#মোহমেঘ; পর্ব:-০২
সুহাসিনী
বেশ কিছুক্ষণ পরেও মেয়েটির সাড়াশব্দ না পেয়ে আহির চোখ মেলে তাকায়।
তার সামনে আরোশী দাঁড়িয়ে। ওর হাতে ইলেকট্রিক তার।
-বিদ্যুতের লাইন! এসব কী করবে তুমি?
-তোমাকে বৈদ্যুতিক শক দেবো। তুমি যন্ত্রণায় কাঁতরাবে। আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখবো। কী সুন্দর, তাই না?
-মানে! কীসব আবোলতাবোল কথা বলছো তুমি? আমাকে কারেন্ট শক দিবে মানে? তোমার কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে! প্লিজ, এইসব পাগলামি ছেড়ে আমার হাতের বাধন খুলে দাও তাড়াতাড়ি।
কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাবার পরেও আহির আরোশীর একগেয়েমি ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে পারে, সে সত্যিই আহিরের সাথে কিছু করতে চায়। এইভাবে চুপচাপ বসে থাকলে মেয়েটা নির্ঘাত ভয়ংকর কিছু একটা করে বসবে। কিন্তু তাকে আটকাতে এই মুহুর্তে কী করা উচিত, সেটাই ভেবে পাচ্ছে না আহির। আরোশী ওর কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ বলে ওঠে,
-কিন্তু আমি তো তোমাকে ভালোবাসি। আমার নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি। এরপরেও কেন মারতে চাইছো আমাকে?
আহিরের মুখে ভালোবাসার কথা শুনে মেয়েটা কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ায়। তারপর ওর ঠোঁটের খুব কাছে এগিয়ে বললো,
-এখন আমাকে ভুলানোর জন্য বলছো?
-এমন চিন্তা করলে তোমাকে নিয়ে আমি বিয়ের দিন এভাবে পালিয়ে আসতাম না আরোশী। আমি আরেকটা মেয়েকে ঠকিয়ে তোমাকে ভালোবেসে তোমার হাত ধরে পালিয়েছি। আর সেই আমাকেই তুমি অবিশ্বাস করছো? তোমার হয়েছেটা কী!
আরোশী উত্তর দেয় না। ঝিম ধরে বসে থাকে। জানালার ফাক দিয়ে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ ভেসে আসছে। এক টুকরো চাঁদের আলো ঢোকার চেষ্টাও কম হচ্ছে না। কিন্তু পুরনো জানালার পর্দা, ময়লা ধরা গ্লাস আর মাকড়সার জালের স্তর ভেদ করে সে চেষ্টা যেন অপচেষ্টা হয়েই থেমে যায়। আহির কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আরোশীর দিকে চেয়ে আছে।
৩.
রনজু হাবীব। নিশাতের বাবা। থলথলে ভুড়িটা সামনে মেলে মুখ পাংশুবর্ণ করে বসে আছেন। আহিরের পালিয়ে যাবার খবর গোপন মাধ্যমে তার কাছে এসেছে। অবশ্য মাধ্যমের খবরটা একটু ইতিবাচকভাবেই পেয়েছেন। আহিরকে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ আগে বরের বেশে তাড়াহুড়ো করে বাইরে বের হয়ে গেছে, এখনো ফেরেনি। ঘড়িতে সময় রাত আটটা। এতক্ষণে চলে আসা উচিত। কিন্তু সে আসেনি। আপাতত এই খবরটাই উড়ো হয়ে চলে এসেছে রনজু হাবীবের কাছে। এখন তিনি খবরটা মেয়ের কাছ থেকে চাপা দিবেন নাকি জানিয়ে দিবেন-সেটাই ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছেন না। তার জানামতে, সুন্দরী কন্যা নিশাতকে ছেড়ে পালিয়ে যাবার দুঃসাহস আহিরের নেই। তবুও কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার মন বলে কথা। দীর্ঘ একটি শ্বাস নিয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলেন, নিশাত ঠিক তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটার বুকের ভেতর কেমন ধক করে উঠলো। কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুললেন ঠিকই, কিন্তু একটা আওয়াজও বের হলো না।
নিশাত অত্যন্ত সন্তর্পণে বাবাকে বললো,
-বাবা, অতিথিদের খাইয়ে বিদেয় করে দাও।
রনজু হাবীব চমকে উঠলেন। তার মেয়ে সবটা জেনে গেছে! মেয়ের চোখের দিকে তাকালেই যে অশ্রু নামার খেলা আরম্ভ হবে, সেটুকু আড়াল করতে এই মুহুর্তে কোথায় লুকোবেন তিনি! ছলছল চোখে আবার মেয়ের দিকে তাকালেন। নিশাত বললো,
-আজ আমার বিয়েটা হচ্ছে না বাবা। আহির পালিয়েছে। আমার ধারণা, তুমিও কোনোভাবে জেনে গেছো। তবে মন খারাপ করো না। আহিরের সাথেই আমার বিয়ে হবে।
-তুই বলছিস!
-উঁহু, আমার মন বলছে। আহির ওই মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে না। আমার কাছে ঠিক ফিরে আসবে। এতগুলো দিন যে মানুষটাকে মুহুর্তে মুহুর্তে বুকের ভিতর ঠাঁই দিয়ে আল্পনায় রাঙিয়েছি, সে আমার না হয়ে কোথায় যাবে! পুরুষ মানুষ নিজের মনকে পড়তে পারে না। আর পড়তে পারে না বলেই বুঝতে পারে না যে, সে যা ভাবছে, তার পিঠেও কী আছে। আহিরেরও তাই। আমার এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না। বাবা, আমি একটু আমার বারান্দায় যাই?
-আচ্ছা যা।
-আমার ঘরে কাউকে ঢুকতে দিও না। কেমন?
-আচ্ছা, দেবো না। তুই বিশ্রাম নে।
নিশাত চলে যায়। রনজু হাবীব আগের মতই থ’ মেরে বসে মেয়ের কথাগুলো আরেকবার ব্যবচ্ছেদ করার চেষ্টা করলেন। আহির কী সত্যিই তার মেয়ের কাছে ফিরবে! আর যদি ফেরেই, তবে নিশাতই কী তাকে গ্রহণ করবে? নাহ, অত চিন্তা করে মাথা যন্ত্রণা বাড়াতে পারছেন না। বাড়িতে ভেড়ার পালের মত আত্মীয় গিজগিজ করছে। ভেড়ার পাল ভাবার কারণ-কারো কানে একবার উড়ো কথা ঢুকলে ভেড়ার পালের মতই সবাই সেই একজনের তালে তাল মিলিয়ে গীত গাইবে। যা রীতিমতো অসহ্যকর। আপাতত নিশাতের পরামর্শ অনুযায়ী সবাইকে খাইয়ে দাইয়ে বিদায় জানাতে হবে। কেউ জিজ্ঞেস করলেই সোজাসাপ্টা জবাব-
“আহির আর নিশাতের মাথায় ভূত চেপেছে। দুজনের কেউই আজ বিয়ে করবে না। আত্মীয়দের খাইয়ে – দাইয়ে ওরা বিয়ে করবে নিজেদের মত। অনেক চেষ্টা করলাম মানানোর। কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না। এ যুগের ছেলেমেয়েদের ব্যাপার তো, কখন কোন ফ্যান্টাসি এসে ভর করে!”
অথবা-
“কী বললেন? আহির পালিয়েছে? আরে, কী যে বলেন! ওই যে বললাম না! ফ্যান্টাসি। আমার মেয়ে আগে থেকেই জানতো। ওবাড়িতে কেউ মানছে না দেখে বেচারা বাড়ি ছেড়েছে।”
ব্যস, এইতো। উত্তর প্রস্তুত। পরে যা হবার, হবে। আগে নিজেদের সম্মান।
আর কাল বিলম্ব না করে রনজু হাবীব আতিথ্যয়তা করতে উঠে দাঁড়ালেন। বুকের ভিতর ভয়ংকর ঝড়, অথচ তার সবটাই চাপা দিয়ে কী অদ্ভুতভাবে ছক কষতে হচ্ছে তাকে! পরিস্থিতি এভাবেই মানুষকে নিজের কাছেই নিজেকে জোকার বানিয়ে দেয় তবে।
৪.
আরোশী হঠাৎ নড়েচড়ে উঠলো। আহিরের প্রতি ক্ষোভ তার কমছে না, বরং ওর চেহারা যতই দেখছে, ততই যেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সে বলল,
-তুমি টের পেতে, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তা জানা সত্ত্বেও তুমি নিশাতকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছো। এটাই অপরাধ। আমার সাথে বেঈমানির সাজা তো তোমাকে পেতেই হবে আহির। তুমি বেঈমান, আর বেঈমানদের কখনো ছাড় দিতে নেই। তাই তোমাকে আমি খুন করবো। কীভাবে জানো? এই ইলেকট্রিক শক দিয়ে। আমার সামনে তুমি যন্ত্রণায় কাঁতরাবে, আর আমি উল্লাস করবো। কেন জানো? তোমাকে তো অনুভব করতে হবে-যখন তুমি অন্য মেয়ের কথা ভেবেছিলে, তখন আমার কতটা কষ্ট হয়েছিল। বুঝেছো?
আরোশী ওর দিকে এগিয়ে যায়। তার হাতে ইলেকট্রিক তার। যাকে সে নিদারুণ ভালোবাসায় এতদিন সব অনুভূতি সুপ্ত রেখেছিল, আজ তাকে মারতে ওর এক বিন্দুও ভাবলেশ হচ্ছে না! আহিরের আরেকটু কাছে এগিয়ে গিয়ে সে দেখে, ছেলেটা ভয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। ভয়ে তার চোখ মুখ ঘেমে একাকার, ঠোঁট দুটিও কাঁপছে-ঠিক যেন পাতলা জানানার পর্দার ন্যায়। ওর এই অবস্থা দেখে আরোহীর কিছু একটা খেয়াল হলো। ভাবান্তর না করেই সে টুক করে আহিরের ঠোঁটে লম্বা একটা চুমু বসিয়ে দেয়। আহির চমকে ওঠে। সে কিছু বলতে যাবে, কিন্তু তার আগেই আরোহী হঠাৎ তারটা অন্যপাশে ফেলে আহিরের শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করে।
-আরে, আরে, এসব কী করছো আরোশী? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল?
আরোশী তার দিকে কামার্ত ভঙ্গিতে চেয়ে মৃদুস্বরে জবাব দেয়,
-উঁহু, পাগল আগেই ছিলাম। তোমাকে কী হট লাগছে, জানো তুমি? আমি এখনই তোমাকে মারবো না। প্রথম এবং শেষবারের মত তোমার সাথে আজ আমি শারিরীক সম্পর্ক করবো। তারপর মারবো। তুমি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে মৃত্যুর আগেও যেমন স্পর্শ করবে না, তেমনি পরেও না। আমি তোমার ভালোবাসার শেষ স্মৃতি নিতে চাই আহির।
আহির বুঝতে পারে-এ তার সেই পুরনো বেস্টফ্রেন্ড আরোশী নয়। মেয়েটা সম্পূর্ণই একটা সাইকো। একমাত্র সাইকো’ই পারে, এই অবস্থাতে এমন নোংরা আবদার করে বসতে। কিন্তু এই মুহুর্তে সে কী করবে, কীভাবেই বা তাকে থামাবে! ওর মুখে এসব শোনার পরপরই কেমন যেন গা গুলিয়ে আসছে। আরেকটু হলেই বমি চলে আসবে। আহিরের মাথা কাজ করছে না। আবার চেয়ারের সাথে তার হাতও বাধা! অন্যদিকে আরোশী ইতোমধ্যে তার শার্টের বোতাম খুলে ফেলেছে। কোনো মেয়ের মধ্যেও এমন ভয়ংকর রুপ থাকতে পারে, তা আজ এই মেয়েটিকে না দেখলে কে বিশ্বাস করতো!
আহির হঠাৎ বলে ওঠে,
-আরোশী, ওয়েট এ সেকেন্ড। আজকে কত তারিখ জানো তুমি? ঠিক আজকের এই দিনে কী ঘটেছিল, মনে আছে তোমার?
আরোশী থমকে দাঁড়ায়। একবার আহিরের দিকে, আরেকবার দেওয়ালের দিকে তাকায়।
-কত তারিখ? আর আজ কী হয়েছিল?
–-চলবে—