#মেঘের_দেশে_প্রেমের_বাড়ি
#লেখনীতে_নৌশিন_আহমেদ_রোদেলা
#পর্বঃ -০৬
হঠাৎ পেয়ে যাওয়া শ্বশুরবাড়ি তরুর পছন্দ হয়েছে। বুক সমান দেওয়ালে ঘেরা একতলা বাড়িটা ছিমছাম। সফেদ রঙা দেওয়াল বেয়ে উঠে গিয়েছে বাগানবিলাসের শাখা। স্টিলের গেট পেরিয়ে খোয়া বিছানো সরু পথ। বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা নিয়ে আঙিনা। সীমানা ঘিরে বড়ো বড়ো ফল গাছ। নারকেল গাছের ছায়া। চৈত্রের বিকেলে ঘন্টাখানেক আগেই সন্ধ্যে ডেকে আনার দায়িত্বে বদ্ধপরিকর তারা। থেকে থেকে পাখি ডাকে। কান খাঁড়া করলে শোনা যায় জোনাক পোকার মিহি রব। মুক্ত বিহঙ্গ, রাত পোকার মিহি কলরব আর ছায়া ছায়া সন্ধ্যেতে চারপাশটায় ভাসে ‘কেউ নেই, কেউ নেই’ গন্ধ। রোদ নেই, ক্লান্তি নেই, দুঃখ নেই, আঙিনার উপর ঝরা পাতার অবশিষ্ট টুকরোটুকু পর্যন্ত পড়ে নেই। বাড়ির গিন্নি যেন নারকেল শলার ঝাড়ুতে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করেছে সকল অকল্যাণ, অশান্তি, অপরিষ্কার।
তরুকে যে ঘরটাতে থাকতে দেওয়া হয়েছে সে ঘরটা মাহবুবের। মধ্যবিত্ত পরিবারের শোবার ঘর যেমন হয়? সেরকমই ছিমছাম, সাধারণ একটি ঘর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নের আতিশয্য ছাড়া কোথাও কোনো আতিশয্য নেই। তবুও চারপাশে ঝিম ধরা শান্তি শান্তি ভাব। বাড়ির গিন্নি যে বাড়িটাকে কত যত্নে আগলে রেখেছেন, সে সুবাস ছুটে বেড়াচ্ছে বাড়ির প্রতিটি ঘর, আঙিনায়। তরু যে নিঃশ্বাস নিচ্ছে? সে শীতল হাওয়ায়। তরু শ্বশুর বাড়ি এসেছে গোধূলির শেষ আর সন্ধ্যের শুরুর মাঝে চির বিষণ্ণ হয়ে থাকা অভিশপ্ত সময়টুকুতে। শাশুড়ী মায়ের সাথে সন্ধ্যের চা খেতে বসে শুনতে হয়েছে শ্বশুরের শারিরীক কষ্টের কথা, অসুস্থতার কথা, যাবতীয় সংসারের কথা৷ যেন তরুই এ সংসারের পরবর্তী হর্তাকর্তা। সরবকে দুই তিনটে চপেটাঘাত দিয়ে পড়তে বসানোর দৃশ্যটা দেখে বড়ো আনন্দ হয়েছে তরুর। মনে পড়েছে, বহুবছর আগে তাদেরও একটা ঘর ছিলো। সত্যিকারের ঘর। যে ঘরে একটা মা ছিলো। সন্ধ্যে নামতেই উচ্চকণ্ঠে পড়তে বসার তাড়া ছিলো। অফিস ফিরতি বাবার সাইকেলে টুংটাং ধ্বনি ছিলো। বহু বছর হলো তরুদের আর ঘর নেই। চার দেওয়ালে ঢাকা চকচকে বাড়ি আছে, কিন্তু সত্যিকারের ঘর নেই।
সন্ধ্যে মিলিয়ে রাত নামতেই তরুর হাতে মিললো অফুরন্ত অবসর। শাশুড়ী মা রান্নাবান্নার কাজ সমাধা করে শ্বশুরের পাশে গিয়ে বসেছেন। দুই ঘর ওপাশ থেকে সরবের উচ্চস্বরে পড়ার আওয়াজ আসছে। একটা ঝিম ধরা রাত পোকার রবও আসছে থেকে থেকে। তরু বারান্দার দরজাটা খোলে দিয়ে সন্ধ্যেরঙা আকাশ দেখছে। বিষণ্ণ লাগছে মন। কোথায় যেন ফাঁকা ফাঁকা নিঃসাড় অনুভব। সেই নিঃসাড় অনুভবে জীবনের কালি দিয়ে লেখা কেবল মাহবুবের নাম। অথচ মাহবুবের দেখা নেই। এখানে আসতেই শাশুড়ী মা হাত ধরে বলেছেন, এই ঘরটা তরুর। এই সংসারটা তরুর। এই সংসারের মানুষগুলো তরুর। তবে কী মাহবুবও তরুর? সত্যিই কী তাই? তরু আশেপাশে তাকায়। ঠোঁটের কোণে ফোটে উঠা হাসিটা রহস্যের নাকি তাচ্ছিল্যের বুঝা যায় না। সন্ধ্যের বাতাসে ভাসে কেবল তার মিহি সুমিষ্ট সুর। তরু গায়,
‘ পরের জায়গা পরের জমিন,
ঘর বানাইয়া আমি রই,
আমি তো সেই ঘরের মালিক নই।।
সেই ঘরখানা যার জমিদারি,
আমি পাই না তাহার হুকুমদারী।।
আমি পাই না জমিদারের দেখা,
মনের দুঃখ কারে কই?
আমি সেই মনের দুঃখ কারে কই?’
তরু বারান্দার দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ঘরের ভেতর এসে দাঁড়ালো। ঠোঁটের কোণের অতিমানবীয় হাসিটা বিস্তৃত হলো। গানের ছন্দ হয়ে এলো আরও চাপা, আরও মিহি। সারা ঘরজুড়ে মিহি গুঞ্জনের রব ছড়িয়ে মাহবুবের ঘরের প্রতিটি জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো তরু। আলমারি খুলে থরে থরে সাজিয়ে রাখা মাহবুবের শার্টগুলো ছুঁয়ে দিলো আঙুলের ডগায়। সাজানো শার্টের বহর দেখে বুঝা গেলো মাহবুবের সাদা রঙ পছন্দ। অথচ সাদা তরুর দু’চোখের বিষ। স্কুলের ড্রেসে সাদা রঙ ছিলো বিধায় কত কতদিন স্কুলে যায়নি তরু! তরু পুরো আলমারি খুঁজে খুঁজে হালকা মিষ্টি রঙের একটা শার্ট পছন্দ করলো। নিজের পরনের জামা খুলে মাহবুবের শার্ট পরতেই নাকের কাছে এসে ধাক্কা লাগলো অচেনা অথচ স্নিগ্ধ এক সুগন্ধির সুবাস। তরু শার্টের কলার টেনে শুকলো। সাথে সাথেই সারা গায়ে বয়ে গেলো অদ্ভুত এক শিহরণ। কৃত্রিম সুগন্ধির সাথে মাহবুবের গায়ের নিজস্ব গন্ধটাও ল্যাপ্টে আছে শার্টের গায়। শার্টটা মাহবুব সপ্তাহ দুয়েকের মাঝে পরেছিলো নিশ্চয়? গায়ে শার্ট গলিয়ে, ব্যাগ থেকে জিন্সের একটা লম্বা স্কার্ট বের করে পরলো তরু। রাতের আঁধারের মতো ঘন অন্ধকার চুলগুলো চুঁড়ো করে খোঁপা বাঁধলো মাথায়। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে অনেকটা সময় নিয়ে দেখে ঠোঁটে ঘষলো টকটকে লাল লিপস্টিক। আলমারির প্রত্যেকটা সাদা শার্ট আর টি-শার্টের কলারে সময় নিয়ে বসালো স্বচ্ছ চুমুর দাগ। শার্টের সাদা জমিনে টকটকে লাল ঠোঁট জোড়ার ছাপ পড়তেই ঠোঁট গোল করে শিষ বাজালো তরু। হাহ্! গরু মাহবুব, এবার বুঝবে তুমি বউ পালার জ্বালা। জ্বালা! জ্বালা! জ্বালা!
‘ একা ছিলাম, ছিলাম ভালো
ছিলো নাতো জ্বালা।
তোমার সনে প্রেম করিয়া,
অন্তর হইলো কালা।
ও তুমি কার দেখা পাইয়া,
গেলা আমায় ভুলিয়া…’
ভুলিয়া গেলেও সমস্যা নেই। ভুলিয়া যাওয়া রোগ ভালো করিবার অজস্র পদ্ধতি তরুর জানা। এই পদ্ধতি ব্যবহারের আগে চলবে গরু মাহবুবের কঠিন পরীক্ষা। এইযে তরুকে এতো এতো অপেক্ষা করালো। কঠিন পরীক্ষা না নিয়ে তো তরু তাকে ক্ষমা করবে না। না! না! না! তরু সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যে কয়দিন এই ঘরে থাকবে প্রতিদিন মাহবুবের ঘরের একটি একটি জিনিসে নিজের ছাপ ফেলে যাবে। মাহবুব যখন ফিরবে তখন চারপাশে পাবে কেবল তরু তরু গন্ধ। শার্টে তরু। টি-শার্টের কলারে তরু। ওয়াশরুমে তরু। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় তরু। বিছানার চাদর, কুশন সব জায়গায় কেবল তরু তরু তরু। তরু মৃদু মৃদু শিষ বাজায়। আনন্দে টলমল মনে গা এলিয়ে দেয় বিছানায়। মাহবুবের শার্ট থেকে ভেসে আসে দমবন্ধকর পুরুষালি সুবাস। তরু বুঝতে পারে, সেই সুবাসের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে তরুর নিজস্ব রমণীয় সুবাস। মাহবুব যখন ফিরবে। বন্ধ ঘরে বেখেয়ালে আবারও এই শার্টটা পরবে তখন কী পাবে এই মিশ্র সুবাস? তারও কী গা কাঁপবে? শিহরণ হবে ঠিক তরুরই মতো? ইশ! তরুর যে জানতে ইচ্ছে হয়।
গভীর ঘুমের মাঝে কারো ফিসফিস আওয়াজে ঘুম ছুটে গেলো তরুর। আচমকা চোখ মেলে কিছুক্ষণ স্থির চেয়ে রইলো ছাদের দিকে। গায়ের শার্টটা চিটচিট করছে ঘামে। তরু কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থেকে বুঝার চেষ্টা করলো, সে ঠিক কোথায় আছে? তারপর প্রশ্ন জাগলো, কে ওমন অধৈর্য হয়ে ডাকছে তাকে? তরু বিছানায় উঠে বসলো। ঘরের আলো জ্বলছে। আলোয় ঝলমলে ঘরে কোথাও কেউ নেই। অথচ তরু স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে, কেউ তাকে ডাকছে। ঠিক পুরুষালি কণ্ঠ নয়। কেমন একটা মিহি, নরম সুর। কোথা থেকে আসছে সেই ডাক? তরু কান খাড়া করতেই বসার ঘরের দেওয়াল ঘড়িটা পেন্ডুলাম দুলিয়ে ঢং ঢং শব্দ তুললো। জানালো, বারোটা বাজে। আচমকা এমন জোড়ালো শব্দে চমকে উঠলো তরু। ওইতো! ওইতো আবার ডাকলো! তরু কান পাতে। জানালার পাট্টায় মৃদু করাঘাত পড়ে এবার। তরু বিছানা থেকে নেমে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বুকের ভেতর খানিক দ্বিধা থাকলেও এক টানে খুলে ফেলে জানালা। বাইরের গাঢ় অন্ধকারে উপর থেকে একটা মাথা উল্টো হয়ে ঝুলে থাকতে দেখে আঁতকে উঠে। চাপা আর্তনাদ করে এক পা পেছিয়ে যেতেই কথা বলে সেই উল্টো মাথা।
‘ ভাবী! ভাবী আমি সরব। এই দেখো।’
নিজের মুখে টর্চের আলো ফেলে দাঁত বের করে হাসলো সরব। সগর্বে বললো,
‘ ভয় পেয়েছো?’
সেদিন দুঃস্বপ্ন দেখার পর থেকে অদৃশ্য এক ভয় তাড়া করছে তরুর ভেতর। সেই ভয়েই ধুকপুক করছে বুক। তারপরও সহজ কণ্ঠে বললো,
‘ তুমি ওখানে কী করছো? এতোরাতে জানালার উপর কী কাজ? চুরি টুরি করতে চাও নাকি ভাইয়ের রুমে? করলে চলে আসো। আমাকে ফিফটি পার্সেন্ট শেয়ার দিলে আমি তোমার সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে রাজি আছি।’
সরব হাসলো,
‘ ধুর! পুলিশের ঘরে চুরি করে মরবো নাকি? ভাইয়ার যে বুদ্ধি! ঢাকায় বসে থেকেই অর্ডার দিয়ে দিবে, এই সরবকে ধর।’
‘ তবে তুমি বাদুড়ের মতো ঝুলছো কেন?’
‘ আমি ছাদ দিয়ে নেমেছি যে তাই। এতোরাতে বাড়ির ভেতর দিয়ে তোমার দরজায় নক করলে মা আমাকে মেরে একদম হাড়গোর ভেঙে দেবে। আম্মু ঘুমানোর আগে চেক দিয়ে গিয়েছে। দেখেছে, আমি ঘুমোচ্ছি।’
‘ কিন্তু তুমি ঘুমোচ্ছ না৷ আমার জানালায় এসে ঝুলে আছো?’
সরব মাথা নাড়লো। তরু শুধালো,
‘ এসব ঝুলাঝুলির ব্যাপারটা কী?’
সরব হতাশ হয়ে বললো,
‘ আজ না আমাদের জ্বিন ধরার কথা? তুমি এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গিয়েছো ভাবী!’
তরুর মনে পড়লো। শ্বশুর বাড়ি আসার পথে সরবকে নিয়ে সাদা-কালো-লাল রঙের মোম, একটা আয়না, কালো লিপস্টিক আর একটা লোহার আংটি কিনেছিলো তরু। এই সবই জ্বিন শিকারের সরঞ্জাম। তরু গম্ভীর হয়ে বললো,
‘ নিজে জ্বিন ধরার টোপ হয়ে নিজেই পুরো ব্যাপারটা ভুলে যাওয়া খুব অপরাধ হয়েছে সরব। আমি দুঃখিত। এখন বলো আমায় কী করতে হবে? লাল টুকটুকে শাড়ি পরে ছাদে আসবো? দেখা গেলো আমাকে দেখে জ্বিন এমনিতেই বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলো। তাহলে আর লাল, নীল, হলুদ মোমবাতি জ্বালানোর প্রয়োজনই পড়লো না?’
সরব বললো,
‘ ওসব লাগবে না। তুমি যেমন আছো তেমনই আসো। আমি কঠিন সব দোয়া শিখে রেখেছি। জ্বিন আংটিতে বন্দী হতে বাধ্য।’
তরুও স্বীকার করলো, অবশ্যই জ্বিন আংটিতে বন্দী হতে বাধ্য। এমন একটা কঠিন দোয়া পড়ার পরও জ্বিন বন্দী হবে না, তা তো হতে পারে না। সরব তরুকে বারবার করে সাবধান করে দিলো,
‘ ঘরের আলো নিভিয়ে রেখে আসো। আম্মু যেন কিছুতেই টের না পায়।’
শার্টের উপর ভারী একটা ওড়না জড়িয়ে সরবের কথামতো খুব সাবধানে ছাদে উঠে এলো তরু। ছাদে তখন ঠান্ডা হাওয়া বইছে। চারপাশটায় দারুণ চাঁদের আলো। সরব ছাদের মাঝ বরাবর দুটো আসন পেতেছে। তরু একটি আসনে গিয়ে বসলো। সরব খুব গম্ভীর গম্ভীর মুখে মোমগুলোকে ৬ ইঞ্চি অন্তর অন্তর সাদা-লাল-কালো এভাবে সোজা লাইন করে দাঁড় করালো। তারপর গম্ভীর আদেশের সুরে বললো,
“আল্লাহ শাহ্-ফিইম শোয়ে-কামিইর”
তরু খুব আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছে। সরব থমথমে মুখে মোমবাতিগুলো ধরালো। কালো লিপস্টিক দিয়ে আয়নার কেন্দ্রে পরিষ্কার ভাবে লিখলো,
‘আলী আল্লাহ হামাল জিন্নি’
আয়নায় লেখা শেষ হতেই মুখ তুলে তরুর দিকে চাইলো। কণ্ঠ নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
‘ এই ভাবী? পুরুষ জ্বিন ধরবো নাকি মহিলা জ্বিন? দুই ধরনের জ্বিন ধরার দুই রকম নিয়ম।’
তরু তার থেকেও ফিসফিস করে বললো,
‘ আমাকে টোপ বানালে তো পুরুষ জ্বিনই ধরতে হবে। নারী জ্বিনের আমাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে কী কাজ? সে মুগ্ধ হবে তোমাকে দেখে। তবু তুমি চাইলে নারী ভূতও ডাকতে পারো। আমার তো বর আছে, তোমার নেই। অবসরে একটু প্রেম-টেম করলে মহিলা ভূতের সাথে?’
সরব লজ্জায় লাল হয়ে বললো,
‘ যাহ্! আমি কেন ভূতের সাথে প্রেম করতে যাবো অযথা? তার থেকে বরং পুরুষ জ্বিন ডাকি। পুরুষ জ্বিনের শক্তি বেশি।’
তরু হেসে সম্মতি জানালো। সরব এবার আয়নায় লিখলো,
‘Muschna’
পরপর লিখলো,
‘ Shamal Al-Amari
Closun ontei.’
তারপর তরুর দিকে চেয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
‘ ভাবী, চোখ বন্ধ করো। এক্ষুনি জ্বিন আসবে।’
তরু বললো,
‘ সেকি! চোখ বন্ধ করে ফেলতে হবে? চোখ মেলে রাখা যাবে না? চোখ বন্ধ করলে জ্বীন দেখবো কী করে? আমি জ্বীনের দিকে তাকালে কী জ্বীন লজ্জা পাবে, সরব?’
সরব বললো,
‘ পেতেও পারে। প্রেমে পড়লে তো মানুষই লজ্জা পায়। আর এ তো জ্বীন। জ্বীন হয়ে মানুষের প্রেমে পড়েছে। নিজস্ব কমিউনিটি থেকে বেরিয়ে এসেছে। লজ্জা পাওয়া উচিত না?’
তরু হেসে ফেললো। চোখ বন্ধ করে বললো,
‘ বেশ! জ্বীন মহাশয় নিশ্চিন্তে মানুষের প্রেমে পড়তে পারে। আমরা তাকে লজ্জায় ফেলবো না।’
সরবও হাসলো। চোখ বন্ধ করে গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ করলো,
‘আমি আশা করছি আপনি এই আংটিতে বাঁধা হবেন, যা আপনাকে উপহার দিচ্ছি। আপনাকে আমার কিছু জীবনী শক্তির বিনিময়ে আমরণ সেবা দেবার অনুরোধ করছি। আসুন… ‘
নিস্তব্ধ মধ্যরাতে সরব গমগমে কণ্ঠে ‘আসুন’ বলতেই দরজায় কলিংবেলের তীক্ষ্ণ আওয়াজ হলো। সাথে সাথে চমকে চোখ মেলে তাকালো সরব-তরু। ভীত চোখে একে অপরের দিকে চাইলো। বাতাসের দাপটে নিভে যাওয়া মোমবাতির দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বললো সরব,
‘ আমরা তো জ্বিনকে আংটিতে বন্দী হতে বলেছিলাম। জ্বিন আংটিতে না ঢুকে কলিংবেল বাজিয়ে আসছে কেন ভাবী? আশ্চর্য!’
সরবের কথার মাঝে আবারও কলিংবেল বাজলো। মধ্যরাতের নিস্তব্ধতাকে চিড়ে ফানা ফানা করে দিলো সেই আওয়াজ। সরব ঢোক গিললো। তরুও চোখ পিটপিট করে চেয়ে আছে ছাদের দরজার মুখে। কেমন একটা ভয় ভয় হাওয়া লাগছে দুজনের মনে। অবস্থা এমন, একজন একটু ‘উঁ’ বলে চেঁচালেই উঠে ছুট দিবে দু’জন। তরু আর সরব আবারও একে অপরের দিকে চাইলো। তারপর একবার আশেপাশে। তারপর গগণ ফাঁটিয়ে চিৎকার দিয়ে ধুপধাপ করে নেমে গেলো নিচে। নিচে নেমে বসার ঘরের দরজার অভিমুখে অন্ধকারে কান খাঁড়া করে দাঁড়ালো দু’জন। সরব-তরুর বুক কাঁপিয়ে দিয়ে আরও বার দুয়েক ঘন্টী বাজলো। সরব ফিসফিসিয়ে বললো,
‘ জ্বীনকে বিদায় করার মন্ত্র তো জানি না। দরজার বাইরে যদি সত্য সত্য জ্বীন হয় তখন কী করবো?’
তরু বললো,
‘ আমরা তাকে বলবো, আমরা আপনাকে চিনি না। রং এড্রেস। রং নাম্বার।’
তরু-সরবের ফিসফাসের মাঝেই শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তরুর শাশুড়ী মা। চুলের খোঁপা শক্ত করে বাঁধতে বাঁধতে দরজার দিকে এগুলেন। দরজাটা খুলে সরে দাঁড়াতেই ভেতরে প্রবেশ করলো তরু-সরবের জ্বীন মহাশয়। লম্বাচওড়া, ছিপছিপে শরীর নিয়ে বসার ঘরের মাঝে এসে দাঁড়াতেই সরব অবাক হয়ে জ্বীনের পরিচয় দিলো,
‘ আরে! এটা তো ভাইয়া!’
#চলবে…..