#মেঘের_পালক_চাঁদের_নোলক
#পর্ব_০৯
#অধির_রায়
নিধি শব্দটা কর্ণধারে আসতেই পিছনে ঘুরে তাকাল৷ হুট করেই একটা মেয়ে নিধিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তোমাকে দেখার খুব ইচ্ছা ছিল৷ সত্যিই তুমি একদম পুতুলের মতো৷ সেজন্য মুগ্ধ তোমাকে খুব ভালোবাসে৷”
নিধি কৌশল বিনিময় করে মুচকি হেঁসে বলল,
“আপু আপনাকে চিনতে পারলাম না৷ মুগ্ধ ভাইয়া আপনার কি হোন? হ্যাঁ মুগ্ধ ভাইয়া খুব ভালো একজন মানুষ৷ নিধি ভাইয়া বলে কথা৷ নিধির ভাইয়া কখনও খারাপ হতে পারে৷”
গর্বের সাথে নিধি কথাটা বলল৷ মেয়েটি নিধির গায়ে আলতো করে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার নাম ইভা৷ আমি মুগ্ধর বেস্টফ্রেন্ড। তোমার কথা আমাকে প্রতিদিন বলে৷ মুগ্ধ বোনের জন্য খুব পা/গ/ল ছিল৷ সে আমাকে অনেক বলত তুই আমার বোন হয়ে জন্ম নিলি না কেন?”
ইভা কথাগুলো বলেই আবার নিধিকে জড়িয়ে ধরল৷ ইভা খুবই মিশুক মেয়ে৷ নিধির খুব ভালো লেগেছে৷ একা একা ভোর হচ্ছিল৷ ইভাকে পেয়ে খুব খুশি হলো৷ নিধি মুচকি হেঁসে জবাব দিল,
“আপু আমি নিচে যাচ্ছি৷ মুগ্ধ ভাইয়াকে হলুদ লাগান৷ ভাইয়া মাধবী বলতে পা/গ/ল। দেখেন না বিয়ের খুশিতে ড্যাং ড্যাং করে নাচছে৷”
“আরে তুমি নিচে যাবে কেন? তুমিও আমাদের সাথে নাচবে৷”
“নিধির মুখটা মলিন হয়ে গেল৷ তবে আনন্দের সাথে বলে উঠল,
“না আপু৷ মহান সৃষ্টিকর্তা মেয়ে জাতীকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে সৃষ্টি করেছেন৷ সম্মান রক্ষা করা মেয়েদের কর্তব্য। আমি নাচতে অবশ্যই পারতাম৷ তবে শালীনতা বজায় রেখে। এখানে অনেক ছেলে আছে৷ ছেলেদের সামনে এসব পোশাক না পড়ে যাওয়ায় ভালো৷ আমি চাইনা কোন ছেলে আমার দিকে খারাপ নজর দেখ৷ যদিও সবাই আমার ভাইয়ের বয়সী৷ আমি আল্লার কাছে সব সময় দোয়া করি আল্লাহ যেন আমার ভাইয়ার মুখে সব সময় হাসি রাখেন৷ আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার তৌফিক দান করেন৷”
নিধির কথাগুলো ইভার খুব ভালো লাগল৷ ইভা মুচকি হেঁসে বলল,
“ওকে পুতুল৷ তোমাকে এখানে আসতে হবে না৷ আমিও চাই তুমি খুব ভালো থাকো৷ আজ সারারাত তোমার সাথে থাকব৷ অনেক গল্প করব৷ আমি যাচ্ছিনা কোথাও৷ তোমার রুমেই আমার জায়গা হবে৷”
নিধি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল৷ উচ্চ স্বরে গান বাজনা বাজছে। নিধি আর দেরি করল না৷ দ্রুত পায়ে নিচে চলে আসল৷ ডাইনিং রুমে আসতেই শায়লা চৌধুরীর ডাক পড়ল। অনেকে বসে আছেন ডাইনিং রুমে৷ নিধি সবাইকে সালাম দিল৷ শায়লা চৌধুরী সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“আমার মেয়ে নিধি৷ আল্লাহ নিজ হাতে আমার কাছে নিধিকে পাঠিয়েছেন৷ আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া। নিধিকে জড়িয়ে ধরল দুইজন মহিলা৷ মুচকি হেঁসে বলল,
“আমরা তোমার কাজিন৷ শাওন, মুগ্ধর খালাতো বোন আমরা৷ আমাদের ভাই নেই৷ তাদের বোন ছিল না৷ এখন তোমাকে পেয়ে তারা খুব খুশি৷”
বিয়ে বাড়ি মানেই লোকজনের সমাহার। গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে মেয়েরা মাধবীদের বাড়িতে গেল৷ সেখানে কোন ছেলে যায়নি৷ ছেলে বলতে গাড়ির ড্রাইভার ছিল৷ নিধিকে যেন সবাই চোখে হারিয়েছে৷ মাধবীদের বাড়িতে নিধিকে ভালোবাসায় সহিত আগলে রেখেছে মুগ্ধ, শাওনের কাজিন৷ চোখের আড়াল হলেই যেন নিধি হারিয়ে যাবে৷ সবার এত ভালোবাসা পেয়ে চোখের কোণে অশ্রু চলে আসল৷ দুঃখ পেলেও চোখে জল আছে৷ কিন্তু বেদনায় বুকে তীব্র ব্যথা হয়৷ সুখের কান্না মনে নিয়ে আসে প্রশান্তি। আল্লাহর রহমতে গায়ে হলুদ ভালোই ভালোই কেটে যায়৷”
__________________
বিয়ে বাড়িতে চলছে হইচই। কিন্তু বরপক্ষকে ফিতা কাটতে হলো। কেউ বরপক্ষকে গেইটে আটকালো না। সকলের মাথায় প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে৷ কিন্তু সমস্যা হয় কনে নির্বাচনে৷ স্ট্যাচে কনের সেজে বসে আছে পাঁচ জন মেয়ে৷ একজন মাধবী অন্য চারজন মাধবীর বান্ধবী। সকলের সাজ এক৷ হায়ের মেহেদী ডিজাইন এক৷ কনে নির্বাচন করতে না পারলে এক লক্ষ্য টাকা জরিমানা। গেইটের টাকা এখানে তুলবে৷ বিষয়টা নিধির কাছে ইউনিক মনে হলো৷ কিন্তু এত টাকা দিতে কেউ রাজি নয়৷ চলছে দুই পক্ষে কথা-কাটাকাটি। এর ফাঁকে লোক চক্ষুর আড়ালে নিধি মাধবীকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷ যাকে সে রীতিমতো দুর্নীতির খাতায় রেখেছে৷ নিধি শনাক্ত করে ফেলে মাধবীকে৷ সবার শেষেরটাই হলো মাধবী৷ মুখে ফুটে উঠল বিশ্ব জয়ের হাসি৷ সবার সামনে এসে নিধি বলল,
“আমরা আপনাদের শর্তে রাজি। এক লক্ষ টাকায় চলবে৷ আমার ভাইয়ার প্রেম আল্লাহর দান৷ উনি ঠিক মাধবী ভাবীকে চিনে নিবেন৷”
মুগ্ধ ভাইয়ার বন্ধুরা এক সাথে বলল,
“এই না না এটা হবে না৷”
নিধি মুগ্ধর দিকে তাকায়৷ মুগ্ধ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমার বোন যা বলেছে তাই হবে৷ কেউ কোন কথা বলবে না৷”
নিধি মুগ্ধকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে কানে ফিসফিস করে বলল,
“সবার শেষে যিনি বসে আছেন উনিই আমাদের ভাবী৷ এমন ভাব করবেন যেন আকাশ পাতাল চিন্তা করে আপনি ভাবীকে শনাক্ত করেছেন৷”
মুগ্ধ মুচকি হেঁসে বলল,
“আমার বোনটার খুব বুদ্ধি। এই না হলে মুগ্ধর বোন৷”
মুগ্ধ গভীর চিন্তায় মগ্ন৷ কোনটা মাধবী হতে পারে৷ মুগ্ধকে অগ্নি পরীক্ষায় ফেলা হয়েছে৷ নিধির কথামতো বলে উঠল,
“সবার শেষেরটাই মাধবী। আর ঘোমটার আড়ালে থাকতে হবে না৷”
মাধবীর বান্ধবীদের মন খারাপ হয়ে গেল৷ তাদের সকল পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে গেছে৷ বিভিন্ন ভাবে বিরক্ত করছে মুগ্ধ ভাইয়ার বন্ধগুলো ওদের৷
আল্লাহকে সাক্ষী রেখে পবিত্র বন্ধনে সারা জীবনের জন্য আটকা পড়ে মাধবী মুগ্ধ। মাধবী বাসর ঘরে মুগ্ধর জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে৷ কিছুতেই মুগ্ধর বন্ধুগুলো মুগ্ধকে বাসর ঘরে প্রবেশ করতে দিবে না৷ অনেক
কষ্টে তাদের মেনেজ করে মুগ্ধ বাসর ঘরে প্রবেশ করে৷ কাঁচা ফুলের সৌরভ ছড়িয়েছে সমস্ত ঘরে৷ মাধবীকে মন ভরে দেখছে মুগ্ধ। কারো মুখে কোন কথা নেই৷ দীর্ঘ অবসানের পর চার হাত এক হয়েছে৷ নিরবতা ভেঙে মুগ্ধ বলল,
“ফ্রেশ হয়ে আসো৷ এক সাথে গল্প করে রাত কাটাব৷”
মাধবী লজ্জমাখা দৃষ্টিতে মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে ওয়াসরুমে চলে যায়৷
__________________
কোন কিছুই থামকে থাকে না৷ নদীর স্রোতের মতো বয়ে যাচ্ছে সময়৷ নিধির পরীক্ষা চলে আসছে৷ নিধি পড়ালেখায় খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে৷ নবম শ্রেণিতে ভালো রেজাল্ট না করলে দশম শ্রেণিতে তুলবে না৷ নিধির জন্য চারটা বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা চারটা হোম টিউটর রাখা হয়েছে৷ খুবই ব্যস্ততার মাঝে সময় পার করছে৷ শাওন চৌধুরীর সাথে তেমন কথা হয়না৷ স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার সময় দুই একটা কথা ছাড়া কোন কথা হয়না৷ বহুদিন পর নিধি শাওনকে নিজের রুমে আবিষ্কার করল৷ ডিনার শেষ করেই নিধির রুমে চলে আসছে৷ নিধি রুমে প্রবেশ করতেই শাওন চৌধুরী নিধির কাছে আসে৷ অপরাধী কন্ঠে বলল,
“তুমি আমার সাথে কথা বলো না কেন পিচ্চি? কেন আমাকে এড়িয়ে চল৷ আমি খুবই খারাপ একজন মানুষ৷ আমাকে তোমার জীবনের সাথে না জাড়ালে প্লিজ কথা বলা বন্ধ করো না৷ আমি না হয় দূর থেকে তোমায় ভালোবেসে যাব৷ আমার ভালোবাসা শুদ্ধ এবং পবিত্র হলে আল্লাহ তোমাকে আমার জন্য রাখবেন৷”
নিধি মলিন কন্ঠে জবাব দিল,
“আমার দেহের চামড়া দিয়ে আপনাদের পায়ের জুতা বানিয়ে দিলেও ঋণ পরিশোধ হবে না৷ সেজন্য বলছি আমাকে এমন কোন কথা বলবেন না৷ যেন আমার জায়গা অন্য কোথাও হয়৷ আমাকে প্লিজ এই পরিবার থেকে দূরে করবেন না৷ দূরে করলে মারাই যাব৷ আমি কখন মায়ের ভালোবাসা পাইনি৷ এখানে মা পেয়েছি৷ ভাইয়ার ভালোবাসা কি জানতাম না৷ মুগ্ধ ভাইয়ার ভালোবাসা পেয়েছি৷ মাধবীকে ভাবীকে পেয়ে বোনের কষ্ট ভুলে গেছি৷ আপনি এমন কোন কাজ করবেন না যাতে আমার প্রিয়জনদের কষ্ট হয়৷”
শাওন চৌধুরী রাগ নিয়ে বলল,
“আমি কি এমন করছি যার জন্য আমায় দূরে ঠেলে দাও৷ সেদিনের পর থেকে তোমায় তো বলিনি আমায় ভালো বাসতে৷ আমার সাথে একটু কথা বলবে শুধু৷ মুগ্ধর সাথে যেভাবে কথা বলো আমার সাথেও তো সেভাবে একটু কথা বলতে পারো৷ এক ছাঁদের নিচে আমরা দু’জন তবুও যেন অদৃশ্য দেয়াল আমাদের আলাদা রেখেছে৷ কেউ পারছি না দেয়াল ভেদ করতে৷”
নিধি মলিন কন্ঠে জবাব দিল,
“আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে৷ তবে চিন্তা করবেন না৷ আপনি যদি শুদ্ধ মন নিয়ে কথা বলতে আসেন আপনার সাথে আমার কথা বলতে কোন আপত্তি নেই৷ আপনাকে আমি ভাইয়ার নজরে দেখি৷”
শাওন চৌধুরী কিছু বলল না৷ বিছানায় লা/থি দিয়ে রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণায় রুম থেকে চলে গেল৷ নিধি পারছে না কিছু মেনে নিতে৷ কেন বারং বার শাওন চৌধুরী তার সামনে ভালোবাসা নিয়ে আসেন৷ ভাইয়ার অধিকার নিয়ে তো আসতে পারেন না কেন? ভাবতেই যেন নেত্রদ্বয় ভিজে উঠল৷
শাওনের যেন দুনিয়া অন্ধকার। না পাওয়ার কষ্ট এতোটা খারাপ হতে পারে৷ সবকিছু তছনছ করে দিতে ইচ্ছা করছে৷ বেঁচে থাকতে কষ্ট হচ্ছে৷ প্রতিটি নিঃশ্বাস মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ নিজেকে পাগল পাগল লাগছে৷ মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“আল্লাহ কেন আমার জীবনে এত কষ্ট রেখেছে৷ কেন আমায় বাজে কাজে লিপ্ত করলেন৷ কেন ভালোবাসার পথ দেখালেন? আমি তো ভালোই ছিলাম৷ দিনটা বিষাদময় হলেও রাতটা কাটতো নেশায় নেশায়৷ ভালোবাসা মানুষকে এত কষ্ট কেন দেয়৷ ভালোবাসা জয় করা যায় না কেন? আমি নিষিদ্ধ পল্লীতে যায় বলেই আমি আজ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। আমি কত বোকা, নিজে চরিত্রহীন হয়ে ফুলের মতো পবিত্র কাউকে নিজের করে পেতে চাই৷ কেন আমার জীবনে প্রেম দিলেন?”
রাগে হাতের ফোনটা ভেঙে চুরমার করে ফেলল৷ গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল অজানা উদ্দেশ্য।
চলবে……
ভুলত্রুটিগুলো মার্জনীয় দৃষ্টিতে দেখবেন৷