– ভাই আপনি বাসাটা ছেড়ে দিন, আপনার মেয়েটা আমার হবু বউকে আম্মু বলে ডাকে আর আদিরার ও বেশ পরিবর্তন দেখছি কিছুদিন যাবত। আমি চাইনা কোনো ঝামেলা সৃষ্টি হোক, আপনি বরং নতুন বাসা দেখুন। ১০ দিনের মধ্যে বাসাটা ছেড়ে দিবেন।
বেশ কড়া গলায়ই কথাগুলা বলে চলে গেলো মাহমুদ।
রামিম মাথা নিচু করে শুনলো সব, মেয়েটাকে এতবার বোঝানোর পরও কেনো যে আদিরাকে আম্মু ডাকে সেটা বুঝে উঠতে পারেনা রামিম।
তিন্নির সাথে তো আদিরার কোনো মিল নেই, না চেহারায় না আচরনে আর তিন বছরের মেয়েটাকে কিভাবেই বা বুঝাবে রামিম।
এবার বাসাটা ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
আদিরা মেয়েটাও সুযোগ পেলেই উপরতলায় চলে আসে। আনভিকে নিয়ে তার যত ব্যস্ততা। অথচ কিছুদিন বাদেই তার বিয়ে মাহমুদের সাথে।
মাহমুদ এই বাসার মালিকের ছেলে, একমাত্র ছেলে।
বাবার টাকায় ফুটানি করে বেশ ভালোই কাটছে তার, ভদ্র সহজ সরল আর বেশ অমায়িক ছেলেটা। মাঝে মাঝে রেগে যায় বটে তবে সে রাগ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়না, যাকে বলে অস্থায়ী রাগ।
সোজা কথায় বললে ছেলেটা বেশ ভালো।
তার সাথে বিয়ে যে মেয়েটার তার নাম আদিরা।
স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে, এটা তার ফুপির বাসা। এখানেই থাকে সে। বাবা মা সিলেট থাকে। এসেছিলো ভার্সিটিতে পড়তে তবে পড়ালেখা শেষ হতে না হতেই মাহমুদের মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। হার্টের রুগি তিনি। তিনি বলেছেন ছেলের বিয়ে দিতে।
আদিরাকে ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছেন তিনি।
সুন্দরী, সুশীল, ভদ্র আর পড়ালেখা জানা এমন মেয়ে তিনি আর পাবেন না।
আদিরাও খুশিমনেই বিয়েতে রাজি হয়ে যায়।
মাহমুদ ছেলেটা কোনোদিক দিয়েই খারাপ নয় তবে প্রেম ভালোবাসা কোনোটাই হয়ে উঠেনি মাহমুদের প্রতি। ছেলেটা কেমন যেনো দুরে দুরে থাকে আদিরার থেকে।
তবুও আদিরার আপত্তি নেই।
রামিম, এ বাসার ভাড়াটিয়া। তিনতলা বাসার ওপরের তলায় থাকে সে আর তার মেয়ে।
বয়স ২৯ বছর। এই বয়সে বিয়ে করে বাচ্চার বাবা হয়ে গেছে তবে কষ্টের বিষয় হলো তার বউ( তিন্নি) মারা গেছে বাচ্চা জন্ম দেওয়ার সময়।
বিয়ের আগে প্রেম রামিমও কখনো করেনি তবে তিন্নি মেয়েটাকে প্রচন্ড ভালোবাসতো সে।
মেয়ের নাম আনভি। তিন্নিরই পছন্দ করা নাম। বিয়ের পর দুজন গল্প করতো মেয়েকে নিয়ে যদিও কেউই জানতো না মেয়ে হবে নাকি ছেলে, তবে তিন্নি বেশ জোর গলায়ই বলতো,
– তুমি দেখে নিয়ো আমাদের মেয়েই হবে আর নাম রাখবো আনভি।
মেয়েটা জন্মানোর পর রামিম প্রথম চুমুটা তিন্নির কপালে দিয়েছিলো তারপর বলেছিলো,
তোমার মেয়েই হয়েছে তিন্নি, দেখো আনভি কাঁদছে তুমি উঠবেনা?
কিছুদিন অস্বাভাবিক আচরন করতো রামিম আস্তে আস্তে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
এতদিন বাবা মা এর সাথে থাকলেও চাকরির জন্য রামিম ঢাকা চলে আসে। মেয়েটাকে রেখে আসতে ইচ্ছা হয়না তার, তাই সাথে করেই নিয়ে আসা।
দুমাস হলো এই বাসায় উঠেছে রামিম। এই দুই মাসে পরিচয় হয়েছে অনেক মানুষের সাথে তাদের মধ্যে একজন আদিরা।
মেয়েটা আনভিকে দেখে দৌড়ে আসে, কোলে তুলে নেয় মেয়েটাকে।
রামিম অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে, কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকায় চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তার। আনভি মেয়েটাও সেদিন মা বলে ডেকে উঠে আদিরাকে। আদিরা এমনভাবে চুমু খায় আনভিকে যেনো তার নিজের সন্তান। তিন্নি থাকলেও হয়তো এভাবে আদর করতো।
এরপর থেকে প্রতিদিন আদিরার কাছে আনভিকে রেখে অফিসে যায় রামিম।
বিকেলে অফিস থেকে রামিম ফিরলে আদিরার প্রধান কাজ হয় দুকাপ কফি বানিয়ে আনভি সারাদিন কি কি করলো সেগুলো বলা।
আধো আধো কথা বলতে শেখা আনভির কথাগুলা যেনো আদিরা মুখস্থ করে রাখে। কফির কাপে চুমুক দিয়ে রামিম দেখে মেয়েটাকে।
ভালোলাগে মেয়েটাকে, প্রেমে পড়তে ইচ্ছা হয় রামিমের তবে বিবাবিত পুরুষের প্রেমে পড়া বারণ।
কথা শেষ হলে সারাদিনের বেতন হিসেবে একটা চকলেট নিয়ে বিদায় হয় আদিরা।
আদিরার কাছে আনভিকে রেখে যেনো নিশ্চিন্ত থাকে রামিম।
ঢাকা শহরের বুয়ারা যেমন হয় কে জানে কখন কি হয়ে যায়। হয়তো মেয়েটাকে বসিয়ে রেখে সে টিভি দেখতে ব্যস্ত হয়ে যাবে। ক্ষুদায় মেয়েটা চিৎকার করে কাঁদলে হয়তো কপট রাগ দেখিয়ে চড় থাপ্পড় মেরে বসবে। আদিরার কাছে যতক্ষণ থাকে মেয়েটা হাসিখুশিই থাকে যেনো নিজের মায়ের কাছেই আছে।
ছুটির দিনগুলাতে আদিরা আর রামিমের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় আনভি কার কাছে যাবে। সবসময় আদিরাই জিতে যায়। রামিমের মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় আদিরাকে বিয়ে করতে তবে সে উপায় নেই। সমাজও খারাপ বলবে আর আদিরাই বা কেনো মানবে বিবাহিত একজনকে বিয়ে করতে?
রামিমের চিন্তাভাবনা এবার দ্বিগুণ হয়ে যায়।
নতুন বাসা খুঁজতে হবে, বুয়া লাগবে আবার সবকিছু গোছগাছ করতেও বেশ সময় লেগে যাবে।
সবচেয়ে বড় চিন্তা হলো আনভি, মেয়েটা কি বুয়ার কাছে ভালো থাকবে? নাকি অনাদরে বড় হবে!
ছাদে এসে সিগারেট ধরায় রামিম। ঢাকা শহড়ের বিকেলটাও শান্ত হয়না, কোলাহল আর গাড়ির হর্নের শব্দে অশান্ত থাকে। তিন্নির কথা মনে পড়ে যায় রামিমের, তিন্নি থাকলে এভাবে মেয়েটাকে নিয়ে ভাবতে হতোনা। মেয়েটা বাচ্চা দেখলেই দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নিতো আর নিজের মেয়েকে আদর করার সুযোগটা সে পেলোনা।
দির্ঘশ্বাস ফেলে রামিম। মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় নিজেও মরে যেতে তবে মেয়েটার জন্য মরতে পারেনা।
মেয়েটার কি হবে সেই চিন্তায়।
রামিম খেয়াল করেনি ওপাশে আদিরা দাড়িয়ে আছে।
আধ খাওয়া চায়ের কাপটা রামিমের দিকে এগিয়ে দেয় তিন্নি,
– খাবেন?
রামিম হঠাৎ আদিরাকে দেখায় কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আজ প্রথমবারের মতো তিন্নিকে দেখতে পায় রামিম। কিন্তু কোথায় তো তিন্নির সাথে মিল নেই তবে কেনো আদিরাকে এমন লাগছে তার।
– ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!
ঘোর কাটে রামিমের, আবার আদিরাকে দেখে সে, কই তিন্নি তো নেই!
– আনভি কোথায়?
– ঘুমাচ্ছে।
– মেয়েটা যা দুষ্টু হয়েছে, ওর আম্মু নিশ্চয় খুব দুষ্টামি করতো তাইনা? আপনিতো শান্তশিষ্ট, নিজেকে ব্যক্ত করেন না মন খারাপ থাকলে ছাদে এসে সিগারেট টানেন। মেয়েটা আপনার মতো হয়নি।
গলাটা ধরে যায় রামিমের। উত্তর দেয়,
– তিন্নির মতোই হয়েছে।
– হুম আমিও সেটাই বলছিলাম। আপনাকে একটা সিক্রেট বলি?
– বলুন।
– আপনি সিগারেট খাওয়া না ছাড়লে আনভিকে আমি সিগারেট খাওয়া শিখাবো।
– আপনি কিভাবে শেখাবেন? আপনি নিজে পারেন নাকি?
– হ্যা পারি, দেখবেন?
– দেখান দেখি।
রামিমের আধপোড়া সিগারেটে টান দিতেই কেঁশে উঠে আদিরা।
রামিম হাসি আঁটকাতে পারেনা। আদিরা রামিমকে হাসতে দেখে নিজেও হেসে উঠে।
রামিমের ইচ্ছা হয় মেয়েটাকে ভালোবাসি বলতে।
কেনো জানি সিগারেট খাওয়া এই ঠোঁটে গাঢ় একটা চুমু খেতে ইচ্ছা হয়।
নিজেকে সংযত করে রামিম। বিবাহিত পুরুষের প্রেমে পড়া বারণ।
রামিম দির্ঘশ্বাসটা চেপে রেখে বলে উঠে,
– মাহমুদ ভাই বাসাটা ছেড়ে দিতে বলেছে, ১০ দিন পর নতুন বাসায় উঠতে হবে।
আদিরার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য অপেক্ষা করেনা রামিম।
এখানে থাকা কষ্টকর। মেয়েটার চোখ হয়তো পানিতে ছলছল করবে, রামিমের শ্বাস নেওয়া কষ্ট হয়ে যাবে।
হঠাৎ পেছন থেকে ডাকে আদিরা,
চলবে?
গল্পঃ মেঘ-মিলন
পর্ব – ১
লেখকঃ Ramim_Istiaq