#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৩৬
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________________
আকাশের বজ্রপাতে হঠাৎ করেই অন্ধকার রুমটা মাঝে মাঝে আলোকিত হয়ে উঠছে। জানালার পর্দা লাগানো হয়নি। জানালার কাচ গলেই মূলত বজ্রপাতের আলোতে ঘর ঝলমল করে ওঠে। সেই হঠাৎ ধেয়ে আসা আলোতে অর্ষা নিবিড় দৃষ্টিতে আহনাফের মুখটি দেখে। কত মায়া, কত স্নেহ সেই মুখটিতে!
অর্ষার পৃথিবীটা খুব ছোট্ট ছিল। তার যাওয়ার স্থানও পরিমাপ করা ছিল। বাড়ি থেকে স্কুল, কলেজ। মাঝেমাঝে বন্ধুদের সাথে আশেপাশের কোনো রেস্টুরেন্ট কিংবা লেকের পাড় এই পর্যন্তই। তার পৃথিবী জুড়ে ছিল তার বন্ধুরা। বাবা-মাকে সে খুব কম সময়ের জন্যই পেয়েছে বলা যায়। জীবনের পথটা হয়তো এখনো অনেক দীর্ঘ। এমনও হতে পারে মৃ’ত্যু খুব সন্নিকটে। মায়ের অনুপস্থিতিতে তার বুকে যন্ত্রণা হতো। কষ্ট হতো। বন্ধুরা তখন ব্যথার উপশম হিসেবে কাজ করত। সে ভাবেইনি এভাবেও যে ভালোবাসা হয়। ভালোবাসা! হ্যাঁ, ভালোবাসাই তো! নতুবা আহনাফের প্রতি কেনই বা তার এত টান? এত মায়া? এর নাম কি ভালোবাসা নয়?
আহনাফের কণ্ঠ থেকে তখন মৃদুস্বরে ভেসে আসে,’বলো না, বলো না!’
অর্ষার বক্ষজুড়ে তখন দীর্ঘশ্বাসের বসবাস। কবে সে মানুষটিকে ভালোবাসার কথা জানাতে পারবে? তার সাহস কম। চিৎকার করে ভালোবাসার কথা সে কখনোই বলতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, কানের কাছে ফিসফিস করে বলতে পারবে, ভালোবাসি। আচ্ছা ভালোবাসলে কি মুখে প্রকাশ করতেই হয়? না বললে কি বোঝা যায় না?
প্রশ্নগুলো নিয়ে আর মাথা ঘামাতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। যা হয়, হোক। যা হবে নিশ্চয়ই সেটা ভালো হবে। সে আহনাফের চুলে বিলি কেটে দিয়ে বলল,
‘ঘুমান।’
আহনাফ সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ে। রাতে আর তার ঘুম ভাঙেনি। জ্বরের প্রভাবে কোনো পাগলামিও করেনি। সকালে যখন ঘুম ভাঙে, শরীরে তখন জ্বর ছিল না। তবে মাথাটা বেশ ভার হয়ে ছিল। অর্ষাকে পাশে না পেয়ে সে একটু জোরেই নাম ধরে ডাকল,
‘অর্ষা?’
বারান্দা থেকে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে আসে অর্ষা। আহনাফ এক পলক তাকিয়ে থেকে বলে,’বারান্দায় কেন এত সকালে?’
জামায় ভিজে যাওয়া হাত মুছে অর্ষা বলল,’বৃষ্টির পানি তো বারান্দায়। তাই মুছে দিচ্ছিলাম।’
‘সকাল সকাল এসব করার কি খুব দরকার?’
‘সমস্যা নেই তো! আপনার জ্বর কমেছে?’
‘জ্বর এসেছিল?’
অর্ষার খুব হাসি পাচ্ছিল তখন। মিটিমিটি করে হাসলেও আহনাফের নজরে পড়েনি। ভাগ্যিস পড়েনি! না হলে সকাল সকাল একটা তুলকালাম কাণ্ড সত্যিই বেঁধে যেত।
অর্ষা হাসি আটকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,’হ্যাঁ।’
‘ওহ। মাথাটা ভার হয়ে আছে। কড়া করে কফি বানিয়ে দিতে পারবে?’
‘হ্যাঁ, শিওর। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন ততক্ষণে।’
অর্ষা কফি আনার জন্য চলে যাওয়ার পর আহনাফও ফ্রেশ হয়ে নেয়। কফির সাথে সাথে সকালের নাস্তাও নিয়ে আসে অর্ষা।
কফি সম্পূর্ণ শেষ করার পর অনেকটাই ভালো লাগছিল আহনাফের। সে ব্রেডে কামড় দিয়ে বলল,
‘তুমি তখন হাসছিলে কেন?’
‘কখন?’ অর্ষার চোখে-মুখে বিস্মিত ভাব।
‘যখন জিজ্ঞেস করলাম আমার জ্বর এসেছিল কিনা।’
‘আমি সত্যিই হাসিনি।’
‘মিথ্যে বলো কেন?’
‘না, সত্যি।’
আহনাফ একবার তাকিয়ে আর কিছু বলল না। অন্যদিকে অর্ষা তো এটাই ভেবে পাচ্ছে না, এই লোকটা সামান্য জিনিসও কীভাবে খেয়াল করে? তখন কিছুই বলল না। আর এখন যখন শরীরটা একটু চাঙ্গা হলো, ওমনিই একদম তেড়ে এসেছে!
অর্ষা চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল,’অফিসে যাবেন আজ?’
‘অবশ্যই।’
‘কখন আসবেন?’
‘জানিনা। কিছু লাগবে তোমার?’
‘উঁহু।’
‘কিছু লাগলে বলতে পারো।’
আহনাফ উঠে গেল আলমারির কাছে। অর্ষা ইতস্তত করে বলল,’একটা কথা বলতাম।’
‘বলে ফেলো।’
‘রাগ করবেন না প্লিজ! আপনি সবসময় এমন গম্ভীর হয়ে থাকেন কেন? কিছুদিন ধরে একদম স্বাভাবিক ব্যবহার করছেন না। কেমন যেন হয়ে থাকেন। বেশি কথাও বলেন না। এমন করেন কেন? আমি কি কোনো ভুল করেছি?’
এক দমে কথাগুলো বলে চুপ হয়ে গেল অর্ষা। ভয়ও লাগছে। আবার রেগে না যায় সে! তবে এমন কিছুই হলো না। আহনাফ অর্ষার এতগুলো কথার পিঠেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। সর্বসময়ের মতোই নিরব ও নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করেছে। নিজের মতো রেডি হতে ব্যস্ত সে। এদিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অর্ষা। মানুষটা ভীষণ একগুঁয়ে, নি’ষ্ঠু’র!
আহনাফ অফিসে যাওয়ার পূর্বেও কিছু বলে যায়নি। নিরবে বাড়ি ছেড়েছে। অর্ষার এখন মনে হচ্ছে, তাকে কথাগুলো বলাই ভুল হয়েছে। কেননা তার মনে হচ্ছে, কথাগুলো বলার পর থেকে আহনাফ আরো বেশি গম্ভীর হয়ে গেছে।
একরাশ মন খারাপ নিয়ে ফোন করে গ্যাঞ্জাম পার্টির গ্রুপ কলে। সর্বপ্রথম লামিয়াই জয়েন হয়। আপাতত এখনো কেউ কলে জয়েন হয়নি।
ওপাশ থেকে লামিয়া জিজ্ঞেস করে,’কী ব্যাপার বোকারানী, কেমন আছিস?’
বিষন্ন কণ্ঠে অর্ষা উত্তর দেয়,’আলহামদুলিল্লাহ্, তুই?’
‘আমি তো একদম ঝাক্কাস আছি। কিছুদিন বাদে সুইজারল্যান্ড আসব। এই খুশিতে তো রাতে ঠিকমতো আমার ঘুমই হয় না।’
অর্ষা নিশ্চুপ। লামিয়া বলল,’তোর মন খারাপ কেন?’
‘আর মন খারাপ! মন থাকলে না মন খারাপ করব।’
‘কী হয়েছে সেটা তো বলবি।’
সেই সময়ে কলে জয়েন হয় জুঁই আর রেশমি। দুজনে একসাথে বলে,’তোরা দুটোয় কী বলিস রে?’
এরপর আবার দুজনেই হেসে ফেলে একসাথে একই কথা বলায়। লামিয়া এ কথার উত্তর না দিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করল,
‘তোরা দুজনে একসাথে কলে আসলি কীভাবে সেটা আগে বল?’
‘টাইমিং মিলে গেছে তাই। এখন বল তোদের কী খবর? অর্ষা চুপ করে আছিস কেন?’ বলল জুঁই।
উত্তরে লামিয়া বলল,’আমি ও’কে সেটাই জিজ্ঞেস করেছি। কী হয়েছে অর্ষা? আমাদের বল।’
কেয়ার ফোন করা, আহনাফের হঠাৎ পরিবর্তন, গম্ভীর আচরণ সবকিছুই অর্ষা তিনজনকে বলল। সব শুনে জুঁই বলল,
‘তুই এত্ত গা’ধী কেন? রাগ করেছে যে কেন সেটা এখনো বুঝিসনি?’
‘শুধু গা’ধী না। সাথে আনরোমান্টিকও। আমি আগে সুইজারল্যান্ড যাই। এই দুটোকে যদি আমিষ না বানাচ্ছি তারপর বলিস!’ বলল লামিয়া।
অর্ষা করুণস্বরে জানতে চায়,’তোরাও কেন রাগ দেখাচ্ছিস?’
রেশমি বলল,’আরে বা’ল! তোরে তো মাথায় তুলে আ’ছা’ড় দেওয়া উচিত। তুই আহনাফ ভাইয়াকে ঐ প্রশ্নটা কেন করতে গেছিস? কেয়া আপুর কথা বলাটাই ঠিক হয়নি।’
‘আমার কি বিষয়টা জানা উচিত নয়? আল্লাহ্ না করুক, যদি সত্যিই কখনো এমন সিচুয়েশন আসে? তখন কী করব বল তো?’
লামিয়া আহ্লাদী হয়ে বলল,’ভয় পাস না জানু। এমন কিছু হবে না ইন-শা-আল্লাহ্। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ।’
‘হ্যাঁ, এসব চিন্তা-ভাবনা করে, এসব প্রশ্ন করে নিজেদের মাঝে দূরত্ব তৈরি করিস না। ভাইয়ার রাগ ভাঙা।’ বলল জুঁই।
অর্ষা অসহায়ের মতো জিজ্ঞেস করল,’কীভাবে?’
লামিয়া, জুঁই আর রেশমি এবার শব্দ করে হেসে ফেলে। রেশমি হাসতে হাসতে বলে,’হাজবেন্ডের রাগ ভাঙাবি সেটাও আমাদের শিখিয়ে দিতে হবে?’
‘তোরা মজা নিচ্ছিস! নে।’
জুঁই তখন মশকরা করে বলল,’অ্যাই তোদের ফুলসজ্জা হয়েছে তো?’
লজ্জায় মুখ রাঙা হয়ে যায় অর্ষার। কান দুটো গরম হয়ে ওঠে। রাগ দেখিয়ে বলে,’তোদের কিছু বলাই বৃথা। আমি ফোন রাখলাম।’
লামিয়া ব্যস্ত হয়ে বলল,’এই, এই শোন! ফোন রাখিস না। রাগ করছিস কেন বল তো? আমরা তো একটু মজাই করছি।’
‘তোরা অনেক ফা’জি’ল। নি’র্ল’জ্জ। তোদের মুখে কিছু আটকায় না।’
তিনজনে ফের আবার হেসে ফেলে। জুঁই বলে,’আচ্ছা শোন। এক কাজ কর তুই। ভাইয়ার পছন্দমতো খাবার রান্না কর। তার সাথে সুন্দরমতো কথা বল। নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চা। আর হ্যাঁ, পারলে ভাইয়াকে ডেডিকেট করে একটা গান শুনিয়ে দিবি। রাগ গলে একদম পানি হয়ে যাবে।’
লামিয়া বলল,’আমি জুঁইয়ের সাথে এক মত।’
রেশমি বলল,’আমিও।’
অর্ষা জানাল,’আচ্ছা ঠিকাছে। গান শুনাতে পারব কিনা জানিনা, তবে চেষ্টা করব।’
‘শোন, যদি লজ্জা লাগে তাহলে কৌশলে গান গেয়ে বুঝিয়ে দিবি।’ বলল লামিয়া।
রেশমি হতাশ হয়ে বলল,’আহারে! তোদেরই জীবন বুঝলি। বিয়েশাদী করে কী সুন্দর সংসার করতেছিস। হাজবেন্ডের সাথে রাগ-অভিমান, ঝগড়া হচ্ছে। রোমান্স হচ্ছে। আর আমি! আমি শা’লা সিঙ্গেলই রয়ে গেলাম!’
লামিয়া হেসে বলল,’এক কাজ কর। আঙ্কেল-আন্টি দুজনেই যখন বাড়িতে থাকবে, তখন সাউন্ড বক্সে একটা গান ছাড়বি।’
‘কী গান?’ উৎসাহের সঙ্গে জানতে চাইল রেশমি।
লামিয়া হাসতে হাসতে বলল,’বাবা আমার কি বিয়ে হবে না, বাবা আমার কি বিয়ে হবে না! এই গানটা।’
‘ভাইরে! জু’তা দিয়ে মা’র’বে আমারে আব্বায়।’
বাকিরা তখন রেশমির কথা শুনে হেসে ওঠে।
.
.
দু’দিনের দিন মনেপ্রাণে সাহস সঞ্চয় করে অর্ষা। আজ সে আহনাফকে কৌশলে একটা গান ডেডিকেটেড করবে। এজন্য আগে আগে ওর পছন্দমতো রান্নাবান্না করেছে। সব কাজে অবশ্য লিলিয়াও সাহায্য করেছে। লিলিয়ার পরামর্শেই অর্ষা গাঢ় নীল রঙের একটা শিফন শাড়ি পরেছে। শাড়িটা তার খালা শাশুড়ি দিয়েছিল। এর আগে কখনো পরা হয়নি। আজ-ই প্রথম। একটু নার্ভাসও লাগছিল তার।
আহনাফ রাতে বাড়ি ফিরে অর্ষার সাজসজ্জা দেখেও কিছুই বলল না। খেতে বসে শুধু জিজ্ঞেস করল,’সব খাবারই তো দেখছি আমার পছন্দের। আজ কি কোনো স্পেশাল ডে? নাকি আমার বার্থডে?’
শেষের প্রশ্নটা কনফিউশন নিয়েই করল। অর্ষা লজ্জা পেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহনাফের দিকে তাকাতেও পারছে না। লিলিয়া হেসে বলল,
‘না, না। তোমার জন্মদিন নয় আজ। অর্ষার ইচ্ছে হয়েছে তাই তোমার পছন্দের খাবারগুলো রান্না করেছে। খেয়ে বলো তো কেমন হয়েছে।’
আহনাফ একবার শুধু অর্ষার দিকে তাকিয়ে বলল,’ওহ। থ্যাঙ্কিউ।’
এরপর বাকিদেরও বলল একসাথে খেতে। খাওয়ার মাঝেই সে অর্ষার রান্নার প্রসংশা করেছে। এক্ষেত্রে অবশ্য সে কোনো রকম কার্পণ্য করেনি তারিফ করতে।
খাওয়া শেষে ঢেকুর তুলে বলল,’বাই দ্য ওয়ে, কোথাও গিয়েছিলে আজ?’
অর্ষা দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বলল,’উঁহু! কেন?’
‘হঠাৎ শাড়ি পরেছ তাই জিজ্ঞেস করলাম।’
অর্ষা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। আহনাফ খেয়ে নিজের রুমে চলে যায়। অর্ষারও খাওয়া শেষ হলে লিলিয়া বলল,’টেবিল আমি গুছিয়ে রাখব। তুমি ঘরে যাও।’
অর্ষা কিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে রুমে গেল। আহনাফ বিছানায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। কাজ করছে নাকি ফেসবুকিং করছে বুঝতে পারছে না। অর্ষা রুমে গিয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে থাকা টুলে বসল। ফোনের ক্যামেরা অন করে আয়নার সামনে রেখে, আড়দৃষ্টিতে আয়নার মাঝেই একবার আহনাফের দিকে তাকাল। বুকের ভেতর তার ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে। হাত-পা কাঁপছে। গান গাওয়ার সময় যদি কণ্ঠস্বরও কাঁপে, তাহলে বিচ্ছিরি একটা ঘটনা ঘটে যাবে। তার সকল প্ল্যানও বৃথা যাবে।
মনে মনে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে গলা পরিষ্কার করে। প্ল্যান অনুযায়ী ফোনের ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে গান শুরু করে। গান গাওয়ার পূর্বে বলে,
‘দিস লিরিক্স ফর ইউ।
আমার পোড়া কপালে
আর আমার সন্ধ্যে সকালে
তুমি কেন এলে জানি না এখনো,
ফন্দি আটে মন পালাবার
বন্দি আছে কাছে সে তোমার…
যদি সত্যি জানতে চাও
তোমাকে চাই, তোমাকে চাই।
যদি মিথ্যে মানতে চাও, তোমাকেই চাই।’
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]