মেঘাচ্ছন্ন আকাশে প্রেমের রংধনু পর্ব ১

0
1136

‘উম!এইটা চেঞ্জিং রুম মিস! নিজের বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে রোমান্স করার জায়গা নয়। সো গেট লস্ট। ‘
ভারী গম্ভীর কন্ঠে কেউ মিরাকে উদ্দেশ্য করে বলে। মিরা কথাটি শুনে পিছনে ঘুড়ে বিরক্তির সাথে। সঙ্গে সঙ্গে অর্ষাও পিছনে ঘুড়ে তাঁকায়। তাদের সামনেই সাদা শার্ট পরা একজন ফর্সা লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার পড়নের শার্টখানাই স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে, লোকটা মাত্রাধিক সুদর্শন। অর্ষা এবং মিরা দুজনেই লোকটির অদ্ভুদ আগমনে বেশ অবাক!
অর্ষা শার্টের হাতা ভালো করে গুটিয়ে লোকটির কাছে গিয়ে, একপ্রকার আঙ্গুল তাঁক করে বলে, ‘ এইযে মিঃ অভদ্র! আপনার কি কোন সেন্স নেই? হুট করে মেয়েদের চেঞ্জিং রুমে ঢুকে যাবেন আবার আমাদেরকেই বলেন চলে যেতে! হাউ ডেয়ার ইউ হ্যা? কে আপনি? ‘
বর্ণ অর্ষার ভারী কন্ঠে বলা কথাটি শুনে বিষম খায়। টিস্যু বের করে, কপালের চিনচিনে থাকা ঘামটুকু মুছে দেয়। আসলেই সে ভুল করে ফেলেছে, যাকে বলে বিরাট ভুল! সে নিজেই জেন্স চেঞ্জিং রুম ভেবে, লেডিস চেঞ্জিং রুমে ঢুকে পরেছিলো। অতঃপর বর্ণ দেখতে পেলো, একটি ছেলে ঘুড়ে একটি মেয়ের কপালে হাত রেখে, উচু হয়ে কিছু একটা করছিলো। যে কোন সুস্হ মষ্তিষ্কের মানুষ দেখে ভাব্বে দুজনে আপত্তিকর কোন কাজ করছিলো। অর্ষার পড়নে ছেলেদের পোষাক থাকায়, অর্ষাকে ছেলে ভেবেছিলো বর্ণ। তার মধ্যে অর্ষা পিছনে ঘুড়ে ছিলো, কিন্তু মিরাকে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলো বর্ণ। অতঃপর অর্ষা যখন পিছনে ঘুড়ে, তখন বর্ণের সমগ্র ভুল ধারণা নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। বর্ণের ভাবনার মাঝেই, অর্ষা হাতে তুড়ি বাজিয়ে বর্ণকে ডাকে,

‘ কি হলো? কি যেন বলছিলেন আপনি? আমরা এখানে কি করছি তাইতো? ‘

বর্ণ প্রতিউত্তরে কোন জবাব দেয় না। অর্ষা বিরক্ত হয়। লোকটা তাদের কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়ে সেই কখন ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, শুধু ভেবেই চলছে। আচ্ছা লোকটা কি লেখক? কি এতো ভাবে সারাদিন? অর্ষা বিষয়টিকে মাথা থেকে ঝেড়ে দিয়ে, মিরাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘ আমি আর আমার মরু বিয়ের জন্যে শপিং করতে এসেছিলাম, মরুর চোখে ময়লা ঢুকে গিয়েছিলো। তাই আমি ওর চোখে ফু দিয়ে দিচ্ছিলাম। ‘

বর্ণ মাথা চুলকে সরি বলার পূর্ব মুহুর্তেই, অর্ষা মিরার কাছে গিয়ে, মিরার হাত ধরে একপ্রকার টেনে নিয়ে যেতে যেতে, বর্ণকে উদ্দেশ্য করে কটাক্ষ করে বলে উঠে,

‘ আমিও বা যাকে তাকে ব্যাখা দিচ্ছি কেন? যত্তসব!’

অর্ষার কথার প্রতিউত্তরে বর্ণও গলা উচিয়ে জবাব দেয়, ‘ মানুষ মাত্রই ভুল হয়ে থাকে, আর আপনি যাকে তাকে বলছেন কাকে? আমার পরিচয় সম্পর্কে আপনার কোন ধারণা আছে?’
কথাটি বলেই, পকেটে হাত গুজে দাঁড়ালো বর্ণ। অর্ষা বুঝতে সক্ষম হলো, লোকটা নিজের পরিচয় নিয়ে,নিজেই গর্ব করছে। যা অর্ষাকে বর্ণের প্রতি আরো বিরক্ত করে ফেলে।

অর্ষা এগিতো নিলে,মিরা অর্ষার হাত খপ করে ধরে ইশারায় বুঝিয়ে দেয়, সে যেন কোন ঝামেলা না করে। অর্ষা তার দৈনন্দিন দিনের মতো আজও মিরার কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে, এগিয়ে গেলো। অর্ষার মতো জেদি, একরোখা মেয়েকে নিয়ে মিরা পরেছে বিপদে। অর্ষা বর্নের সামনাসামনি দাঁড়ায়, যদিও বর্ণ কাধ অব্দিও সে পৌঁছানোর ক্ষমতা রাখেনা,তবুও দাপটের সাথে কোমড়ে হাত রেখে বলে,

‘ হ্যা আপনার পরিচয় আমি খুব করে জানি।আপনি একজন নির্লজ্জ মানুষ, যে কিনা লেডিস চেঞ্জিং রুমে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করে। ‘

বর্ণ দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইলো। অর্ষা নিজের পকেট থেকে কালো সানগ্লাসখানা বের করে, তা চোখে পরে নেয়। অতঃপর,
‘লেট’স গো! ‘ বলে বেড়িয়ে যায়। অহনাও পিছনে পিছনে বেড়িয়ে যায়। বর্ণ দেয়ালে ঠেস মেরে দাঁড়িয়ে, কিছু একটা ভেবে বলে,

‘ মেয়ে তো নয় যেন মিস ঝাঁজওয়ালী। ‘

বর্ণ অর্ষার বিষয় বাদ দিয়ে ফোনে কারো সাথে কথা বলতে বলতে বেড়িয়ে যায়। দুটো বড় বড় প্রযেক্ট নিয়ে তার আজকে মিটিং আছে। বাবা অসুস্হ থাকায়, গোটা আরএস কম্পানিকে নিজ হাতে সামলায় সে। ক্যানাডা থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করে, সদ্য নতুন এমডি হিসেবে নিজের বাবার কম্পানিতে
নিয়োগ হয়েছে। সবাই তাকে বর্ণ আহমেদ নামেই চিনে। ২৬বছর বর্ষে পা রাখলেও, প্রেম নামক জটিল বন্ধন তার মনে প্রবেশ করতে পারেনি।

________________

অর্ষা গটগট পায়ে হেঁটে নিজের গাড়িতে বসলো। ছোটবেলা থেকেই, অর্ষাকে নিজের ছোট্ট বোনের মতোই নিজ হাতে আগলে রেখেছে মিরা। মিরা সম্পর্কে অর্ষার মামাতো বোন । তাদের বয়সের তফাৎ দু বছর হলেও, তারা একে- অপরের বেস্টফ্রেন্ড। মিরার পুরো বিপরীত অর্ষা। ছেলেদের মতো পোষাক, চালচলন। চুলগুলোকে খোপা করে রেখে,মাথায় ক্যাপ দিয়ে রাখে। যে কেউ দূর থেকে অর্ষাকে ভাব্বে সে একজন ছেলে, ছেলেদের মতোই চালচলন তার। অর্ষা এবং মিরা এসেছিলো, মিরার বিয়ের জন্যে শপিং করতে। পরশু গাঁয়ে হলুদ। সব শপিং শেষ হলেও, টুকটাক কেনাকাটা করতে দুজনে আজ এসেছিলো এবং এসেই বর্ণের মতো অসভ্য অপরিচিত লোকের সাথে অর্ষার দেখা হয়, যদিও
সেই অজ্ঞাত ব্যাক্তির সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই,কেমন একটা অস্হির অস্হির লাগছে সবকিছু! কিন্তু কেন? জানেনা অর্ষা। শুধু মনে হচ্ছে লোকটির সাথে যেন তার দেখা না হয়।
অহনা অর্ষার দিকে একপলক তাকিয়ে রইলো। অর্ষা অত্যান্ত মনোযোগ দিয়ে ফোনে ভিডিও গেমস খেলছে। আশে পাশের অবস্হা নিয়ে তাঁকানোর সময় নেই। মিরা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে আনমনে ভাবতে লাগলো, ‘ অর্ষাও তো আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো লাইফ লিড করতে পারতো, তবে কেন সে আজ ব্যাতিক্রম! হ্যা অতীতে লুকিয়ে থাকা কোন এক ভয়ংকর ঘটনার জন্যে,আজ অর্ষা সকলের কাছে ব্যাতিক্রম। ‘

__________________________

মিরাকে তার বাসায় পৌঁছে দিয়ে, নিজের বাড়িতে এসেই নিজের রুমে ঢুকে পরে অর্ষা। তড়িৎ গতিতে নিজের পোষাক পাল্টে, কাউকে ফোন করে জানায়,

‘ তুই সব রেডি করে রাখ তন্ময়। আমি আসছি। আমাদের এলাকায় এসে, আমাদের এলাকার ছেলেকেই মারধোর করবে, আর আমি অর্ষা রেজওয়ান তা মোটেও সহ্য করবো না। ‘

‘ তোর বাবা একজন জর্জ বুঝতে পারছিস? সোসাইটিতে সকলে তাকে বেশ সম্মানের নজরে দেখতো, কিন্তু তুই উনার মেয়ে ছেলেদের মতো মারামারি করে এলাকায় ঘুড়ে বেড়াচ্ছিস! এইসব কি ঠিক বল?তোর বাবা…. ‘

পরেরটুকু বলতে পারলেন না অর্ষার মা। তার আগেই উত্তেজিত হয়ে, অর্ষা একপ্রকার তার মায়ের দিকে তেড়ে এসে,প্রশ্ন করে,

‘ কে আমার বাবা? কিসের বাবা? উনি আমার বাবা নন। উনার মেয়ে ৫ বছর আগেই মরে গিয়েছে। তুমিও জানো আমি শুধুমাত্র তোমার জন্যই এই বাড়িতে থাকি, নাহলে কবেই চলে যেতাম। ”

‘ এইভাবে বলিস না মা! তুই আমাদের একমাত্র সন্তান। তোর বাবা একজন জর্জ। তার সম্মানের দিকটাও তোর ভাবা উচিৎ। ‘

অর্ষা এইবার তার মায়ের দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে নরম সুরে বললো,

‘ কিসের জর্জ মা? কিসের মান -সম্মান? উনি তো নিজের মান- সম্মানের জন্যে নিজের সন্তানকেও ন্যায় বিচার দিতে পারেননি। থেমে গিয়েছিলেন। সেদিন কতটা অসহায় ছিলাম আমি। ভেবে দেখেছো মা? আমি সেদিন ন্যায় বিচার পাইনি মা। পাইনি আমি। ‘

কথাটি বলতে বলতে একপ্রকার দৌড়ে ছুটে বেড়িয়ে যায় অর্ষা। মেয়ের কথা শুনে মুখ চেপে উঠে অর্ষার মা। জানালায় উকি দিয়ে দেখতে পায়, নিজের মুখশ্রী শক্ত করে, বাইক নিয়ে বাগানের গেট দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে অর্ষা। উদ্দেশ্যে আজকেও কাউকে হসপিটালে পাঠিয়ে দেওয়া। নিজের এলাকায় বেশ অল্পসময়ের মধ্যেই নিজের জায়গা করে নিয়েছে অর্ষা। পলিটিক্সে থাকার সুবিধায়ে বেশ বড় বড় মানুষের সাথে পরিচয় তার।

______________

বর্ণ চুল সেট করতে করতে গাঁয়ে হলুদের স্টেজের জন্যে ছাঁদের দিকে যাচ্ছিলো। সে খেয়াল করে দেখে, কয়েকজন মেয়ে তার দিকে তাঁকিয়ে, খুঁটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। হলুদ শেরওয়ানীর
সাথে, কালো কুটি পড়েছে। চোখে কালো সানগ্লাস লাগিয়ে। যে কারো নজর কেড়ে নেওয়ার মতো সুদর্শন যুবক সে! মূলত নিজের বন্ধুর বিয়ে এটেন্ড করতে এসেছে সে। কাল বিয়ে। বন্ধুর বিয়ে হলেও,তার কাজ কম নয়। আরফানের বাবা সম্পূর্ন দায়িত্ব বর্ণের কাঁধের উপর ছেড়ে দিয়েছেন, তার ভাষ্যমতে বর্ণ একজন দায়িত্ববান ছেলে। তাকে যেকোন দায়িত্ব দিয়ে নিশিন্ত থাকা যায়। বর্ণ স্টেজে গিয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষন করছিলো। আরফানের বাবা বিশাল ছাঁদেই, ছেলে মেয়ের গাঁয়ে হলুদ একত্রে আয়োজন করেছেন। কিছুক্ষনের মাঝেই পাত্রিপক্ষ চলে আসবে। যদিও আরফান এখনো উপস্হিত হয়নি।

__________

অপরদিকে, অর্ষা এবং মিরার অন্যান্য কাজিনেরা এবং আত্বীয়সজন আরফানদের বাড়ির সামনে নিজেদের গাডি থামায়। সঙ্গে সঙ্গে আকাশে আতশবাজি শুরু হয়। প্রথমে অর্ষা বের হয়ে, মিরার হাত ধরে আস্তে আস্তে সামনের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। তাদের উপর বর্ষিত হতে থাকা ফুল। আজ যদিও লেডিস শর্ট একটি টপ্স পড়েছে অর্ষা। চুলগুলো বরাবরের মতো খোপা করে, ড্রেসের সাথে মিলিয়ে একটা ক্যাপ পড়েছে৷ মিরা এতোবার বলেও, অর্ষাকে শাড়ি পড়তে রাজি করাতে পারলো না। তা নিয়ে, ব্যর্থতার রেশ মুখশ্রীতে ফুঠে উঠেছে মিরার।
সকলকে স্বাগতম জানিয়ে, ভেতরের দিকে নিয়ে থাকে আরফানের আম্মু এবং আব্বু। অপরদিকে জরুরী ফোন পেয়ে, ভিতরে না ঢুকে অর্ষা বাগানের দিকে দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকে। কথা বলার মাঝে নিজের ক্যাপটা হাতে নিয়ে নেয় অর্ষা। তখনি পিছন থেকে কেউ অধরার খোপা করে চুলে………..

চলবে কী?
#মেঘাচ্ছন্ন_আকাশে_প্রেমের_রংধনু 🌸
#পর্ব- ১
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
আসসালামু আলাইকুম! কেমন আছেন সবাই? প্রায় দুমাস পরে পুনরায় গল্প নিয়ে ফিরলাম সকলের মাঝে। দীর্ঘ সময় পর লেখালিখি করার ফলে, অনেকটাই হাত কাঁচা হয়ে গেছে আমার 😅! তাই ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আশা করছি পূর্বের গল্পের ন্যায়, এই গল্পতেও আপনাদের ভালোবাসা পাবো। 🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here