#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৪৬
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
অকস্মাৎ দু’ভাই বিভ্রান্তিতে পড়ে গেছে। সবচেয়ে করুণ অবস্থা আহিলের। আহনাফ তার দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। সকাল ঠোঁট টিপে হাসছে।
আহনাফ গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করল,’তুই এমন করলি কেন?’
আহিল ফাঁকা ঢোক গিলে বলল,’না মানে, কেন জানি মুখ থেকে বের হয়ে গেল।’
‘এমনি? এমনি?’
‘না। আসলে তুমি হঠাৎ ভয় পেলে তাই আমিও ভয় পেয়ে গেছি।’
কথাটা যুক্তির মধ্যে পড়ল কিনা আহনাফ তা নিয়ে বিশেষ ঘাঁটাল না। বলল,’কোথায় যাচ্ছিলি যা।’
এরপর সে অর্ষার দিকে তাকিয়ে বলে,’এভাবে হুটহাট কোত্থেকে সামনে এসে পড়ো বুঝিনা! কবে জানি হার্ট-অ্যাটাক হয়ে যায়।’
অর্ষাকে পাশ কাটিয়ে আহনাফ রুমে চলে গেল। আহিলও আর সময় নষ্ট করেনি। দ্রুত লম্বা পা ফেলে নিজের রুমে চলে গেছে।
অর্ষা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সকালকে বলল,’চলো।’
সকাল মনে মনে হাসলেও সামনে প্রকাশ করল না। মুখে বলল,’চলেন।’
ইফতারির সময় সকলে একত্রে বসেছে। টেবিলে বসেনি। ফ্লোরে বসেছে। ছেলেরা সবাই এক সাইডে আর মেয়েরা সবাই এক সাইডে। এই সময়টিতে সকাল চুপচাপ থেকেছে। কোনো রকম দুষ্টুমি করেনি। আহিলকে জ্বালাতনও করেনি। মোট কথা বাড়ির কাউকে বুঝতেই দেয়নি কিছু। ইফতারের পর ছেলেরা মসজিদে চলে যায় নামাজ পড়ার জন্য। মেয়েরা সবাই বাসায়ই নামাজ পড়ে নিয়েছে। কুসুম বিশ্রাম করার জন্য আফরিনের রুমে শুয়েছে। সকাল, তিয়াস আর অর্ষা আছে অর্ষার রুমে। লামিয়া, জুঁই আর রেশমি ছাদে গেছে একটু হাঁটাহাঁটি করতে।
সকাল তিয়াসকে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল আর তিয়াসও খিলখিল করে হাসছিল। অর্ষা কাৎ হয়ে শুয়ে আছে। শরীরটা ক্লান্ত লাগছে খুব।
তিয়াসকে চুমু দিয়ে সকাল জিজ্ঞেস করল,’আপনার বাকি বান্ধবীরা কোথায় আপু?’
‘ছাদে গেছে।’
‘এই সময়ে ছাদে?’
‘ওদের ইচ্ছের কোনো ঠিক-ঠিকানা আছে নাকি!’
‘আর সবাই কোথায়?’
অর্ষা সরু চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,’আর সবাই কোথায় জানতে চাচ্ছ নাকি আহিল কোথায় সেটা জানতে চাচ্ছ?’
সকাল ধরা খেয়ে যায়। চোখ-মুখের অস্বাভাবিক অবস্থা। মুখে কোনো ‘রা’ নেই। অর্ষা উঠে বসে বলল,’আমি বুঝি সব।’
‘না মানে, তেমন কিছু নয় আপু।’
‘আহিলকে তুমি পছন্দ করো তাই তো? খুব বেশি ভুল যদি না হই, তাহলে তুমিই সে যার সাথে রেশমিকে নিজের গার্লফ্রেন্ড সাজিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।’
‘তার মানে আপনি আমায় চিনতেন?’
‘না। তবে জানতাম সব। তুমিই যে সেই মেয়ে সেটা বুঝেছি তোমার হাভভাব দেখে। কিন্তু অবাক লাগছে এটা ভেবে যে, রেশমি কিংবা আহিল কেউই বিষয়টা আমায় জানায়নি।’
‘ভাবিকে আমিই বারণ করেছিলাম। আহিলের কথা কিছু জানি না।’
‘তুমি খুব সুন্দর সকাল। স্মার্ট। তবে ছোটো। অনেক চঞ্চলও। তোমার বয়সটাই এখন চঞ্চলতার। কিন্তু একটা অজানা কথা কি জানো? আহিল কিন্তু বেশ শান্ত স্বভাবের। নরম মনের। ও’কে জ্বালাতন করে কখনো ওর মন পাবে না।’
‘তাহলে কী করব আপু?’ করুণস্বরে বলল সকাল।
‘আপাতত নরমাল কথাবার্তা বলবে। স্বাভাবিক একটা সম্পর্ক রাখবে। তুমিও ও’কে বোঝার জন্য সময় নাও। এখনো অনেক সময় আছে। ধৈর্যহারা হয়ো না। আহিল যা অপছন্দ করে, এমন কিছুও কোরো না।’
সকাল মুচকি হেসে বলল,’ঠিক আছে আপু। আপনি যা বলেছেন আমি তাই শুনব। এখন তাহলে ভাবির কাছে যাই?’
‘যাও।’
সকাল তিয়াসকে আদর করে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। দরজার কাছে যেতেই পেছন থেকে অর্ষা বলে,’বাই দ্য ওয়ে, আহিলের পাশে কিন্তু তোমাকে বেশ লাগে।’
কথাটি শুনে অর্ষার দিকে ঘুরে দাঁড়ায় সকাল। লজ্জামাখা হাসি দিয়ে আবার দৌঁড়ে চলে যায়। সকাল যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই আহনাফ আসে। সোজা শুয়ে পড়ে সে। ক্লান্তস্বরে বলে,
‘আর ভালো লাগে না!’
তিয়াস ছিল অর্ষার বামপাশে। ডানপাশে এসে আহনাফ শুয়েছে। মাঝখানে রয়েছে অর্ষা। তিয়াস অর্ষার পেটের ওপর উঠে উঁকি দিয়ে তাকায় আহনাফের দিকে।
আহনাফও ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। হেসে হেসে জিজ্ঞেস করে,’কেমন আছো আঙ্কেল?’
তিয়াস মিষ্টি করে হেসে বলে,’আন্তেল, আন্তেল।’
আহনাফ ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,’আন্তেল আবার কী?’
‘আরে আঙ্কেল ডেকেছে।’ বলল অর্ষা।
আহনাফ তিয়াসকে নিজের কাছে এনে পেটের ওপর বসাল। দু’হাত ধরে বলল,’আন্তেল কী ব্যাটা? বাবা বলো।’
মাঝখানে ফোঁড়ন কাটে অর্ষা। ‘বাবা ডাকবে কেন?’
‘ফুপিকে মা ডাকতে পারলে ফুপাকে বাবা ডাকতে পারবে না কেন? আমি দেখেছি, তুমি প্রায়ই তিয়াসকে বলো মা ডাকতে।’
অর্ষা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। আহনাফ মিথ্যে বলেনি। সত্যিই সে তিয়াসকে মা ডাকতে শেখাত। তবে কখনো এইটুকু বিষয় নিয়েও যে তাকে লজ্জায় পড়তে হবে কল্পনাও করেনি।
‘অর্ষা?’
সংবিৎ ফিরে পেয়ে অর্ষা বলল,’হু?’
‘আমার ওপর কি রেগে আছো তুমি?’
তিয়াস চকোলেট খাচ্ছে মাঝখানে বসে। আহনাফ মসজিদ থেকে ফেরার সময় নিয়ে এসেছিল। চকোলেটের খোসা ছাড়িয়ে দিতে দিতে অর্ষা বলল,
‘না। রাগ করব কেন?’
‘তাহলে কি অভিমান?’
‘কোনোটাই না।’
‘মিথ্যে বলছ।’
‘আমি?’
‘তুমিও মিথ্যে বলছ। তোমার চোখও মিথ্যে বলছে।’
‘এমন কিছুই নয়।’
‘কী কারণে রাগ-অভিমান সেগুলো মনের ভেতর জমিয়ে না রেখে আমায় বলো। তাহলে নিজেকে হালকা লাগবে। আমাদের মাঝখানে থাকা ভুল বুঝাবুঝিগুলোও দূর হবে।’
‘রাগ-অভিমান নেই তো।’
‘কিন্তু তোমার চোখ যে বলছে, আমার ওপর তোমার এক আকাশ সমান অভিমান রয়েছে।’
‘কীসব যে বলছেন!’
‘ভুল বলছি না আমি। তুমি কি আমার কথাগুলো বুঝতে পারছ।’
অর্ষা মাথা নত করে বসে আছে। আহনাফ শোয়া থেকে উঠে বসেছে। অর্ষার নতজানু করে রাখা মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,’আমি সম্পর্কটাকে ঠিক করতে চাইছি অর্ষা।’
অর্ষা নিরুত্তর। আহনাফ বলল,’অভিমানে কি আমায় ফিরিয়ে দেবে?’
অর্ষার বুক ভারী হয়ে ওঠে। চাপা অভিমানগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। চোখ ভরে ওঠে জলে। নাকের পাটা ফুলছে। ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। এখনই যেন চোখের পানিতে বন্যা বইবে।
আহনাফ আতঙ্কিতস্বরে বলল,’একি! কাঁদছ কেন তুমি?’
অর্ষা দু’হাতে চোখের পানি মুছে মাথা নাড়াল। বোঝাতে চাইল সে কাঁদছে না। অথবা কাঁদতে চাইছে না। আহনাফ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
‘প্লিজ আমি স্যরি সব কিছুর জন্য।তুমি কান্না থামাও।’
আদর, আহ্লাদে অর্ষার কান্না থামল তো না-ই, উল্টো আরো বেড়ে গেল। এক হাতে টেনে কাছে নিয়ে এল আহনাফ। আলতো করে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘সময় আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দেয় অর্ষা। সময়ের যাঁতাকলে পড়ে আমরা অনেক খারাপ ব্যবহার, অন্যায়ও করে ফেলি। হয়তো আমিও এমন অনেক কিছুই করেছি। ভুল তো মানুষ মাত্রই করে। আমি যদি সম্পর্কটিকে একটা সুযোগ এবার সত্যিই দেই, তাহলে তুমি আমায় ফিরিয়ে দেবে না তো?’
অর্ষা ফোঁপাচ্ছে। বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে রয়েছে। যার সাথে মৃত্যু পর্যন্ত থাকতেও প্রস্তুত তাকে সে ফিরিয়ে দেবে কীভাবে?
‘চুপ করেই থাকবে? তবে তোমার নিরবতাকেই কিন্তু সম্মতির লক্ষণ হিসেবে ধরে নিলাম।’
অর্ষা তবুও নিরব রইল। নিরবতার উত্তর তো সে দিয়েই দিয়েছে। সবকিছু মুখ ফুটে বলতে হয়?
দু’হাতে অর্ষার মাথাটা তুলে ধরে আহনাফ। এক হাত মাথায় রেখে অন্য হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দিচ্ছে। এরপর আবারো জড়িয়ে ধরেছে। এবার আর আলতো করে নয়। বেশ শক্ত করেই জড়িয়ে ধরেছে।
সেই সময়ে পাশ থেকে তিয়াস অর্ষার হাত টেনে ধরে বলে,’ফুপি, হাগু দেবো।’
অর্ষা নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। আহনাফ হতবিহ্বল। সে বিড়বিড় করে বলল,’বাচ্চাটার হাগু আসারও আর সময় পেল না?’
ওর রিয়াকশন দেখে অর্ষা হেসে ফেলে। তিয়াসকে নিয়ে ওয়াশরুমে যায়। আহনাফ কাঁদোকাঁদো মুখ করে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়ায়। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আমি কি সত্যিই আহনাফ? সত্যিই কথাগুলো অর্ষাকে বলেছি? হায় আল্লাহ্! বিশ্বাসই তো হচ্ছে না। নাকি রোজায় ধরেছিল? ইশ! স্বভাব মনে হয় পাল্টে গেছে।’
সেই মুহূর্তে আহনাফের প্রতিবিম্ব যেন বলে উঠল,’শুধু স্বভাব না। তুই নিজেও পাল্টে গেছিস।’
আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলে,’আমারও তাই মনে হয়। বললাম তো বললাম এমন সময়ই যখন কিনা একটু সুন্দর মুহূর্ত শুরু হচ্ছিল! আর ঐ সময়ই তিয়াসটা! উফ!’
রাতে ঘুমানোর সময়ও আহনাফকে একই রকম পাগলামি করতে দেখা গেল। মাঝখানে কোলবালিশ রেখেছে। সে রাগী রাগী চেহারা বানিয়ে বলল,
‘তোমার ভাতিজাকে রাখতে পারলে ভালো হতো। তাহলে এই কোলবালিশটার আর প্রয়োজন হতো না।’
‘আপনি কি এজন্য রেগে আছেন?’
‘না, না রাগ করব কেন? পটি কি আর সময়-অসময় হিসেব করে আসে নাকি।’
‘তাহলে এমন কেন করছেন বুঝতে পারছি না।’
‘এখন বুঝতে হবে না। সময় হলেই বুঝবে। ধৈর্য ধরো। ধৈর্যের ফল মিষ্টি হয় জানো না?’
‘আমি আবার অধৈর্য হলাম কখন? শুয়ে পড়ুন। আমি লাইট নিভিয়ে দিচ্ছি।’
অর্ষা লাইট নিভিয়ে এসে নিজেও শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে থেকে বলল,’একটা কথা বলি?’
‘হু।’
‘আপনি হঠাৎ করে এতটা পরিবর্তন কেন?’
আহনাফের রাগ বেশি। জেদ বেশি। মেজাজ খারাপ হতে সময় লাগে না। এবারও তাই হলো। অর্ষার এমন কথা শুনে মেজাজ চটে গেল তার।
‘এভাবে কেন বলছ? আমার পরিবর্তন কি তোমার পছন্দ হচ্ছে না? একটা মানুষ কি সবসময়ই এক রকম থাকে?’
‘আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? আমি তো এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম।’
‘এজন্য বারবার? যাই হোক, ঘুমাও।’
আহনাফ অন্যপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। অর্ষা গোপনে দীর্ঘশ্বাস নেয়। মানুষটা যে কেন এমন! আজকেও তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার সময়ে আহনাফেরই আগে ঘুম ভেঙেছে। আহনাফ অর্ষাকে উঠিয়ে নিজে ওজু করতে চলে যায়। নামাজ পড়া, সেহরি সবকিছু কেমন যেন গম্ভীর হয়েই শেষ করল। ঘুমানোর সময়ও তেমন কথা বলল না। দিনে আহিলকে নিয়ে অফিসে গেল। দুটো দিন আহনাফ এভাবেই পার করল। তার এমন ব্যবহারে অর্ষা রীতিমতো বিরক্ত হয়ে গেছে। সবসময় একপাক্ষিকভাবে শুধু সে-ই রাগ দেখাবে?
রাতে নামাজ পড়ে আহনাফ মাত্র বাড়িতে ফিরেছে। ঘরে আসার আগে রেণুকে বলেছে এক কাপ চা দিয়ে যেতে। রেণুর বদলে চা নিয়ে এসেছে অর্ষা।
আহনাফ গম্ভীর হয়ে থাকলেও অর্ষার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করে। স্বাভাবিকভাবেই কথাবার্তা বলে। যেন কিছুই হয়নি। অন্যদিকে আহনাফের এড়িয়ে চলাটা অর্ষার সহ্য হচ্ছে না। কষ্ট হয়। খারাপ লাগে। সেও চেষ্টা করে নরমাল থাকার। নরমাল ব্যবহার করার। কিন্তু সবার পক্ষে তো আর সবকিছু সম্ভব হয়ে ওঠে না। অর্ষাও ঠিক এরকম ব্যতীক্রম।
আহনাফ চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিল। জিজ্ঞেস করল,’নামাজ পড়েছ?’
অর্ষা ছোটো করে বলল,’হুম।’
‘তাহলে আর জেগে আছো কেন? ঘুমিয়ে পড়ো।’
‘একটা কথা বলতাম।’
‘বলো।’
‘ভাইয়ার কাছে যাব কাল। কয়দিন থাকব।’
‘কোনো দরকার?’
‘ইচ্ছে হয়েছে।’
‘আচ্ছা।’
আহনাফ বাধা দিল না। তার মানে অর্ষার যাওয়া হচ্ছে। সে মূলত দুটো কারণে যেতে চাচ্ছে। প্রথমত ভাইয়ের সাথে আগে কেয়ার সম্পর্কে কথা বলতে হবে। বোঝাতে হবে। আর দ্বিতীয়ত সে আহনাফের থেকে একটু দূরে থাকতে চাচ্ছে। মনকে নিজের আয়ত্তে আনার জন্য কিছু সময়ের জন্য চোখের আড়াল হওয়া প্রয়োজন। সে ঘুমুতে যাওয়ার পূর্বে রুহুল আমিনকে ফোন করে তার যাওয়ার কথা বলে দিয়েছে।
পরেরদিন অর্ষাকে বাড়িতে রেখে এলেন জহির চৌধুরী। ফিরে আসার সময় বারবার করে বলেছেন,’বেশি দিন কিন্তু থাকা যাবে না। জলদি বাড়ি ফিরে আসতে হবে।’
অর্ষা মৃদু হেসে সায় দিয়েছে। বাড়িতে পৌঁছিয়ে আহনাফকেও ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে। এরপর সারাটা দিন আহনাফের ফোনের অপেক্ষা করেছে। কুসুমের সঙ্গে হাতে হাতে কাজ করলেও তার মনটা পড়ে ছিল ফোনের ওপর। কখন ফোনটা বেজে উঠবে আর কখন সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটি ফোন করবে। সন্ধ্যায় ইফতারের পর আহিলের ফোন এলো।
অর্ষা ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলল,’কী অবস্থা? কেমন আছিস?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো। তুই কেমন আছিস? ইফতার করেছিস?’
‘আমিও আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। ইফতারও করেছি। তোরা সবাই ইফতার করেছিস?’
‘হ্যাঁ। কী করছিস এখন?’
‘কিছুই না রে। তিয়াসকে নিয়ে বসে আছি। তোর প্রেম কেমন চলছে?’
‘কীসের প্রেম? আমি প্রেম করি নাকি?’
‘সকালের সাথে তাহলে কী চলে হু?’
‘আরে ধুর! পাগল একটা মেয়ে। বাচ্চা তো, বুঝে না কিছু।’
‘তোর চেয়ে বেশিই বোঝে। এমনিতে তো মেয়ে ভালো। তাহলে সমস্যা কী?’
‘ভালো লাগে না এসব। প্যারা লাগে।রিলেশন একটা করেই শিক্ষা হয়ে গেছে।’
অর্ষা শব্দ করে হেসে বলে,’সবাই কি আর এক রকম হয় নাকি? তাছাড়া এখন অনেক কিছুই বদলে গেছে। সকালের সাথে তোর কথা হয়?’
‘না। প্রথম রোজায় রাতে ফোন দিয়েছিল। আমি কথা বলিনি। কেটে দিছি। নাম্বার মনে হয় রেশমি দিছে।বে’য়া’দ’ব’টার জন্য আমি ফেঁসে গেছি!’
‘কথা বলিস। একটু কথা বললে তো আর সমস্যা নেই। ও তোকে আর জ্বালাবে না।’
‘তুই কী করে জানলি?’
‘কথা হয়েছিল ওর সাথে। ও স্বাভাবিক কন্টাক্ট রাখতে চাইলে তুইও রাখ। নয়তো জ্বালাবে আর তুইও জ্বলবি।’
আহিলও এবার হেসে বলে,’আচ্ছা বলব।’
‘একটা সত্যি কথা বলবি?’
‘কী?’
‘সকালকে তোর মন থেকে কেমন লাগে? মিথ্যে বলবি না কিন্তু।’
আহিল কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল,’খারাপ না। ভালোই।’
অর্ষার ফোনে তখন আহনাফের কল আসে। ওয়েটিং পেয়ে কল কেটে দিয়েছে ইতিমধ্যে।
অর্ষা আহিলকে বলল,’তোর ভাই ফোন দিছে।’
‘আচ্ছা কথা বল। আমি একটু গেম খেলি।’
‘ওকে।’
ফোন রেখে সে আহনাফকে কল করে। আহনাফ কল কেটে দিয়ে ব্যাক করল। সরাসরি জিজ্ঞেস করল,’কেমন আছো?’
অর্ষা অবাক হয়। সে ভেবেছিল, আহনাফ আগে জানতে চাইবে কার সাথে সে কথা বলছিল। কিন্তু সে এটা কথা বলার মাঝখানে একবারও জিজ্ঞেস করল না। দুজনের মধ্যে কথাও হলো ফরমাল। কী করো, খেয়েছ,বাড়ির সবাই কেমন আছে এই টাইপ। এতে অর্ষার অভিমান যেন তরতর করে আরো বাড়তে থাকে।
_______
রোজার মাস বলে রুহুল অফিস থেকে আগে আগেই বাড়িতে ফেরে। তিনটায় ছুটি। অর্ষা অপেক্ষা করছিল ভাইয়ের জন্য। দু’দিন ধরে কেয়ার কথা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু সাহসেই কুলাচ্ছে না। কুসুমও চায় অর্ষা বলুক। রুহুলকে রাজি করাক। আপন বোন তো! ভালোবাসা বা টান একটু হলেও তো আছে। বিকেলে রুহুল বাড়িতে ফিরল তো ঠিকই। তবে ভীষণ ব্যস্ত দেখাল তাকে।
অর্ষা আর কুসুমের উদ্দেশ্যে তাড়া দিয়ে বলল,’দুজনে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।’
অর্ষা বলল,’হঠাৎ? কোথাও যাবে?’
‘আর বলিস না। আমার এক বন্ধুর নাকি আজ বিবাহবার্ষিকী। বাড়িতে ছোটোখাটো আয়োজন করেছে। আমরা কাছের বন্ধু যারা আছি সবাইকে নাকি যেতেই হবে। এত করে বলল, না গেলেও এখন যাচ্ছে তাই একটা অবস্থা হয়ে যাবে। হাতের অবস্থাও খুব ভালো নয়! কী যে করি! একেবারে খালি হাতে কি যাওয়া যায় বল?’
শেষ কথাটা একটু মিনমিন করে চিন্তিত হয়েই বলল রুহুল। অর্ষা ঘরে গিয়ে ব্যাগ থেকে নিজের জমানো টাকা নিয়ে এলো। প্রায়ই আহনাফ, আহিল, আমেনা বেগম, জহির চৌধুরী ও’কে টাকা দেন কিছু কিনে খাওয়ার জন্য। ওর বারণ কেউ কখনো শোনেও না। অর্ষার কখনো একা বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না, কিছু কেনারও প্রয়োজন হয় না। বাড়িতে কাউকে বললেই তারা এনে দেয়। তাই টাকাগুলোও অক্ষত অবস্থাতেই থাকে।
সাড়ে চার হাজার টাকা রুহুলের হাতে দিয়ে বলল,’খালি হাতে যাওয়ার দরকার নেই। যাওয়ার সময় কিছু কিনে নিয়ে যেও।’
রুহুল খুশি হয়ে অর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। টাকাগুলো নিয়ে বলল,’যা এবার রেডি হয়ে নে।’
‘আমি যাব না ভাইয়া। তোমরা যাও। রোজা রেখে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।’
‘আমরা রাতে ফিরব না আজ। তুই একা থাকবি নাকি?’
‘তাতে কী হয়েছে? দরকার হলে পাশের বাসার টুম্পাকে এনে আমার সাথে রাখব।’
‘না, না তুইও চল।’
রুহুল অনেক জোড়াজুড়ি করার পরও অর্ষা যেতে রাজি হইল না। অগত্যা রুহুলকেও হার মানতে হইল। যাওয়ার আগে টুম্পার মাকে বলে গেছে, টুম্পাকে যেন আজ অর্ষার সাথে থাকতে দেয়। অর্ষার মনটা একটু খারাপই হলো। আজও কেয়ার বিষয়টা ভাইয়াকে জানানো হলো না।
একার জন্য আজ আর ইফতার বানাল না অর্ষা। আজানের একটু আগ দিয়েই বাটিভরতি ইফতার নিয়ে টুম্পা বাসায় এসে পড়ে। মেয়েটা ছোটমোটো। ক্লাস এইটে পড়ে এবার। অর্ষার দারুণ ভক্ত।
টুম্পা রুমে যেতে যেতে বলল,’তুমি তো বাসায় যাবে না। তাই মা ইফতার পাঠিয়ে দিয়েছে।’
‘এগুলো আনার কী দরকার ছিল? ঘরে তো ফলমূল, রান্না করা খাবারও ছিল।’
‘দরকার ছিল-ই। তুমি আর আমি একসাথে ইফতার করব। দাঁড়াও, আমি ওজু করে আসি আগে।’
দুজনে একসাথে ইফতার করে। একসাথে নামাজ পড়ে। আহনাফ প্রতিদিন শুধু নিয়ম করে একবার ফোন দেয়। খোঁজ-খবর নিয়ে আবার রেখে দেয়। আজ এখনো ফোন করেনি। কখন করবে কে জানে। অর্ষা আর টুম্পা শুয়ে শুয়ে গল্প করছিল। দুজনের গল্প করতে করতে ফের এশার নামাজেরও সময় হয়ে যায়। টুম্পা শুধু এশার আর বিতরের নামাজ পড়ে শুয়ে পড়ে। অর্ষা তারাবীর নামাজ পড়ছে। বাইরে তখন প্রচণ্ড বাতাস বইছিল। ঝড় হবে বোধ হয়। টুম্পা উঠে গিয়ে সব জানালাগুলো ভালো করে বন্ধ করে, দরজাও ভেতর থেকে লাগিয়ে দিল।
.
মাঝরাস্তায় যে আহনাফকে বৃষ্টির কবলে পড়তে হবে তা কে জানত। অবশ্য সে এতে রাগ করল না। রহমতের বৃষ্টি। মন প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। সে গাড়ি থামিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে হাত বাড়ায়। বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে মনে মনে আল্লাহ্-কে বলে,’সব ঠিক করে দিও আল্লাহ্। মনে একটু প্রশান্তি দাও।’
অর্ষা এই বাড়িতে আসার পর থেকে বুকটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। রাগ, জেদ কোনোটাই নিজের আয়ত্তাধীন রাখতে পারেনি। তাই তো সবকিছু তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে অর্ষাকে এক পলক দেখার জন্য ছুটে চলে এসেছে।
গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতর যেতে যেতেই অনেকটা ভিজে গেছে আহনাফ। হাত দিয়ে শার্টে লেগে থাকা পানি ঝেড়ে, চুলগুলোও হাতের সাহায্যে ঝেড়ে নেয়। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে দরজায় নক করে। কয়েক সেকেণ্ড বাদেই দরজা খুলে দেয় টুম্পা।
আহনাফ টুম্পাকে চেনে না। তাই সে চুপ করে তাকিয়ে রইল। টুম্পা উৎসাহিত হয়ে বলল,’দুলাভাই আপনি?’
‘তোমায় তো চিনলাম না।’
‘চিনবেনও না। কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। আপনি অর্ষা আপুর হাজবেন্ড।’
আহনাফ মৃদু হাসল। টুম্পা বলল,’আগে ভেতরে আসেন।’
আহনাফ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতেই বলল,’বাসার বাকিরা কোথায়?’
‘সবাই দাওয়াতে গেছে। আপু ঐ রুমে নামাজ পড়তেছে।’
‘ও। আচ্ছা এবার তোমার পরিচয় দাও শুনি।’
‘আমার নাম টুম্পা। এইযে পাশের বাড়িটা দেখেছেন? ঐ বাসায় থাকি। ভাইয়া আর ভাবি তো আজ রাতে ফিরবে না। তাই আমি থাকতে এসেছিলাম। এখন তো আপনিই এসে পড়েছেন। আমি চলে যাই।’
‘না,না। তুমি এই বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যাবে? থাকো তুমি। সমস্যা নেই।’
‘কিছু হবে না। ছাতা নিয়ে এক দৌঁড়ে চলে যাব।’
‘কোনো দরকার নেই। তুমি থাকো।’
টুম্পা আহনাফের কথা শুনল না। সে রুমে থাকা ছাতাটি নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। আহনাফ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে বলল,’তুমি যাও। আমি এখানেই দাঁড়িয়ে আছি।’
টুম্পা হেসে বলল,’আপনি অনেক ভালো দুলাভাই।’
আহনাফ মৃদু হাসল। যতক্ষণ না টুম্পা বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল ততক্ষণ আহনাফ বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে রইল।
বৃষ্টির শব্দের কারণে আহনাফ এবং টুম্পার কথোপকথন অর্ষা শুনতে পায়নি। তবে নামাজের মাঝেও আহনাফের আগমন সে টের পায়। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথাটা শুরু হয়। আহনাফের পারফিউমের মিষ্টি ঘ্রাণটা নাকে প্রবেশ করছে। ইচ্ছে করছে দৌঁড়ে গিয়ে একবার জড়িয়ে ধরতে। সে মনকে ধাতস্থ করল। পূণরায় নামাজে মনোযোগ দিল।
অন্যদিকে অস্থিরচিত্তে রুমের মাঝে পায়চারি করছে আহনাফ। অর্ষার নামাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছে। অর্ষা যখন নামাজ শেষ করে এলো তখন আহনাফের সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। যা বলবে বলে ভেবে এসেছিল, সব ভুলে গেছে। জড়িয়ে ধরার আকুল আবেদন মনেপ্রাণে জাগ্রত হলেও বাস্তবিকভাবে সেই আবেদন সে রক্ষা করতে পারছে না। এদিকে টানা দু’দিন পর আহনাফকে দেখে অর্ষার বুকের ভেতর যেই কালবৈশাখীর ঝড় শুরু হয়েছে, সেটা জড়িয়ে না ধরা অব্দি থামবে না। তবুও দুজনই দুজনের সামনে নিজেদের স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করল।
প্রথম কথা অর্ষাই বলল। জিজ্ঞেস করল,’হঠাৎ এত রাতে?’
আহনাফ আমতা আমতা করে বলল,’আসলে জরুরী একটা কাজে এদিকে আসতে হয়েছিল। ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে যাই।’
‘ও। খেয়েছেন?’
‘না। আজ অফিসে কাজ ছিল তাই বাসায় ইফতারও করা হয়নি। এখন সোজা অফিস থেকে এখানেই এসেছি।’
‘জরুরী কাজে এসেছিলেন বললেন একটু আগে!’
নিজের কথায় নিজেই ধরা পড়ে গেছে আহনাফ। কী বলবে বুঝতে পারছে না। উপস্থিত কোনো বুদ্ধিই এখন মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে না। উত্তরের অপেক্ষায় অর্ষা তাকিয়ে রয়েছে।
আহনাফ হাসার চেষ্টা করে বলল,’এখান থেকে ঐ কাজে যাব।’
‘ওহ। তাহলে ডিনার করে যান।’
‘আচ্ছা।’
অর্ষা খাবার গরম করতে যায়। আহনাফ ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হতে। নিজেই নিজেকে ইচ্ছেমতো বকছে সে। নিজেকে বলছে,’আহনাফ! গাধা, বোকা তুই? কী করতে এসেছিস? আর কী করছিস? এত ভয় কেন পাচ্ছিস তুই? নার্ভাস-ই বা কেন হচ্ছিস বুঝতে পারছি না। অর্ষা তোর জন্য কোনো পরনারী হয়। সে তোর বিয়ে করা স্ত্রী। তার কাছে আবার সংকোচ কীসের? এখনই যা। গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবি। কপালে চুমু খেয়ে বলবি, ভালোবাসি। বুঝেছিস? সময় নষ্ট করিস না। যা।’
মনের জোড়ে সে ফ্রেশ না হয়েই রুমে ফিরে এলো। অর্ষা খাবার সাজাচ্ছিল।
আহনাফকে দেখে বলল,’ফ্রেশ হননি এখনো?’
‘তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।’
অর্ষা পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’কী?’
পূণরায় সব ঘেটে গেছে আহনাফের। মুখ দিয়ে কাঙ্ক্ষিত কথাগুলো বের হলো না। গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’একদিন চলো কোথাও ডিনারে যাই।’
অর্ষা ভাবলেশহীন হয়ে বলল,’আচ্ছা।’
মনে মনে আবারও আহনাফ নিজেকে বকতে লাগল। জিদ্দে ফ্রেশ না হয়েই খেতে বসল। অর্ষার রান্নার হাত ভীষণ ভালো। কিন্তু এত ভালো খাবারও এখন তার ভালো লাগছে না। তিতকুটে লাগছে সবকিছু। মনটা অস্থির হয়ে আছে। বুকটা অস্থির হয়ে আছে অর্ষার স্পর্শ পাওয়ার জন্য। এসব কি তবে কিছুই হবে না? ভালোবাসা লুকায়িত-ই থাকবে?
কোনো রকম খাওয়া শেষ করল আহনাফ। ওদিকে অর্ষার মাঝেও অস্থিরতা কাজ করছে। যত যাই হোক না কেন, সে তো আহনাফকে ভালোবাসে। কিন্তু আর যেচে সে নিজেকে ধরা দেবে না। এতটা মূল্যহীন, সস্তাও সে নয়।
বাইরে তখনো বৃষ্টি পড়ছিল। তবে এখন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।
অর্ষা বলল,’গেলে এখনই চলে যান। পরে কিন্তু আবার জোরে বৃষ্টি শুরু হবে।’
অর্ষার কথায় আহনাফ ভীষণ কষ্ট পেল। কীরকম নিষ্ঠুরের মতো করে বলল চলে যেতে। একটুও কি মায়া লাগে না? ও না বলে ভালোবাসে? তাহলে কী করে ভালোবাসার মানুষটিকে আবার চোখের আড়াল হতে বলে? আহনাফের অভিমান হলো। পাহাড় সমান নয়, সমুদ্র সমানও নয়। এক আকাশ সমান অভিমান নিয়ে সিদ্ধান্ত নিল সত্যিই সে চলে যাবে। কিছুই বলবে না।
খাটের ওপর থেকে ওয়ালেট আর ফোন নিয়ে যাওয়ার পূর্বে বলল,’যাচ্ছি। ভালো থেকো।’
‘সাবধানে যাবেন।’
আহনাফ আর পিছু তাকাল না। বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা গাড়িতে গিয়ে উঠল। অর্ষা ভেবেছিল আহনাফ হয়তো একবার পিছু তাকাবে। কিন্তু তাকায়নি! মানুষটা তো তাকে ভালোই বাসে না! সেদিন শুধু শুধু ওসব কথা বলেছিল। আচ্ছা ভালো না বাসুক, কী হতো আজ রাতটা থেকে গেলে? কাজটা কি এত বেশিই জরুরী ছিল?
দরজা বন্ধ করে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে অর্ষা। দরজায় তখন কড়া নাড়ার শব্দ হয়। দু’হাতে চোখের পানি মুছে দরজা খুলে দেয়। আধভেজা হয়ে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে আহনাফ। অর্ষার চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক দেখা যাচ্ছে। আবার মনে প্রশ্নও জাগল। ফিরে এলো কেন?
অর্ষা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আহনাফ বলল,’অর্ষা, বুকের ভেতর অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে। চিনচিন ব্যথা করছে। তৃষ্ণায় কাতর হয়ে রয়েছে। এত ঝড়বৃষ্টিও মনকে শান্ত করতে পারছে না। বরং উলটো প্রাকৃতিক ঝড়বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বুকের ঝড়বৃষ্টিও প্রবলবেগে বাড়ছে। আমার মনে হচ্ছে আমি ম’রে যাচ্ছি। তুমি কি আমায় বাঁচাবে? এই ব্যথার উপশম হবে? তৃষ্ণার্ত বুকের তেষ্টা মেটাবে? জড়িয়ে ধরবে একবার?
কী নিদারুণ আবদার! অর্ষা আপ্লুত হয়। আবেগে ভেসে যায়। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে। কান্না আটকায় না। ঝাঁপিয়ে পড়ে সে আহনাফের বুকে। আহনাফ শতসহস্র বার চায়, তার বুকের এই ব্যথাটা বারংবার হোক; আর সেই ব্যথার উপশমের একমাত্র নিয়ামক হোক অর্ষা।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]