মেঘ-মিলন অন্তীম পর্ব

0
1742

#মেঘ_মিলন
পর্ব – ৫
শেষ পর্ব
লেখকঃ Ramim_Istiaq
.
পরদিন আদিরার সিলেট চলে যাবার কথা কিন্তু যায়নি।
বাবা মায়ের সাথে আদিরা সকালবেলাই রামিমের বাসায় চলে এসেছে।
মেয়ে যার জন্য বিয়ে ভেঙে দিয়েছে তার সাথে দেখা না করে গেলে কি হয়?
অবশ্যই হয়না, কেনো হবে?

ভদ্রলোক চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে রামিমের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
– প্রথম স্ত্রী কিভাবে মারা গেলো?
– বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে।

লোকটা কিছুটা দুঃখিত হলো বলে মনে হলো।
চোখমুখ প্রথমে কঠিন থাকলেও আপাতত কোমল মনে হচ্ছে রামিমের।
আদিরা আনভিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
আদিরার মা পাশে বসে কথা শুনছেন আর খুুঁটিয়ে খুুঁটিয়ে দেখছেন সবকিছু, আজই সব ফয়সালা হবে। শেষবেলা তিনি বলবেন তাই চুপ করে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করেছেন।

ভদ্রলোক বলল,
– তোমাকে কিছু কঠিন কথা বলে চলে যাব।

কঠিন কথা বলবেন বললেন কিন্তু তার চোখে মুখে কাঠিন্য নেই, ঠিক মানাচ্ছে না লোকটাকে।
চোখমুখ শক্ত করে, গম্ভির একটা ভাব নিয়ে কথাটা বললে বেশ মানাতো।
বয়স হয়েছে, মুখের চামড়ায় ঘোঁজ পড়েছে তবুও সৌন্দর্য কমেনি লোকটার।

আদিরাকেও চুপচাপ দেখছে রামিম, যদিও আনভিকে নিয়ে ব্যস্ত তবুও এদিকের কথাবার্তা শোনার ইচ্ছা সে দমিয়ে রাখতে পারছেনা। রাখবে কেনো? তার বিয়ের কথাবার্তাই তো হচ্ছে।
রামিম ঘাবড়ে যাচ্ছে কিছুটা, ঘেমে যাচ্ছে।

লোকটা আবার চায়ের কাপে চুমুক দিলো তারপর আবার বলা শুরু করলো।
মনে হয় এটা তার অভ্যাস। প্রতিবার চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার পরপর একটা করে সিরিয়াস বাক্য নির্গত করবেন।

– আমি তোমার সম্পর্কে শুনেছি, আদিরা বলেছে। কিছুটা বাড়িয়ে বলেছে তবে পঁচানব্বই দশমিক পাঁচ ভাগ সত্য বলেছে। আমি তোমাকে আমার কোনো সিদ্ধান্ত দিবোনা, সবটাই তোমার ওপর নির্ভর করবে। তুমি চাইলে আমার মেয়েকে এখনি তোমার কাছে রেখে যাবো আর না চাইলে নিয়ে যাবো আর কোনোদিন দেখা পাবেনা। তার আগে আমার কিছু কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে এটা আদিরার সিদ্ধান্ত।
– বলুন আমি শুনছি।

রামিম বুঝতে পারছেনা উনি কি বলবেন। তবে এটুকু বুঝতে পারছে এমন কিছু বলবেন যেটাতে রামিম নিশ্চুপ হয়ে যাবে। এত সহজে তো কেউ বলতে পারেনা মেয়েকে রেখে যাবেন, নিশ্চয় কোনো কিন্তু আছে!

ভদ্রলোক চায়ের কাপে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন,

তোমাকে গতকাল আদিরা বলেছিলো সে বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে। কথাটা ও মিথ্যা বলেছে।
রামিম খেয়াল করলো লোকটার গলা কেঁপে উঠলো। আওয়াজ নিচু হয়ে আসলো।
তবুও বলতে শুরু করলো।
ও মিথ্যে বলেছে, বিয়েটা ও ভাঙেনি বিয়েটা মাহমুদ আর তার বাবা ভেঙেছে।
কেনো ভেঙেছে জানতে চাও?

চাই!

ওইযে মেয়েটাকে দেখছো বাচ্চাটাকে নিয়ে খেলতাছে। কত খুশি তাইনা?
ওর ছোটবাচ্চা পছন্দ, কিন্তু কয়েকদিন আগে জানতে পেরেছে ও নাকি আর মা হতে পারবেনা।
কথাটা ও চেপে গেছে ঠিকই তবে মাহমুদের পরিবার জেনে গেছে বিষয়টা! একমাত্র ছেলের বিয়ে এমন মেয়ের সাথে কেনো দিবে? যতই আত্মিয় হোক তার একটামাত্র ছেলে, বাচ্চাকাচ্চা না হলেতো এখানেই বংশ নির্মুল। তুমি হলেও নিশ্চই এই সিদ্ধান্তটাই নিতে?

জ্বি নিতাম।

মানুষ সুযোগসন্ধানী, আমিও। আমার মেয়েটার কোনো ভালো যায়গায় বিয়ে হবেনা, কোনো বাবাই চাইবেনা তার ছেলে এমন কাওকে বিয়ে করুক যে কখনো মা হতে পারবেনা। যেমনটা আমি চাইনি আমার মেয়ের বিয়েটা কোনো বিবাহিত ছেলের সাথে হোক। যদিও তোমার বয়স অল্প তবুও চাইনি। এখন চাচ্ছি কেনো জানো?

জানি।

বলো কেনো?

আমার চাইতে ভালো ছেলে পাবেন না তাই।

ঠিক ধরেছ! ভদ্র শিক্ষিত অল্পবয়সী আর এমন সুদর্শন ছেলে আমি পাবোনা তাছাড়া আমার মেয়েটাও তোমাকে ভালোবাসে তবে তোমার চাইতে তোমার মেয়েটাকে বেশি ভালোবাসে।
আমি আমার কথা বললাম এবার তুমি তোমার উত্তর জানিয়ে দাও!

রামিমের এবার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
মেয়েটা মা হতে পারবেনা এটা কি খুব বড় কারন? ভালোবাসার চাইতেও বড়?
কয়েকমিনিট চিন্তাভাবনা করার পর রামিম উত্তর দিলো,
– আদিরাকে নিয়ে আপনি চলে যান! আমি বিয়েটা করতে পারবোনা।

চশমাটা ঠিক করে চায়ের কাপে শেষ একটা চুমুক দিয়ে ভদ্রলোক উঠে গেলেন।
আদিরার মা বিশেষ কিছু বললোনা শুধু ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো।
আদিরার দিকে তাকিয়ে রামিম দেখলো।
হাস্যজ্জ্বল মুখটা ইতিমধ্যে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে, চোঁখের কোনে অশ্রুবিন্দু জমা হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে অশ্রু গড়িয়ে পড়বে গাল বেয়ে! ঠোঁটের কাছে এসে থেমে যাবে।
আদিরা দাড়ালোনা!
সে চায়না রামিম দেখুক!

কিছু সিদ্ধান্ত খুব তারাতারি নিতে হয়! জিবন থেকে অনেককিছু হারিয়ে যায়,অনেক প্রিয়জন,অনেক প্রিয় জিনিস। অনেকসময় ভালোবাসাও তবুও নিতে হয়! না নিয়ে উপায় কোথায়?
তবে রামিম কি ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা অজানা।
হয়তো আদিরা মা হতে পারবেনা সেই চিন্তায়!

ঘন্টাখানেক পর আনভিকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে রামিম।
আনভি খাবেনা, তার মা লাগবে!
সে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে মা এনে দিতে হবে!
আনভি ভুলে গেছে তার আসল মা কে!
সে জানে আদিরাই তার মা। এতদিন আবদার না করলেও ইদানিং কিছুটা বুঝতে শুরু করেছে!
– মাকে এনে দাও নইলে খাবোনা। কখনো না।

রামিম ভাবনা থেকে জেগে উঠে। এটাই কি করার ছিলো? মেয়েটা এতটা ভালোবাসতো আনভিকে! পরিবারটাকে নিজের মনে করেই মাসের পর মাস মেয়েটাকে আগলে রেখেছে সে।
আজ একটা ক্ষুদ্র কারনে মেয়েটাকে সারা জিবনের জন্য দুরে সরিয়ে দিলো সে?

কল দিলো রামিম, ফোন বন্ধ।
মেয়েকে নিয়ে রওনা দিলো কমলাপুর রেলস্টেশনে।
গুলিস্তান পৌঁছাতে পৌঁছাতে আরো বিশ মিনিট। সেখান থেকে রিক্সা নিয়ে আরো দশ মিনিট।

দেড়ঘন্টা কেটে গেছে। এতক্ষণে ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার কথা।
হ্যা ট্রেন আরো পনেরমিনিট আগেই ছেড়ে গেছে।
এতক্ষণ দৌড়াদৌড়িতে শরীর ঠান্ডা থাকলেও এখন ঘামতে শুরু করেছে।
রামিম স্পষ্ট আনভির চোখে পানি দেখতে পায়। মেয়েটা কাঁদছে।
তার কি এতটাও বোঝার ক্ষমতা হয়েছে যে সে কাঁদবে?

রামিম শুন্য হাতে রিক্সায় উঠে। এটাই হবার ছিলো। কেনো যে তখন না বললো। একটা ভুল সিদ্ধান্ত সারাজিবন হয়তো কাঁদাবে রামিমকে।

অন্যমনস্ক রামিম রিক্সায় উঠে বসলো।
চোখ লাল হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। এত মানুষের সামনে কাঁদা যাবেনা সে বড় হয়েছে।

– ওদিকে চেপে বসুন।

রামিম ঘাবড়ে যায়!
আদিরার কন্ঠ!
আবারো শুনতে পায় রামিম,
– বললাম না ওদিকে চেপে বসুন।

ঝাপসা চোখ পরিষ্কার হয় রামিমের। সত্যিই আদিরা সামনে দাড়িয়ে।
– আপনি কি ভেবেছেন আমি চলে যাবো? ভালোবাসি আপনাকে আর আনভিকে। মা না হতে পারার মিথ্যে নাটকটা আমিই সাজিয়েছি কার জন্য জানেন? শুধুমাত্র আপনার আর আনভির জন্য। আমার বাবা সুযোগসন্ধানী মানুষ! তিনি জিবনেও আপনার সাথে আমার বিয়ে দিতোনা।
এখন দিবেন।

রামিমের মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। সহজ সরল এই মেয়েটার মাথায় এত প্যাচ কোথা থেকে আসলো? রামিম নিজেও বুঝতে পারেনি এতবড় একটা মিথ্যা আদিরা বলতে পারবে।
স্বপ্ন মনে হচ্ছে সবকিছু।

আদিরা আবারো বলে,
– কাজি অফিস চলুন।

রিক্সা কাজি অফিসে থামে। বিয়ে হয়। রামিমের ঘোর এখনো কাটেনি।
আদিরা মুচকি হাসছে! রামিম মেয়েটার বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারেনা।

আনভি ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুম ভাঙলে মাকে পেয়ে নিশ্চয় আনন্দে লাফিয়ে উঠবে।

বাসায় ঢুকার আগে মাহমুদের সাথে দেখা রামিমের।
ছেলেটার হাস্যজ্জ্বল মুখটাতে কাঠিন্য ভাব চলে এসেছে।
রামিম ডাক দেয়,
– মাহমুদ ভাই, আজ বাসায় বিরিয়ানি রান্না হবে, খেতে আসবেন।

রাতে বৃষ্টি নামে। মাহমুদ বিরিয়ানি খেতে আসেনা। বিরিয়ানি আজ হজম হবেনা তার, আজ সে সারারাত সিগারেট ফুঁকবে।

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here