#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_১২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_______________
ঘুনে পোঁকার অত্যাচার দেখেনি এমন মানুষ বোধ হয় বিরল। আবার নাও হতে পারে! কাঠের ওপর সে কি নিদারুণ অত্যাচার তার! আহনাফেরও এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে একটা অদৃশ্য ঘুনে পোঁকা একটু একটু করে তার মস্তিষ্ক কুটকুট করে কাটছে। কাকে সে মিস করছে সেটা সে জানে না। এটা নিয়ে অবশ্য তার কোনো সমস্যাও নেই। সবকিছু জানতে নেই। যা জানতে নেই তা কেন মস্তিষ্কে তল্পিতল্পা নিয়ে বসে থাকবে? সে তো এই অত্যাচার নিতেই পারছে না।
সে মন ও মস্তিষ্ককে এই অসভ্য কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে ধরেই নিল, বাবা-মাকে সে মিস করছে। নতুবা সেই ব্যক্তিটা শুধুই তার মা। নিশ্চয়ই মায়ের জন্য মন এমন করছে! মাকে কি একটা ফোন করবে? কয়টা বাজে এখন? বাংলাদেশ থেকে ফিরে যে শুয়েছে; ঘুম তো আসেনি। শুধু উদ্ভট সব চিন্তা-ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে।
আলস্য ভঙ্গিতে বিছানা ছাড়ে। ঘুম ঠিকঠাকভাবে না হওয়াতে মাথা ঝিমঝিম করছে। জানালার কাছে এগিয়ে গিয়ে আলগোছে পর্দাটা।সরায়। একফালি সোনালী রোদ্দুর এসে পড়ে জানালার কপাটে। আহনাফ জানালার কাচগুলোও খুলে ফেলে। মিষ্টি রোদ গায়ে মাখলে হয়তো ভালো লাগবে। সে হেলতে-দুলতে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে। মাথায় পানি দেয়। তবে অস্থিরতা কমে না। এমন হলে তো এত স্ট্রং মানুষটাও অসুস্থ হয়ে পড়বে।
বালিশের পাশ থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে হোয়াটসএপে যায়। তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতে মায়ের নাম্বারে ডায়াল করে।
রিং হওয়ার সাথে সাথেই আমেনা বেগম ফোন রিসিভ করলেন। হয়তো ফোন তার হাতেই ছিল। তিনি ফোনের স্ক্রিনে ছেলের মুখটি দেখে আনন্দিত হন।
মাকে দেখে আহনাফেরও ভালো লাগে। সে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করে,’কেমন আছো মা?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্ বাবু। তুই কেমন আছিস?’
‘আমিও আলহামদুলিল্লাহ্। শুধু মাথাটা একটু ব্যথা করছে।’
‘সেকি! কখন থেকে?’
‘বাড়ি ফিরে একটু শুয়েছিলাম। ঘুম হচ্ছে না। আবার এত জার্নি করলাম! সম্ভবত এজন্যই। একটু আগে থেকে মাথা ব্যথাটা অনুভব করলাম।’
‘দেখেছিস যেতে না যেতেই আরো অসুস্থ হয়ে গেছিস! কত করে বললাম আর কয়টা দিন থাক। শুনলিই না আমার কথা। এখন তোর টেক কেয়ার কে করবে বল তো?’
‘রিল্যাক্স আম্মাজান! একটু মাথা ব্যথাই তো? ঠিক হয়ে যাবে। তুমি অত চিন্তা কোরো না তো। তাছাড়া ক্যাথিওন তো আছেই।’
‘সবসময় পাগলামি! বিড়াল করবে তোর দেখাশোনা?’
মায়ের রাগ দেখে আহনাফ হেসে ফেলে। বালিশে মাথা রেখে বলে,’কী যে বলো! ক্যাথিওন মানুষের চেয়ে কম না। অনেক ভালোবাসে আমায়। বুঝেছ?’
‘আমার অত বুঝে কাজ নেই। তুই মেডিসিন নে এক্ষুণী। কড়া লিকারের চা খা।’
‘সব হবে। তুমি এত ব্যস্ত হইয়ো না তো। বাড়ির সবাই কেমন আছে বলো?’
‘সবাই ভালো। কিন্তু তোকে ছাড়া বাড়িটা বড্ড ফাঁকা লাগছে বাবু!’
‘মন খারাপ করে না আমার সোনা মা। আমি আবার আসব। একটা কথা বলি?’
‘তুই অনুমতি নিচ্ছিস কেন? বল না কী বলবি? খুব কষ্ট হচ্ছে বাবু?’
‘না। তুমি আসবে আমার কাছে? কিছুদিন থাকবে?’
আমেনা বেগম চুপ করে থাকেন। নিষ্পলকভাবে দেখেন ছেলেকে। মৌনতা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করেন,’তোর কি মন খারাপ?’
‘মন খারাপ’ শব্দটি মনে মনে আওড়াতে থাকে আহনাফ। তার কি সত্যিই মন খারাপ? কাউকে মিস করলে কি মন খারাপ লাগে? হবে হয়তো! মায়ের সাথে কথা বলে শান্তি তো লাগছে; তবে কেন যেন মনে হচ্ছে মিস করা মানুষটি মা ব্যতীতও অন্য কেউ।
মাকে নিশ্চিন্তে রাখতে বলল,’আরে নাহ্! তোমাকে আমার কাছে রাখতে ইচ্ছে করে তাই বললাম। তুমি বাবার সাথে কথা বলে রেখো। এখন আমি রাখছি কেমন?’
‘আচ্ছা। মনে করে মেডিসিন নিস কিন্তু। আর ফোন দিস রাতে।’
‘ঠিক আছে। আল্লাহ্ হাফেজ।’
ফোন রেখে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে শুয়ে থাকে আহনাফ। পরক্ষণে মনে পড়ে ক্যাথিওনের কথা। ফিরে এসে সে সাথে সাথেই ক্যাথিওনকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। খাটেই তো ছিল। এখন কোথায় গেল? সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে অবশেষে পাওয়া গেল সোফার চিপায়। আহনাফ ধরতে গেলেই দৌঁড়ে পালাচ্ছে।
আহনাফ দাঁড়িয়ে পড়ে। কোমরে হাত রেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,’তোর আবার কী হলো? রাগ করেছিস?’
ক্যাথিওন আবার মুখ ঘুরিয়ে নেয়। জীবজন্তুর কথা বলার ভাষা নেই; হয়তো আছে তবে মনুষ্যজাতির সেই ভাষা বোধগম্য নয়। তবে ওদের চোখের ভাষাই যা বলার, যা বোঝানোর বুঝিয়ে দেয়। এই মুহূর্তে ক্যাথিওনের চোখের ভাষাও বলছে সে ভীষণ অভিমান করেছে আহনাফের ওপর।
আহনাফ সরল হেসে সোফায় বসে বলে,’তোর এত অভিমান আসে কোত্থেকে রে? তোকে কি ঐ বাড়িতে খেতে দেয়নি?’
বাড়ির কলিংবেলটা বেজে ওঠে তখন। আহনাফ উঠে যায় দরজা খুলতে। হলুদ গাউন পরে পাশের ফ্ল্যাটের সেই বাচ্চা মেয়েটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। সোনালী সিল্কি চুলগুলো ঘাড়ের ওপর ছড়ানো। চোখগুলো বাদামী। মুখে সবসময়কার মতো মিষ্টি হাসি। দেখে মনে হচ্ছে হলুদ পরী একটা! ওর হাতে ছোটো চায়ের ফ্লাক্স আর দু’পিস স্যান্ডউইচ।
মেয়েটির নাম হানি। সে সুন্দর করে হেসে স্পষ্ট ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল,’কেমন আছো আঙ্কেল?’
উত্তরে আহনাফও হেসে ইংরেজিতে বলল,’আলহামদুলিল্লাহ্,ভালো মামনি। তুমি কেমন আছো?’
‘ভালো। মা তোমার জন্য খাবারগুলো পাঠিয়েছে।’
আহনাফ ওর হাত থেকে খাবারগুলো নিয়ে বলল,’ভেতরে আসো।’
হানিকে নিয়ে ভেতরে যায় আহনাফ। ক্যাথিওন দৌঁড়ে আসে হানিকে দেখে। হানি ও’কে কোলে নিয়ে আদর করে। আহনাফ অবাক হওয়ার ভান ধরে বলে,’বাপরে! ক্যাথি দেখছি হানির ভক্ত হয়ে গেছে।’
হানি হেসে বলল,’জানো আঙ্কেল, ক্যাথি তোমার ওপর ভীষণ রাগ করেছে।’
আহনাফ ফ্লাক্স থেকে কাপে চা ঢালে। এক চুমুক দিয়ে বলে,’হ্যাঁ, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। আমার কাছে আসছেই না।’
‘তুমি এত দেরি করলে কেন এবার?’
‘এক্সিডেন্ট হয়েছিল। তাই লেট।’
হানি আঁৎকে ওঠে। ছোটো মানুষ তাই সবকিছুতেই বেশি ভয় পায়। আহনাফ আশ্বস্ত করে বলল, এখন সে সুস্থ এবং ভালো আছে।
________
গ্যাঞ্জাম পার্টির সকলে এখন যে যার পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। সকলেরই ভালো একটা রেজাল্ট চাই। সারা বছর বাউণ্ডুলেপোনা করলেও পরীক্ষার সময় সব সিরিয়াসনেস এসে প্রত্যেকের মাঝে ভর করে। যদিও অর্ষা এবং আহিল এর ব্যতিক্রম। ওদের সিট পাশাপাশি পড়লেও আশঙ্কা থেকেই যায়। যদি কড়া গার্ড পড়ে? তাহলে তো সাড়ে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এজন্য পাশ মার্ক তুলতে যতটুকু না পড়লেই নয় ততটুকু পড়া নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে নিচ্ছে বাকিরা।
অর্ষার চিন্তা-ভাবনা অবশ্য আরেকটু ভিন্ন। তার শুধু পাশ নয়; অবশ্যই ভালো একটা রেজাল্ট চাই। একমাত্র ভালো রেজাল্ট, ভালো একটা চাকরীই পারে তাকে মুক্ত, স্বাধীন একটা জীবন দিতে। তাই সে পুরোদমে নিজের পড়াগুলো কমপ্লিট করছে। মাঝেসাঝে আমেনা বেগম আহিল এবং অর্ষার রুমে গিয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। রেণু সময়মতো নাস্তা, চা, পানি এগুলো ঘরেই দিয়ে যাচ্ছে।
পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসে। প্রিপারেশন ভালো হওয়া সত্ত্বেও প্রচুর নার্ভাসনেস কাজ করছে অর্ষার। এটা তো নতুন নয়। প্রতিবারই বোর্ড পরীক্ষার সময় তার এমন অনুভূতি হয়। নার্ভাস থাকলেও প্রথম পরীক্ষাটা বেশ ভালো হয় গ্যাঞ্জাম পার্টির।
এক্সাম শেষে হল থেকে বের হয়ে আশিক তো শার্টের কলার উঁচিয়ে বলে,’মামা! যা পরীক্ষা দিছি এবার বুঝলি? আমারে আর ঠেকায় কে?’
অর্ষা চোখগুলো বড়ো বড়ো করে জিজ্ঞেস করে,’গোল্ডেন আসবে তো?’
আশিক মুখ ঝামটা মেরে ধমকের সুরে বলে,’আমি অর্ষা নাকি? আমি আশিক।’
‘গোল্ডেনের ওপরেও কি আরো ভালো রেজাল্ট আছে?’ জানতে চাইল লামিয়া।
আশিক বলল,’নিচে আছে। আমি বলতে চাইছি, পরীক্ষা ভালো দিছি। আমার পাশ কেউ আটকাইতে পারবে না।’
জুঁই দুম করে ওর পিঠে একটা কিল বসিয়ে বলল,’ধুর! আজাইরা।’
আশিক মিথ্যে চোখ রাঙিয়ে বলল,’দেখ জুঁই, তোর কুইকুই আগে সহ্য করছি। কিন্তু এখন করব না। অন্যের গার্লফ্রেন্ড আমারে টাচ করুক এটা আমার পছন্দ না বুঝছিস?’
জুঁই তো উত্তরে মুখে কিছু বলল না। তবে উরাধুরা আরো কয়েকটা কিল, ঘুষি পিঠে বসিয়ে দিলো। অর্ষা জুঁইকে থামিয়ে বলল,’আহা! বেচারাকে আর মারিস না।’
আশিক কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,’একমাত্র তুই-ই আমাদের ছেলেদের কষ্ট বুঝিস অর্ষা। লাভ ইউ দোস্ত!’
আশিকের এই কথায় আহিল হেসে বলে,’কী বললি? অর্ষা আমাদের কষ্ট বোঝে? হাসালি!’
আহিলের মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল। শেষ হওয়ার পূর্বেই অর্ষার হাতের কয়েক ঘা ওর পিঠে পড়ল। ব্যথায় নাকমুখ কুঁচকে ফেলে সে।
দিদার মিটিমিটি হেসে বলে,’কেন যে মামু সব জায়গায় মুখ খুলতে যাও!’
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]