মেঘের_অন্তরালে অন্তিম পর্ব

0
1137

#মেঘের_অন্তরালে
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
অন্তিম পর্ব

চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে ইসরা। অপারেশন থিয়েটার থেকে কেবলই বেড়িয়ে ফ্রেশ হয়ে চেয়ারে এসে বসলো। মাত্র সাত বছরের একটা বাচ্চার অপারেশন ছিলো কিন্তু অপারেশনের মাঝেই মারা গেছে বাচ্চাটা। যদিও ইসরা অপারেশন করেনি, সে শুধু সাথে ছিলো তবু খুব খারাপ লাগছে তার। বাচ্চাটা জীবনের মানে বুঝার আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলো, নিয়তি খুব নিষ্ঠুর। বাচ্চাটার মায়ের কান্না এখনো ভাসছে ইসরার কানে। ফোনের শব্দে বিরক্ত হয়ে তাকালো ইসরা, স্কিনে তাকিয়ে মায়ের নাম্বার দেখে রিসিভ করলো।

রিসিভ করে বললো, আসসালামু আলাইকুম মা। কী হয়েছে, কোনো সমস্যা ?

পারভীন বেগম গলা পরিষ্কার করে বললো, তুই একটু তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আয়।

ইসরা চিন্তিত হয়ে বললো, কী হয়েছে মা ? ইমন ঠিক আছে তো ?

আরে ব্যস্ত হওয়ার মতো কিছু না, সবাই ঠিক আছে। একটু প্রয়োজন আছে তাই বললাম তাড়াতাড়ি চলে আয়।

ইসরা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, আচ্ছা ঠিক আছে। এখন রাখছি, আসসালামু আলাইকুম।

ইসরা কল কেটে দিয়ে আবার আগের মতো বসলো। আয়মানের সাথে দেখা হওয়ার দুদিন আজ। এই দুদিনে ইসরা কোনো খোঁজ পায়নি তার। যেনো হঠাৎ করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ইসরা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলো।

বিকেলে বাড়ি ফিরে কলিং বেল বাজিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো ইসরা। আরো একবার বেল বাজানোর আগেই দরজা খোলে গেলো।

ইসরা সামনে না তাকিয়েই বললো, মা এতো সময় কেনো লাগলো দরজা খুলতে ?

কথাটা শেষ করে সামনে তাকিয়ে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো ইসরা।

থেমে থেমে বললো, আপনি ?

আয়মান দু পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে বললো, হুম আমি, আজ তোমাকে দেওয়া পনেরো দিনের, শেষ দিন।

কিন্তু আমি তো দুদিন আগেই আপনাকে উত্তর দিয়ে দিয়েছি।

তুমি তোমার উত্তর জানিয়েছো কিন্তু আমি তো তোমাকে আমার সিদ্ধান্ত জানায়নি।

ইসরা কিছু বলবে তার আগেই ইসরার মা বললো, চলে এসেছিস ?

ইসরা একবার নিজের মায়ের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার আয়মানের দিকে। আয়মান সামনে থেকে সরে দাঁড়ালে ইসরা ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। ভেতরে যেতেই ড্রয়িংরুমে বসা এক ভদ্র মহিলাকে দেখতে পেলো। সে ইসরার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাঁসলো। বুঝতে বাকি রইলো না উনি আয়মানের ফুপি। ইসরা ভাবতে পারছে না আয়মান এভাবে বাসায় চলে আসবে। ইসরা আয়মানের ফুপিকে নিচু আওয়াজে সালাম দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। রুমে গিয়ে বসতেই কোথা থেকে ইমন চলে এলো।

আপু আজকে আমি খুব খুশি /লেখনীতে তাহমিনা তমা/

ইসরা ইমনের দিকে না তাকিয়েই বললো, কেনো ?

ইমন ইসরার পাশে ধপ করে বসে পড়ে বললো, আয়মান ভাইয়াকে আমার খুব পছন্দ। তাকে দুলাভাই হিসাবে পাবো, ভাবতেই নাচতে ইচ্ছে করছে আমার।

ইসরা কিছু না বলে তাকিয়ে রইলো ইমনের দিকে। পারভীন বেগম ইমনকে ডাকতেই সে বের হয়ে গেলো।

একটু পর পারভীন বেগম রুমে এসে বললো, তাড়াতাড়ি শাওয়ার নিয়ে এসে রেডি হয়ে নে। আয়মানের ফুপি সেই কখন থেকে তোর জন্য বসে আছে।

ইসরা অবাক হয়ে বললো, মা তোমার কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে ?

পারভীন বেগম ভ্রু কুঁচকে বললো, মাথা কেনো খারাপ হবে ?

তাহলে উনারা কেনো এসেছেন এখানে ?

আয়মান আর তুই একে অপরকে ভালোবাসিস। আয়মানের ফুপি চাইছে বিয়েটা হয়ে যাক, সেসব নিয়ে কথা বলতেই তো এসেছে।

মায়ের কথা শুনে ইসরার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো।

ইসরা নিজেকে সামলে বললো, আমরা একে অপরকে ভালোবাসি এটা তোমাকে কে বললো ?

কেনো, আয়মান তো বললো।/লেখনীতে তাহমিনা তমা /

ইসরা ভেঙে ভেঙে বললো, কবে বলেছে ?

দুদিন আগেই তো এসেছিলো, তুই হসপিটালে চলে যাওয়ার পর। তুই নাকি বলে উঠতে পারছিলি না, তাই আয়মান বলে গেছে।

ইসরার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো৷ এবার ভালো করে বুঝতে পারছে সেদিন আয়মানের রহস্যময় হাসির পেছনের রহস্য। ইসরা এটা কল্পনাও করতে পারেনি।

পারভীন বেগম ইসরার মাথায় হাত রেখে বললো, ছেলেটা খুব ভালো রে মা, তুই ওকে বকিস না। আমাকে বলেছে আন্টি আমি এসেছিলাম এটা ইশুকে বলবেন না। তাহলে আমার সাথে রাগ করবে। আর এটাও বলেছে তুই নাকি আমার আর ইমনের কথা চিন্তা করে বিয়ে করতে রাজি হতে চাইছিস না। তুই আমাদের নিয়ে চিন্তা করিস না। আয়মান কথা দিয়েছে তুই এখন যেমন আমাদের দেখাশোনা করিস বিয়ের পর শুধু তুই একা না আয়মানও আমার আরেক ছেলের মতো আমাদের পাশে দাঁড়াবে। তোর আর আমাদের মাঝে কোনো বাঁধা হবে না।

ইসরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। আয়মান তার আড়ালে এতোকিছু করে ফেলেছে আর সে কিছুই টের পায়নি।

ইসরা গড়িয়ে যাওয়া চোখের পানিটা মুছে নিয়ে বললো, এতোকিছু বলেছে যখন তাহলে নিশ্চয়ই এটাও বলেছে নিহান রেজওয়ানের ভাই সে।

পারভীন বেগম দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে পাশে বসে বললো, হুম এটাও বলেছে। তবে তুই ভালো থাকলেই আমি খুশি। ভালো থাকার কারণটা কে হলো সেটা দেখতে চাই না। শুধু এটা বলবো তুই একদম খাঁটি সোনা খোঁজে পেয়েছিস।

ইসরা মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, একদিনের পরিচয়ে এতটা আত্মবিশ্বাসের সাথে কী করে বলছো ? একই রক্ত বইছে তাদের শরীরে।

পারভীন বেগম বললো, এক মায়ের পেটে জন্ম নিয়ে এক ভাই হয় পুলিশ তো আর এক ভাই খুনী। এক ভাই হয় আলেম আবার অন্যজন মসজিদের ধারে কাছে ঘেঁষে না। যেখানে এক মায়ের পেটের সব সন্তান একরকম হয় না, সেখানে এক পরিবারের ছেলে একরকম হবে। এটা কেনো ভাববো আমি ? আমার বিশ্বাস আয়মান তোকে সুখেই রাখবে। তোর বাবা তো তোকে সুখী দেখে যেতে পারলো না, আল্লাহ হয়তো আমার ভাগ্যে সেটা রেখেছে।

পারভীন বেগম বের হয়ে গেলো রুম থেকে। ইসরা দোটানায় ভুগছে, কোনদিকে যাবে এখন। আয়মান অনেকটা এগিয়ে এসেছে এখন ইসরার পক্ষে পিছিয়ে যাওয়াটা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এগিয়ে যেতে ভয় হচ্ছে মা আর ভাইয়ের কথা ভেবে। দরজায় ঠকঠক আওয়াজ পেয়ে সেদিকে তাকালো ইসরা। হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়মান আর ঠোঁটে তার বাঁকা হাসি।

ইসরা কিছুটা রেগে বললো, আমি কখন বললাম আপনাকে ভালোবাসি আমি।

আয়মান সোজা হয় নিজের শার্টটা টেনে ঠিক করে ইসরার দিকে এগিয়ে গেলো। ইসরা আয়মানকে দেখে উঠে দাঁড়িয়েছে আর আয়মান ইসরাকে পাশ কাটিয়ে বেডে বসে পড়লো পায়ের উপর পা তুলে।

বেশ আয়েশ করে বসে বললো, ভালো না বাসলে ওভাবে জড়িয়ে ধরার মেয়ে নও তুমি। এতটুকু তোমাকে আমি চিনেছি।

ইসরা কী বলবে খোঁজে পাচ্ছে না। চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো ইসরা। আয়মান উঠে ইসরার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ইসরা আয়মানের দিকে তাকালো।

আয়মান ইসরার দুগাল ধরে বললো, কেনো এতো ভয় পাচ্ছো ? সাহস করে একবার হাতট ধরে দেখো। ইনশাআল্লাহ কখনো তোমাকে এক বিন্দু কষ্ট পেতে দিবো না। মা ভাইয়ের কথা ভাবছো ? আমার পুরো পরিবার থেকেও নেই। তোমার মা আর ভাইকে নিজের মা ভাইয়ের যত্নে রাখবো কথা দিলাম। বিনিময়ে শুধু তোমার ভালোবাসা চাই।

ইসরা কী হলো সে নিজেও জানে না। আয়মানের চোখে ভরসা খোঁজে পেলো, নিজের জন্য ভালোবাসা খোঁজে পেলো।

চোখ বন্ধ করে বললো, আমি রাজি।

আয়মানের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফোটে উঠলো। সে পেরেছে ভালোবাসা দিয়ে ইসরাকে জয় করতে, জোর করে নয়।/লেখনীতে তাহমিনা তমা /

৩৩.
চারদিকে সাদা কাশফুলের বাহার জানিয়ে দিচ্ছে শরৎ এসে গেছে। প্রকৃতি সেজেছ নতুন রঙে, নতুন রুপে। তবে রেজওয়ান পরিবারে নেমেছে শোকের ছায়া। আকরাম রেজওয়ান হসপিটালে ভর্তি, অবস্থা খুবই খারাপ। তিনি নিজের শেষ ইচ্ছে হিসাবে আয়মানের সাথে দেখা করতে চেয়েছেন। তাকে খবর দেওয়া হয়েছে, কে জানে অভিমানের পাহাড় ঠেলে আদৌও সে আসবে কিনা।

সাত বছরের মেয়ের পাশে এক বছরের ছেলেকে কোলে নিয়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে আছে ইসরা। পাঁচ বছর পর আবার নিজের দেশের মাটিতে পা রেখে আলাদা শান্তি লাগছে তার। আয়মান তাদের দাঁড় করিয়ে রেখে কোথায় চলে গেছে। আয়মানের সাথে বিয়ের পর পাসপোর্ট করতে যতটা সময় লেগেছিলো ততদিন বাংলাদেশে ছিলো ইসরা। ইমনের এইচএসসি রেজাল্টের পর তাকে আর পারভীন বেগমকেও নিয়ে গিয়েছিলো আয়মান। যদিও পারভীন বেগম যেতে চাইনি কিন্তু তাকে বাংলাদেশে একা রাখতে রাজি হয়নি কেউ। বিয়ের তিন বছর পর ঘর আলো করে জন্ম হয় মেয়ে আইরাতের। কিন্তু তার দু’বছর পরেই ইসরা হারিয়ে ফেলে নিজের মাকে। পারভীন বেগম সবসময় বলতেন তাকে যেনো গ্রামে ইখতিয়ার আহমেদের কবরের পাশেই কবর দেওয়া হয়। সেবার মায়ের কথা রাখতেই বাংলাদেশে আসা হয়েছিলো। আজ আবার পাঁচবছর পর আসা হলো, তবু দুঃসংবাদ শুনে। পুরনো কথা ভেবে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো ইসরা। ইমনও পড়াশোনা শেষ করে চাকরি নিয়ে ইউএস সেটেল্ড হয়ে গেছে। বিয়েও করেছে মাত্র দুমাস আগে।

ইসরার ভাবনার মাঝেই আয়মান হন্তদন্ত হয়ে এসে বললো, সরি সরি তোমাদের দাঁড় করিয়ে রেখেছি।

বাবা গাড়ি পেয়েছো ?

আয়মান মুচকি হেসে বললো, তোমার দাদুনের বাসা থেকে ড্রাইভার এসেছে।

ইসরা বললো, কোথায় যাচ্ছি এখন আমরা ?

আয়মান লাগেজ ধরে বললো, আগে ফুপির বাসায় যাবো তারপর হসপিটালে।

ইসরা কিছু বলতে চেয়েও বললো না। এতো বছরেও আয়মানের রাগ কমেনি তার পরিবারের উপর। তারা যোগাযোগ করতে চাইলেও আয়মান করেনি। কিন্তু এবার আরিয়ানার থেকে আকরাম রেজওয়ানের অসুস্থতার কথা শুনে আর থাকতে পারেনি।

আয়মান একহাতে লাগেজ ধরে অন্যহাত ছেলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, আয়াত বাবা আমার কাছে এসো এবার। মায়ের হাত ব্যাথা করছে।

ইসরা ছেলেকে একটু ভালো করে ধরে বললো, না না ঠিক আছে। আপনি চলুন ও আমার কাছেই থাক, আপনি বরং আইরাতের হাত ধরে নিয়ে চলুন, নতুন জায়গা তো।

আয়মান কথা না বাড়িয়ে ইসরার কথা মতো কাজ করতে লাগলো৷ আগে আরিয়ানার বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তারপর হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেলো। আরিয়ানা এসেছে দুদিন আগেই। সেও হসপিটালেই আছে এখন। আয়াত ঘুমিয়ে পড়েছে তাকে কোলে রাখতে বেশ কষ্টই হচ্ছে ইসরার। আয়মান বেশ কয়েকবার নিতে চাইলেও ইসরা দিলো না তবু। করিডোরে যেতেই একে একে বাড়ির সবাইকে চোখে পড়লো ইসরার। সতেরো বছর কম সময় নয়। আজ সতেরো বছর পর ইসরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে রেজওয়ান পরিবারের। বিয়ের পরও আয়মান ইসরাকে নিয়ে রেজওয়ান বাড়িতে যায়নি। সতেরো বছরে সব কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। সেদিন ইসরা ছিলো সদ্যো আঠারো বছরে পা রাখা অসহায় একটা মেয়ে। আর আজকের পয়ত্রিশ বছর বয়সী ইসরা সফল একজন ডাক্তার, দুজন সন্তানের আদর্শ মা আর একজনের ভালোবাসার স্ত্রী। আজ ইসরাকে একটা কথা বলতে গেলে দশবার ভাবতে হয়। আয়মান তাকে আরো পড়ালেখা করিয়ে আজকের জায়গায় দাঁড় করিয়েছে।

মিষ্টি একটা মেয়ে ইসরার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, ছোট মা ?

ইসরা তাকালো মেয়েটার দিকে। নিহানের সাথে মেয়েটার চেহারায় মিল থাকলেও গায়ের রঙে একদমই নেই।

ইসরা চিনতে না পেরে আয়মানের দিকে তাকালে আয়মান ইশারায় বুঝালো নিহানের মেয়ে। সেদিন নিশিতাকে দেখে মায়া জন্মেছিল আয়মানের মনে। নিশিতা একটু বড় হলে বাড়ির সবার মতো সেও চেষ্টা করেছিলো আয়মানের সাথে যোগাযোগ করার। আয়মান এড়িয়ে যেতে পারেনি মেয়েটাকে। তবে শর্ত দিয়েছিলো কাউকে জানানো যাবে না। আয়মানের কথা মেনে নেয় নিশিতা। ইসরাকেও কিছু জানায়নি আয়মান, সেটা ভেবে খানিকটা রাগ হলো ইসরার ৷ তবে প্রকাশ করলো না। নিশিতা ইসরার কোল থেকে ঘুমন্ত আয়াতকে কোলে তুলে নিলো। ইসরা আর আয়মান গেলো আকরাম রেজওয়ানের সাথে দেখা করতে। আয়মান একটা চেয়ার টেনে বসলো আর ইসরা পাশে দাঁড়িয়ে রইলো।

আয়মান ধীর আওয়াজে ডেকে বললো, বড় আব্বু ?

মিটিমিটি চোখে তাকালো আকরাম রেজওয়ান। তবে বেশ খানিকটা সময় লাগলো আয়মানকে চিনতে। যখন চিনতে পারলো ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে উঠলো। কাঁপা হাত আয়মানের দিকে এগিয়ে দিতেই আয়মান হাতটা ধরে ফেললো।

আকরাম রেজওয়ান কাঁপা গলায় বললো, আমাকে মাফ করে দে বাবা। তোর সাথে অনেক অন্যায় করে ফেলেছি আমি। আমিরকে একবারও বলিনি নিশানও এই বাড়ির ছেলে। সে কেনো বাড়ি ছেড়ে যাবে। তুই চলে যাওয়ার পর তোর খোঁজ পর্যন্ত নেইনি। যখন নিজের ভুল বুঝতে পারলাম তখন তুই আমাদের থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলি।

আয়মান শক্ত করে হাতটা ধরে বললো, এসব কথা এখন থাক না বড় আব্বু। /লেখনীতে তাহমিনা তমা /

আজ না বললে আর হয়তো বলার সুযোগ হবে না।

ইসরার দিকে তাকিয়ে বললো, মা রে তোর সাথেও অন্যায় করেছি, পারলে মাফ করে দিস।

আকরাম রেজওয়ান নানা কথা বলতে লাগলেন আয়মান আর ইসরা চুপচাপ শুনে যাচ্ছে। ইসরা নার্সের থেকে আকরাম রেজওয়ানের সব রিপোর্ট নিয়ে ভালো করে দেখলো। ফুসফুসে ক্যান্সার হয়েছে, সব হাতের বাইরে চলে গেছে আর কিছুই করার নেই।

নিহান হসপিটালের করিডোরে আসতেই নিশিতার কোলে ছোট বাচ্চা দেখে এগিয়ে গেলো। দেখে মনে হচ্ছে এক টুকরো চাঁদ।

নিহান আলতো করে গালে হাত রেখে বললো, এটা কে নিশি ?

ছোট আব্বুর ছেলে আর আমার ভাই আয়াত রেজওয়ান।

নিহান চমকে উঠলো নিশিতার কথায়। অবিশ্বাসের চোখে তাকালো নিশিতার দিকে।

কাঁপা গলায় বললো, নিশান এসেছে ?

নিশিতা মুচকি হেঁসে বললো, হুম দাদু ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেছে।

হঠাৎ কোথা থেকে আইরাত এসে বললো, আপু ভাইকে এবার আমার কাছে দাও। মা একদমই নিতে দেয় না আমাকে, বলে আমি নাকি ফেলে দিবো। তুমি বলো আমি আমার ভাইকে ফেলে দিতে পারি ?

নিহান আইরাতের দিকে তাকিয়ে আবার নিশিতার দিকে তাকালো। আইরাতকেও চিনতে পারেনি নিহান।

নিশিতা বললো, আয়াতের বোন আইরাত।

নিহান স্তব্ধ হয়ে গেলো নিশিতার কথা শুনে। ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইলো আইরাত আর আয়াতের দিকে। আইরাতের গায়ের রঙ অনেকটা সাদা গোলাপি আর আয়াতের গায়ের রং আয়মানের মতো উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। দেখতে দুজনেই অনেক কিউট। নিহানের বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে আঠারো বছর বয়সী সেই ইসরা আর আজকের নামকরা নিউরোসার্জন ইসরার মধ্যে তফাত কতটা। তার ফেলে দেওয়া পাথরটাকে নিশান কতো সুন্দর করে একটা দামী ভাস্কর্য তৈরি করেছে। নিহানের চিন্তার মাঝেই বের হয়ে এলো আয়মান আর ইসরা। গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি গায়ে জড়ানো এক রমণীকে দেখা যাচ্ছে আয়মানের পাশে। তবে মুখটা দেখার উপায় নেই, কারণ মুখে মাস্ক পড়া। তারা বাইরে আসতেই বাড়ির সকলে একে একে কথা বলতে লাগলো আর ক্ষমা চাইতে লাগলো। আয়মানের বাবা মা ইসরার মাথায় হাত রেখে দোয়া করলো। নিজের নাতি নাতনি দুজনকেই কাছে টেনে নিলো। দূরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখতে লাগলো নিহান। যেনো অদৃশ্য দেয়াল তাকে সামনে এগিয়ে যেতে বাঁধা দিচ্ছে। এতক্ষণে ইসরার চোখ গেলো নিহানের দিকে, চুলে পাক ধরেছে, বয়সের ছাপ পড়ে গেছে, বয়সের তুলনায় একটু বেশি বয়স্ক লাগছে।

কী হলো দাঁড়িয়ে রইলে কেনো ?

নিহানের পাশে এসে দাঁড়ানো রমনীকে দেখে একটু চমকালো ইসরা। গায়ের রঙ হয়তো ইসরার থেকেও কালো হবে, তবে চেহারা মায়াবী। হ্যাঁ নিহান আবার বিয়ে করেছে এক কালো আর বন্ধ্যা মহিলাকে। পরিবারের চাপে আর মেয়ের আবদার পূরণ করতে। তবে মিতা মেয়েটার ভালোবাসার কাছে হার মেনেছে নিহানও। এদিকে মিতাকে সবাই নিশিতার আপন মা ভাবে আর নিশিতাও। মিতা অনেকটা টেনে সামনে নিয়ে গেলো নিহানকে।

ইসরা মাস্কের নিচে মুচকি হেঁসে বললো, আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।

নিহান আরো একবার চমকে উঠলো তবে থতমত খেয়ে সালামের উত্তর নিলো। ইসরা আরো কিছু কথা বললো নিহানের সাথে তবে আয়মান এড়িয়েই গেলো। ইসরার একটা জরুরী ফোন এলে সে একটু দূরে চলে গেলো। কথা শেষ করে ঘুরতেই নিহানকে দেখে প্রথমে একটু চমকে গেলেও পরে নিজেকে সামলে নিলো।

কিছু বলবেন ভাইয়া ?

ইসরার প্রত্যেকটা ভাইয়া ডাকে চমকে উঠছে নিহান। ব্যাপারটা খেয়াল করে আবারও মুচকি হাসলো ইসরা।

নিহান আমতা আমতা করে বললো, আসলে কীভাবে বলবো, কোথা থেকে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। একবার ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটাও দাওনি।

আমার সাথে যা করেছিলেন সেটা নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ কখনোই ছিলো না। কারণ এতে আমার বাবার ভুলের শাস্তি পেয়েছি আমি। তবে আমার বাবার সাথে অফিসে যা হয়েছিলো তার জন্য হয়তো কখনো আপনাকে মাফ করতাম না৷ যদি আয়মান আমার ভুল না ভাঙাতো। আয়মান আমার সামনে প্রমাণ করেছিলো সেদিনের জন্য আপনি দায়ী ছিলেন না। তাই আপনার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই বরং আমি কৃতজ্ঞ। হয়তো আপনার জন্যই আয়মানের মতো কাউকে পেয়েছি আমি। ভালো থাকবেন আসছি।

ইসরা না দাঁড়িয়ে চলে গেলো আর নিহান তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো৷ ইসরা আয়মান বাচ্চাদের নিয়ে বাসায় চলে গেলো। বাচ্চারা প্রথম অনেকটা জার্নি করেছে তাই ক্লান্ত হয়ে গেছে।

ভোর রাতের দিকে হসপিটাল থেকে খবর এলো আকরাম রেজওয়ান আর বেঁচে নেই। শোকের ছায়া নেমে এলো পরিবারে। সতেরো বছর পর সেই একই বাড়িতে ইসরা প্রবেশ করলো তবে ভিন্ন পরিচয়ে। দাফন হয়ে গেলে মানুষের আনাগোনা কমে এলো, আমির রেজওয়ান ভেঙে পড়েছে ভাইকে হারিয়ে। নিহানের মায়ের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। ইসরা তাদের দেখাশোনা করছে। বিকেলের দিকে পুরো বাড়ি একদম শান্ত হয়ে গেলো। ইসরা ধীর গতিতে এগিয়ে গেলো সেই রুমটাতে, যেখানে সে জীবনের জঘন্যতম দুই মাস কাটিয়েছে। কিছুই আগের মতো নেই সেখানে।

মা, বাবা তোমাকে খোঁজছে।

আইরাতের কথা শুনে ইসরা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে আয়মানের রুমের দিকে গেলো। আয়মান এখান থেকে চলে যেতে চাইছে কিন্তু ইসরা অনেক বুঝিয়ে রাখতে সক্ষম হলো। তবে আকরাম রেজওয়ানের মৃত্যুর দুদিন পরই আয়মান সবাইকে নিয়ে নিজ ঠিকানায় রওনা হয়। পরিবারের সকলে তাকে আটকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। ইউএসে নিজের ছোট একটা বাড়ি তৈরি করেছে আয়মান। ইসরা আর নিজের সন্তান নিয়েই আয়মানের সাজানো পৃথিবী। ইসরাকে নিয়ে এই পরিবারে কখনো কোনো কথা উঠুক সেটা সহ্য করতে পারবে না আয়মান। তাই তার আলাদা পৃথিবীতেই থাকতে চায় সে, কারো উপর অভিমান করে নয়। আরিয়ানাও তাদের সাথেই চলে এলো। নিহান নিজের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে নিশানদের চলে যাওয়া দেখে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। আইরাত চলে গেলো আরিয়ানার সাথে আর আয়াত ইসরা আর আয়মানের সাথে। আয়াতটার ঘুম একটু বেশি, এখনো মায়ের কোলে ঘুমাচ্ছে। ইসরার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে তবে কোলে ছেলে থাকায় ঘুমাতে পারছে না। ঘুমের সাথে যুদ্ধ করে একসময় হেরে গেলো। আয়মানের কাঁধে মাথা রাখতেই আয়মান ইসরার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাঁসলো। ইসরার মুখের উপরের চুল সরিয়ে কপাল কিস করলো, আয়াতকে নিজের কোলে নিয়ে ইসরাকে ভালো করে ঘুমানোর সুযোগ দিলো। আয়াতকে নিতেই ইসরা আয়মানের হাত আঁকড়ে ধরে আরাম করে ঘুমাতে লাগলো।

আয়মান একবার ইসরার দিকে তাকিয়ে আবার ছেলের দিকে তাকালো, মা ছেলে দুটোই ঘুমকাতুরে।

ঘুমের মধ্যে আয়াত ঠোঁট কুঁচকে নিলো। আয়মান ছেলের কান্ড দেখে মুচকি হাঁসলো।

ইসরার দিকে তাকিয়ে বললো, আমার ছন্নছাড়া জীবনটা এতো সুন্দর করে গুছিয়ে দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ মায়াবতী।

★ সমাপ্ত ★

[বিঃদ্রঃ গল্পটা আপনাদের কেমন লেগেছে আমার জানা নেই। তবে আমার সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন গল্প এইটা। গল্পের শুরু থেকেই অনেক কিছু ফেস করতে হয়েছে। তবে গত পর্বে আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। গত পর্বে আমি একটা প্রবাদ বাক্য ব্যবহার করেছিলাম। খুব প্রচলিত একটা বাংলা প্রবাদ “জন্ম মৃত্যু বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে।” এটা আমি নিজে বানাইনি কিন্তু এটুকু বুঝতে আমার অসুবিধা হয়নি, এখানে তিন শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে জন্ম মৃত্যু বিয়ে এই তিনটা জিনিসের সংখ্যা হিসাবে। মহান আল্লাহ তাআলা এক ও অদ্বিতীয়। তাই তিন শব্দটা বিধাতার ক্ষেত্রে ব্যবহার করার প্রশ্নই আসে না। প্রবাদটা আমি বানাইনি, যেভাবে প্রচলিত আছে সেভাবেই ব্যবহার করেছি। আমার তো বুঝতে অসুবিধা হয়নি কিন্তু আপনারা এই সামান্য একটা বিষয় বুঝতে পারবেন না সেটা আমার কল্পনার বাইরে ছিলো। যারা বুঝতে পারেননি আমার মনে হয় তারা বাংলাদেশে থাকেন না। থাকলে অবশ্যই প্রবাদটি শুনে থাকতেন। নাকি বুঝতে পেরেও ইচ্ছা করে একটা বিভ্রান্তিকর পরিবেশ তৈরি করেছেন সেটা আপনারা ভালো জানেন। আল্লাহ তাআলার হুকুম ছাড়া একটা গাছের পাতাও নড়ে না। কারো সাথে পরবর্তী এক সেকেন্ড পরও কী হবে, সেটা তার জানা সম্ভব নয়। সবই আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা। প্রবাদটিতে একটা ভুল আছে বলে আমার মনে হয়, আর সেটা হলো এখানে কেবল তিনটি বিষয়ের কথাই উল্লেখ আছে কিন্তু পৃথিবীতে কোনো কিছুই আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে হয় না। যারা তিন সংখ্যাটাকে ভুল হিসাবে দেখেছেন তাদের সত্যি কিছু বলার নেই। আমি কোনো মাদ্রাসার স্টুডেন্ট নই কিন্তু মুসলিম পরিবারের সন্তান। নিজের ধর্মকে মনে প্রাণে ভালোবাসি, বিশ্বাস করি, আমার পক্ষে যতটা মেনে চলা সম্ভব নয় মেনে চলি। তাই দয়া করে কেউ এমন বিভ্রান্তিকর পরিবেশ তৈরি করবেন না। ধর্ম কোনো মজা করার বিষয় নয় বা ধর্ম নিয়ে তর্ক করার মতো জ্ঞানী আমি নই। খুবই সাধারণ একজন মানুষ আর মানুষ মাত্রই ভুল। আমিও ভুলের ঊর্ধ্বে নই। প্রবাদটি নিয়ে এখনো যাদের সমস্যা আছে তারা গুগল ইউটিউব যেকোনো জায়গায় লিখে সার্চ দিতে পারেন। আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। কোনো ভুল কিছু বলে থাকলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। নিজের উপরেই প্রচন্ড বিরক্ত তাই আগামী গল্প কবে দিবো বলতে পারছি না। ভালো থাকবেন, আল্লাহ হাফেজ। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here