#যখন_আমি_থাকবোনা
#পর্ব_৩
#লেখক_দিগন্ত
মুক্তি হাতে একটা ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিপ্লবদের বাগানে। বিভিন্নরকম ফুলের ছবি তুলছে। ছোটবেলা থেকেই বেশ প্রকৃতিপ্রেমী সে। ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে পুরো পৃথিবী ভ্রমণ করে দেখবে আর সবকিছু ক্যামেরাবন্দী করবে। ভাগ্যের খেলায় এখন সে এই চৌধুরী বাড়ির বউ। চার দেয়ালে বন্দি থাকতে হচ্ছে সবসময়।
হঠাৎ করে মুক্তি খেয়াল করে কেউ দূরে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে তাকায় পর্যবেক্ষণ করছে। মুক্তি বুঝতে পারে সে কে। মুচকি হেসে বলে,
‘আমার উপর নজরদারি করে কোন লাভ নেই। আমার ডান হাতের খবর আমার বাম হাত জানে না। সেখানে অন্য কেউ আমার ব্যাপারে কিভাবে জানবে?’
মুক্তি ছবি তুললেই ব্যস্ত ছিল। কারো পায়ের শব্দে পিছনে ফিরে তাকাতেই আলেয়া বেগমকে দেখে মুক্তি। আলেয়া বেগম মুক্তিকে এভাবে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে দেখে বেশ খানিকটা অবাক হয়েছেন।
মুক্তি বলে,
-“আমার আসলে ছবি তুলতে খুব ভালো লাগে।”
আলেয়া বেগম কিছু না বলে চলে যান। মুক্তির কেমন যেন লাগে ব্যাপারটা। আলেয়া বেগম এভাবে কেন চলে গেল? হিসাবটা ঠিক মিলাতে পারছে না। আজকাল সবকিছুই মুক্তির কেমন জানি অদ্ভুত লাগে। মুক্তি নিজের ক্যামেরায় একটি ছবি দেখে বলে,
-“তোমার জন্যই তো এতকিছু করছি আমি। তুমি তো আমাকে ছেড়ে চলে গেছ। তোমার অসমাপ্ত কাজ তো আমাকেই সমাপ্ত করতে হবে। তুমি তো বলেছিলে আমায়, যখন আমি থাকবোনা তখন কিন্তু তোকে এসব করতে হবে। আমি তো তাই করছি। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও আমি করব।”
_____________
বিপ্লব রোজ সকালের মতো জগিং করতে বের হয়েছে। আজ সকালে উঠে মুক্তিকে দেখে নি। ব্যাপারটাকে একদম গুরুত্ব দেয়নি সে। এমনিতেও মেয়েটাকে সহ্য হয়না। কেন যে একমাসের জন্য চুক্তি করল। মেয়েটা মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলে যেন ওকে ছাড়া বিপ্লবের চলবেই না। সে যেন বিপ্লবের খুব কাছের কেউ।
বিপ্লব নিজের গলার চেইন থেকে একটা ছবি বের করে। একটা বাচ্চা মেয়ের ছবি। ছবিটা দেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বিপ্লব। ভেতর থেকে অজান্তেই হাহাকার বেরিয়ে আসে। বিপ্লব আহত কন্ঠে বলে,
-“আমি কিন্তু এখনো তোমার অপেক্ষায় আছি বন্ধু। তুমি বলেছিলে তুমি আমার কাছে একদিন ঠিকই ফিরবে। আমি সেইদিনের অপেক্ষায় আছি। তুমি ছাড়া আর কাউকে নিজের মনে ঠাঁই দেবো না আমি। আর ঐ মেয়ে ভাবছে ওকে এক মাসে ভালোবেসে ফেলব। এক মাস তো দূরের কথা সারাজীবন এখানে পড়ে থাকলেও ওর জন্য আমার মনে কোন অনুভূতি তৈরি হবে না। কারণ আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।”
•
মুক্তি স্নেহার রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার কিছু কথা শুনতে পায়। স্নেহা কাউকে যেন বলছে,
-“আজকে রাতেই যা করার করবে। সবকিছু যেন ঠিকঠাক হয়। কোন ভুল কিন্তু আমি পছন্দ করি না।”
বিপরীত দিক থেকে উত্তর আসে,
-“আমি সবকাজ একদম ঠিক ভাবেই করব। কাকপক্ষীতে টের পাওয়ার আগেই খে*ল খতম করে দেব একদম।”
-“গুড। আমি তাহলে এখন রাখছি।”
স্নেহা ফোন রেখে দিয়ে রহস্যজনক হাসে। মুক্তি স্নেহার সেই হাসি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলে,
-“এই হাসি যে আমার খুব চেনা। তাহলে স্নেহা ভাবিই কি সে? যার খোঁজ আমি এতদিন ধরে করছিলাম?”
মুক্তি দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল তখন হঠাৎ আশরাফ চলে আসে৷ মুক্তিতে নিজের রুমের বাইরে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,
-“তুমি এখানে কি করছ?”
মুক্তি ভূত দেখার মতো চমকে যায়। আশরাফ যে এই সময় চলে আসবে সেটা তার একদম ধারণাতেই ছিল না। মুক্তি বলে,
-“এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। আসলে কিছু কাজ ছিল।”
মুক্তি আর সেখানে না দাঁড়িয়ে দ্রুত চলে যায়। আশরাফ ব্যাপারটাকে গুরুত্ব না দিয়ে রুমে প্রবেশ করে। আশরাফকে দেখে স্নেহা কিছু একটা লুকিয়ে রাখে। আশরাফ স্নেহাকে প্রশ্ন করে,
-“কি লুকাচ্ছ আমার থেকে?”
-“আমি কেন কিছু লুকাতে যাব? তুমি নিজের কাজ করো। এমনিতে তো এই রুমে আসো না। হসপিটালেই সারাদিন কা*টিয়ে দাও। তাহলে আজ কোন দুঃখে এলে?”
স্নেহার এমন কথায় আশরাফ রাগান্বিত হয়। অনেক কষ্ট কথা নিজের রাগটাকে দমিয়ে বলে,
-“আমার রুমে আমি কখন আসব, যাব সেটার পারমিশন তোমার থেকে নিতে যাবো না। তুমি আমার জীবনে এসে আমার জীবনটাকে একদম ন*ষ্ট করে দিয়েছ। নিজের রুমে আসতেও ভয় লাগে। তুমি যা ডেঞ্জারাস। কোথায় কি লুকিয়ে রাখ।”
স্নেহা প্রতিত্তোরে বলে,
-“ডেঞ্জারাস জন্যই আজ অব্দি টিকে আছি। নাহলে তো…”
-“নাহলে কি হতো?”
-“কিছু হতো না। আমি আসছি।”
স্নেহা বাইরে চলে যায়। আশরাফ স্নেহার কথাগুলো মনযোগ দিয়ে ভাবতে লাগে। আসলেই মেয়েটাকে ভালোভাবে বোঝা যায় না। কখনো খুব রহস্যময় ব্যবহার করে। বিয়ের পর থেকেই আশরাফ এসব দেখে আসছে।
স্নেহার অতীত সম্পর্কে যদিও বা তার কোন ধারণা নেই। তবুও সে এতটুকু আন্দাজ করতে পারে স্নেহার সাথে এমন কিছু হয়েছিল যার কারণে সে এমন অদ্ভুত ব্যবহার করায়। সে আসলে যেমনটা দেখায় তেমনটা নয়৷ কিন্তু স্নেহা ভালো নাকি খারাপ সেটা বোঝা আশরাফের দ্বারা কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাই সে বোঝার চেষ্টাও করে না।
____________
বিপ্লব অফিসের কাজ শেষে রাতে বাড়িতে ফিরে দেখতে পায় মুক্তি তার জন্য অনেক সুন্দর করে খাবার সাজিয়ে রেখেছে। বিপ্লবের কাছে এসবকিছু আদিখ্যেতা মনে হয়। তাই সে মুক্তির উদ্দ্যেশ্যে বলে,
-“এসব করে আমার মন জয় করতে পারবেন না। এরকম ট্রিকস আমার উপর কাজ করবে না।”
মুক্তি বিনিময়ে হেসে বলে,
-“এটা কোন ট্রিকস নয়। এটাকে কেয়ার বলে।”
-“এসব করে কি প্রমাণ করতে চাইছেন? আপনি খুব কেয়ারিং ওয়াইফ?”
-“প্রমাণ করার কি আছে? আমি তো কেয়ারিং। আপনি আমায় ভালো নাই বাসতে পারেন। কিন্তু এই সত্যটা তো অস্বীকার করতে পারবেন না।”
বিপ্লব কিছু বলে না। কারণ সত্যি মুক্তি খুব কেয়ারিং। এই মেয়েকে দেখে মনেই হয়না সে লন্ডনে বড় হয়েছে। বিপ্লব খাবার খেতে বসে যায়। মুক্তি একটু বাইরে আসে। এনাল ফোন করেছে। ফোনটা রিসিভ করে। এনাল বেশ রাগী গলায় বলে,
-“তুই এভাবে কি করে বিয়েটা করলি? তুই এভাবে ঠকাতে পারলি? ভালোবাসার কোন মূল্য নেই তোর কাছে? আজ ভালোবাসার থেকে তোর উদ্দ্যেশ্যটাই বড় হয়ে গেল?”
মুক্তি বলে,
-“শান্ত হও ভাইয়া। আমার কাছে ভালোবাসার মূল্য আছে। কিন্তু সবার আগে আমার উদ্দ্যেশ্য। তুমি তো জানো যে কত বড় একটা নোংরা স্বীকার হতে হয়েছিল আমায়। এখনো হতে হচ্ছে। আমি চাই এই নোংরা খেলাটা বন্ধ করতে। রাজনীতির এই নোংরা খেলায় কত মানুষের জীবন গেলো। তার মধ্যে আমার বাবাও অন্যতম। আমার মনে হয় না তার মৃত্যুটা স্বাভাবিক।”
এনাল অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করে,
-“ডাক্তারি রিপোর্ট তো তাই বলছে। তাহলে তোর কিসের সন্দেহ? আর কার উপর সন্দেহ?”
-“আমার সন্দেহ মিসেস জামিলার উপর। আমার সৎমা মিসেস জামিলা। মহিলাটাকে বরাবরই আমার সন্দেহজনক মনে হয়।”
এনাল বলে,
-“আমি খোঁজ নিয়ে তোকে বলছি। এরপর থেকে আমাকে না জানিয়ে কিছু করবি না। মনে রাখবি তোর প্রত্যেকটা নিঃশ্বাসের খবর আমাকে দিতে হবে।”
মুক্তি মুচকি হেসে ফোনটা কে*টে দেয়। তারপর বলে,
-“সেটা সম্ভব নয়। কারণ তোমাদের থেকে অনেক কিছুই আমি লুকিয়েছি। তোমরা আমার ব্যাপারে বা এই রহস্যের ব্যাপারে যা জানো সেটা তো সব নয়। আমার রহস্যের শিকর যে অনেক গভীরে লুকায়িত আছে। সেই শিকর পর্যন্ত তোমরা কেউ পৌঁছাতে পারবে না। আর আমি চাইওনা তোমরা পৌঁছাতে পারো।”
দূর থেকে দাঁড়িয়ে কেউ একজন মুক্তির উপর নজর রাখছিল। সে বলছিল,
-“তোমার ব্যাপারে সবকিছু আমি জানি। আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী নাকি শত্রু সেটা বলতে পারবো না। তবে এটা আমি জানি যে আমাদের উদ্দ্যেশ্য অনেকটা একই। তবে পথ আলাদা। তুমি যা করো গোপনে করো আর আমি সরাসরি। কিন্তু তুমি হয়তো জানো না আমি তোমার সব গোপন ব্যাপারে জানি।”
আগন্তুক কথাটা বলে রহস্যজনক হেসে চলে যায়।
(চলবে)