ময়ূখ পর্ব ৭

0
1520

#ময়ূখ
#পর্ব-৭
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

১৯.
‘কিছু বলবে আম্মু?’
‘তোর বাবা তোকে ডাকছে।’

কথাটা শুনে কপালে ভাঁজ ফেলে তাকায় নিভৃত। হঠাৎ তাকে কি প্রয়োজন!
‘যাক অবশেষে আমার কথা মনে হলো তোমাদের। আমি তো ভেবেছি ভুলেই গিয়েছো।’
‘এসব কেমন কথা বাবুই?’
‘ঐ মেয়েটাই তো এখন তোমাদের সব।’
‘এমন বলতে নেই বাবা। ও এখানে নতুন এসেছে। বাবা-মা, বোনদের ছেড়ে থাকাটা কি এতোই সহজ!সারাদিন একা থাকে। এখন আমরাও যদি খারাপ ব্যবহার করি মেয়েটা যাবে কোথায় বাবুই?’
‘বুঝেছি। রুহানির জায়গা দিয়ে দিয়েছো তাকে। তাই না?’
‘তুই ভুল বুঝছিস বাবুই। রুহানির জায়গা কেউ নিতে পারবে? রুহানি আমাদের মেয়ের মতোই ছিল। তাই বলে অন্য একটা মেয়ের প্রতি তো আমরা অন্যায় করতে পারিনা। জীবন তো কারো জন্য থেমে থাকেনা।’
‘আমার যে আছে আম্মু। আমার জীবনটা যে একেবারে পরম স্থির বস্তুর মতো থেমে আছে।’
‘রুহানিকে তো ভুলে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। রুহানি থাকুক তার জায়গায়। মৌনকে কি একটু জায়গা দেওয়া যায়না?’
‘অসম্ভব।’
‘আমার কি মনে জানিস বাবুই?’
‘কি?’
‘তুই একদিন আফসোস করবি। আর সেই আফসোসের মূলে থাকবে মৌন। মৌনকে অবহেলা করার জন্য তুই অনেক আফসোস করবি।’

নিভৃত হো হো করে হেসে উঠে। মিরা রহমান তাকিয়ে থাকেন। ছেলের হাসি দেখে তিনি খুশি হতে পারছেন না। কারণ এটা তাচ্ছিল্যের হাসি।

__________________

‘বাবা, আসবো?’
‘আসো।’

নাজমুল সাহেব বারান্দায় বেতের সোফায় বসে আছেন। তার দৃষ্টি মানি প্ল্যান্ট গাছটার দিকে। সবুজ, হলদে পাতার রং। এঁকেবেঁকে গাছের মূল লতাটা বেড়ে উঠছে। কি সুন্দর আল্লাহর কারুকার্য! প্রকৃতির প্রতিটা জিনিসই সুন্দর।

নিভৃত পাশের সোফায় বসে বাবার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো। সেখানে সে মানি প্ল্যান্ট গাছ ছাড়া আর কিছুই আবিষ্কার করতে পারেনি। তার বাবা এমনই। খামখেয়ালি।

‘বাবা’
‘হুম?’
‘আমাকে ডেকেছিলে?’

মানি প্ল্যান্ট থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নাজমুল সাহেব ছেলের দিকে তাকালেন। বাইরের মিষ্টি রোদ ছেলের মুখে পড়েছে। দেখতে সুদর্শন লাগছে। চোখের নিচে কালোদাগটা কিঞ্চিৎ কমেছে। শরীরটাও একটু রুষ্টপুষ্ট। মনেমনে হাসলেন নাজমুল। স্ত্রীর পছন্দের প্রশংসাও করলেন। মেয়েটার আগমনে ছেলেটা কিঞ্চিৎ হলেও পরিবর্তন হয়েছে।

‘আমরা আগামীকাল ফরিদপুর যাচ্ছি।’
‘তো যাও।’
‘তুমিও আমাদের সাথে যাচ্ছো।’
‘মানে। আমি কেন যাবো?’
‘আলম সবাইকে দাওয়াত করেছে।’
‘তোমার বন্ধু দাওয়াত করেছে তোমরা যাও। আমাকে এর মাঝে টানছো কেন?’
‘দেখো তোমাকে টানতাম না। তবে না টেনেও উপায় নেই। বিয়ের পর মৌন এই প্রথম বাবার বাড়ি যাচ্ছে। এখন সে যদি একা যায় তাহলে গ্রামের লোকে নানান কথা বলবে। আলমের সম্মান ক্ষুণ্ণ হবে। সেই সাথে আমাদের রহমান বাড়িরও।’
‘বাবা, এসব ঝামেলায় কেন আমাকে জড়াচ্ছো। আমি আগেরবার কেবল গিয়েছিলাম মায়ের ওয়াদা রাখতে। কিন্তু এইবার আমি যেতে চাইনা। আমার যে রুহানিকে ছাড়া কোথাও থাকতে ভালোলাগেনা।’
‘তুমি তো রুহানিকে ভালোবাসো তাই না?’
‘তোমার কোনো সন্দেহ আছে?’
‘ভালোবাসার মানুষ দূরে সরে গেলেই যে ভালোবাসা কমে যায় তা কিন্তু নয়। সবসময় মানুষটির স্মৃতি আঁকড়ে বাঁচাটা কি খুব জরুরি? মনের স্মৃতিই হলো আসল। পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় থেকেও প্রিয় মানুষটিকে ভালোবাসা যায়, অনুভব করা যায়।’
‘তুমি কি সত্যিই আমাকে না নিয়ে যাবেনা?’
‘এটা তোমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার। তবে তুমি আমাদের সাথে গেলে আমরা খুশি হতাম।’

নিভৃত বাবার যুক্তির কাছে হার মেনে যেতে রাজি হলো। ছোটবেলা থেকে এমনই হয়ে আসছে। তার বাবা তাকে কখনো বকেনি, ধমক দেয়নি, মারেনি। কোনো ভুল করলে আদর করে কাছে টেনে নিয়ে বুঝাতো।

২০.
বারান্দায় দাঁড়িয়ে টিপটিপ বৃষ্টি দেখতে মগ্ন মৌন। মাঝেমাঝে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়েও স্বচ্ছ বৃষ্টির ফোঁটাগুলো দুহাত পেতে নিচ্ছে। কখনো ছিটিয়ে বাইরে দিচ্ছে আবার কখনো নিজের শরীরে।
নিভৃত বিরক্তি নিয়ে বারান্দায় প্রবেশ করলো। উদ্দেশ্য বেয়াদব মেয়েটার সাথে একদফা ঝগড়া করা।
‘এই মেয়ে।’

নিভৃতের কর্কশ আওয়াজে পিছনে ফিরে তাকায় মৌন। মুখে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির পানি। সামনের ছোট ছোট অবাধ্য চুলগুলো এলোমেলো হয়ে বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে মুখে লেপ্টে আছে। চিবুকের লাল তিলটা যেন বর্ষণের নির্মল ফোঁটায় আকর্ষণীয় হয়ে গেছে কয়েকগুণ। নিভৃত বিরক্তি নিয়ে অনেকটা সময় তাকিয়ে রইলো। মুখটা অনেক মায়াবী আর স্নিগ্ধ। নিজের ভাবনায় নিজের উপর রাগ হয় তার। নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। নিভৃতকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৌন গলা উঁচিয়ে বলে,
‘কিছু বলবেন?’

উচ্চশব্দে ধ্যান ভাঙ্গে নিভৃতের। মেয়েটা তো আচ্ছা বেয়াদব। এভাবে কেউ চেঁচায়! নিভৃতের কান তব্দা লেগে আছে। কিছু সময় আগের মোহ কেটে যায় তার। মাথায় পুরানো ভাবনাগুলো ফিরতেই রাগ উঠে যায়।

‘এই মেয়ে তুমি বাবাকে ফুসলিয়েছো আমাকে ফরিদপুর নিয়ে যেতে?’
‘আমার তো আজাইরা থেকে কাজ নেই যে বাবাকে বলবো আপনাকে নিয়ে যেতে।’
‘এসব কি ভাষা! প্রথমে ভাষা ঠিক করো। দ্বিতীয়ত আমি সিউর তুমিই বাবাকে বলে আমাকে ফাঁসিয়েছো।’

মৌন চোখ ছোট করে তাকিয়ে থাকে। এই লোকটার কি তার সাথে ঝগড়া না করলে হয়না।
‘আরেকটা কথা এমন সং সেজে আমার বন্ধুদের সামনে গিয়েছিলে কেন? বাসায় কি কাজের লোক নেই।’
‘কেন? আমি না এই বাড়ির নতুন কাজের লোক তাহলে আমি নাস্তা নিয়ে গেলে সমস্যা কি?’

মৌনর কন্ঠে কিঞ্চিৎ রাগ, অভিমান। নিভৃত থমকে যায়। জবাব খুঁজে পায়না। প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
‘বের হও তো তুমি। আমার ঘর থেকে বের হও।’
‘যদি বের না হই?’
‘তুমিসহ তোমার চৌদ্দগোষ্ঠী বের হবে?’

নিভৃত তেড়ে এলো মৌনর দিকে। মৌন ভয়ে দৌঁড় দিতে গিয়ে ধপাস করে পড়ে গেলো। ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠেছে মৌন। অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো নিভৃতের দিকে। নিভৃত তাকে উঠানো তো দূরে থাক হো হা করে হাসছে। মৌন রাগে কটকট করছে কেবল। বদলোক!

‘ছোটআফা, হায়হায় আফনে ধপাস করলেন কেমনে?’

জুলেখার কথা শোনে আরো জোরে হেসে দেয় নিভৃত। জুলেখা অবাক চোখে সে হাসি দেখে। প্রায় দেড়বছর পর তার ভাইজানকে এভাবে হাসতে দেখেছে সে।
‘বুঝলি জুলেখা তোর ছোটআফা দৌড়াদৌড়ি খেলছিলো। আহারে বেচারি দৌড়ে জিততেও পারলোনা আবার পড়েও গেলো। আহারে!’

বলতে বলতে বারান্দা থেকে বাইরে বেরিয়ে গেলো নিভৃত। জুলেখা কিছু না বুঝেই নিভৃতের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বললো,
‘জ্বে ভাইজান?’

২১.
‘আসসালামু আলাইকুম ভাবি?’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে?’
‘ওমা, আমায় চিনেন নাই ভাবি?’

মিরা ফোনটা নামিয়ে নাম্বারে চোখ বুলালেন। তিনি সত্যিই চিনতে পারেননি।
‘জ্বি, কে বলছেন?’
‘আমি মহিনের আম্মু।’
‘ওহ্, রুনা ভাবি কেমন আছেন? কত বছর পর ফোন দিলেন।’
‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। একটা দরকারে ফোন দিয়েছিলাম ভাবি।’

মিরার কপালটা খানিক কুঁচকে গেলো। এই রুনা হলো এক অদ্ভুত মহিলা। প্রায় বছর দুয়েক আগে নিভৃতের বিয়েতে কথা হয়েছিল। এরপর আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। হঠাৎ কি দরকার পড়লো?

‘কি দরকার ভাবি?’
‘আসলে ছেলেটার তো বিয়ের বয়স হয়েছে।’
‘মহিনের কথা বলছেন?’
‘হ্যাঁ।’

মিরা যারপরনাই আরো অবাক হলেন। অদ্ভুত তো উনার ছেলের বিয়ের বয়স হয়েছে তাতে তার কি করার আছে।

‘আমি আর মহিনের বাবা একটু আপনাদের বাড়িতে আসতে চাই।’
‘ভাবি আসলে আমরা তো কাল সকালেই ফরিদপুর রওনা দিবো।’
‘ও তাহলে কবে নাগাদ ফিরবেন?’
‘সামনের রবিবারে।’
‘আচ্ছা, তাহলে আমরা রবিবার বিকেলে আসি?’
‘আচ্ছা, আসেন ভাবি। এতো ফর্মালিটির কিছু নেই।’

কিছুক্ষণ কথা বলে কল কেটে দিলেন মিরা। বিষয়টা নিয়ে আর মাথা ঘামালেন না। ফরিদপুর যাওয়ার প্রস্তুতিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

_________________

নিভৃত রীতিমতো বাবার উপর চরম বিরক্ত। এই বেয়াদব মেয়েকে তার গাড়িতে বসিয়ে নিজেরা আগেভাগেই কেটে পড়েছে। গাড়ি ড্রাইভ করছে নিভৃত। মৌন একধ্যানে বাইরে তাকিয়ে আছে। বাতাসে তার লম্বা চুল উড়ে নিভৃতের চোখে মুখে উড়ে আসছে। হঠাৎ গাড়ি থামায় মৌন প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে নিভৃতের দিকে তাকালো। নিভৃত মৌনের কাছে এগিয়ে আসছে। নিভৃতের হঠাৎ এমন কান্ডে মৌন চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলেছে। কিছুসময় পর কিছু অনুভূত না হওয়ায় চোখ মেলে তাকায় সে। নিভৃত নিশ্চিত মনে গাড়ি ড্রাইভ করছে। মৌন জানালার দিকে তাকিয়ে দেখে বন্ধ। এরমানে লোকটা জানালা বন্ধ করেছে!
‘এই আপনি জানালা বন্ধ করলেন কেন?’
‘আমার গাড়ি। আমার ইচ্ছা।’

মৌন রাগীদৃষ্টিতে নীল টি-শার্ট পরিহিত বদলোকটার দিকে তাকিয়ে থাকে। আগবাড়িয়ে কিছু বলেনা সে। যদি গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়!

‘এই মেয়ে চুল বাঁধো। নয়তো কেটে ফেলবো।’
‘এ্যাহ্, বললেই হলো। আমার চুল। আমার ইচ্ছা। হুহ্।’

নিভৃত এই অসহ্য মেয়ের সাথে কথা না বলে গাড়ি ড্রাইভে মন দিলো। মেয়েটা যথেষ্ট ঘাড়ত্যাড়া।

(চলবে)……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here