মেঘাচ্ছন্ন আকাশে প্রেমের রংধনু শেষ পর্ব

0
833

#মেঘাচ্ছন্ন_আকাশে_প্রেমের_রংধনু 🌸
#পর্ব- ১৫
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
মিরা কবুল বলার পূর্বে, নিজের বিয়ের আসরে প্রেমিকা রুপী রোজিয়ানাকে বধু রুপে দেখে তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ায় আরফান। মিরাও থেমে যায়। । রোজিয়ানা লাল বেনাসরি পড়ে গাঁয়ে ভারি ভারি গয়না পরিহিত করে,বধু রুপে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রোজিয়ানাকে বধু রুপে দেখে মিরা উঠে চেচানো সুরে বলে, ‘ বউয়ের সাঁজে তুমি এখানে কেন? তোমার মতলব কি? ‘
রোজিয়ানা সামান্য হেসে আরফানের কাছে গিয়ে, আরফানের হাত জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ আমি বউ সাঁজবো না তো কে সাঁজবে? আজ তো আমার এবং আমার আরফানের বিয়ে। আজকে বিয়েটা হবে কিন্তু আমার সাথে। ‘

‘ ওয়াট! কিসব যাতা বলছো তুমি?’

রোজিয়ানার দিকে একপ্রকার তেড়ে গিয়েই প্রশ্ন করে মিরা। রোজিয়ানা নিজের ঘোমটা টানতে টানতে, নিম্ন গলায় বলে, ‘ তা তুমি আমার আরফান বেবীকেই জিজ্ঞাসা করো। ‘

রোজিয়ানার কথা শুনে মিরা আরফানের শার্টের কলার ধরে একপ্রকার ঝাঁকিয়ে বলে, ‘ কি বলছে ও? কেন বলছে? ও কি শুধুই তোমার বেস্টফ্রেন্ড? তুমি কি তার মানে আমাকে ঠকিয়েছো? কিছু বলছো না কেন আন্সার মি! শিট!’

মিরা প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে পরে। আরফানের বুকে মা/রতে মা/রতে প্রশ্ন করতে থাকে সে, কিন্তু কোনরুপ উত্তর না পেয়ে, ধপ করে বসে কেঁদে উঠে। আরফান কোনরুপ উত্তর দেয় না। নিষ্চুপ থেকে, ক্ষিপ্ত নয়নে রোজিয়ানার দিকে তাঁকায়। রোজিয়ানা মিটিমিটি হাঁসছে। আরফান বুঝতে পারে, শুধুমাত্র এমন একটা মুহুর্তের জন্যে রোজিয়ানা এতোদিন কিছু করেনি। চুপ ছিলো বরং একপ্রকার নাটক করে গিয়েছে। রোজিয়ানা আরফানের পাশে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ তোমার গেম অভার মিঃ আরফান। আমাকে বিয়ে করা ছাড়া তোমার কোন উপায় নেই। ‘

‘ এই প্ল্যান শুধুমাত্র তোমার হতে পারে না। এর পিছনে নিশ্চয় কেউ রয়েছে। ‘

রোজিয়ানা ভ্রু কুচকে হাসে কিছুক্ষন। আরফান হাত ছাড়িয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে তাকিয়ে থাকে। রোজিয়ানা পুনরায় আরফানের কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘ অনেকসময় কাছের পুরনো কিছু বন্ধু বড় শত্রু হয়ে উঠে। সুযোগের অভাবে শুধু তারা আমাদের কাছের বন্ধু হয়ে থাকে, সুযোগ পেয়ে গেলেই, তারা সঠিক সময়ে ছোবল মেরে দেয়। যেমনটা তোমরা করেছিলে। ‘

আরফান ঠোট ভিজিয়ে চিন্তায় পরে গেলো। আশেপাশে ভালো করে তাঁকালো। বর্ণকে দেখতে না পেয়ে, তৎক্ষনাৎ বলে উঠলো, ‘ বর্ণের প্ল্যান এইসব?’

‘ ইয়েস আমাদের এমডি বর্ণ আহমেদের প্ল্যান সব! তোমরা মতো কুৎসিত মানুষের থেকে, মিরার মতো ভালো একটা মেয়ের জীবন বাঁচাতেই, আমরা এইসব প্ল্যান করেছি। ‘

আরফানের মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছে একপ্রকার। বর্ণ এমন করবে, ভাবতে গেলেই গলা শুকিয়ে আসে তার। তার মানে কি অতীতের সবকিছু জেনে গেছে বর্ণ?

____________

বর্ণের থেকে দু পা পিছিয়ে যায় অর্ষা। মষ্তিষ্ক কেমন যেন কাজ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছে তার। অতীতের ভয়ংকর ঘটনাগুলো তার বুকে পুনরায় যন্ত্রনার সুত্রপাত ঘটাচ্ছে। কি বেদনাদায়ক ব্যাথা। নেত্রজোড়া পিটপিট করে বন্ধ করে, আধো আধো গলায় সুধোয় অর্ষা, ‘ আমি কালো রং কে ভয় পাই না বরং এই অন্ধকার জগতের কিছু ভয়ং/কর মানুষকে ভয় পাই, যারা মেঘাচ্ছন্ন আকাশের ন্যায় আমার জীবনকে অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছে। যেই অন্ধকার থেকে কখনো আমি বের হতে পারবো না। ‘

‘ অন্ধকার এবং আলো নিয়েই জীবন। অন্ধকার যেমন জীবন থাকে, সেই অন্ধকারকে ভেদ করে, আলোর পথে ফিরে আসতে একজন বিশ্বস্ত হাতের প্রয়োজন হয়। ‘

বর্ণের কথা শুনে, অর্ষা দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসলো। অশ্রু টলটল করছে। বর্ণ ঝুঁকলো। হাত বাড়াতে চাইলে, অর্ষা বর্ণের হাত ধরে করুণ গলায় বলে, ‘ কাঁদতে মানা করবেন না, আজ বড্ড কান্না পাচ্ছে। ‘

বর্ণ অর্ষার হাত শক্ত করে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে, আলতো হেসে জবাব দিলো, ‘ কাঁদতে বারণ করবো না বরং মাথায় হাত বুলিয়ে দিবো। আপনি মন ভরে কাঁদুন, আপনার সব কষ্ট ধুঁয়ে মুছে যাক। আমি আপনার পাশে সবসময় রয়েছি। বেশি করে কাঁদুন, আমি শুধু সেই অশ্রুসিক্ত নয়নের দিকে ক্ষানিক্ষণ তাকিয়ে থাকবো। অনুভব করতে চাইবো আপনার ভেতরের সমগ্র ব্যাথা। ‘

অর্ষা মাথা নুইয়ে তাই করলো। শব্দ করে কেঁদে ফেললো। ছলছলে আখিতে, সামনে থাকা মানুষকে একপলক দেখে নিলো, কেমন মায়াভরা দৃষ্টি নিয়ে অর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। অর্ষার বড্ড শান্তি লাগলো, দিনশেষে কেউ তার মাথায় পরম যত্ন নিয়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আলাদা শান্তি। যার সীমা নেই। বর্ণ কিছুক্ষন সময় নিয়ে, অর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। অপর হাত বাড়িয়ে প্রশ্ন করলো,

‘ আমায় ভালোবাসেন? তবে একটিবার আমার হাত ধরুন। ভরসা করবেন আমায়?’

‘উহু! আমি আপনাকে ভালোবাসি না। ‘

‘বেশ ভালো মিথ্যে বলতে পারেন। আপনার মুখে ভালোবাসি শুনতে ইচ্ছে করছে মিস ঝাঁঝওয়ালী। একটিবার বলবেন? ‘

কতটা আকুতি নিয়ে একজন যুবক তার প্রেয়সীর নিকট আবেদেন করলো একটিবার ভালোবাসি শব্দটি শুনার জন্যে। তার প্রেয়সী আশেপাশে হাতড়ে পানি খুঁজতে চাইলো। যুবক হয়তো বুঝলো, তার প্রেয়সী কি চাইছে। তাই সে পাশের টেবিলে থাকা পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো, তার সামনে থাকা রমনীর দিকে। অর্ষা গ্লাস হাতে নিয়ে,ঢগঢগ করে সমস্ত পানি পান করে ফেললো। অতঃপর গ্লাসটা নীচে রেখে মিয়ে যাওয়া কন্ঠে বললো,

‘ ভালোবাসতে ভয় করে, বিশ্বাস করতে ভয় করে। প্রেম আমার জীবনে আরো একবার এসেছিলো। যেই প্রেমের রং আমাকে অন্ধকারের অতলে ডুবিয়ে, আমাকে শেষ করে দিয়েছিলো। কেড়ে নিয়েছিলো আমার সবকিছু। ‘

অর্ষার নেত্রপল্লব ধীরে ধীরে বন্ধ হতে লাগলো। অন্ধকারে হাতছানি দিয়ে উঁকি দিলো অতীতের বেদনাদায়ক কিছু স্মৃতি। অর্ষা ধীর কন্ঠে বলতে থাকে তার পুরনো অতীত।

পাঁচ বছর আগে ফেসবুকের একটা গানের ব্যান্ডে অডিও লাইভে একজন ছেলে গান গাইতো। কি সুন্দর তার গানের গলা। তখন সবেমাত্র কিশোরি বয়স পেরিয়ে, যুবতী বয়সে ধাবিত হচ্ছিলো অর্ষা। মনে তার একরাশ আবেগ ভালোলাগা। সকলে সেই ছেলেকে আবদ্ধ মেহেক নামেই চিনতো। সেই ছেলেটাকে না দেখেও তার প্রতি অজানা ভালোলাগা কাজ করেছিলো অর্ষার। বেশ কষ্টে তার নাম্বার জোগাড় করে, তাকে মেসেজ দিতো অর্ষা। হুট করে যেদিন সে রিপ্লাই পেয়ে গেলো, সারা বাড়িতে নেঁচে গেঁয়ে বেড়িয়েছিলো সে। সে কি সুন্দর অনুভুতি! রোজ রাতে সেই রকষ্টার আবদ্ধের টুকটাক কথা বলতো সে! মাঝে মাঝে গান শুনার আবদার ও করতো সে। অদ্ভুদ্ভাবে আবদ্ধও তার সকল আবদার নির্ধিদ্বায় মেনে নিতো। আবদ্ধ নিয়ে নিজের মনে শত শত স্বপ্ন দেখে ফেলেছিলো সে। আবদ্ধ দেশের বাইরে ছিলো, অস্ট্রেলিয়াতে। যখন সে দেশে ফিরেছিলো তখন, অর্ষার কলেজে এসে অর্ষাকে একপ্রকার চমকে দিয়েছিলো আবদ্ধ। কালো শার্ট পরিহিত শ্যামবর্ণের বলিষ্ঠ গড়নের মানুষটা দেখে প্রথম দেখায় নিজের মন খয়ে বসে অর্ষা। আবদ্ধের ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলো আরফান। যাকে নিজের ভাইয়ের মতো সম্মান এবং বিশ্বাস করতো অর্ষা। যদিও কেন যেন আবদ্ধের গলার স্বর তার কাছে অন্যরকম লেগেছিলো। তাদের মাঝে বন্ধুত্বের সূচনা ঘটে, তাদের সম্পর্ক ভালোবাসায় পরিনিত হয়। একদিন সাহস করেই অর্ষা জেদ ধরে বসলো, ‘ তার বাসায় যেন, আবদ্ধ বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। ‘

উত্তরে আবদ্ধ খানিক্টা চিন্তিত হয়ে বলে, ‘

‘ আপাতত বাসায় কীভাবে জানাবো? এখনো আমি অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করছি৷ বিয়ে এখনো সম্ভব নয়। ‘

‘ আমি কিচ্ছু জানি না। আমার কেন যেন তোমাকে হারানোর বেশ ভয় রয়েছে। মনে হয় এই বুঝি তোমাকে হারিয়ে ফেলবো। ‘

অর্ষার জেদের কাছে একপ্রকার বাধ্য হয়েই বিয়ে করতে বাধ্য হয় আবদ্ধ। গোপনভাবে। সেই বিয়েতে আরফান ছাড়াও আরো অনেকে উপস্হিত ছিলো। বিপত্তি তখন ঘটে যখন অর্ষা জানতে পারে, সে মা হতে চলেছে। খুশিতে সেদিন তার নেত্রকোণে জল টলটল করছিলো। মাতৃত্বের স্বাদ উপভোগ করতে চলেছে সে, কিন্তু সেই খবর জানার পর বিষাদে ছেঁয়ে যায় আবদ্ধের মুখস্রী। সে অর্ষাকে বাচ্ছাকে নষ্ট করতে বলে, কিন্তু অর্ষা রাজী নয় না। তার ভাষ্যমতে তার সন্তানতো বৈধ তবে? যখন অর্ষা রাজি হচ্ছিলো না তখন আবদ্ধ চরম ঘৃণীত কাজ করে।

‘ কি করেছিলো আবদ্ধ? ‘

বর্ণের প্রশ্নে অর্ষা অতীত থেকে বেড়িয়ে, কম্পিত কন্ঠে বলে,

‘ ওরা সবাই মিলে আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলেছিলো। ‘

বর্ণ মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। অর্ষা চিৎকার করে কেঁদে উঠে। অর্ষা দ্রুত উঠে বর্ণের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে, ফুঁপাতে ফু্ঁপাতে বলতে থাকে, ‘ আমি কাউকে ভালোবাসতে পারবো না। ভালোবাসা আমার থেকে আমার সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে।’ কথাটি বলতে বলতে দরজা দিয়ে দৌড়ে পিছনের দিকে দিয়ে ছুটে বেড়িয়ে যায়। বর্ণ ‘ দাঁড়ান’ বলে অর্ষার পিছনে ছুটে যায়। অর্ষা কাঁদতে কাঁদতে মেইন রোডের মাঝখানে চলে আসে। বর্ণকে এগিয়ে আসতে দেখে চিৎকারের সুরে বলে, ‘ চলে যান আপনি। আমার মেঘাচ্ছন আকাশে আপনার কোন ভালোবাসার রংয়ের অস্তীত্ব আমি দেখতে চাই না। আমি চাই না ভালোবাসা। আমি আপনাকে ভালোবাসি না। ‘

‘ আপনি ভালো না বাসলেও, আপনাকে আমি ভালোবাসি। ‘

অতীতের বিষাদময় স্মৃতি শুনার পরেও, বর্ণের মুখে ‘ভালোবাসি ‘ কথাটি শুনে ফের দৌড়াতে থাকে অর্ষা, তখন একটি ট্রাক এসে তাকে ধাক্কা মারে।অর্ষার র/ক্তাক্ত নিথর দেহ রাস্তার কোণে গিয়ে ছিটকে পরে থাকে। অর্ষার র/ক্তে রক্ত/ক্ত হয়ে পরে, রাস্তা। বর্ণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মাথা শূন্য শূন্য লাগছে তার। অর্ষা একপলক হাত বাড়িয়ে বর্ণকে কাছে ডাকে। বর্ণের আখিজোড়াতে কালো মেঘ এসে হানা দেয়। অন্ধকার হয়ে উঠে তার পৃথিবী। প্রাণের প্রিয় প্রেয়সীকে করুণ অবস্হায় দেখার সাধ্যি হয় না তার। সে ছুটে যায় অর্ষার কাছে। অর্ষাকে বক্ষে নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। বিড়বিড়িয়ে বলে,

‘ আপনাকে কিচ্ছু হতে দিবো না আমি। আপনি আমার সব। আপনাকে নিজের থেকে দূরে আমি যেতে দিবো না। ‘

অর্ষাকে কি আদোও সেই বাণী শুনলো? হয়তো না।

আকাশ ছেঁয়ে গেছে ঘনকালো মেঘের প্রান্তরে। অবাক গর্জণে মেঘের কান্না। থমকে গেছে সময়। থমকে গেছে সবকিছু। রাস্তার একধারে নিজের প্রেয়সীর রক্তা/ক্ত অবস্হায় বুকে জড়িয়ে ধরে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে বর্ণ। রাস্তার সকলে ছুটে আসছে।
সমাপ্ত।
#প্রথম _পরিচ্ছেদের_সমাপ্তি
দেখা হবে দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে।🙂
নোটঃ প্রথমেই আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, অনেকেই জানেন পারিবারিক সমস্যার কারণে আমি একদমই ফোন হাতে পাচ্ছি না, তার মধ্যে আজকে থেকে প্রি টেস্ট এক্সাম শুর‍ু হয়েছে। তাই আমি গল্পটার দুই খন্ড করলাম। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে সব রহস্যের সমাধান করেই খুব তাড়াতাড়ি শেষ করবো গল্পটা। আপতত এক্সামের পরে গল্প আসবে। এই মাসেই আসবে। আশা করি সকলে বুঝবেন🙂এবং আমার জন্যে দোয়া করবেন। আল্লাহ হাফেজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here