#মেঘ-মিলন
পর্ব – ৩
লেখকঃ #Ramim_Istiaq
.
দরজায় টোকা পড়ার আওয়াজ পাওয়া যায়।
বন্ধ দরজার ওপাশে কে আছে সেটা বুঝতে পারেনা রামিম।
দরজা খুলে ভিতরে চলে রামিম, আদিরা আর মাহমুদ ভাই আনভিকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকে।
চকলেটে কামড় দিতে দিতে আদিরা বলে,
– আব্বুকে বলো কোথায় কোথায় ঘুরেছো আজ।
বলেই মাহমুদ আর আদিরা মুচকি হাসে।
অপেক্ষায় থাকে রামিম, আনভি বলবে কোথায় ঘুরেছে।
তবে আনভির হাসিমাখা মুখটা হঠাৎই ফ্যাকাসে হয়ে যায়।
কথা বলেনা আনভি, মুড নেই বলার এমন একটা ভাব।
রামিমকে খাবারের প্যাকেটটা হাতে দিয়ে আদিরা বলে,
– আজ আর ঠান্ডা খাবার খেতে হবেনা, এটা খেয়ে নিয়েন রাতে।
রামিম মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
মাহমুদ ভাই দরজার দিকে পা বাড়ায়, সঙ্গ দেয় আদিরা।
দুজনকে বেশ মানিয়েছে, এখানে রামিম কেনো ঝামেলা বাধাবে?
রামিম মনে মনে ঠিক করে নেয়, এমন কিছু সে করবেনা যাতে মাহমুদ আর আদিরা কোনোভাবে কষ্ট পায়।
কদিন গেলেই মেয়েটা বুঝতে শিখে যাবে, তখন আর সমস্যা হবেনা।
বর্ষাকাল চলে এসেছে।
রোজ সন্ধায় বৃষ্টি নামে। সারাদিন ভ্যাঁপসা গরমে সিদ্ধ হয়ে সন্ধায় ঠান্ডা বাতাসে যেনো প্রান জুড়িয়ে যায় রামিমের।
বৃষ্টি রামিমের পছন্দ নয় তবে বৃষ্টির পর ঠান্ডা বাতাসটা ইদানিং ভালো লাগতে শুরু করেছে।
মাহমুদ ছেলেটা ইদানিং ভিষন ব্যস্ত, বিয়ের সব ব্যাবস্থা তাকেই করতে হচ্ছে।
বাবার একমাত্র ছেলে, নিজের বিয়ের কাজও নিজেকেই করতে হচ্ছে তার।
আদিরাকে নিয়ে নাকি তার অভিযোগ বেড়ে গেছে। আদিরা নাকি বিয়ের কোনো কাজ করছেনা, কেনাকাটা করছেনা।
কোথাও যাচ্ছেওনা কারোর সাথে, সবসময় শুধু আনভিকে নিয়ে ব্যস্ত।
মাহমুদ ছেলেটা অকপটে বলে দিলো রামিমকে সব কথা।
নিচে আদিরা, আনভির হাসির আওয়াজ পাওয়া যায়।
খিলখিল করে হাসে আদিরা, বিল্ডিংটা মনে হয় কেঁপে উঠেছে,সাথে রামিমের হ্রদয়ও। কে জানে হয়তো মাহমুদের একই অবস্থা। তবে মাহমুদের হ্রদয় কম্পিত হওয়াটা স্বাভাবিক, রামিমের কেনো কাঁপবে?
আদিরা তো কেউ না রামিমের।
২৩ দিন বাকি বিয়ের, বড় প্রস্তুতি। বড় পরিবারের বড় ছেলের বিয়ে। আত্মিয়-স্বজনের অভাব নেই।
মাহমুদ ছেলেটা ইঙ্গিতে আবারো বুঝিয়ে দেয় – বাসাটা নিজ ইচ্ছায় ছেড়ে দিন রামিম ভাই।
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার পর মাহমুদের আওয়াজ পাওয়া যায়,
– কি এই মেয়েটাকে নিয়ে পড়ে আছো আদিরা? কদিন পর তোমার বিয়ে একটু নিজের ব্যাপারেও ভাবো।
– এরকম রিয়েক্ট করছো কেনো? আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি? বিয়েটা তো তোমাকেই করছি তাইনা?
– হ্যা আমাকেই করছো তবে মনে হচ্ছে মনটা অন্য কাওকে দিয়ে দিয়েছো। বউ মরে যাওয়া লোকটার ঘরে এত কেনো থাকতে হবে তোমার?
চড়ের একটা আওয়াজ পাওয়া যায়। কে কাকে মারলো বুঝতে পারেনা রামিম তবে এবার বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে মাহমুদ ছেলেটা মোটেও আদিরার এই বাসায় আসাটা পছন্দ করছেনা।
নিচে নামেনা রামিম। এই সময়ে নিচে নামলে হয়তো কারো চোখে পানি দেখতে পাওয়া যাবে, কেউবা রাগ লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করবে।
দির্ঘশ্বাস ফেলে আনমনে রামিম বলে উঠে, বাসাটা ছেড়ে দিতে হবে।
কয়েক মিনিট পর নিচে নামে রামিম। তিন্নির মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।
নাহ কোথাও চড়ের কোনো চিহ্ন নেই, না আছে কাঁন্নার ছাপ।
– আদিরা বসুন একটু কথা আছে।
– জ্বি বলুন।
– মাহমুদ ভাইয়ের সাথে ওরকম আচরন করাটা আপনার উচিত হয়নি, মাফ চেয়ে নিবেন আর আনভির কাছে কম আসিয়েন। মেয়েটাও আপনার প্রতি দূর্বল হয়ে যাচ্ছে।
– আর আপনি?
– মানে? বুঝলাম না ঠিক।
– কিছুনা, রান্নাঘরে খাবার রাখা আছে খেয়ে নিয়েন। আমি আসি।
রামিম অবুঝ নয়, আদিরা যে শুধু আনভির জন্য সারাদিন এখানে পড়ে থাকে সেটা যেমন সত্যি তেমনই দিনশেষে রামিমের সাথে কিছুটা কথা বলা, দেখা হওয়ার জন্যও এ বাসায় থাকে আদিরা।
আনভির সাথে রামিমের দুরত্ব তৈরি হচ্ছে, সারাক্ষণ শুধু আম্মু আর আম্মু। দিন শেষে ঠিকমতো কথা বলার সুযোগটাও পায়না রামিম। মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়ে। শুক্রবার বাদে সপ্তাহের বাকি দিনগুলা ঠিকমতো খেয়ালও রাখতে পারেনা রামিম।
মেয়েটা আদিরার কাছে ভালো থাকবে আর আদিরা মাহমুদের কাছে।
যদি তা নাও হয়। আদিরার পরিবার কেনো মানবে একটা বিবাহিত ছেলের কাছে নিজের অবিবাহিত শিক্ষিত সুন্দরী মেয়েটাকে বিয়ে দিতে?
কেনো দুইটা পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট করবে তারা?
দুদিন আদিরা আসেনি আনভির কাছে। মেয়েটা কিছু খাচ্ছেনা, বারবার আদিরার কথা বলছে।
মাসের শেষ আজ। নতুন বাসা দেখা হয়ে গেছে, আগামিকাল চলে যাবে।
দাঁতে দাঁত চেপে মেয়েটাকে রাগ দেখায় রামিম। ভয় পেয়ে, কাঁন্না করে ঘুমিয়ে যায় আনভি।
দিনশেষে আনভি ঘুমালে রামিম একা। মেয়েটাকে কিভাবে বুঝাবে সে এই সম্পর্কটা কেউ মানবেনা।
পরেরদিন,
শুক্রবার। মাহমুদকে ভাড়া দিতে গিয়ে আদিরার কাছে মেয়েকে রেখে যায় রামিম।
বাসার জিনিসপত্র নামানো হয়েছে, গাড়িতে উঠিয়ে নতুন বাসায় নেওয়া হচ্ছে।
এ বাসা থেকে কাছেই, পনের কি আঠারোটা বিল্ডিং পড়েই দোতলা বাসার ওপরের ফ্লাটে।
কাছেই অফিস সেজন্য দুরে বাসা নেয়না রামিম।
মাহমুদ কয়েকবার মিথ্যে আটকানোর চেষ্টা করেছিলো বটে। তবে রামিম সেকথা শোনেনি।
বাসাটা না ছেড়ে দিলে হয়তো কয়েকটা জিবন ভুল পথে পা বাড়াবে।
সবকিছু নিয়ে গোছাতে গোছাতে বিকেল হয়ে যায়।
সন্ধার পর আনভিকে আনতে যায় রামিম। মাহমুদের মা বলে আদিরার সাথে ছাদে গেছে।
পরিচিত বাসায় এই প্রথমবার ছাদে যেতে দ্বিধাবোধ করছে রামিম। এই প্রথমবার মনে হচ্ছে কে কি ভাববে।
আনভিকে ঘুম পাড়িয়ে কোলে নিয়ে হাটছে আদিরা, শেষ সিঁড়িটায় দাড়িয়ে রামিম দেখে ঘুমন্ত আনভিকে কয়েকবার চুম্বন করে আদিরা। হঠাৎ থমকে দাড়ায় মেয়েটা। ছাদে এনার্জি বাল্বের আলোয় কারো ছাঁয়া থেকে দাড়িয়ে পড়ে।
মুখটা পরিষ্কার হতেই জিজ্ঞেস করে,
– কখন এসেছেন?
– এইমাত্র।
– চা খাবেন?
– নাহ, আজ সময় নেই।
– বসুন, আর হয়তো সন্ধার পর এভাবে চা খেতে বলবোনা।
আনভিকে রামিমের কাছে দিয়ে চা বানাতে চলে যায় আদিরা।
মেয়েটার আচরন বেশ ভাবাচ্ছে রামিমকে। তবে শেষ সিদ্ধান্ত এটাই, নিজে থেকে কিছু প্রকাশ করবেনা।
এ সমাজে কেউ মেনে নিবেনা, বরং কটু কথা শুনতে হবে, মান-সম্মানে টান পড়বে।
কয়েকমিনিট পর দু কাপ চা হাতে খুব সাবধানে ছাদে আসে আদিরা।
ছাদের গেটটা লক করে দেয় রামিমকে চা দিয়ে।
– কোন বাসায় উঠলেন?
– মোস্তফা সুফিয়ান।
আদিরা শ্লান হেসে বলে,
– ওই টাকাওয়ালা ভুঁড়িমোটা লোকটা?
– হুম।
– ভাড়া কত?
– ৮ হাজার।
– এখানে ৬ হাজার ছিলো।
– বুয়ার বেতন কত?
– দুজন মিলে ৮৫০০।
– এখানে একজন লাগতো।
– আনভি কার কাছে থাকবে?
– বুয়ার কাছে।
– সে যত্ন নিবে ওর?
– নিবে।
– সন্ধার পর চা বানিয়ে খাওয়াবে আপনাকে?
– বুয়া বিকেলে চলে যাবে।
– এখানেই থেকে যেতে পারতেন।
– কদিন পর আপনার বিয়ে।
– একটা কথা বলবো?
– বলুন।
– আপনি বিয়ে করবেন আমাকে? অন্তত আনভির জন্য হলেও।
মেয়েটার মুখের দিকে তাকায় রামিম।
উত্তরের অপেক্ষায় একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মেয়েটা।
আজ না বললে হয়তো আর কখনো বলা হবেনা।
চলবে?