল চয়ন। অক্ষরের চোখে এই প্রথম চোখ তুলে তাকাল। বলল, স্যার আপনি খু’নী নন?

অক্ষরের দৃষ্টি দূরে। চোখে-মুখে উৎকন্ঠা। তেজী মুখশ্রী শান্ত করার বৃথা চেষ্টা। সামাল দিল রাগের তেজ বলল, রাস্তায় কথা বলা ঠিক হচ্ছে না চয়ন। তাছাড়া আমরা বিয়েতে যাচ্ছি অযথা সময় নষ্ট করতে দিও না।

চয়ন কম যায় না। তেজ নিয়ে বলল, আমার বোন কোথায় যাবে না, সে এখন বাসায় যাবে। আপনার সাথে আমি আমার বোনকে ছাড়বো না স্যার।

রাগী দৃষ্টিতে তাকাল অক্ষর। চয়ন প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও দম ছাড়েনি। চৈতি দুজনের রে’ষা’রে’ষি দেখে দমে গেল। ক্ষীণ গলায় বলল, বাসায় গিয়ে কথা হোক। আমি জানি অক্ষর খু’ন করতে পারে না।
-” তোর অক্ষরকে জিজ্ঞাসা করে দেখ সে খু’ন করেনি?

চৈতি অশ্রু চোখে তাকাল। অক্ষর চোখ সরিয়ে চয়নের উদ্দেশে বলল, তুমি আমায় বারণ করতে পারো না চয়ন। আমি আমার বিয়ে করা বউকে যেখানে খুশি সেখানে নিয়ে যাব। আমার সেই অধিকার আছে। তুমি কিছুই করতে পারবে না। বিয়ের ডকুমেন্ট চাইলে দেখাতে পারি।

হতবিহুল হলো চয়ন। বিস্ময় নিয়ে বলল, বিয়ে মানে?

##চলবে
®ফারজানা মুমু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here