#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_২৬
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
অজানা আশঙ্কায় আতঙ্কিত দেখাচ্ছে অর্ষাকে। সুইজারল্যান্ডে আসার পর এয়ারপোর্টের ঘটনাটি পূণরায় তার চোখের দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে। মনে পড়ে যায় সুজিকার কথা। বিভীষিকাময় অতীতের রাতের কথা মনে পড়ে ভয়ে কাঁপতে থাকে সে। একটু একটু করে পেছাতে থাকে। দরজায় পিঠ ঠেকে গেলে সে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ায়।
হেলেন বুঝতে পারছে না, হঠাৎ করে অর্ষার মুখাবয়ব এমন পরিবর্তন হয়ে গেল কেন। সে চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে জানতে চায়,’কী হয়েছে?’
অর্ষার ভয় কেন জানি আরো বেড়ে যায়। সে যে আহনাফকে ডাকবে সেটাও পারছে না। এই মুহূর্তে তার কথা বলার শক্তিও যেন লোপ পেয়েছে।
দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে হেলেন বলে,’হেই, তুমি এমন করছ কেন?’
সেই সময়ে ক্যাথি অর্ষার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ‘ম্যাউ ম্যাউ’ করছে। অর্ষার ভয় এতে আরো বেড়ে যায়।
ক্যাথির চিৎকার শুনেই আহনাফ এসে দরজা খোলে। হঠাৎ দরজা খোলায় অর্ষা কিছু বুঝে ওঠার আগেই, পড়তে যাবে তখন আহনাফ দু’হাতে ও’কে ধরে ফেলে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে অর্ষা। ওর শরীরের কাঁপুনি টের পেয়ে আহনাফ জিজ্ঞেস করে,
‘ঠিক আছো তুমি?’
‘এই মেয়ে কে?’ জানতে চায় হেলেন। আহনাফ তখনো হেলেনকে খেয়াল করেনি। প্রশ্নের বাণ তার দিকে আসায়, সে হেলেনের দিকে তাকায়।
অর্ষাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে হেলেনকে বলে,’তুমি কখন এলে?’
‘মাত্রই। কিন্তু এই মেয়ে কে?’
আহনাফ দরজা থেকেই লিলিয়াকে ডেকে অর্ষাকে তার সাথে পাঠিয়ে দিলো। হেলেনকে নিয়ে বসল ড্রয়িংরুমে।
হেলেন অস্থির হয়ে আবারও সেই একই প্রশ্ন করে,’বলছ না কেন এই মেয়ে কে?’
আহনাফ ছোটো করে বলে,’অর্ষা।’
হেলেন ঠোঁট উলটে বলে,’অশা?’
‘অর্ষা। মাই ওয়াইফ।’
আহনাফের কথা শুনে হেলেন যেন সাত আসমান থেকে ধপাস করে নিচে পড়ে গেল। অবিশ্বাস্যকণ্ঠে বলল,’সিরিয়াসলি?’
‘ইয়েস।’
‘আমি তাকে দেখেছি।’
এবার আহনাফও অবাক হলো। বিস্ময় প্রকাশ করে জানতে চাইল,’মানে! কীভাবে?’
‘সেদিন বার থেকে ফিরে রিশিতাকে যে এয়ারপোর্ট আনতে গেলাম? এয়ারপোর্টেই দেখেছিলাম।’
আহনাফের এবার আফসোস হলো। তার কাছে যদি অর্ষার ছবি থাকত এবং হেলেনকেও দেখাত, তাহলে নিশ্চয়ই সেই রাতে অর্ষাকে অমন বিপদের মুখোমুখি হতে হতো না। অবশ্য তার-ই বা কী দোষ? সে কি আর জানত নাকি যে, অর্ষা তাকে না জানিয়ে সুইজারল্যান্ড আসবে!
‘কী হলো? চুপ করে আছো কেন?’ আহনাফকে নিশ্চুপ বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন করল হেলেন।
আহনাফ বলল,’না, এমনি। কী খাবে বলো?’
‘উম! এখানে কিছু খাব না। বারে যাব চলো।’
‘এখন?’
হেলেন হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলল,’একটু পর গেলেও হবে। বাই দ্য ওয়ে, এই মেয়েটা তো সুন্দর। তাহলে মেনে নিচ্ছ না কেন?’
আহনাফ হেসে বলল,’তোমার মতো সুন্দরের পূজারি হলে হয়তো পারতাম।’
হেলেন হাসল। লিলিয়া এসে আহনাফকে জানাল, অর্ষার আবার জ্বর এসেছে। চিন্তিত হয় আহনাফ।
হেলেনের উদ্দেশ্যে বলল,’কফি পাঠাচ্ছি। তুমি একটু বসো। আমি আসছি।’
হেলেন হেসে বলল,’শিওর।’
আহনাফ রুমে গিয়ে দেখল, অর্ষা কম্বল জড়িয়ে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে। শরীর কাঁপছে তার। আহনাফ ওর কপালে হাত রেখে বলল,’কী হলো হঠাৎ?’
অর্ষা তখন জ্বরের ঘরে। চোখ বন্ধ করে রেখেছে। আহনাফ জিজ্ঞেস করে,’তুমি কি ভয় পেয়েছ?’
অর্ষা নিরুত্তর রইল। আহনাফ বুঝতে পারে, এখন আর প্রশ্ন করে কোনো কাজ নেই। তাই সে অর্ষাকে জ্বরের ট্যাবলেট খাইয়ে আবার শুইয়ে দিলো। কিছুক্ষণের মাঝে অর্ষা ঘুমানোর পর সে রুম থেকে বের হয়।
হেলেন ফোন চাপছিল। আহনাফকে দেখে জিজ্ঞেস করে,’সবকিছু ঠিক আছে?’
আহনাফ মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে পাশে বসল। হেলেন মুচকি হেসে বলে,’ইউর ওয়াইফ ইজ সো ইনোসেন্ট এন্ড অলসো সি ইজ রিয়েলি বিউটিফুল।’
‘হ্যাং অন অ্যা মোমেন্ট। আর ইউ ফ্লার্টিং?’
হেলেন তার সুন্দর হাসিটা হেসে বলল,’নো, ম্যান। আ’ম জাস্ট টেলিং ট্রু।’
‘দ্যান প্লিজ স্টপ ইট!’
‘হোয়াই? আর ইউ ফিলিং জেলাস?’
‘নেভার এভার। প্লিজ চেঞ্জ দ্য টপিক।’
হেলেন পূণরায় হাসল। তার মন বলছে, আহনাফ যত-ই না বলুক না কেন; মনে মনে ঠিক-ই হিংসা হচ্ছে তার। লিলিয়া তখন এসে বলল,
‘খাবার তৈরি। খেতে আসো।’
হেলেন বাধা দিয়ে বলল,’না। আমরা আজ বাইরে খাব।’
‘বাইরে কেন?’ জানতে চাইল আহনাফ।
হেলেন বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,’বিশেষ কোনো কারণ নেই। আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই।’
আহনাফ অনেকটা ইতস্তত করে বলল,’আজ কোথাও না যাই?’
হেলেন দুষ্টু হেসে ভ্রুঁ নাচিয়ে বলে,’কেন হু? অশাকে রেখে যেতে মন সায় দিচ্ছে না?’
আহনাফ গম্ভীর হয়ে বলে,’এমন কিছু নয়।’
‘তাহলে আর সমস্যা কী? চলো।’
হেলেনের এমন একটা কথা বলার পর, এখন আর না গিয়ে উপায় নেই। সে রুমে গিয়ে তৈরি হয়ে নিল। রুম থেকে বের হওয়ার সময় আড়চোখে একবার ঘুমন্ত অর্ষাকে দেখেও নেয়।
লিলিয়ার উদ্দেশ্যে বলে,’একটুপর অর্ষাকে ঘুম থেকে তুলে খেতে দিয়েন।’
হেলেন তাড়া দিয়ে বলল,’দেবে, দেবে। তুমি চলো এখন।’
আহনাফ যাওয়ার পথে কিছুটা উঁচুস্বরে বলে গেল,’আর হ্যাঁ, ক্যাথিওন যেন অর্ষার কাছে না যায় খেয়াল রাখবেন।’
.
অর্ষার ঘুম ভাঙে সাড়ে পাঁচটার দিকে। এরমাঝে লিলিয়া এসে বেশ কয়েকবার ডেকে গেছিল। অর্ষা ওঠেনি। শরীর ঘেমে একাকার অবস্থা। জ্বর ছেড়েছে বোঝা যাচ্ছে। কিছুটা ক্লান্তবোধও করছিল। তাই অন্যকিছু না করে আগে গোসল করে আসে।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে স্মিথকে দেখতে পায়। স্মিথ বলল,’মম খেতে ডাকে।’
‘যাও,আসছি।’
‘ওকে।’
স্মিথ চলে যাওয়ার পর চুলগুলো ঝেড়ে নেয় অর্ষা। চিরুনি দিয়ে সুন্দর করে আঁচড়িয়ে খেতে যায়। লিলিয়া কড়া একটা কফি বানিয়ে দিয়েছে।
মগ হাতে নিয়ে অর্ষা জিজ্ঞেস করে,’এটা কী?’
‘কফি।’ লিলিয়ার উত্তর।
‘এমন কালো কুচকুচে কেন?’
‘ব্ল্যাক কফি। খাও, ভালো লাগবে।’
অর্ষা এক চুমুক দিয়েই সাথে সাথে মগ টেবিলের ওপর রেখে দিলো। বমি আসছে তার। তেতোয় মুখ নষ্ট হয়ে গেছে। সে মুখটা বিকৃতি করে বলল,’ইয়াক ছি! এত বাজে কফি আমি জীবনেও খাইনি।’
স্মিথ বলল,’এটার স্বাদ এমনই। তবে উপকারী।’
‘আমার এত উপকার দরকার নেই ভাই। আমাকে দুধ-চিনি মেশানো কফি দিতে বলো।’
অর্ষাকে জোর করে লাভ নেই বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে লিলিয়া। অর্ষার কথামতো কফি বানিয়ে টেবিলের ওপর রাখে। কিচেনে যাওয়ার সময় অর্ষা পিছু ডেকে বলে,’উনি কোথায়?’
‘কে? আহনাফ?’
‘হ্যাঁ।’
‘হেলেনের সাথে বাইরে গেছে।’
‘হেলেন কে?’
‘ওর বন্ধু। তখন যে এসেছিল।’
অর্ষা অবাক হয়ে বলল,’তার বন্ধু!’
‘হ্যাঁ। কিন্তু তোমার হঠাৎ কী হয়েছিল?’
অর্ষার মনটা খারাপ হয়ে যায়। সে বলে,’এমনি কিছু না। আপনি যান।’
লিলিয়া চলে যাওয়ার পর সে কফিতে চুমুক দেয়। স্মিথ তখনো গল্পের বইটা পড়ছিল।
‘ক্যাথিওনকে কি এখনো বাইরেই রেখেছে?’ স্মিথের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল অর্ষা।
‘না। তোমার সাথেই ঘরে এনেছিল।’
‘কোথায়? দেখছি না যে?’
‘নিচে তাকাও।’
অর্ষা নিচে তাকিয়ে এক লাফে পা দু’টো চেয়ারের ওপর তুলে ফেলে। ক্যাথি ওর পায়ের কাছেই বসে ছিল। এমন করায় ক্যাথি মাথা তুলে ওর দিকে তাকায়। স্মিথ শব্দ করে হাসে।
অর্ষা চোখ বন্ধ করে বলে,’উফ আল্লাহ্!’
স্মিথ তখন বলল,’তুমি ভয় পেও না। ও তো কিছু করবে না।’
‘হ্যাঁ, কিছু করবে না। এই দেখো হাতে এখনো আঁচড়ের দাগ রয়েছে।’ নিজের হাতটা দেখিয়ে বলল অর্ষা।
‘তুমি ও’কে একটু আদর করলে কী হয়?’
‘কিহ! আদর? আরে ভাই, ধরতে গেলেই তো ভয় লাগে।’
স্মিথ মুখে হাত দিয়ে হেসে বলে,’তুমি অনেক ভীতু।’
অর্ষার মুখটা চুপসে যায়। মুখটা একটুখানি করে বলে,’জানি!’
_______
সারা বিকাল এদিক-ওদিক ঘুরে সন্ধ্যায় বারে এসেছে হেলেন আর আহনাফ। হেলেনের আগমন হওয়া মাত্র মেয়েরা ছুটে আসে কাছে। আহনাফ পাশ কাটিয়ে সাইডে চলে যায়। দূর থেকে দেখতে পায়, মেয়েরা পারে না শুধু হেলেনকে খেয়ে ফেলে।
সে একটা চেয়ারে বসে। এত হৈ-হুল্লোড়ের মাঝেও হুট করে অর্ষার কথা মনে পড়ে যায়। জ্বরের মধ্যে মেয়েটাকে রেখে আসা কি ঠিক হলো? মন তো তার এভাবে আসাকে সায় দিচ্ছে না মোটেও।
তখন একটি মেয়ে বিয়ারের বোতলে চুমুক দিতে দিতে আহনাফের কাছে আসে। হাত বাড়িয়ে বলে,’ডান্স করার পার্টনার হবে?’
আহনাফ মৃদু হেসে বলে,’স্যরি।’
‘ইট’স ওকে।’ বলে মেয়েটা যেভাবে এসেছিল সেভাবেই আবার চলে যাচ্ছিল। তখন হেলেনের সাথে দেখা হয়।
হেলেনের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,’হেই! কোথায় ছিলে তুমি? মিস করেছিলাম।’
হেলেন গলা থেকে মেয়েটির হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,’মিস ইউ টু সুইটহার্ট। তুমি ইনজয় করো। আমি একটু পর আসছি।’
‘ওকে।’
মেয়েদের ছাড়িয়ে আহনাফের কাছে আসে হেলেন। পাশের একটা চেয়ারে বসে বলে,’তুমি এখানে কী করছ?’
‘দেখছি।’
‘কী?’
‘এতগুলো মেয়েকে কীভাবে সামলাচ্ছিলে সেটাই।’
হেলেন শব্দ করে হেসে ফেলে। দুটো ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে একটা আহনাফের দিকে এগিয়ে দেয়।
আহনাফ গ্লাসটি সরিয়ে দিয়ে বলল,’স্যরি। ড্রিঙ্ক করব না আজ।’
হেলেন অবাক হয়ে বলল,’কেন? অশার জন্য বুঝি?’
হেলেন বারবার অর্ষার নামটা ভুল উচ্চারণ করছিল বলে আহনাফও মৃদু হাসে। বলে,’বাড়িতে তো আর আমি এখন একা থাকি না। অর্ষা, লিলিয়া আন্টি আর স্মিথও আছে। বিষয়টা খারাপ দেখায়।’
হেলেন ঠোঁট টিপে হেসে বলে,’সত্যি করে বলো তো, তুমি কি অশাকে ভালোবাসার চেষ্টা করছ?’
আহনাফ স্মিত হেসে বলে,’লাভ ইজ নট এনি পারপোজলি সাবজেক্ট। ইট’স প্রোপারলি ম্যাটার অফ হার্ট।’
‘বুঝলাম।’ কাঁধ নাচিয়ে বলল হেলেন।
যেই মেয়েটা একটু আগে আহনাফকে ডান্স করার জন্য বলেছিল সেই মেয়েটা আবার এসেছে। বেশ নে’শা যে করেছে সেটা বোঝা যাচ্ছে,মেয়েটির হাঁটার ধরণ দেখে।
সে পূণরায় হেলেনের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,’এবার তো চলো!’
হেলেন ও’কে ছাড়াতে গিয়ে হাতের ড্রিঙ্কসটা আহনাফের টি-শার্টের ওপর পড়ে। হেলেন তড়িঘড়ি করে বলে,’স্যরি, স্যরি ম্যান।’
আহনাফ টি-শার্ট ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,’ইট’স ওকে।’
হেলেন এবার মেয়েটিকে বলল,’এখন ডান্স করার মুড নেই বেবি। তুমি যাও।’
মেয়েটি কয়েকবার রিকোয়েস্ট করেও হেলেনকে রাজি করাতে পারল না। তাই বিরক্ত হয়েই চলে গেল।
মেয়েটির যাওয়ার পথে একবার তাকিয়ে আহনাফ বলল,’গেলে না কেন?’
‘শী ইজ অ্যা ক্রেজি গার্ল। এন্ড শী ওয়ান্টস টু শেয়ার দ্যা বেড উইথ মি।’
‘সো হোয়াট? আফটার অল শী ইজ ইউর গার্লফ্রেন্ড।’
‘হোয়াটএভার! ইউ নো, আ’ম স্টিল ভার্জিন! এন্ড আই ওয়ান্ট টু লস মাই ভার্জিনিটি উইথ মাই ট্রু লাভ।’
আহনাফ ভ্রুঁ উঁচিয়ে বলল,’গ্রেট!’
_______
ভিডিয়ো কলে কথা বলছিল অর্ষা, আশিক, দিদার, রেশমি আর জুঁই। লামিয়া আর আহিল অনুপস্থিত। অনলাইনেই নেই ওরা।
অর্ষা মনমরা হয়ে বলে,’আমি তো খুবই অশান্তিতে আছি জানিস?’
‘কী হয়েছে আবার? ভাইয়া কিছু বলেছে?’ জিজ্ঞেস করল রেশমি।
‘না। উনার একটা বিড়াল আছে। ভীষণ জ্বালায়।’
‘জ্বালায় মানে?’
‘মানে সারাক্ষণ আমার পেছনে ঘুরঘুর করে।’
আশিক অবাক হয়ে বলে,’বলিস কিরে! শেষমেশ বিলাইও তোর পেছনে ঘোরে?’
জুঁই ভেংচি কেটে বলল,’একদম তোর মতো স্বভাব।’
আশিক চোখমুখ শক্ত করে বলল,’তোরে দেখলেও মনে হয় বিলাই,
এই সুখে আয় তোরে একটু কিলাই।’
‘ফাল’তু!’
রেশমি বলল,’বিড়ালটা কোথায়?’
‘ড্রয়িংরুমে। পিছুই ছাড়ছিল না। তাই ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বসে আছি।’
সবাই শব্দ করে হেসে বলে,’কবে যে তুই একটু চালাক আর সাহসী হবি।’
‘যতই চালাক আর সাহসী হই না কেন, বিড়াল বা কোনো প্রাণী আমি ধরতে পারব না।’
কথার মাঝে দরজায় টোকা পড়ে। বাইরে থেকে আহনাফের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
‘উনি এসেছে। পরে কথা বলছি।’ বলল অর্ষা।
‘ঢং। রোমান্স-টোমান্স তো কিছু করবি না। তাহলে আমরা কলে থাকলে কী সমস্যা?’ ভেংচি কেটে বলল রেশমি।
‘তোরা বড্ড বেশি বাজে কথা বলিস। রাখছি আমি।’
কল কেটে দরজা খুলে রীতিমতো অবাক হয় অর্ষা। ভয়ে দু’পা পিছিয়ে যায়। একবার আহনাফের হাতের দিকে তাকায়, আরেকবার পায়ের দিকে। ক্যাথিওন দাঁড়িয়ে আছে পায়ের কাছে। অন্য একটা বিড়াল আহনাফের হাতে।
অর্ষা অস্থির হয়ে বলে,’এটা কে?’
‘দেখতে পাচ্ছ না বিড়াল?’
‘এটাকে কোত্থেকে ধরে আনলেন আবার?’
‘রাস্তায় পেয়েছি।’
‘আশ্চর্য! রাস্তায় পেলেই এমন কুকুর, বিড়াল ধরে আনতে হবে? ওদের বাগানবাড়ি বানাবেন নাকি এটা?’
আহনাফ ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,’তোমার কী সমস্যা?’
‘আমার কী সমস্যা মানে? একটা বিড়াল কি কম পড়েছিল যে আপনি আরো একটা নিয়ে এসেছেন?’
‘মনে করো তাই।’
অর্ষা এতটাই বিরক্ত হলো যে কিছু বলতেও পারছে না। আহনাফ লিলিয়াকে ডেকে বিড়ালটিকে তার কোলে দিলো। বলল,’ও’কে পরিষ্কার করে কিছু খেতে দিও।’
ক্যাথি আহনাফের সাথেই রুমে ঢুকল। অর্ষাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় আহনাফের গায়ে ড্রিঙ্কসের গন্ধ পায় অর্ষা।
নাকমুখ কুঁচকে বলে,’আপনি ড্রিঙ্কস করেছেন?’
আহনাফ ফিরে তাকায়। অর্ষা নিজেই আবার বলে,’আপনি ড্রিঙ্কস কেন করেন? আমি সত্যিই ভাবতে পারছি না। বিশ্বাসও হচ্ছে না। আপনি জানেন না এটা শরীরের জন্য কত খারাপ?’
আহনাফ সত্যটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। তার ভেতরের সত্তাটা বলে উঠল,’এই মেয়েকে সবকিছুর কৈফিয়ত কেন দিতে হবে?’
তাই সে গম্ভীর হয়ে বলল,’অয়েল ইউর ওউন মেশিন।’
অর্ষার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে তো ভালো কথা-ই বলেছে। তবুও কেন আহনাফ তার সাথে এমন শক্ত হয়ে কথা বলে? রাগ করে সে ঘর থেকেই বের হয়ে গেল। ক্যাথিও ওর পিছু যাওয়া ধরে তখন আহনাফ ও’কে ধরে ফেলে।
কোলে তুলে নিয়ে বলে,’জানিস যে অর্ষা তোকে পছন্দ করে না, তবুও কেন সারাক্ষণ ওর পিছু পিছু ঘুরিস?’
অর্ষা নিজের ফোনটা নিতে এসে কথাটি শুনতে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। কথার মাঝে ফোঁড়ন কেটে বলে,’আমি কখন বলেছি, ক্যাথিকে পছন্দ করি না? আমি ভয় পাই। তার মানে তো এই নয় যে অপছন্দ করি। বাচ্চাদের উলটা-পালটা বোঝাবেন না।’
আহনাফ ভ্রুঁজোড়া উঁচু করে বলে,’যেভাবে বলছ মনে হচ্ছে, ক্যাথি তোমার বাচ্চা।’
‘আপনার বাচ্চা হতে পারলে আমার বাচ্চা হতে পারবে না কেন?’
‘বাচ্চা হলে দূরে সরিয়ে দিতে না নিশ্চয়ই?’
‘ভয় পেলে আমি কী করব?’
‘ভয় দূর করবে।’
‘হয় না। স্পর্শ লাগলেই ভয় লাগে। কেমন জানি লাগে! আমি বলে বোঝাতে পারব না।’
এই পর্যায়ে আহনাফ হেসে ফেলে। অর্ষা গম্ভীর হয়ে শুধায়,’হাসছেন কেন?’
‘মানুষের কত রকম ফোবিয়া থাকে। আর তোমার কিনা বিড়ালে ফোবিয়া রয়েছে!’
‘শুধু বিড়াল নয়, আমি অন্য প্রাণীও ভয় পাই। এমনকি হাঁসের বাচ্চা, মুরগির বাচ্চাও।’
‘তুমি তো ভীষণ অদ্ভুত। সাপ, বাঘ দেখে ভয় পাওয়াটা না হয় মানানসই। তাই বলে, বিড়াল; এমনকি হাঁস-মুরগিও?’
অর্ষা থম মেরে তাকিয়ে থাকে। একটু না হয় ভয়-ই পায়। এতে এত অবাক হওয়ার কী আছে?
ক্যাথিকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে আলমারি থেকে জামা-কাপড় বের করতে যায় আহনাফ। তখন জিজ্ঞেস করে,’তোমার জ্বর সেরেছে?’
‘হুম।’
‘তখন এত ভয় পাচ্ছিলে কেন?’
‘আপনার বন্ধুকে দেখে।’
কাবার্ড থেকে ট্রাউজার আর সাদা টি-শার্ট বের করে, অর্ষার দিকে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,’কেন?’
অর্ষা নতমুখে জানায়,’সেই রাতের কথা মনে পড়ে গেছিল।’
‘ভুলে যাও অর্ষা। চেষ্টা করো সম্পূর্ণ ভুলে যেতে। স্বাভাবিক হও। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।’
অর্ষা মুখ তুলে তাকায়। মানুষটাকে দেখে। কথা শেষ করে ততক্ষণে আহনাফ ওয়াশরুমে ঢুকে গেছে। অর্ষা এই মানুষটিকে ঠিক বুঝতে পারে না। কখনো ভীষণ নরম তো কখনো ভীষণ কঠোর। কখনো ভীষণ কেয়ারিং তো কখনো ভীষণ রাগী। হতাশ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে সে।
আহনাফের গোসল শেষ হলে দুজনে একসাথে খেতে বসে। স্মিথ আর লিলিয়া আগেই খেয়ে নিয়েছে। মূলত অর্ষাই লিলিয়াকে জোর করে বলেছিল,’বাড়িতে এসেই অনেক কাজ করেছেন। খেয়ে রেস্ট নিন এখন।’
খাওয়ার সময়ও অর্ষা খেয়াল করল ক্যাথিওন ওর পায়ের কাছে বসে খাচ্ছে। সে তখন আহনাফকে জিজ্ঞেস করে,’ওর নাম ক্যাথিওন কেন?’
এমন প্রশ্নে আহনাফ একবার তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। বলল,’আমি রেখেছি তাই।’
‘আচ্ছা। ক্যাথিওন মানে কী?’
‘জানিনা। শুধু জানি একটা নাম। মাথায় এসেছে রেখে দিয়েছি।’
‘ও ছেলে নাকি মেয়ে?’
আহনাফ ফের এক পলক তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিয়ে বলল,’চেক করে দেখো।’
অর্ষা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। ওর রিয়াকশন দেখে মনে মনে হাসি পায় আহনাফের। সে ভাবলেশহীনভাবে বলে,’ছেলে।’
খাওয়া শেষ করে ঘুমানোর সময় মুখটা কাচুমুচু করে দাঁড়িয়ে রইল অর্ষা। আহনাফ আরাম করে বিছানায় একটু শুয়েছিল।
অর্ষার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,’মুখ অমন করে রেখেছ কেন?’
‘আমি ঘুমাব কোথায়?’
‘ছাদে।’
‘কী?’
‘শোনোনি কী বললাম? কাঁথা-বালিশ নিয়ে ছাদে চলে যাও। তুমি তো আবার কারও সাথে ঘুমাতে পারো না।’
অর্ষা কী করবে বুঝতে পারছে না। আহনাফ কি সত্যিই চাইছে অর্ষা ছাদে যাক? নাকি মজা করে বলল কথাটা?
আহনাফ বিছানা থেকে উঠে বলল,’দেখো অর্ষা, পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে শেখো। লিলিয়া আন্টি আর স্মিথ ঐ রুমে। আর এখানে রুম-ই দুটো। আমাদের এক রুম শেয়ার করা ছাড়া উপায় নেই।’
অর্ষা মনে মনে ভাবল, নিজে যে কত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়েছে তা তো সে দেখেছেই। কিন্তু মুখে ছোটো করে বলল,’আচ্ছা।’
‘তুমি শুয়ে পড়ো। আমি ক্যাথিকে লিলিয়া আন্টির রুমে রেখে আসছি।’
‘থ্যাঙ্কিউ।’
‘কেন?’
‘এটলিস্ট ও’কে অন্য রুমে রাখার জন্য।’
আহনাফ কোনো রকম প্রত্যুত্তর করল না। ক্যাথিকে কোলে তুলে নিল। ক্যাথি যখন বুঝতে পারল, তাকে এই রুমের বাইরে রাখা হবে তখন আহনাফের কোল থেকে এক লাফ দিলো। লাফ দেওয়ার সময় ও’কে ধরতে গিয়ে পাশে দাঁড়ানো অর্ষাকে নিয়ে বিছানায় পড়ে যায় আহনাফ। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে যায় দুজনই। অর্ষা মুখটা কাঁদোকাঁদো করে বলল,’ম’রার বিড়াল!’
আহনাফ জ্ঞানশূন্য হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। অর্ষা দু’হাত দিয়ে আহনাফকে ঠেলে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,’আপনার ওয়েট কত?’
অস্ফুটস্বরে আহনাফের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে,’হোয়াট!’
অপরদিকে তার মন তাকেই বলে ওঠে,’কী আনরোমান্টিক মেয়ে রে বাবা!’
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]